মা’গো তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে? দেখো আমি বড় হয়ে তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না। মানুষের বাড়িতে তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। সারাজীবন তোমাকে আমি আগলে রাখব। তুমি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। 

দেড় বছর বয়সে বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিন ভাই-বোন নিয়ে শুরু হয় আমার দুঃখিনী মায়ের সংগ্রামী জীবন। নিজের সুখ-শান্তি আর আরাম-আয়েশের কথা চিন্তা না করে, তিন ভাই-বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে, চক্ষুলজ্জা পিছনে ফেলে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন মা। নিজে না খেয়ে মা খাবার নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য।

অন্যদের অনেক গালমন্দ খেতে তুমি, মুখটি তোমার মলিন হত। আমি ছোট, তবুও বুঝতাম তোমার কষ্ট। তুমি সবই হাসিমুখে মেনে নিতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তুমি ছিলে সোনায়-সোহাগী। আজ বাবা নেই, তাই তোমার জীবনে নেমেছে অন্ধকার। শত কষ্টের মাঝে কেটে গেলো আমাদের জীবনে কয়েকটি বছর।

আরো পড়ুন:

আমার একজন সংগ্রামী মা

আমার মা

তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। শরীরে আমার অনেকটা জোর হয়েছে। মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যায় তার কর্মস্থলে। সেখানে মার কাজের পরিমাণ আর কষ্ট দেখে নিজের মধ্যে জেগে উঠে শক্তি আর সাহস। মা তুমি বাড়ি চলো, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না? কিন্তু মা বলেন, “আরে পাগল ছেলে কষ্ট না করলে তোরা বড় হবি কি করে? আজ আমার কষ্ট হচ্ছে, একদিন তোরা আমাকে সুখে রাখবি।”

মায়ের কষ্ট আমার কমল হৃদয়ে পীঁড়া দেয়। তাই এই বয়সেই নিজেকে বড় করে তুললাম। সন্ধ্যায় কুঁড়েঘরে মা ফিরে আসলে, মায়ের আঁচল টেনে ধরলাম।

-মা কাল থেকে আমি কাজ করব, তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না।

-তুই ছোট মানুষ, কি কাজ করবি, আবার তোর লেখাপড়া?

-মাগো আমি সব পারবো তোমার জন্য, পাশাপাশি লিখাপড়াও করবো। 

শুরু হলো মাকে নিয়ে আমার সংগ্রামী জীবন। গায়ে-গতরে জোর কম থাকলেও মনের জোরে শুরু হলো আমার পথ চলা। অন্যের দোকানে কাজ, রেলস্টেশনে যাত্রীর মালামাল টানা। তাতে সারাদিনে আয় হত ১০ থেকে ১৫ টাকা। চালের কেজি তখন ৬ থেকে ৭ টাকা। দেড় কেজি চাল আর অন্যান্য সবজি। এতেই কোনরকম চলতো আমাদের কুঁড়েঘরের সংসার।

সারাদিনের কর্মযজ্ঞ শেষে খরচের ব্যাগ হাতে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, মা তখন দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করতেন। আর তার মায়া মাখানো আঁচল দিয়ে আমার গাম ঝরা মুখ মুছে দিতেন। এভাবে শুরু হয় ভাই-বোন আর দুঃখিনী মাকে নিয়ে আমার শৈশবের জীবন।

পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বললাম, “মা আমি আর লেখাপড়া করব না। এখন আমি আরো কাজ করব।” কিন্তু মা বললেন, “নারে বাপ তোর মাথা ভাল, মেট্রিক পাস করতে হবে।”

মায়ের দোয়া নিয়ে আবারো আমার কিশোর জীবন শুরু হলো। এবার মেট্রিক পাস হলো, গ্রামে মা আমাকে নিয়ে গর্ব করে সবাইকে বলেন, “আমার ছেলে মেট্রিক পাস করেছে।” মায়ের মুখের হাসি আমার সামনে চলা আরও অনুপ্রেরণা জোগালো, কলেজে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে লেখাপড়া, অনেকটা কষ্টের। তবে মায়ের আদর, স্নেহ, ভালবাসা আর দোয়া আমার সব কাজ সহজ করে দেয়। আইএ পাস করলাম। এবার চাকরির পালা। মায়ের অনেক স্বপ্ন, আমি চাকরি করব।

পেলাম কোম্পানির চাকরি, সেই নীলফামারী জেলা। সব অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষ। মা ছাড়া কখনো একা থাকিনি, মা ছাড়া যেন সব ফাঁকা। একদিন বসকে বললাম, “বস, আমি তো কখনো মা ছাড়া থাকিনি। মাকে কি এখানে আনতে পারি?” বস অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি মাকে অনেক ভালবাসেন তাই না?”

বসের কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না, কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অনুমতি পেলাম আমার মাকে কাছে রাখার। কোম্পানির চাকরি একটি উপজেলার দায়িত্বে। একটি ঘর ভাড়া নিলাম, শুরু হলো এখানে মা-ছেলের ছোট সুখের সংসার। মার তো তেমন কাজ নেই, সারাদিন আমি কি খেতে পছন্দ করি, সেসব খাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। ছেলে তো বড় হয়ে গেছে, মায়ের চিন্তা- ছেলের বৌ আর নাতি-নাতনি দেখবেন।

আবারো নিজ এলাকায় এসে মা তার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। মায়ের দোয়া নিয়ে নতুন সংসার এবং শুরু হলো নতুন ব্যবসা। মায়ের দোয়া থাকলে পৃথিবীও জয় করা যায়। দিনে দিনে ব্যবসায় আয়-উন্নতি হতে থাকে। বাড়িঘর তেমন ছিল না, ছিল মাটির একটি ঘর। তৈরি করা হলো ইটের পাকা বাড়ি। বাড়িঘর দেখে মায়ের চোখে পানি বয়ে পড়ে।

-মা তুমি কাঁদছো কেনো?

-বাবারে, এত বড় বাড়ি আর এত সুখ আমি কখনই চাইনি।

-মাগো তোমার দোয়াতে আল্লাহপাক আজ আমাকে সব দিয়েছে। তুমি দোয়া করো বলেই আমার সব হয়। তোমার দোয়ার কারণে আমার কোন বিপদ-আপদ হয় না। যে কাজে হাত দেই, সেই কাজে আল্লাহ রহমত করে। মাগো তুমি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ উপহার।

দেখতে দেখতে জীবনে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে। সুখের দিনগুলো সহজেই অতিবাহিত হয়ে যায়। আজ আমারো ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরাও মায়ের সেবা-যত্ন করে। জীবনে চলার পথে মাকে কখনো অবহেলা করিনি। প্রতিটি যাত্রাপথে মায়ের দোয়া নিয়ে চলেছি। কখনো হোঁচট খাইনি, পেয়েছি সাফল্যতা।

বর্তমান মায়ের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। আজো প্রতিবছর মা দিবসে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি, হে আল্লাহ, তুমি আমার মাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখ।

(লেখক: ব্যবসায়ী, হিলি, দিনাজপুর)

ঢাকা/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম দ বস ক জ কর আম দ র আম র ক আম র ম র জ বন র অন ক প স কর আম র স আল ল হ

এছাড়াও পড়ুন:

রেহানা, টিউলিপ, আজমিনা ও রাদওয়ানের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু

পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক তিন মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের (ববি) বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।

দুর্নীতির দমন কমিশনের (দুদক) করা এই তিন মামলায় আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম আলোকে এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তরিকুল ইসলাম।

টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি)। তিনি দেশটির সাবেক ‘সিটি মিনিস্টার’। তিনি এখন বাংলাদেশে বিচারের মুখোমুখি।

এর আগে গত ১১ আগস্ট প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের অপর তিন মামলায় শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।

পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকের করা পৃথক ছয় মামলায় শেখ হাসিনা, তাঁর পরিবারের সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে গত ৩১ জুলাই অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার দুই বিশেষ জজ আদালত। এর মধ্যে তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১১ আগস্ট তারিখ ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এর বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন। বাকি তিন মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ১৩ আগস্ট তারিখ ধার্য করেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এর বিচারক মো. রবিউল আলম।

আরও পড়ুনপ্লট বরাদ্দে দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু১১ আগস্ট ২০২৫

মামলায় শেখ হাসিনা পরিবারের বাইরে যে ১৬ জন অভিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা হলেন জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, গণপূর্তের তৎকালীন সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিয়া, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, সদস্য কবির আল আসাদ, সদস্য তন্ময় দাস, সদস্য নুরুল ইসলাম, সাবেক সদস্য মোহাম্মদ নাসির উদ্দীন, সাবেক সদস্য সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী, পরিচালক শেখ শাহিনুল ইসলাম, উপপরিচালক হাফিজুর রহমান, হাবিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার।

আরও পড়ুনটিউলিপের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে১১ ঘণ্টা আগে

দুদকের পিপি খান মো. মইনুল হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের সংশ্লিষ্ট বিধান অনুযায়ী, ঢাকায় যাঁদের প্লট-গাড়ি-বাড়ি কিছুই নেই, তাঁরা মূলত সংস্থার প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনার পরিবার রাজউকের কাছে মিথ্যা হলফনামা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তাঁদের ঢাকা শহরে জমি-বাড়ি কোনো কিছুই নেই। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, শেখ হাসিনা পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নামে বাড়ি-জমি-গাড়ি সবই আছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁরা রাজউকের ৬০ কাঠার প্লট নিয়েছেন, যা অপরাধ। অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গসহ অন্যান্য অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আরও পড়ুনশেখ হাসিনা-রেহানা-টিউলিপসহ ২৩ জনকে আদালতে হাজিরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির নির্দেশ০১ জুলাই ২০২৫

দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের ছয় মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে মামলাগুলো বিচারের জন্য দুটি বিচারিক আদালতে বদলির আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত।

শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ছয় মামলায় গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক।

টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে: দুদক চেয়ারম্যানআমাকে হয়রানির জন্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে: টিউলিপটিউলিপের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আদালতের বিষয়, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ নয়: মুহাম্মদ ইউনূস

সম্পর্কিত নিবন্ধ