গাজা উপত্যকায় চলমান মানবিক সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এ অবস্থায় গাজায় ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে ইসরায়েল, যা প্রত্যাখ্যান করেছে জাতিসংঘ। বিশ্ব সংস্থাটি বলছে, মানবিক নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে– এমন কোনো ত্রাণ কার্যক্রমে তারা অংশ নেবে না।

জাতিসংঘের উপমুখপাত্র ফারহান হক বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে যে নতুন ত্রাণ পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে, সে বিষয়ে জাতিসংঘকে সরাসরি কিছু জানানো হয়নি।

এ পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সমন্বয়ে একটি বেসরকারি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাজায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে ত্রাণ পৌঁছানোর কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে উপমুখপাত্র বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, এই পরিকল্পনার মাধ্যমে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাত্রা এতটাই কঠোর হবে যে, তা শেষ দানা চাল ও শেষ ক্যালোরি বিন্দু পর্যন্ত নির্ধারিত থাকবে।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি শুধু সেই ব্যবস্থাতেই অংশ নেবে, যা ‘মানবতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার’ মূলনীতিকে মেনে চলে।

এদিকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফায় সংঘর্ষে আরও দুই ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও চার সেনা। এক বিবৃতিতে আইডিএফ জানিয়েছে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধে এ পর্যন্ত মোট ৮৫৬ সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া শুক্রবার গাজার বিভিন্ন অংশে ইসরায়েলের চালানো বিমান ও আর্টিলারি হামলায় চার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের একটি আবাসিক ভবনে হামলায় একই পরিবারের স্বামী-স্ত্রী ও তাদের শিশুসন্তান মারা গেছে।
একই দিন গাজার উত্তরাঞ্চলের আল-রিমাল এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে হামলায় আরও এক ফিলিস্তিনি নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হন। এ ছাড়া আল-জাওয়াইদা শহরের একটি অ্যাপার্টমেন্টে হেলিকপ্টার থেকে হামলায় বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। গাজার উপকূলীয় অঞ্চলে গোলাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরায়েলি নৌবাহিনীও। যদিও এ হামলায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

ইউএনআরডব্লিউএর ৬ স্কুল বন্ধের নির্দেশ

শুক্রবার পূর্ব জেরুজালেমের শুয়াফাত শরণার্থী শিবিরে ইউএনআরডব্লিউএ পরিচালিত ছয়টি স্কুলে অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জোর করে বের করে দিয়ে স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয় তারা।

এর আগে গত এপ্রিল মাসে শুয়াফাতের একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাকে একটি সামরিক নির্দেশনা দেয় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। তাতে বলা হয়, ৮ মের মধ্যে স্কুল বন্ধ করতে হবে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী, ৮ মের পর থেকে স্কুল ভবনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। এবার ওই আদেশে আরও পাঁচটি স্কুল যুক্ত হয়েছে। এগুলো সিলওয়ান, ওয়াদি আল-জোজ ও সুর বাহের এলাকায় অবস্থিত। এসব স্কুলে ৮০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি শিশু পড়াশোনা করে।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে ইউএনআরডব্লিউএকে ‘সন্ত্রাসী সংস্থা’ আখ্যা দেয় ইসরায়েল। এর পর তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে এসব স্কুল বন্ধের নির্দেশ দেয়। এসব শিক্ষার্থীকে ইসরায়েলি স্কুলে পাঠানোর নির্দেশও দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘এই হামলা জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের পরিচয় ও অস্তিত্ব মুছে ফেলতে একটি পরিকল্পিত যুদ্ধের অংশ। এর লক্ষ্য শহরটিকে পুরোপুরি ইহুদি বানানো।’ জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি স্কুলগুলো দ্রুত খুলে দেওয়ার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে তারা।

এদিকে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, যা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হবে। পরিকল্পনার আওতায় গাজাজুড়ে মানবিক সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন ও অবকাঠামো পুনর্গঠনের কথা বলা হয়েছে। সূত্র: আলজাজিরা, মিডিলইস্ট মনিটর। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল ইসর য

এছাড়াও পড়ুন:

পৃথিবীকে নীল বিন্দু খেতাব দিয়েছিলেন যে বিজ্ঞানী

জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান মহাবিশ্বের সৌন্দর্যকে জনসমক্ষে নিয়ে আসার জন্য আলোচিত। তিনি ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। কিংবদন্তি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, লেখক ও বিজ্ঞান প্রচারক হিসেবে কার্ল স্যাগান আলোচিত। বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোকে সহজ ও কাব্যিক ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্বকে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন। তাঁর কাজ কেবল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

কার্ল স্যাগানের সবচেয়ে বড় অবদান বলা যায় বিজ্ঞানবিষয়ক নানা বিষয়কে লেখালেখি ও টেলিভিশনের মাধ্যমে সবার সামনে ছড়িয়ে দেওয়া। ১৯৮০ সালে প্রচারিত তাঁর যুগান্তকারী টেলিভিশন সিরিজ ‘কসমস: এ পার্সোনাল ভয়েজ’ বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ দর্শককে মহাবিশ্বের রহস্যের প্রতি আকৃষ্ট করে। এই সিরিজ বৈজ্ঞানিক ধারণাকে এমনভাবে উপস্থাপন করে, যা গভীর অথচ সহজে বোধগম্য। স্যাগানের বিখ্যাত উক্তি, ‘আমরা সবাই স্টারডাস্ট বা তারাধূলি দিয়ে তৈরি।

একজন পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে স্যাগানের গবেষণা মূলত ছিল গ্রহবিজ্ঞান নিয়ে। তিনি শুক্র, বৃহস্পতি গ্রহসহ অন্যান্য গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে ছিল শুক্র গ্রহের তীব্র তাপমাত্রা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা, যা পরে প্রমাণিত হয়। স্যাগান মঙ্গল গ্রহে প্রাণের অনুসন্ধান এবং এর পরিবেশ নিয়ে ব্যাপক কাজ করেন। তিনি নাসার মেরিনার, ভয়েজারসহ বিভিন্ন গ্রহ অনুসন্ধানকারী মিশনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। মঙ্গলের পৃষ্ঠে থাকা রহস্যময় ক্যানালি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিতর্ক ছিল। স্যাগান বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করেন, এসব এলিয়েনদের তৈরি খাল নয়, বরং প্রাকৃতিক ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য।

দূরবর্তী মহাজাগতিক প্রাণীর কাছে পৃথিবীর অস্তিত্ব জানান দিতে স্যাগান দুটি ঐতিহাসিক প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭২ সালে উৎক্ষেপিত পাইওনিয়ার ১০ মহাকাশযানে একটি বিশেষ ফলক সংযুক্ত করার ধারণা দেন স্যাগান।

এই প্লেটে মানব জাতির চিত্র, আমাদের সৌরজগতের অবস্থান এবং মহাকাশযানের উৎক্ষেপণের সময়কাল চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড পাঠানোর সময় তাঁর ভূমিকা ছিল। এটি ছিল স্যাগানের নেতৃত্বাধীন সবচেয়ে বিখ্যাত প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৭৭ সালে উৎক্ষেপিত ভয়েজার ১ এবং ভয়েজার ২ মহাকাশযানে পৃথিবীর ছবি, শব্দ, সংগীত এবং বিভিন্ন ভাষার শুভেচ্ছাবার্তা নিয়ে তৈরি এই সোনালি রেকর্ড পাঠানো হয়। কার্ল স্যাগান ১৯৯৬ সালে আমাদের ছেড়ে চলে যান।

ভয়েজার ১ মহাকাশযান থেকে তোলা একটি ছবিকে জনপ্রিয় করেন তিনি। সেই ছবিতে পৃথিবীকে একটি ফ্যাকাশে নীল বিন্দুর মতো দেখায়। ৬০০ কোটি কিলোমিটার দূর থেকে ধারণ করা ছবিটি বিশ্বকে চমকে দেয়। ছবিটি তুলতে স্যাগান নাসাকে উৎসাহিত করেছিলেন। কার্ল স্যাগানের চিন্তায় প্রথমবারের মতো মানব জাতি বুঝতে পারে, মহাবিশ্বের বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে মানবজাতির গুরুত্ব ও ক্ষুদ্রতা কত নগণ্য।

ভয়েজার ১ মহাকাশযান থেকে পৃথিবীকে আলোর রশ্মিতে ঝুলে থাকা এক ফোঁটা নীল ধূলিকণার মতো মনে হয়। স্যাগান সেই ছবির বর্ণনায় বলেন, এই ক্ষুদ্র বিন্দুর ওপরই বাস করছে আপনার পরিচিত প্রতিটি ব্যক্তি। আমাদের সব হাসি-কান্না, আমাদের হাজারো ধর্ম, মতাদর্শ, অর্থনৈতিক বিশ্বাস, সভ্যতার উত্থান-পতন, রাজা-প্রজা, প্রেমিক-প্রেমিকা, উদ্ভাবক আর আমাদের প্রজাতির ইতিহাসে যত পাপি ও সাধু এসেছে সবাই। তারা সবাই ছিল সূর্যের আলোয় ভেসে থাকা ধূলিকণার এক কণামাত্র।
তথ্যসূত্র: আমেরিকান সায়েন্টিস্ট

সম্পর্কিত নিবন্ধ