আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ের বিয়েতে গিয়ে বিতর্কে ওসি
Published: 27th, February 2025 GMT
চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে আওয়ামী লীগের এক নেতার মেয়ের বিয়েতে থানার ওসির উপস্থিতি ঘিরে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ওসির এমন সখ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি উপজেলার চরলক্ষ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন তালুকদারের মেয়ের বিয়ের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হয় উপজেলার সৈন্যারটেকের একটি কনভেনশন সেন্টারে। বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন কর্ণফুলী থানার ওসি মোহাম্মদ শরীফ। প্রতিবেদকের হাতে আসা একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ নেতা হোসেনসহ কর্ণফুলীর থানার ওসি শরীফ স্টেজে ছবি তুলছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে বিভিন্ন মহলে সমালোচনার সৃষ্টি হয়।
হোসেন তালুকদার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমাতে শুরু থেকে রাজপথে সক্রিয় ছিলেন বলে অভিযোগ আছে। সমকাল প্রতিবেদকের হাতে আসা ছবিতে দেখা যায়, গত ৪ আগস্ট উপজেলার মইজ্জারটেকে ছাত্র-জনতাকে রুখতে কর্ণফুলী আওয়ামী লীগের বিশেষ টিমের কঠোর অবস্থান কর্মসূচিতে অংশ নেন এ নেতা।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের এ নেতা আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মাঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর পরিবারের বিয়েতে গিয়ে ছবি তোলা মানে অভ্যুত্থানের সঙ্গে বেইমানি করা।
উপজেলা বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এতদিন দেশে দুঃশাসন কায়েম করে মানুষকে সীমাহীন যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছিল। আন্দোলন চলাকালে দেশের মানুষের ওপর গুলি ছুড়েছে। ওই সংগঠনের নেতার অনুষ্ঠানে কীভাবে একজন ওসি গিয়ে ছবি তোলেন? তৎকালীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশ দানবে পরিণত হয়েছিল, সেই পিছুটান কি এখনও রয়ে গেছে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘বিএনপি নেতা নুর উদ্দীনের দাওয়াতে ওই বিয়েতে গিয়েছিলাম। এটা যে আওয়ামী লীগ নেতার মেয়ের বিয়ে, তা জানতাম না। আমি কয়েক মিনিট ছিলাম। ভাতও খাইনি। ছবি তুলে চলে এসেছি।’ তবে তিনি প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘একজন মানুষ কি কোনো বিয়েতে যেতে পারে না?’
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বাকলিয়া থানার সাবেক ছাত্রদল সভাপতি নুর উদ্দীন বলেন, ‘হোসেন তালুকদার আমার আত্মীয়। আমার অনুরোধেই ওসি সেখানে গিয়েছিলেন।’ তবে খোঁজ নিয়ে বিএনপি নেতার সঙ্গে আওয়ামী লীগের এ নেতার সম্পর্কের কোনো সূত্র পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ আছে, ওসি মোহাম্মদ শরীফ কর্ণফুলীতে যোগদানের পর থেকে অভিযান করে ‘চুনোপুঁটি’ আটক করে কৃতিত্ব দেখালেও বড় নেতাকর্মীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক বজায় রাখছেন। নানা সময় তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। চলতি মাসে উপজেলার চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের এক ব্যবসায়ী এবং এক ইউপি সদস্যকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে গাড়ি থেকে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ