চুলায় পোড়ে সুন্দরবনের বাহারি ফল, থমকে যায় বনের স্বপ্ন
Published: 9th, July 2025 GMT
সকালের দিকে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর তীরে দাঁড়ালে দূর থেকে মনে হবে, নদী যেন বন থেকে ভেসে আসা ফলের অস্থায়ী হাট বসিয়েছে। গরান, গেওয়া, খলিশা, সুন্দরী, পশুর, বাইন গাছের নামের তালিকা লম্বা হলেও কে আর গুনে রাখে। নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসা এসব গাছের ফল নতুন চারা হয়ে বনভূমিকে বাঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন বয়ে আনে; কিন্তু সেই স্বপ্ন তীরেই ভেঙে যায়। কারণ, নদীর পাড়ে অপেক্ষায় থাকে গ্রামের মানুষ, যাঁরা দল বেঁধে সেই ভাসমান ফল কুড়িয়ে নিয়ে যান চুলার জ্বালানি বানাতে।
মঙ্গলবার সকালে কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দেখা গেল সেই দৃশ্যেরই এক খণ্ডচিত্র। ভোরের বৃষ্টি থেমেছে, ভেজা রাস্তার ধারে লালচে বাদামি ফলগুলো ছড়িয়ে রোদে শুকানোর চেষ্টা চলছে। আকাশ এখনো ভেজা, কোথাও মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে হালকা রোদ। কাটকাটা গ্রামের আরতি মণ্ডলসহ কয়েকজন নারী নদীর পানিতে নেমে ভেসে আসা ফলে ঝুড়ি ভর্তি করছেন।
শাকবাড়িয়া নদীর তীরে বসে লক্ষ্মী রানী ফলের মধ্য থেকে শ্বাস আলাদা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘সব ফল একরকম না। শ্বাস থাকলে শুকায় না। তাই শ্বাস ফেলে খোলসটাই জ্বালাই। আর বাইনগাছের ফল তো আগুনে পোড়েই না, গরু-ছাগলের পেটে যায়।’
শুধু শাকবাড়িয়া নদীর তীরেই নয়, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী থেকে মহেশ্বরীপুর পর্যন্ত কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীর তীরবর্তী গ্রামেও একই দৃশ্য। জোয়ারে নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে নদীতে নামে, কেউ নেট জাল টেনে, কেউ ঝুড়ি ভরে। তারপর রাস্তার ধারে সারি সারি ফল শুকায়। রোদে শুকালে তবেই চুলায় আগুন জ্বলে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জোয়ারে একজন এক থেকে দেড় মণ ফল তুলতে পারেন। শুকিয়ে তা চুলার জ্বালানি হয়, কিছু যায় গবাদিপশুর খাবার হিসেবে। কেউ কেউ আবার তা বিক্রি করে দু-চার টাকা আয় করেন।
কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘দেখেন, এ ফলগুলো যদি নদীর চরে পড়ে থাকত, নতুন বন হতো। গরান-গেওয়ার সবুজ বেষ্টনী হলে নদীর পাড় ভাঙত না এতটা; কিন্তু সেই ফল চুলার আগুনেই শেষ।’
তবে এভাবে ভাসমান ফল চুলায় পোড়ানো নিয়ে মন খারাপ আছে যাঁরা ফল কুড়ান তাঁদেরও। তাঁরাও জানেন এই ফল না তুললে নদীর তীরে ছোট ছোট চর বনায়ন হয়ে উঠত, ভাঙন কমত, পাখিরাও ফিরে আসত। কয়রার মঠবাড়ী গ্রামের হালিমা বেগম হেসে বলেন, ‘চরে গাছ হইলে ভালোই হতো, নদী ভাঙত না; কিন্তু কয়ডা দিন কীভাবে চুলা বন্ধ রেখে থাকব কন?’
সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লোকজন বলে চুলার জন্য কাঠ নেই, তাই এই ভাসমান ফলই ভরসা; কিন্তু এ ভরসাই আবার নতুন চরের গাছ হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে। সচেতন করতে করতে গলা শুকায়; কিন্তু কথা তো কেউ শোনে না।’
বিষয়টি নজরে আনা হলে বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, সুন্দরবনের গাছ থেকে স্বাভাবিকভাবে ফল পড়ে যায়, নদীর ঢেউ সেই ফল ভাসিয়ে আনে। বনাঞ্চলে যেগুলো পাড়ে আটকে যায়, সেগুলোই নতুন চারা হয়ে ওঠে; কিন্তু লোকালয়ের পাড়ে এলে মানুষ তুলে নেয়। এই প্রতিটা ফলই একেকটা বীজ, একেকটা নতুন গাছ; কিন্তু মানুষের দরকার শুধু জ্বালানি, গাছের কথা তাদের ভাবায় না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ন দরবন নদ র ত র নদ র প
এছাড়াও পড়ুন:
চুলায় পোড়ে সুন্দরবনের বাহারি ফল, থমকে যায় বনের স্বপ্ন
সকালের দিকে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর তীরে দাঁড়ালে দূর থেকে মনে হবে, নদী যেন বন থেকে ভেসে আসা ফলের অস্থায়ী হাট বসিয়েছে। গরান, গেওয়া, খলিশা, সুন্দরী, পশুর, বাইন গাছের নামের তালিকা লম্বা হলেও কে আর গুনে রাখে। নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসা এসব গাছের ফল নতুন চারা হয়ে বনভূমিকে বাঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন বয়ে আনে; কিন্তু সেই স্বপ্ন তীরেই ভেঙে যায়। কারণ, নদীর পাড়ে অপেক্ষায় থাকে গ্রামের মানুষ, যাঁরা দল বেঁধে সেই ভাসমান ফল কুড়িয়ে নিয়ে যান চুলার জ্বালানি বানাতে।
মঙ্গলবার সকালে কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দেখা গেল সেই দৃশ্যেরই এক খণ্ডচিত্র। ভোরের বৃষ্টি থেমেছে, ভেজা রাস্তার ধারে লালচে বাদামি ফলগুলো ছড়িয়ে রোদে শুকানোর চেষ্টা চলছে। আকাশ এখনো ভেজা, কোথাও মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে হালকা রোদ। কাটকাটা গ্রামের আরতি মণ্ডলসহ কয়েকজন নারী নদীর পানিতে নেমে ভেসে আসা ফলে ঝুড়ি ভর্তি করছেন।
শাকবাড়িয়া নদীর তীরে বসে লক্ষ্মী রানী ফলের মধ্য থেকে শ্বাস আলাদা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘সব ফল একরকম না। শ্বাস থাকলে শুকায় না। তাই শ্বাস ফেলে খোলসটাই জ্বালাই। আর বাইনগাছের ফল তো আগুনে পোড়েই না, গরু-ছাগলের পেটে যায়।’
শুধু শাকবাড়িয়া নদীর তীরেই নয়, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী থেকে মহেশ্বরীপুর পর্যন্ত কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীর তীরবর্তী গ্রামেও একই দৃশ্য। জোয়ারে নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে নদীতে নামে, কেউ নেট জাল টেনে, কেউ ঝুড়ি ভরে। তারপর রাস্তার ধারে সারি সারি ফল শুকায়। রোদে শুকালে তবেই চুলায় আগুন জ্বলে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জোয়ারে একজন এক থেকে দেড় মণ ফল তুলতে পারেন। শুকিয়ে তা চুলার জ্বালানি হয়, কিছু যায় গবাদিপশুর খাবার হিসেবে। কেউ কেউ আবার তা বিক্রি করে দু-চার টাকা আয় করেন।
কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘দেখেন, এ ফলগুলো যদি নদীর চরে পড়ে থাকত, নতুন বন হতো। গরান-গেওয়ার সবুজ বেষ্টনী হলে নদীর পাড় ভাঙত না এতটা; কিন্তু সেই ফল চুলার আগুনেই শেষ।’
তবে এভাবে ভাসমান ফল চুলায় পোড়ানো নিয়ে মন খারাপ আছে যাঁরা ফল কুড়ান তাঁদেরও। তাঁরাও জানেন এই ফল না তুললে নদীর তীরে ছোট ছোট চর বনায়ন হয়ে উঠত, ভাঙন কমত, পাখিরাও ফিরে আসত। কয়রার মঠবাড়ী গ্রামের হালিমা বেগম হেসে বলেন, ‘চরে গাছ হইলে ভালোই হতো, নদী ভাঙত না; কিন্তু কয়ডা দিন কীভাবে চুলা বন্ধ রেখে থাকব কন?’
সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লোকজন বলে চুলার জন্য কাঠ নেই, তাই এই ভাসমান ফলই ভরসা; কিন্তু এ ভরসাই আবার নতুন চরের গাছ হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে। সচেতন করতে করতে গলা শুকায়; কিন্তু কথা তো কেউ শোনে না।’
বিষয়টি নজরে আনা হলে বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, সুন্দরবনের গাছ থেকে স্বাভাবিকভাবে ফল পড়ে যায়, নদীর ঢেউ সেই ফল ভাসিয়ে আনে। বনাঞ্চলে যেগুলো পাড়ে আটকে যায়, সেগুলোই নতুন চারা হয়ে ওঠে; কিন্তু লোকালয়ের পাড়ে এলে মানুষ তুলে নেয়। এই প্রতিটা ফলই একেকটা বীজ, একেকটা নতুন গাছ; কিন্তু মানুষের দরকার শুধু জ্বালানি, গাছের কথা তাদের ভাবায় না।