জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে। দেশের বাইরে থেকে নেতারা যা-ই বলুন; আন্দোলন-সংগ্রামে সিদ্ধহস্ত দলটি এখন পর্যন্ত চলমান বিপর্যয় কাটানোর কার্যকর কৌশল বের করতে পারেনি।

প্রতিপক্ষ অনেকে বলছেন, ৭৫ বছর আগে যে মুসলিম লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটেছিল; দলটি নিজেই সেই পরিণতি বরণ করতে যাচ্ছে। তবে নির্বাচন নিয়ে কথা উঠলেই আওয়ামী লীগের প্রাসঙ্গিতা এড়ানো যাচ্ছে না। দেশি-বিদেশি মুরুব্বিদের প্রত্যাশা অনুসারে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে কিনা– জনপরিসরে এ আলোচনা যেমন প্রবল, তেমনি তাতে আওয়ামী লীগের অবস্থান সম্পর্কেও কৌতূহল কম নয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিএনপি তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পেয়ে এসেছে আওয়ামী লীগকে। রাজনৈতিক যে কোনো বিশ্লেষণে বরাবরই দুই দলকে তুলে ধরা হয় ‘যুযুধান দুই পক্ষ’ হিসেবে। কিন্তু বিএনপিও ক্ষমতাচ্যুত দলটি সংক্রান্ত প্রশ্ন এড়াতে পারছে না; যদিও প্রশ্নগুলো তার জন্য বেশ অস্বস্তিকর। বিশেষত গত দেড় দশকে আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে বিএনপির শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত– সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে যে চরম দুর্দশা ও ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, তা ছিল নজিরবিহীন। তদুপরি এ মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন চেষ্টার অভিযোগ তুলে দলটিকে কোণঠাসা করার প্রয়াস চালাচ্ছে। এমন এক সময়ে আওয়ামী লীগ-সংক্রান্ত যে কোনো প্রশ্নে বিএনপি নেতাকর্মীর বিব্রত হওয়ারই কথা।

তবে এই পরিস্থিতিতেও বিএনপির কোনো কোনো নেতা আওয়ামী লীগ প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান নিয়ে খোলামেলা কথা বলছেন। যেমন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের একটি সাক্ষাৎকার সমকালে ছাপা হয়েছে গত ৩ মে। বিএনপির ৩১ দফায় প্রস্তাবিত অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠন প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেটা আওয়ামী লীগের জন্যও প্রযোজ্য হবে কিনা? তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার নজির টেনে বলেছেন, ‘মূল কথা হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা আনা। কত লাখ, কত হাজার মানুষের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়? তা করতে গেলে তো রাষ্ট্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হতে পারে। ভালো হচ্ছে, রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে সমাধানের দিকে যাওয়া।’ তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের কারা কারা অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন? তিনি বিস্তারিত না বলে সম্ভবত প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতেই শুধু বলেন, ‘কারা রিকনসিলিয়েশনের সুযোগ পাবে, তা বিধিবিধানে উল্লেখ থাকবে। বিএনপি রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রে শান্তি বজায় রাখতে চায়– এটাই মূল কথা।’ 

সালাহউদ্দিন আহমেদ বিএনপির শুধু শীর্ষ পর্যায়ের নেতা নন; মুখপাত্রও বটে। এ রকম একজন নেতা যখন এই সেদিনও তাদের ‘চিরশত্রু’ বলে পরিচিত দলটিকে ‘কবর’ না দিয়ে বরং তাঁর রিকনসিলিয়েশনের পক্ষে যুক্তি দেন, তা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বটে।

প্রসঙ্গত, অভিধানে রিকনসিলিয়েশন শব্দের মানে– ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার’। ৩ মে সমকালের ওই সাক্ষাৎকারের খবর দিতে গিয়ে বিবিসি বাংলা ‘সমঝোতা’ শব্দটি ব্যবহার করেছে। 

সালাহউদ্দিন আহমেদ এর আগেও আওয়ামী লীগ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিবিসি নিউজ চ্যানেল একটি ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেছে, সেটি সামাজিক মাধ্যমে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই ভিডিওতে সালাউদ্দিন আহমেদকে সরকারের উদ্দেশে বলতে শোনা গেছে– ‘আওয়ামী লীগকে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে রাস্তায় নামতে দিবেন না, মানি; সমর্থন করি। কিন্তু এভাবে আওয়ামী লীগকে আপনি কয়দিন রাজপথে পুলিশ দিয়ে ঠেকাবেন?’ 

এর আগে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিকবার বলেছেন, তারা কোনো দল নিষিদ্ধের পক্ষে নন; বিষয়টি জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়ারই পক্ষপাতী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীও বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগকে ভোটে হারিয়ে ‘গুঁড়িয়ে’ দিতে চান; অন্য কোনোভাবে নয়। 

এটা সত্য, বিএনপি নেতারা সরাসরি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের দায় নিতে চান না। কারণ তা থেকে এ মুহূর্তে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো, যারা কার্যত একই ভোটব্যাংকনির্ভর; ফায়দা তুলতে পারে। তবে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য ওলটপালট করে দিতে পারে এবং এমনকি এর ফলে বিএনপিরও টাল সামলানো কঠিন হতে পারে– সাড়ে তিন দশকের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দলটি তা ভালোই বুঝতে পারে।

আগেও বলেছি যে, বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থার দফারফা করার পাশাপাশি সরকার তো বটেই, দলকেও সুবিধাবাদীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পরিণত করে আওয়ামী লীগ নিজেই পতনের শর্ত তৈরি করেছিল। জুলাই আন্দোলন সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে; আন্দোলন-সংগ্রাম ও ক্ষমতার মধ্য দিয়ে ৭৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ যেভাবে এ দেশের মাটিতে শিকড় গেড়েছে, সেটা উপড়ে ফেলা সহজ নয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আওয়ামী লীগের বয়ানই এখনও জনমনে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। উপযুক্ত বিকল্পের অভাবে বিশেষত দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো এবং শ্রমজীবী-কৃষিজীবী মানুষদের কাছে এখনও দলটির মূল্য যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। তাই যারা ভাবছেন, হামলা-মামলার মাধ্যমে এবং নির্বাচনের বাইরে রেখে আওয়ামী লীগকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা যাবে, তারা অন্তত বাস্তবসম্মত চিন্তা করছেন বলে মনে হয় না।

হামলা-মামলা তো আওয়ামী লীগ গত দেড় দশকে বিশেষত বিএনপি ও জামায়াতের ওপর কম চালায়নি। কিন্তু ৫ আগস্টে শেষ হাসি তো এ দুই দলই হাসল। এত কিছু দেখেও কীভাবে একই পন্থায় আওয়ামী লীগকে নির্মূল করার চিন্তা করা যায়?

সুনির্দিষ্ট অভিযোগে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীর শাস্তি নিশ্চিত করা হলে ন্যায়বিচারপন্থি সবাই স্বাগত জানাবে। কিন্তু দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গয়রহ হত্যা মামলায় আটকে রাখার চেষ্টা এমনকি ন্যায়সংগত শাস্তিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করবে। এতে দিন শেষে প্রতিহিংসার রাজনীতিই পুষ্ট হবে, যা থেকে বেরিয়ে আসাই হতে পারে জাতির সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বিএনপির সঙ্গে অন্য দলগুলোও এ বাস্তবতা দ্রুত বুঝবে– এটাই প্রত্যাশা।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন ত দ ন আহম দ ন ত কর ম র জন ত ক ব এনপ র আওয় ম ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

এখনও আদালত আমাদের সেকেন্ড হোম: গয়েশ্বর

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আগেও আদালতপাড়া বিএনপি নেতাকর্মীদের ঠিকানা ছিল, এখনও আছে। এই আদালতপাড়া এখনও আমাদের সেকেন্ড হোম। প্রায়ই সেখানে যেতে হয়।

সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ পেশাজীবী জোট আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের আমলে দায়েরকৃত মামলাসমূহের অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার নামেও অনেক মামলা দেওয়া হয়েছিল। সেসময় আমরা তার প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন তিনি তার বিরুদ্ধের সব মামলা প্রত্যাহার করে চেয়ারে বসেছেন, অথচ আমি গয়েশ্বর কেন এখনও কোর্টে হাজিরা দিই?

তিনি বলেন, বিএনপি কখনও প্রতিহিংসার রাজনীতি করেনি। এর ফলে যে সুবিধাটা হয়েছে, অনেকেই ভেবে নিয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে লেখা ও বলা সবচেয়ে নিরাপদ। সাংবাদিকরা আগে বলতো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নাই। তাই আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু লেখা যেত না, কিন্তু বিএনপির বিরুদ্ধে নানা কথা লেখা হতো। তবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানেই সাংবাদিকদের স্বাধীনতা নয়। সংবাদপত্রের মালিক বা প্রকাশকের স্বাধীনতাই মূল স্বাধীনতা। কিছু মিডিয়ার মালিক সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে, ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো নিউজ করে না। অনেক মিডিয়ার পয়সার অভাব নেই, কিন্তু সাংবাদিকদের ঠিকমতো বেতন দেয় না।

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্ট যদি হাসিনা না পালিয়ে পদত্যাগ করতেন, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দেওয়া লাগতো। তাহলে এখন নির্বাচন কমিশনের দেড় দুই বছর সময় লাগছে কেন? আমরা এখন নির্বাচন কমিশনের কীসের প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করছি?

সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিএনপির চেয়াপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাকিস্তান যেভাবে ভূপাতিত করল ভারতের ৫ যুদ্ধবিমান
  • যেভাবে ভূপাতিত ভারতের ৫ যুদ্ধবিমান
  • কুমিল্লায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থেকে আয় হলেও চালু হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ রুট
  • ঢাকায় আসছে ‘বায়ান’
  • আন্তর্জাতিক ফ্লাইট থেকে আয় হলেও চালু হচ্ছে না অভ্যন্তরীণ রুট
  • অলস সময় কাটছে শুটারদের
  • কলাপাতায় মোড়ানো মিষ্টি ইতিহাস
  • আইপিএলের প্লে-অফে যেতে কার কী সমীকরণ?
  • এখনও আদালত আমাদের সেকেন্ড হোম: গয়েশ্বর