বাংলাদেশ–মিয়ানমার: সীমান্তের মাইন কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ; কেউ পঙ্গু, কেউ নিঃস্ব
Published: 3rd, May 2025 GMT
ডান পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ উড়ে গেছে মাইন বিস্ফোরণে। ক্ষতবিক্ষত পায়ের বাকি অংশ নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন জেলে মোহাম্মদ ফিরোজ (৪৫)। মাছ ধরে ফেরার সময় গত ৬ এপ্রিল মাইন বিস্ফোরণে আহত হন তিনি। কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের শূন্যরেখার অদূরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
ফিরোজের মতো প্রায়ই মাইন ও আইইডি (ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) বিস্ফোরণে হতাহত হচ্ছেন মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষ। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১ মে পর্যন্ত বিস্ফোরণে অন্তত ১৩ জন আহত হয়েছেন। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান এক তরুণ। বিস্ফোরণের ঘটনা বেশি ঘটেছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত এলাকায়।
মাইন বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই পঙ্গু হয়ে গেছেন। জীবিকা হারিয়ে অনেকেরই এখন দুর্বিষহ জীবন। চিকিৎসা ব্যয়সহ নানা খরচ সামাল দিতে হতাহতদের পরিবারও অনেকটা নিঃস্ব।
মিয়ানমারে দেশটির সামরিক বাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাতে ব্যাপক হারে প্রাণঘাতী ভূমিমাইন ও গোলাবারুদ ব্যবহার হচ্ছে। ২০২৩ সালের নভেম্বরে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা শুরু করে আরাকান আর্মি। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে রাজ্যটির বেশির ভাগ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির হাতে।
মূলত আরকান আর্মির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলের সদস্যদের ঠেকাতেই মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো আরাকান আর্মিও সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।বান্দরবান ও কক্সবাজার অঞ্চলে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমানা রয়েছে ২৭১ কিলোমিটারের মতো। অভিযোগ উঠেছে, আরাকান আর্মিও বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ব্যাপক হারে মাইন পুঁতে রেখেছে, যাতে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। মূলত আরকান আর্মির সঙ্গে বিরোধপূর্ণ অবস্থানে থাকা রোহিঙ্গা সশস্ত্র দলের সদস্যদের ঠেকাতেই মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা। যদিও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মতো আরাকান আর্মিও সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রাখার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
ভূমিমাইনে বিশ্বে যেসব দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মিয়ানমার। গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু ব্যান ল্যান্ডমাইনসের (আইসিবিএল) ‘ল্যান্ডমাইন মনিটর ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ভূমিমাইন ও বিস্ফোরক ধারণকারী গোলাবারুদের আঘাতে ২০২৩ সালে মিয়ানমারে এক হাজার তিনজন হতাহত হয়েছেন। একই সময়ে সিরিয়ায় হতাহত হয়েছেন ৯৩৩ জন।
১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তি হয়। ভূমিমাইন তৈরি, ব্যবহার ও মজুত নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই চুক্তিতে। তবে যেসব দেশ এই চুক্তিতে সই করেনি, মিয়ানমার তার মধ্যে একটি।
ফিরোজ জানান, তাঁর বাড়ি থেকে অদূরেই নাফ নদী। সেই নদী পার হয়ে লালচর এলাকায় কিছু মাছের ঘের রয়েছে। এসব মাছের ঘের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে হলেও সীমান্ত এলাকার মানুষ সেখানে মাছ ধরেন। তিনিও মাছ ধরতেই গিয়েছিলেন। সেখানে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন।‘আমার ডান পা উড়ে গেছে’
মাইন বিস্ফোরণে আহত মোহাম্মদ ফিরোজ টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আমতলী এলাকার মো.
ফিরোজ জানান, তাঁর বাড়ি থেকে অদূরেই নাফ নদী। সেই নদী পার হয়ে লালচর এলাকায় কিছু মাছের ঘের রয়েছে। এসব মাছের ঘের মিয়ানমারের অভ্যন্তরে হলেও সীমান্ত এলাকার মানুষ সেখানে মাছ ধরেন। তিনিও মাছ ধরতেই গিয়েছিলেন। সেখানে মাইন বিস্ফোরণে আহত হন।
মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা স্মরণ করতেই তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। বলেন, ‘অনেকেই একসঙ্গে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। আগে মাছ ধরে ধরে পানি বেয়ে ফিরতাম। তবে এবার খিদে বেশি লাগায় ঘেরের মাঝখানে থাকা আল ধরে হেঁটে ফিরছিলাম। হঠাৎ করেই বিস্ফোরণ। মুহূর্তের জন্য হুঁশ হারিয়ে ফেলি। হুঁশ ফিরতেই দেখি, আমি গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি, আমার ডান পা উড়ে গেছে।’
ফিরোজ বলেন, ‘তখনো আমার কাঁধের ওপর মাছ ধরার জাল। মাছ রাখার খালুইও কাঁধে। সেখানে প্রায় সাত কেজির মতো মাছ ছিল। আমি জালটা কাঁধ থেকে ফেলে দিই, খালুইটা ধরে রাখি। ভাবি, অন্তত ঘরে ছেলে-মেয়েরা এসব মাছ খাবে। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যাই। জোরে ডাক দিই। চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে উখিয়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামে।’
২০ বছরের বেশি সময় মাছ ধরে সংসার চালিয়ে আসছেন জানিয়ে ফিরোজ বলেন, ‘যে এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে, সেখানে আগেও অনেকবার মাছ ধরেছি। কখনো এ রকম ঘটনার মুখে পড়তে হয়নি।’
তখনো আমার কাঁধের ওপর মাছ ধরার জাল। মাছ রাখার খালুইও কাঁধে। সেখানে প্রায় সাত কেজির মতো মাছ ছিল। আমি জালটা কাঁধ থেকে ফেলে দিই, খালুইটা ধরে রাখি। ভাবি, অন্তত ঘরে ছেলে-মেয়েরা এসব মাছ খাবে। এরপর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে যাই। জোরে ডাক দিই। চিৎকার শুনে আশপাশে থাকা জেলেরা আমাকে উদ্ধার করে উখিয়ার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রামে।ফিরোজবিস্ফোরণের পর থেকে সংসারের ভরণপোষণ নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন বলেও জানান ফিরোজ। তিনি বলেন, ৪ ছেলে ২ মেয়ে আর স্ত্রী সাবেকুন্নাহারকে নিয়ে সংসার তাঁর। তাঁর আয়েই মূলত সংসারের খরচ চলত। সম্প্রতি তাঁর ১৮ বছর বয়সী বড় ছেলেটি দিনমজুর হিসেবে কাজ করে কিছুটা আয় করছে। তবে ছেলের একার আয়ে সংসার চালানো সম্ভব নয়।
ফিরোজ বলেন, ‘এক মাস ধরে হাসপাতালে আছি। মানুষের কাছ থেকে টাকাপয়সা সংগ্রহ করে স্ত্রী চিকিৎসার খরচ চালাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে কখন ছাড়া পাই, জানি না। ছাড়পত্র পেলেও অনেক দিন চিকিৎসা চালিয়ে নিতে হবে। কীভাবে যে চিকিৎসার খরচ জোগাব, আর কীভাবেই–বা সংসারের খরচ মেটাব, ভেবে কূল পাই না।’
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে আহত আবদুস সালাম। গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেউৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ও স ম ন ত এল ক আর ক ন আর ম ভ ম ম ইন এসব ম ছ ম ইন প এল ক য় র খরচ
এছাড়াও পড়ুন:
দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছেন সচিবালয়ের আন্দোলনকারী কর্মচারীরা
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ বাতিলের দাবিতে দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করছেন সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আন্দোলনকারী কর্মচারীরা।
আন্দোলনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের ডাকে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। আজ সোমবার বেলা ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবেন তাঁরা।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে আন্দোলনকারীরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অবস্থিত সচিবালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে অবস্থান নিয়ে অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন। এখান থেকে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন তাঁরা।
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ বাতিলের দাবিতে গত ২৪ মে থেকে আন্দোলন করছেন সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মচারীরা।
আন্দোলন চলার মধ্যেই ২৫ মে অধ্যাদেশটি জারি করে সরকার। এরপর থেকে বিক্ষোভ, কর্মবিরতি ও স্মারকলিপি দেওয়ার মতো কর্মসূচি পালন করছেন আন্দোলনকারী কর্মচারীরা।
পবিত্র ঈদুল আজহার ছুটি শেষে অফিস খোলার এক দিন পর গত সোমবার থেকে আন্দোলনকারী কর্মচারীরা আবার সচিবালয়ের ভেতর টানা বিক্ষোভ করে আসছেন।