সকালের দিকে সুন্দরবনের পাশ ঘেঁষে বয়ে চলা নদীর তীরে দাঁড়ালে দূর থেকে মনে হবে, নদী যেন বন থেকে ভেসে আসা ফলের অস্থায়ী হাট বসিয়েছে। গরান, গেওয়া, খলিশা, সুন্দরী, পশুর, বাইন গাছের নামের তালিকা লম্বা হলেও কে আর গুনে রাখে। নদীর ঢেউয়ে ভেসে আসা এসব গাছের ফল নতুন চারা হয়ে বনভূমিকে বাঁচিয়ে তোলার স্বপ্ন বয়ে আনে; কিন্তু সেই স্বপ্ন তীরেই ভেঙে যায়। কারণ, নদীর পাড়ে অপেক্ষায় থাকে গ্রামের মানুষ, যাঁরা দল বেঁধে সেই ভাসমান ফল কুড়িয়ে নিয়ে যান চুলার জ্বালানি বানাতে।

মঙ্গলবার সকালে কয়রার শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে দেখা গেল সেই দৃশ্যেরই এক খণ্ডচিত্র। ভোরের বৃষ্টি থেমেছে, ভেজা রাস্তার ধারে লালচে বাদামি ফলগুলো ছড়িয়ে রোদে শুকানোর চেষ্টা চলছে। আকাশ এখনো ভেজা, কোথাও মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে হালকা রোদ। কাটকাটা গ্রামের আরতি মণ্ডলসহ কয়েকজন নারী নদীর পানিতে নেমে ভেসে আসা ফলে ঝুড়ি ভর্তি করছেন।

শাকবাড়িয়া নদীর তীরে বসে লক্ষ্মী রানী ফলের মধ্য থেকে শ্বাস আলাদা করছিলেন। তিনি বলেন, ‘সব ফল একরকম না। শ্বাস থাকলে শুকায় না। তাই শ্বাস ফেলে খোলসটাই জ্বালাই। আর বাইনগাছের ফল তো আগুনে পোড়েই না, গরু-ছাগলের পেটে যায়।’

শুধু শাকবাড়িয়া নদীর তীরেই নয়, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী থেকে মহেশ্বরীপুর পর্যন্ত কপোতাক্ষ ও কয়রা নদীর তীরবর্তী গ্রামেও একই দৃশ্য। জোয়ারে নারী-পুরুষ-শিশুরা দল বেঁধে নদীতে নামে, কেউ নেট জাল টেনে, কেউ ঝুড়ি ভরে। তারপর রাস্তার ধারে সারি সারি ফল শুকায়। রোদে শুকালে তবেই চুলায় আগুন জ্বলে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, জোয়ারে একজন এক থেকে দেড় মণ ফল তুলতে পারেন। শুকিয়ে তা চুলার জ্বালানি হয়, কিছু যায় গবাদিপশুর খাবার হিসেবে। কেউ কেউ আবার তা বিক্রি করে দু-চার টাকা আয় করেন।

কয়রার কপোতাক্ষ কলেজের শিক্ষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, ‘দেখেন, এ ফলগুলো যদি নদীর চরে পড়ে থাকত, নতুন বন হতো। গরান-গেওয়ার সবুজ বেষ্টনী হলে নদীর পাড় ভাঙত না এতটা; কিন্তু সেই ফল চুলার আগুনেই শেষ।’

তবে এভাবে ভাসমান ফল চুলায় পোড়ানো নিয়ে মন খারাপ আছে যাঁরা ফল কুড়ান তাঁদেরও। তাঁরাও জানেন এই ফল না তুললে নদীর তীরে ছোট ছোট চর বনায়ন হয়ে উঠত, ভাঙন কমত, পাখিরাও ফিরে আসত। কয়রার মঠবাড়ী গ্রামের হালিমা বেগম হেসে বলেন, ‘চরে গাছ হইলে ভালোই হতো, নদী ভাঙত না; কিন্তু কয়ডা দিন কীভাবে চুলা বন্ধ রেখে থাকব কন?’

সুন্দরবন ও উপকূল সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘লোকজন বলে চুলার জন্য কাঠ নেই, তাই এই ভাসমান ফলই ভরসা; কিন্তু এ ভরসাই আবার নতুন চরের গাছ হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে দিচ্ছে। সচেতন করতে করতে গলা শুকায়; কিন্তু কথা তো কেউ শোনে না।’

বিষয়টি নজরে আনা হলে বন বিভাগের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা নাসির উদ্দীন বলেন, সুন্দরবনের গাছ থেকে স্বাভাবিকভাবে ফল পড়ে যায়, নদীর ঢেউ সেই ফল ভাসিয়ে আনে। বনাঞ্চলে যেগুলো পাড়ে আটকে যায়, সেগুলোই নতুন চারা হয়ে ওঠে; কিন্তু লোকালয়ের পাড়ে এলে মানুষ তুলে নেয়। এই প্রতিটা ফলই একেকটা বীজ, একেকটা নতুন গাছ; কিন্তু মানুষের দরকার শুধু জ্বালানি, গাছের কথা তাদের ভাবায় না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স ন দরবন নদ র ত র নদ র প

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনে ফাঁদে আটকে ছটফট করছিল প্রাণীটি

ফাঁদে আটকে ছটফট করছিল প্রাণীটি। তাতে আরও শক্ত হয় পায়ে আটকে যাওয়া রশির বাঁধন। কেটে রক্ত পড়ছিল বাঁ পা দিয়ে। প্রাণীটির আর্তনাদে নীরবতা ভাঙে সুন্দরবনে। সেই চিৎকার ভেসে আসে বনকর্মীদের কানে। কাছে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, হরিণ শিকারের জন্য চোরাশিকারিদের পাতা ফাঁদে আটকে পড়েছে একটি ছোট বানর। পরে বনকর্মীরা বানরটি ফাঁদ থেকে উদ্ধার করে শুশ্রূষা দিয়ে বনে অবমুক্ত করেন।

ঘটনাটি শনিবার সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ঘাগমারী এলাকার। রোববার নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে হরিণ শিকারের সিটকা ফাঁদে আটকে গাছে ঝুলে থাকা ওই বানর এবং সেখান থেকে প্রাণীটি উদ্ধারের ছবি প্রকাশ করেন সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী।

বন কর্মকর্তা রেজাউল করিম ফেসবুকে লেখেন, ‘আসলে গোটা সুন্দরবনে শিকারিরা হরিণ ধরতে গিয়ে শুধু হরিণই মারে না, মারে অন্য প্রাণীও। গত পাঁচ মাসে আমার কর্মকালে (সুন্দরবন পূর্ব) সহকর্মীরা যে পরিমাণ ফাঁদ অপসারণ করেছে, তা না করতে পারলে কত শত হরিণ এবং অন্যান্য প্রাণী যে শিকার হতো তার সীমা নেই! এটাই বাস্তব সত্য। আপনারা এসব প্রাণী হত্যাকারীকে সহায়তা না দিয়ে বা তাদের নিকট থেকে মাংস না কিনে বরং আমাদের কাছে তাদের সোপর্দ করুন দয়া করে। আপনার একটু সহযোগিতায় আমার আপনার প্রাণের সুন্দরবন বাঁচবে ইনশা আল্লাহ।’

আটকে পড়া বানরটির বিষয়ে ডিএফও রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের সহকর্মীরা প্যারালাল লাইন সার্চিং পদ্ধতিতে ফুট প্যাট্রল করে হরিণ শিকারের জন্য পাতা ফাঁদে আটকে পড়া একটি বানর উদ্ধার করে চিকিৎসা দিয়ে বনে ছেড়ে দিয়েছে। আমরা প্রাণ বাঁচানোর কাজ করছি। তাই অনুরোধ করব, এসব প্রাণী হন্তারকদের সহায়তা করবেন না। যাঁরা হরিণের মাংস কেনেন বা শিকারিদের আশ্রয় দেন, তাঁরাও পরোক্ষভাবে এই অপরাধে জড়িত। আমরা সবাই সচেতন হলে রক্ষা পাবে এই অরণ্যের প্রাণ, রক্ষা পাবে আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুন্দরবনে ফাঁদে আটকে ছটফট করছিল প্রাণীটি
  • সুন্দরবনে রাসপূজায় যেতে বন বিভাগের পাঁচটি রুট নির্ধারণ
  • মোংলা নদী দিয়ে লোকালয়ে ভেসে এল মৃত কুমির
  • হরিণ শিকারের ফাঁদে আটকা পড়ল বানর
  • সুন্দরবনের প্রাণ সুন্দরীগাছ পরগাছার আক্রমণে বিপন্ন