অন্যের বাড়িতে কাজ করে মা খাবার নিয়ে আসতেন
Published: 11th, May 2025 GMT
মা’গো তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে? দেখো আমি বড় হয়ে তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না। মানুষের বাড়িতে তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। সারাজীবন তোমাকে আমি আগলে রাখব। তুমি বেঁচে থাকবে অনন্তকাল।
দেড় বছর বয়সে বাবা চলে গেছেন না ফেরার দেশে। তিন ভাই-বোন নিয়ে শুরু হয় আমার দুঃখিনী মায়ের সংগ্রামী জীবন। নিজের সুখ-শান্তি আর আরাম-আয়েশের কথা চিন্তা না করে, তিন ভাই-বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে, চক্ষুলজ্জা পিছনে ফেলে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে শুরু করেন মা। নিজে না খেয়ে মা খাবার নিয়ে আসতেন আমাদের জন্য।
অন্যদের অনেক গালমন্দ খেতে তুমি, মুখটি তোমার মলিন হত। আমি ছোট, তবুও বুঝতাম তোমার কষ্ট। তুমি সবই হাসিমুখে মেনে নিতে, আমাদের দিকে তাকিয়ে। বাবা যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তুমি ছিলে সোনায়-সোহাগী। আজ বাবা নেই, তাই তোমার জীবনে নেমেছে অন্ধকার। শত কষ্টের মাঝে কেটে গেলো আমাদের জীবনে কয়েকটি বছর।
আরো পড়ুন:
আমার একজন সংগ্রামী মা
আমার মা
তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। শরীরে আমার অনেকটা জোর হয়েছে। মায়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে যায় তার কর্মস্থলে। সেখানে মার কাজের পরিমাণ আর কষ্ট দেখে নিজের মধ্যে জেগে উঠে শক্তি আর সাহস। মা তুমি বাড়ি চলো, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না? কিন্তু মা বলেন, “আরে পাগল ছেলে কষ্ট না করলে তোরা বড় হবি কি করে? আজ আমার কষ্ট হচ্ছে, একদিন তোরা আমাকে সুখে রাখবি।”
মায়ের কষ্ট আমার কমল হৃদয়ে পীঁড়া দেয়। তাই এই বয়সেই নিজেকে বড় করে তুললাম। সন্ধ্যায় কুঁড়েঘরে মা ফিরে আসলে, মায়ের আঁচল টেনে ধরলাম।
-মা কাল থেকে আমি কাজ করব, তোমাকে আর কষ্ট করতে দেব না।
-তুই ছোট মানুষ, কি কাজ করবি, আবার তোর লেখাপড়া?
-মাগো আমি সব পারবো তোমার জন্য, পাশাপাশি লিখাপড়াও করবো।
শুরু হলো মাকে নিয়ে আমার সংগ্রামী জীবন। গায়ে-গতরে জোর কম থাকলেও মনের জোরে শুরু হলো আমার পথ চলা। অন্যের দোকানে কাজ, রেলস্টেশনে যাত্রীর মালামাল টানা। তাতে সারাদিনে আয় হত ১০ থেকে ১৫ টাকা। চালের কেজি তখন ৬ থেকে ৭ টাকা। দেড় কেজি চাল আর অন্যান্য সবজি। এতেই কোনরকম চলতো আমাদের কুঁড়েঘরের সংসার।
সারাদিনের কর্মযজ্ঞ শেষে খরচের ব্যাগ হাতে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, মা তখন দৌড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করতেন। আর তার মায়া মাখানো আঁচল দিয়ে আমার গাম ঝরা মুখ মুছে দিতেন। এভাবে শুরু হয় ভাই-বোন আর দুঃখিনী মাকে নিয়ে আমার শৈশবের জীবন।
পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বললাম, “মা আমি আর লেখাপড়া করব না। এখন আমি আরো কাজ করব।” কিন্তু মা বললেন, “নারে বাপ তোর মাথা ভাল, মেট্রিক পাস করতে হবে।”
মায়ের দোয়া নিয়ে আবারো আমার কিশোর জীবন শুরু হলো। এবার মেট্রিক পাস হলো, গ্রামে মা আমাকে নিয়ে গর্ব করে সবাইকে বলেন, “আমার ছেলে মেট্রিক পাস করেছে।” মায়ের মুখের হাসি আমার সামনে চলা আরও অনুপ্রেরণা জোগালো, কলেজে ভর্তি হলাম। বিভিন্ন কাজের ফাঁকে লেখাপড়া, অনেকটা কষ্টের। তবে মায়ের আদর, স্নেহ, ভালবাসা আর দোয়া আমার সব কাজ সহজ করে দেয়। আইএ পাস করলাম। এবার চাকরির পালা। মায়ের অনেক স্বপ্ন, আমি চাকরি করব।
পেলাম কোম্পানির চাকরি, সেই নীলফামারী জেলা। সব অচেনা জায়গা, অচেনা মানুষ। মা ছাড়া কখনো একা থাকিনি, মা ছাড়া যেন সব ফাঁকা। একদিন বসকে বললাম, “বস, আমি তো কখনো মা ছাড়া থাকিনি। মাকে কি এখানে আনতে পারি?” বস অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি মাকে অনেক ভালবাসেন তাই না?”
বসের কথার কোন জবাব দিতে পারলাম না, কিন্তু চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। অনুমতি পেলাম আমার মাকে কাছে রাখার। কোম্পানির চাকরি একটি উপজেলার দায়িত্বে। একটি ঘর ভাড়া নিলাম, শুরু হলো এখানে মা-ছেলের ছোট সুখের সংসার। মার তো তেমন কাজ নেই, সারাদিন আমি কি খেতে পছন্দ করি, সেসব খাবার তৈরিতে ব্যস্ত থাকতেন। ছেলে তো বড় হয়ে গেছে, মায়ের চিন্তা- ছেলের বৌ আর নাতি-নাতনি দেখবেন।
আবারো নিজ এলাকায় এসে মা তার পছন্দের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। মায়ের দোয়া নিয়ে নতুন সংসার এবং শুরু হলো নতুন ব্যবসা। মায়ের দোয়া থাকলে পৃথিবীও জয় করা যায়। দিনে দিনে ব্যবসায় আয়-উন্নতি হতে থাকে। বাড়িঘর তেমন ছিল না, ছিল মাটির একটি ঘর। তৈরি করা হলো ইটের পাকা বাড়ি। বাড়িঘর দেখে মায়ের চোখে পানি বয়ে পড়ে।
-মা তুমি কাঁদছো কেনো?
-বাবারে, এত বড় বাড়ি আর এত সুখ আমি কখনই চাইনি।
-মাগো তোমার দোয়াতে আল্লাহপাক আজ আমাকে সব দিয়েছে। তুমি দোয়া করো বলেই আমার সব হয়। তোমার দোয়ার কারণে আমার কোন বিপদ-আপদ হয় না। যে কাজে হাত দেই, সেই কাজে আল্লাহ রহমত করে। মাগো তুমি আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ উপহার।
দেখতে দেখতে জীবনে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে। সুখের দিনগুলো সহজেই অতিবাহিত হয়ে যায়। আজ আমারো ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে যাচ্ছে। আমার সঙ্গে স্ত্রী, ছেলে-মেয়েরাও মায়ের সেবা-যত্ন করে। জীবনে চলার পথে মাকে কখনো অবহেলা করিনি। প্রতিটি যাত্রাপথে মায়ের দোয়া নিয়ে চলেছি। কখনো হোঁচট খাইনি, পেয়েছি সাফল্যতা।
বর্তমান মায়ের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। আজো প্রতিবছর মা দিবসে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করি, হে আল্লাহ, তুমি আমার মাকে অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখ।
(লেখক: ব্যবসায়ী, হিলি, দিনাজপুর)
ঢাকা/মেহেদী
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম দ বস ক জ কর আম দ র আম র ক আম র ম র জ বন র অন ক প স কর আম র স আল ল হ
এছাড়াও পড়ুন:
জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো একটু সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রূপান্তর এগিয়ে নেওয়া। এ জন্য যে ধরনের সংস্কার দরকার, সেই সংস্কার নিশ্চিত করা। আর কয়েক মাস পর নির্বাচন। নির্বাচন ভালোমতো করার জন্য যা যা করা দরকার, সেটি করার জন্য এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ ফিরিয়ে আনা। অথচ এসব দিকে সরকারের মনোযোগ বা সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনের এসব বিষয়ে মনোযোগ না দিয়ে যেটিতে তাদের এখতিয়ার নেই, সেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতেই সরকারের যত আগ্রহ। রীতিমতো জোরজবরদস্তি করে সরকার এসব চুক্তি করছে। দেশের মানুষ, বিশেষজ্ঞ—কারও কথা না শুনে, জাতীয় স্বার্থ বিবেচনা না করে ভয় দেখিয়ে একের পর এক চুক্তি করছে সরকার।
একটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার কোনো এখতিয়ার এ রকম অস্থায়ী সরকারের থাকে না। এসবের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার হয়। শুধু নির্বাচিত সরকারও এভাবে করতে পারে না। নির্বাচিত সরকার এ ধরনের চুক্তি করলে সেগুলো সংসদে তুলতে হবে, সেখানে তর্ক-বিতর্ক হবে, দেশের মানুষ জানবে। আর কয় মাস পর নির্বাচন। এই সময় সরকারের এই ধরনের চুক্তিতে এত আগ্রহ কেন? বন্দর নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যদি দেশের উন্নয়নের জন্যই হয়, তাহলে এত গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা ও তাড়াহুড়া কেন?
চুক্তি নিয়ে এই সরকারের অতি আগ্রহ বড় সন্দেহের কারণ। মনে হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির কিছু লবিস্ট এই সরকার চালাচ্ছে। তাদের কাজ হলো কোনো না কোনোভাবে বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় গোপনে অস্বচ্ছভাবে চুক্তি করে ফেলা। সেটা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যাতে পরবর্তী কোনো সরকার এসে কিছু করতে না পারে। কিন্তু এই চুক্তির বোঝা বাংলাদেশের মানুষকে ভোগ করতে হবে বহু বছর।
গণ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জনগণের যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, স্বচ্ছতা নিয়মনীতি মেনে কাজ হবে, তার প্রতি এটা বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কিছু নয়। একই সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলাপ-আলোচনা করছে, অথচ সরকারের জাতীয় স্বার্থবিরোধী তৎপরতা নিয়ে তারা যে নিশ্চুপ থাকল, সেটার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে।
আমরা দেখেছি, এ রকম চুক্তির আগে সব সময় যুক্তি দেওয়া হয়, বিদেশি কোম্পানি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কোম্পানি। আবার মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করা হয় যে আমরা পারব না। আমাদের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয়। বিদেশিরা এলে কাজ হবে। আবার আমরা থাকলে দুর্নীতি হবে। বিদেশিরা এলে দুর্নীতি হবে না। এই হীনম্মন্যতা তৈরি করে এবং তার ওপর ভর করে বিদেশি কোম্পানিকে সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরা হয়। বিদেশিদের পক্ষে বিজ্ঞাপনী প্রচার চালাতে থাকে তাদের সুবিধাভোগী দেশি লোকজন। কিন্তু বিদেশিরা এলে যে দুর্নীতি হবে না, সেটার নিশ্চয়তা কীভাবে দেওয়া হয়? আন্তর্জাতিকভাবে কি দুর্নীতি হয় না? চুক্তির আগে মাশুল যে বাড়ানো হলো, এটাও তো দুর্নীতির একটা ধরন।
বিদেশি কোম্পানি যে দক্ষ, আন্তর্জাতিক যে স্বীকৃতি, সেই কোম্পানিগুলো কিন্তু এমনিতেই গড়ে ওঠেনি। জাতীয় সক্ষমতার প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠেছে এসব কোম্পানি। বাংলাদেশকেও জাতীয় সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে হবে। সে জন্য নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একটা দেশ শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে, যখন নিজের সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সরকার দেশকে বিপন্ন করে তার উল্টো দিকে যাত্রা করছে।
লেখক পরিচয়: অর্থনীতিবিদ ও সম্পাদক, সর্বজনকথা