বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা বলেছেন যে সংবাদমাধ্যমকে প্রশ্ন করতেই হবে, প্রশ্ন তুলতে হবে। বর্তমান সরকার সংবাদমাধ্যমের প্রশ্ন নিতে রাজি আছে।
প্রতিবছরই এ ধরনের অনুষ্ঠানে সরকার বা সরকারের তরফে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে নানা কথা বলা হয়। কথাগুলো শুনতে ভালো। কিন্তু সেগুলো বাস্তবতার সঙ্গে মেলাতে গেলে কিছুটা ধন্দে পড়তে হয়। এর একটা কারণ হতে পারে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের মুক্ত সাংবাদিকতা নিয়ে তৈরি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান। অবশ্য ২০২৪ সালের তুলনায় এ বছর ১৬ ধাপ অগ্রগতি ঘটিয়েছে বাংলাদেশ। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের স্থান এখন ১৪৯তম।
সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার নিয়ে তথ্য উপদেষ্টার বক্তব্যের তাৎপর্য কারও কাছে নতুন করে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। এ বক্তব্যের সঙ্গে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টার কাছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও বাংলা নববর্ষের আয়োজন নিয়ে তিনজন সাংবাদিকের করা প্রশ্নের জেরে সৃষ্ট ‘ঘটনাপ্রবাহ’ জড়িয়ে আছে। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপরিসর—দুই-ই সরগরম। ওই তিন সাংবাদিককে চাকরিচ্যুতির মাধ্যমে মালিকপক্ষ একটা ‘ফয়সালা’ করতে চেয়েছেন। তবে তাতে গুরুতর প্রশ্নটিও আরেক দফায় সামনে চলে এসেছে—একজন সাংবাদিকের প্রশ্ন করার সীমা আসলে কতটুকু? আর সেই সীমার আড়ে-বহরইবা কীভাবে নির্ধারণ করা হয়?
বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক, কবি ও সাংবাদিক জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকতা হলো এমন কিছু প্রকাশ করা, যা প্রকাশিত অবস্থায় অন্য কেউ দেখতে চায় না; আর বাদবাকিটা জনসংযোগ।’ বহুল উদ্ধৃত এই কথাকে মান্য ধরলে বলা যায়, একজন সাংবাদিক প্রকাশের উদ্দেশ্যে এমন তথ্য সংগ্রহ করবেন, যা অন্য কারও ‘অপছন্দের’ কারণ হবে। অর্থাৎ প্রশ্ন করার মধ্য দিয়েও তিনি কারও না কারও ‘বিরাগভাজন’ হতে পারেন।
বলা বাহুল্য, সাংবাদিকদের অন্যতম কাজ প্রশ্ন করা। কিন্তু তাই বলে কি তিনি যেকোনো জায়গায় যে কাউকে যেকোনো প্রশ্ন করতে পারেন? বিষয়টির একদিকে রয়েছে মতপ্রকাশের অধিকার, অন্যদিকে রয়েছে গোপনীয়তা, শালীনতা ও আইনগত সীমা। আছে সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মান্য রীতি-রেওয়াজের বিষয়টিও।
সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তবে বিষয়টি তিনটি মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে—জনস্বার্থ, স্থান এবং আচরণ। অর্থাৎ সাংবাদিকের তথ্য অনুসন্ধানের অধিকার সম্পূর্ণ ‘সীমাহীন’ নয়।
সাংবাদিকতার সর্বজনগ্রাহ্য রীতি অনুযায়ী দুর্নীতি, জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে জনস্বার্থে প্রশ্ন করায় বাধা নেই। জনস্বার্থে না হলে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন না করাই উচিত। অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত স্থানে অনুপ্রবেশ আইন লঙ্ঘনের আওতায় পড়বে। প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক হেনরি লুইস মেনকেন বলেছিলেন, সাংবাদিকের কাজ হলো দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রশ্নের মুখোমুখি করা। অতএব প্রশ্ন করা জারি রাখতে হবে।যুক্তরাষ্ট্রের সোসাইটি অব প্রফেশনাল জার্নালিস্ট ও অ্যাসোসিয়েট প্রেস ম্যানেজিং এডিটরস-এর কোড অব এথিকস এবং নিউইয়র্ক টাইমস-এর গাইডলাইনস অন ইন্টেগ্রিটিতে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। মোটাদাগে জনস্বার্থের মূলনীতি হলো সাংবাদিকদের প্রধান দায়িত্ব জনস্বার্থে তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করা। স্থানবিষয়ক মূলকথা হলো সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের অধিকার স্থানভেদে ভিন্ন হতে পারে, তবে জনস্বার্থে তথ্য সংগ্রহের অধিকার স্বীকৃত। এবং আচরণের বিষয়টি হলো সাংবাদিকদের উচিত পেশাগত আচরণ বজায় রাখা, যাতে তাঁদের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অক্ষুণ্ন থাকে।
ইউরোপিয়ান কনভেনশন অন হিউম্যান রাইটসের আর্টিকেল ১০-এ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা স্বীকৃত বলে উল্লেখ আছে। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারও সমান গুরুত্বপূর্ণ (আর্টিকেল ৮)।
যুক্তরাষ্ট্রের এসপিজে কোড অব এথিকসে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে ‘সিক ট্রুথ অ্যান্ড রিপোর্ট ইট’। অর্থাৎ সত্যের পেছনে ছুটতে হবে, সেটা জনসমক্ষে আনতে হবে। এর সঙ্গে বলা আছে আরও তিনটি বিষয়। ‘মিনিমাইজ হার্ম’, অর্থাৎ প্রশ্ন বা প্রতিবেদন যেন কাউকে অকারণে ক্ষতিগ্রস্ত না করে। ‘অ্যাক্ট ইনডিপেনডেন্টলি’, অর্থাৎ ব্যক্তিগত স্বার্থের বাইরে থেকে কাজ করা। এবং ‘বি অ্যাকাউন্ট্যাবল অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্ট’, অর্থাৎ ভুল হলে তা স্বীকার করা, জবাবদিহি করা।
আরও পড়ুনসংবাদমাধ্যম কি এমনি এমনি ভয় পাচ্ছে০৬ মে ২০২৫২০১৮ সালের ঘটনা। হোয়াইট হাউসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চ্যালেঞ্জ করে প্রশ্ন করেছিলেন সিএনএনের সাংবাদিক জিম অ্যাকোস্টা। এর জেরে অ্যাকোস্টার হোয়াইট হাউসের ঢোকার ‘প্রেস পাস’ স্থগিত করে ট্রাম্প প্রশাসন। তবে আদালত পরে সাংবাদিকের পক্ষেই রায় দেন। এ ঘটনায় এটা পরিষ্কার হয় যে কর্তৃপক্ষের নাখোশ হওয়ার মতো প্রশ্ন করার অধিকার একজন সাংবাদিক রাখেন।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২০২১ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তথ্য সংগ্রহের সময় সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কয়েক ঘণ্টা আটকে রাখা এবং মামলার করার উদাহরণ টানা যায়। এ ঘটনার জেরে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বনাম রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার প্রশ্নটি সামনে আসে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয় এবং একে ‘সাংবাদিক নিপীড়ন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
২০২৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশে সঞ্জয় রানা নামের এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল একজন মন্ত্রীকে ‘উচিত’ প্রশ্ন করায়। এর আগে ২০১৯ সালে রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ নিয়ে একটি টুইটারে (বর্তমানে এক্স) একটি ভিডিও শেয়ার করার কারণে সাংবাদিক প্রশান্ত কানোজিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে কানোজিয়া মুক্তি পান।
তুরস্কে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের ‘নাপসন্দ’ প্রশ্ন করায় অনেক সাংবাদিককেই রোষানলে পড়তে হয়েছে। উদাহরণ, সাংবাদিক এরদেম গুল ও ক্যান ডুন্দরকে দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
সাংবাদিকতার সর্বজনগ্রাহ্য রীতি অনুযায়ী দুর্নীতি, জনস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিষয়ে জনস্বার্থে প্রশ্ন করায় বাধা নেই। জনস্বার্থে না হলে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন না করাই উচিত। অনুমতি ছাড়া কারও ব্যক্তিগত স্থানে অনুপ্রবেশ আইন লঙ্ঘনের আওতায় পড়বে। প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক হেনরি লুইস মেনকেন বলেছিলেন, সাংবাদিকের কাজ হলো দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো এবং সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রশ্নের মুখোমুখি করা। অতএব প্রশ্ন করা জারি রাখতে হবে।
মোদ্দাকথা, প্রশ্ন করা সাংবাদিকের পেশাগত অধিকার, দায়িত্ব। তবে সেটি যেন জনস্বার্থ, নীতিমালা ও নৈতিকতা দিয়ে পরিচালিত হয়। আর প্রশ্ন করার ধরন, স্থান ও পটভূমিও গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিকদের উচিত দায়িত্বশীল ও সংবেদনশীল আচরণ করা। রাষ্ট্রেরও উচিত সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া। তবে কোন রাষ্ট্রে সাংবাদিকদের কেমন সুরক্ষা দেওয়া হয়—এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে যাওয়ার বিষয়টি হতে পারে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ খোলার নামান্তর। অতএব এ বিষয়ে আজ এখানেই ‘দাঁড়ি’।
হাসান ইমাম সাংবাদিক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জনস ব র থ ব দ কত র ব ষয়ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
মাদক একটা ওয়ানওয়ে জার্নি, এটা দিয়ে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না: উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘মাদক একটা ওয়ানওয়ে জার্নি, এটা দিয়ে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। এ পথে ঢুকলে ফেরার রাস্তা নেই। কাজেই আগেই সাবধান হতে হবে। অভিভাবকদের অনুরোধ করব, আপনাদের সন্তানদের সময় দিন। ব্যস্ততা থাকবে, কাজ থাকবে, কিন্তু সন্তানদের সময় দিন। সময় না দিলে সন্তানদের বিপথে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে।’
আজ রোববার দুপুরে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুড়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
শিক্ষকদের প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যে শিক্ষকেরা আমাদের পড়িয়েছিলেন, তাঁদের বেতন ছিল অত্যন্ত কম। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ডেডিকেশনের অভাব ছিল না। তাঁরা প্রচণ্ডভাবে ডেডিকেটেড ছিলেন ছাত্রদের প্রতি। খুবই যত্ন নিতেন আমাদের। তাঁদের তুলনায় আমাদের বর্তমান শিক্ষকদের বেতন অনেক ভালো। প্রাইমারি স্কুলে আমাদের যাঁরা পড়িয়েছেন ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, একজন শিক্ষকের বেতন ছিল ৩২ টাকা। আমার বাবা বেতন পেতেন ৫০০ টাকার বেশি। তাঁরাও কিন্তু প্রচণ্ড ডেডিকেশন নিয়ে আমাদের শিখিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, আপনাদের (শিক্ষকদের) যথেষ্ট মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। আমি জানি, শিক্ষকদের কত সমস্যা। এরপরও আপনাদের আন্তরিকতা ধরে রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘নেপাল থেকে মালয়েশিয়াতে একজন কর্মী যায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায়। আমাদের এখান থেকে যায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়। একই কাজের জন্য একই বেতনে। আমি পৃথিবীর অনেক দেশে গেছি। বাঙালি আছে সব জায়গাতে। অনেক ক্ষেত্রে চাকরি করছে, ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, সবচেয়ে কম বেতনে চাকরি করে বাঙালিরা। কারণ, প্রশিক্ষণের অভাব, শিক্ষার অভাব। আমাদের যে ম্যানপাওয়ার এজেন্ট আছেন, তাঁরাও প্রতারিত করেন। এটা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার ব্যর্থতা। এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা আমরা নিতে পারি নাই।’
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘লেখাপড়ার কোনো বিকল্প নেই। তোমাদের সামনে প্রচুর সুযোগ আছে। যে জাতি আগে লেখাপড়া শিখেছে, তারা আগে উঠতে পেরেছে। তোমরা লেখাপড়ার প্রতি মনযোগী হও। কারণ, আমাদের এর কোনো বিকল্প নেই। আমাদের কোনো শর্টকাট নেই, কাজেই আমাদের কঠিন পথে এগোতে হবে। আমাদের সময়ের তুলনায় তোমাদের সুযোগ অনেক বেশি। তোমাদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, যোগ্যতা অর্জনের পথ একমাত্র লেখাপাড়া।’
সভায় সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবদুল কুদ্দুস সরকার। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ নায়িরুজ্জামান, পুলিশ সুপার শেখ জাহিদুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা জামান, মাগুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আখতারুজ্জামান প্রমুখ।