বিএনপির ‘রিকনসিলিয়েশন’ তত্ত্বের ব্যবহারিক তাৎপর্য
Published: 8th, May 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে। দেশের বাইরে থেকে নেতারা যা-ই বলুন; আন্দোলন-সংগ্রামে সিদ্ধহস্ত দলটি এখন পর্যন্ত চলমান বিপর্যয় কাটানোর কার্যকর কৌশল বের করতে পারেনি।
প্রতিপক্ষ অনেকে বলছেন, ৭৫ বছর আগে যে মুসলিম লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটেছিল; দলটি নিজেই সেই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন নিয়ে কথা উঠলেই আওয়ামী লীগের প্রাসঙ্গিতা এড়ানো যাচ্ছে না। দেশি-বিদেশি মুরুব্বিদের প্রত্যাশা অনুসারে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা– জনপরিসরে এ আলোচনা যেমন প্রবল, তেমনি তাতে আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কেও কৌতূহল কম নয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়ে এসেছে আওয়ামী লীগকে। রাজনৈতিক যে কোনো বিশ্লেষণে বরাবরই দুই দলকে তুলে ধরা হয় ‘যুযুধান দুই পক্ষ’ হিসেবে। কিন্তু বিএনপিও ক্ষমতাচ্যুত দলটি সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াতে পারছে না; যদিও প্রশ্নগুলো তার জন্য বেশ অস্বস্তিকর। বিশেষত গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত– সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে যে চরম দুর্দশা ও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা ছিল নজিরবিহীন। তদুপরি এ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেষ্টার অভিযোগ তুলে দলটিকে কোণঠাসা করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এমন এক সময়ে আওয়ামী লীগ-সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নে বিএনপি নেতাকর্মীর বিব্রত হওয়ারই কথা।
তবে এই পরিস্থিতিতেও বিএনপির কোনো কোনো নেতা আওয়ামী লীগ প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান নিয়ে খোলামেলা কথা বলছেন। যেমন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার সমকালে ছাপা হয়েছে গত ৩ মে। বিএনপির ৩১ দফায় প্রস্তাবিত অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেটা আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য হবে কিনা? তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নজির টেনে বলেছেন, ‘মূল কথা হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনা। কত লাখ, কত হাজার মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়? তা করতে গেলে তো রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। ভালো হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সমাধানের দিকে যাওয়া।’ তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কারা কারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন? তিনি বিস্তারিত না বলে সম্ভবত প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতেই শুধু বলেন, ‘কারা রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ পাবে, তা বিধিবিধানে উল্লেখ থাকবে। বিএনপি রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে শান্তি বজায় রাখতে চায়– এটাই মূল কথা।’
সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির শুধু শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নন; মুখপাত্রও বটে। এ রকম একজন নেতা যখন এই সেদিনও তাদের ‘চিরশত্রু’ বলে পরিচিত দলটিকে ‘কবর’ না দিয়ে বরং তাঁর রিকনসিলিয়েশনের পক্ষে যুক্তি দেন, তা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বটে।
প্রসঙ্গত, অভিধানে রিকনসিলিয়েশন শব্দের মানে– ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার’। ৩ মে সমকালের ওই সাক্ষাৎকারের খবর দিতে গিয়ে বিবিসি বাংলা ‘সমঝোতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ এর আগেও আওয়ামী লীগ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিবিসি নিউজ চ্যানেল একটি ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেছে, সেটি সামাজিক মাধ্যমে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই ভিডিওতে সালাউদ্দিন আহমেদকে সরকারের উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে– ‘আওয়ামী লীগকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে রাস্তায় নামতে দিবেন না, মানি; সমর্থন করি। কিন্তু এভাবে আওয়ামী লীগকে আপনি কয়দিন রাজপথে পুলিশ দিয়ে ঠেকাবেন?’
এর আগে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন; বিষয়টি জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ারই পক্ষপাতী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগকে ভোটে হারিয়ে ‘গুঁড়িয়ে’ দিতে চান; অন্য কোনোভাবে নয়।
এটা সত্য, বিএনপি নেতারা সরাসরি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দায় নিতে চান না। কারণ তা থেকে এ মুহূর্তে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো, যারা কার্যত একই ভোটব্যাংকনির্ভর; ফায়দা তুলতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য ওলটপালট করে দিতে পারে এবং এমনকি এর ফলে বিএনপিরও টাল সামলানো কঠিন হতে পারে– সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দলটি তা ভালোই বুঝতে পারে।
আগেও বলেছি যে, বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থার দফারফা করার পাশাপাশি সরকার তো বটেই, দলকেও সুবিধাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করে আওয়ামী লীগ নিজেই পতনের শর্ত তৈরি করেছিল। জুলাই আন্দোলন সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে; আন্দোলন-সংগ্রাম ও ক্ষমতার মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ যেভাবে এ দেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে, সেটা উপড়ে ফেলা সহজ নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের বয়ানই এখনও জনমনে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। উপযুক্ত বিকল্পের অভাবে বিশেষত দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো এবং শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষদের কাছে এখনও দলটির মূল্য যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। তাই যারা ভাবছেন, হামলা-মামলার মাধ্যমে এবং নির্বাচনের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা যাবে, তারা অন্তত বাস্তবসম্মত চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না।
হামলা-মামলা তো আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে বিশেষত বিএনপি ও জামায়াতের ওপর কম চালায়নি। কিন্তু ৫ আগস্টে শেষ হাসি তো এ দুই দলই হাসল। এত কিছু দেখেও কীভাবে একই পন্থায় আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার চিন্তা করা যায়?
সুনির্দিষ্ট অভিযোগে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীর শাস্তি নিশ্চিত করা হলে ন্যায়বিচারপন্থি সবাই স্বাগত জানাবে। কিন্তু দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গয়রহ হত্যা মামলায় আটকে রাখার চেষ্টা এমনকি ন্যায়সংগত শাস্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এতে দিন শেষে প্রতিহিংসার রাজনীতিই পুষ্ট হবে, যা থেকে বেরিয়ে আসাই হতে পারে জাতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোও এ বাস্তবতা দ্রুত বুঝবে– এটাই প্রত্যাশা।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন ত দ ন আহম দ ন ত কর ম র জন ত ক ব এনপ র আওয় ম ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
পূজার ছুটির পর গকসুর অভিষেক
৭ বছরের বিরতির পর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে (গবি) অনুষ্ঠিত হলো চতুর্থ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভোটগ্রহণ ও ফলাফল ঘোষণার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন নতুন নেতৃত্ব।
তবে পূজার ছুটি শেষ না হওয়ায় এখনও হয়নি অভিষেক ও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান। ফলে দায়িত্বভার নিতে পারছেন না নবনির্বাচিতরা।
আরো পড়ুন:
গকসুর জিএস, এজিএসের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আপত্তি, পুনর্নির্বাচন দাবি
চাকসু নির্বাচন: দুই নারী প্রার্থীকে সাইবার বুলিংয়ের অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুর্গাপূজার পর অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের অভিষেক। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখনও নির্দিষ্ট তারিখ জানানো হয়নি। এতে নির্বাচনের পর যে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তা এখন রূপ নিয়েছে অপেক্ষার আবহে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ২৫ সেপ্টেম্বর দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ৭ বছরের ব্যবধান ঘুচিয়ে শিক্ষার্থীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব বেছে নেন। ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, প্রার্থীদের প্রচারণা আর ভোটের দিন ক্যাম্পাসজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে তোলে।
ভোট শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হলেও আনুষ্ঠানিক অভিষেক না হওয়ায় এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেননি তারা।
আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রেশমা আক্তার বলেন, “গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হলেও নির্বাচিত সদস্যরা এখনও শপথ গ্রহণ করেননি। এই বিলম্বের সুযোগে কিছু মহল নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে সফল করতে এবং অপপ্রচার রোধে নির্বাচিত সদস্যদের দ্রুত শপথ গ্রহণের ব্যবস্থা করা জরুরি। প্রশাসনের উচিত অবিলম্বে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করতে পারেন।”
সদ্য নির্বাচিত সহ-সভাপতি ইয়াছিন আল মৃদুল দেওয়ান বলেন, “নির্বাচনের পরের দিনটি সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল এবং দুর্গাপূজার ছুটির কারণে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম ছিল। উপাচার্য স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি জানিয়েছেন পূজার ছুটির পর যতদ্রুত সম্ভব অভিষেক ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার প্রকৌশলী মো. ওহিদুজ্জামান বলেন, “ছুটি শেষে শপথ গ্রহণ ও অভিষেক অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এখন পর্যন্ত কোনো তারিখ নির্ধারিত হয়নি।”
২০১৩ সালে প্রথমবার গকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ ২৫ সেপ্টেম্বর চতুর্থ নির্বাচনে সম্পাদকীয় ও অনুষদ প্রতিনিধি মিলিয়ে মোট ১২টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ৫৮ জন প্রার্থী। ভোটার ছিলেন ৪ হাজার ৭৬১ জন।
ঢাকা/সানজিদা/মেহেদী