সীমান্ত অঞ্চলে ব্যাহত টহল কাজ পর্যটন, পণ্য পরিবহনে ভোগান্তি
Published: 6th, May 2025 GMT
ভারতীয় সীমানা লাগোয়া সুনামগঞ্জের বেহাল সীমান্ত সড়কের কারণে ভোগান্তি বেড়ে চলেছে স্থানীয়দের। এ সড়কের কারণে সীমান্তে বিজিবির নিরাপত্তা টহল, গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পটে পর্যটকদের যাতায়াত, শুল্ক ওস্টেশনগুলোয় পরিবহনসহ বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। 
 সদর থেকে ধর্মপাশা পর্যন্ত এ সীমান্ত সড়কের অধিকাংশ স্থানই ভাঙাচোরা। কোথাও উঠে গেছে কংক্রিট, বেরিয়ে এসেছে কাঁচামাটি। কোথাও আবার বড় বড় গর্ত। বেহাল এ সড়কে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তি অবর্ণনীয়। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিপণ্য পরিবহনে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। সীমান্ত টহলে অনেক স্থানেই বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে বিজিবিকে।
 সীমান্তের বিশ্বম্ভরপুরের কারেন্টের বাজার থেকে মধ্যনগর পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার সীমান্ত সড়ক ও চারটি সংযোগ সড়ক মিলিয়ে ১৩টি প্যাকেজে দুই হাজার ৮৬৭ কোটি টাকার কাজ চলমান আছে। তবে এ কাজে গতি কম। কবে কাজ শেষ হবে– এ নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা।
 স্থানীয়রা বলছেন, সড়কটি সঠিকভাবে মেরামত করা হলে এসব ভোগান্তি দূর হওয়ার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ হবে সুনামগঞ্জের। অর্থাৎ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের সড়ক যোগাযোগে বড় পরিবর্তন আসবে।
 প্রায় ৫০ কিলোমিটার সীমান্তের একমাত্র এ সড়কে কাজ হলে পার্শ্ববর্তী নেত্রকোনা জেলার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হতে পারে সুনামগঞ্জ জেলার। বিকল্প এ সড়ক ধরে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের যেমন যোগাযোগে সুবিধা হবে, তেমনি টাঙ্গুয়া, নীলাদ্রি, লাউড়েরগড়, শিমুল বাগানসহ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোয় যাতায়াতে সুবিধা হবে। দূরত্ব কমবে ময়মনসিংহসহ রাজধানী ঢাকার সঙ্গে।
 দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, ৫০ কিলোমিটার সড়কে দুটি প্যাকেজের একটির কাজ চলমান রয়েছে। অন্যটি শুরু হয়নি। এর মধ্যে তাহিরপুর উপজেলার ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া একমাত্র সড়কটির অবস্থা বেশি খারাপ। এতে বিপাকে পড়তে হয় পরিবহন চালকদের। গোটা সড়কই একটা দুর্ভোগ হয়ে উঠেছে তাদের জন্য। সামান্য বৃষ্টিতে এ সড়ক একেবারেই চলাচলে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সড়কটিতে একাধিক সেতু রয়েছে, যেগুলোর দু’পাশের রেলিংয়ের পিলার ভেঙে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে।
 তাহিরপুর সীমান্তে রয়েছে তিনটি শুল্ক স্টেশন। সড়কের কাজ হলে নৌপথের পাশাপাশি সড়কপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়লা-পাথর পরিবহন করা যাবে। পর্যটনেও নতুন গতি আসবে।
 কলাগাঁওয়ের বাসিন্দা মো.                
      
				
সীমান্তের এ সড়কটি হলে চোরাচালান প্রতিরোধ ও টহল কার্যক্রম আরও সহজ হবে বলে জানিয়েছে বিজিবি। সুনামগঞ্জ-২৮ বিজিবির অধিনায়ক একেএম জাকারিয়া কাদির বলেন, ‘সীমান্ত সড়কটি হলে বিজিবির সদস্যদের জন্য টহল কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হবে। এ এলাকায় হেঁটে ও মোটরসাইকেলের মাধ্যমে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সড়ক হলে অন্যান্য বাহন ব্যবহার করা যাবে।’
তাহিরপুরের বাঁশতলা গ্রামের বাসিন্দা হারুনুর রশিদ বলেন, ‘রাস্তাঘাট ভালো হলে সবদিকে যোগাযোগ ভালো হতো। এ সড়কে সেতুগুলোর অ্যাপ্রোচ সড়ক দেবে গেছে। স্বাভাবিকভাবে গাড়ি ওঠানামা করানো যায় না।’
চারাগাঁও মাইজহাটির বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, ‘কিছু সড়কের কাজ হলেও এ এলাকার সড়কের কোনো উন্নয়ন নেই। অনেক অংশে কাঁচা সড়ক। বৃষ্টি হলে চলাচল কঠিন হয়ে পড়ে।’ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে অনেক কষ্ট করে গাড়ি চালাতে হয়। গাড়ির যন্ত্রপাতি নষ্ট হয় বেশি। ১৫ বছর ধরে এ সড়কে কোনো কাজ না হওয়ায় চলাচলের অনুপযোগী হয়ে গেছে।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডির) দায়িত্বশীলরা জানান, তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে বাদাঘাট হয়ে সীমান্ত সড়কে সংযোগ, তাহিরপুর সোলেমানপুর হয়ে মধ্যনগর পর্যন্ত সংযোগ সড়ক, জামালগঞ্জের সাচনাবাজার-তাহিরপুর সংযোগ সড়ক এবং সুরমা নদীতে সাচনা-জামালগঞ্জ সংযোগ সেতু এবং ধর্মপাশা-জয়শ্রী সংযোগ সড়ক– এই গুচ্ছ প্রকল্পে পর্যায়ক্রমে কাজ করার কথা রয়েছে। ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি এ প্রকল্পের প্রথম প্যাকেজের কাজ শুরু হয়। শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ৩০ ডিসেম্বর ২০২৬ সালে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বিশ্বম্ভরপুরের কারেন্টের বাজার থেকে মধ্যনগর পর্যন্ত সীমান্ত সড়কের কাজসহ এর সঙ্গে চারটি উপজেলাকে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাবনা আছে। এক পর্যায়ে ২২টি প্যাকেজে এ কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করা হয়। ২ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩ প্যাকেজের কাজ চলছে। আটটি প্যাকেজ মূল্যায়ন পর্যায়ে, একটির অনুমোদন মেলেনি। বরাদ্দ মিলেছে ৯১ কোটি টাকা। নির্ধারিত মেয়াদে কাজ শেষ হবে না।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ম ন ত সড়ক স য গ সড়ক স ন মগঞ জ সড়ক র ক পর বহন এ এল ক র সড়ক টহল ক ব যবস এ সড়ক
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।
বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।
সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।
কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।
একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।
শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক