সুরা কারিয়া (মহাপ্রলয়) পবিত্র কোরআনের ১০১তম সুরা। কিয়ামতকে মহাপ্রলয় বলা হয়েছে, এ জীবনে যাদের সৎকর্মের পাল্লা ভারী হবে, সেদিন তারাই সুখের জীবন লাভ করবে। আর যার পাল্লা হালকা হবে, তার স্থান হবে গনগনে আগুন হাবিয়ায়।

সুরা কারিয়ার অর্থ আবার দেখে নিই

১. মহাপ্রলয়! ২. মহাপ্রলয় কী? ৩. মহাপ্রলয় সম্বন্ধে তুমি কী জান? ৪.

সেদিন মানুষ বাতির পোকার মতো বিক্ষিপ্ত হবে। ৫. আর পাহাড়গুলো ধুনিত হবে রঙিন পশমের মতো। ৬. তখন যার পাল্লা ভারী হবে ৭. সে তো পাবে সুখ ও শান্তির জীবন, ৮. কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে ৯. তার জায়গা হবে হাবিয়া। ১০. সেটা কী, তুমি কি তা জান? ১১. (সে) এক গনগনে আগুন।

সুরার মূল বিষয়বস্তু

প্রথমেই আল্লাহ করিয়াহ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং একটি শব্দেই প্রথম আয়াত শেষ করে দিয়েছেন। এর ফলে প্রশ্ন জাগে এই ‘করিয়াহ’ কী? আল্লাহ বলে দিচ্ছেন পরের আয়াতে। এরপর আবার আল্লাহ প্রশ্ন করে বললেন মহাপ্রলয় সম্বন্ধে তুমি কী জান? করিয়াহ শব্দটি বেশ অর্থবহ। করিয়াহ বলতে বিকট শব্দ বোঝায়, বিরক্তিকর, ভীতিকর, ধ্বংসাত্মক। আল্লাহ সুরার শুরুতে তিনবার (১ম, ২য়, ৩য় আয়াতে) এই শব্দ ব্যবহার করে এর গুরুত্ব তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনবার ফুৎকার দেওয়ার কথা জানা যায়, প্রথম ফুৎকারে কিয়ামত হবে, দ্বিতীয়তে সবাই মারা যাবে, তৃতীয় ফুৎকারে আবার সবাই জেগে উঠবে। এই তিনবার করিয়াহ বলার মাধ্যমে ওই তিন ফুৎকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

আরও পড়ুনসুরা বাকারার শেষ দুই আয়াতের বিশেষ ফজিলত০৭ মার্চ ২০২৫

চতুর্থ আয়াতে বলা হয়েছে, সেদিন মানুষ বাতির পোকার মতো বিক্ষিপ্ত হবে। তারা এদিক–সেদিক লক্ষ্যহীন ছুটতে থাকবে। এখানে আল্লাহ মানুষ বোঝাতে ‘নাস’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।

পঞ্চম আয়াতে আছে, আর পাহাড়গুলো ধুনিত হবে রঙিন পশমের মতো। পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে হালকা হয়ে যাবে যে উড়তে থাকবে। এরপরই ষষ্ঠ আয়াতে আল্লাহ বললেন, তখন যার ওজনের পাল্লা ভারী হবে, সে সুখী জীবন লাভ করবে। অপর দিকে কিন্তু যার পাল্লা হালকা হবে, তার জায়গা হবে হাবিয়া (৮ম ও ৯ম আয়াত)। এখানে হাবিয়াহকে তার মা হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে।

হাবিয়াহ জাহান্নাম ‘মা’ বলা হলো কারণ শিশু তার মায়ের দিকে এমনিতেই, নিজ ইচ্ছাতেই এগিয়ে যায়। তেমনি পাপী মানুষেরাও নিজেরাই তাদের মায়ের (হাবিয়াহ জাহান্নাম) দিকে এগিয়ে যাবে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। মা যেমন তার শিশুকে জন্মের আগে পেটের মধ্যে যত্নে রাখে, বড় হলেও বুকে আগলে রাখে, তেমনি হাবিয়াহ জাহান্নামও পাপীদের তার ভেতরে যত্নসহকারে আটকে রাখবে, বের হতে দেবে না। ১০ম আয়াতে সেটা কী, তুমি কি তা জানো? প্রশ্ন করার পর পরের (১১তম) আয়াতে আল্লাহই এর উত্তর দিয়েছেন। তা হলো (সে) এক গনগনে আগুন।

আরও পড়ুনমুসা (আ.)-এর বিয়ের শর্ত১৫ এপ্রিল ২০২৫

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কর য় হ আল ল হ

এছাড়াও পড়ুন:

টুকরো টুকরো প্লাস্টিক গড়ছে শক্তিশালী অর্থনীতির ভিত্তি

ভোরের আলোয় শুকিয়ে উঠছে কিছু ভেজা পলিথিন– রোদ, হাওয়া আর খাদিজা বেগমের নিরলস শ্রমে। এগুলো কুড়িয়ে আনা হয়েছে শহরের গলি থেকে, ডাস্টবিনের কোণ থেকে, কারও অবহেলার ফেলে দেওয়া জিনিস থেকে; যেটি কারও কাছে ছিল ফেলনা, সেটিই কারও কাছে স্বর্ণের মতো মূল্যবান। সেই প্লাস্টিক বিক্রি করে কেনা হয় শিশুর স্কুলের টিফিন, বা চালিয়ে নেওয়া হয় বাসার এক বেলার খাবার।
চট্টগ্রামের প্রতিদিনের ব্যস্ত নগরজীবনে এমন হাজারো গল্প বয়ে চলে টুকরো টুকরো প্লাস্টিকের মধ্য দিয়ে; যেখানে ‘বর্জ্য’ শব্দটা শুধু দূষণ নয়; বরং হয়ে ওঠে কোনো কোনো পরিবারের টিকে থাকার কৌশল, শ্রমের গল্প এবং বিকশিত হওয়ার সংগ্রাম।
শহরজুড়ে প্রতিদিন উৎপন্ন হয় প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য, যার একটি বড় অংশই সিঙ্গেল ইউজড প্লাস্টিক; একবার ব্যবহারের পরই ফেলে দেওয়া হয়। ফেলে দিলেই তো সবকিছু শেষ হয় না। বরং ঠিক তখনই শুরু হয় অন্য কারও জীবনের সংগ্রাম, আর কারও সম্ভাবনার নতুন এক যাত্রা।
বন্দর নগরীর একটি বর্জ্য পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রে দেখা যায় ৬০ বছর বয়সী এক নারী–রহিমা বেগম; সম্মাননাপ্রাপ্ত একজন ওয়েস্ট পিকার। প্রতিদিন ভোরে বের হন ময়লার স্তূপে প্লাস্টিক খুঁজতে। তিনি মাসে গড়ে প্রায় পাঁচ মণ প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন, যার বিক্রয়মূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা। এই আয়ে চলে তাঁর পরিবারের খরচ। রহিমার মতো আরও অসংখ্য নারী ও পুরুষ প্রতিদিনই নামেন এই অদৃশ্য অথচ অমূল্য সংগ্রামে।
এই সংগ্রহ করা প্লাস্টিক পড়ে থাকে না অকেজো বস্তু হয়ে। বরং প্রক্রিয়াজাত হয়ে তা তৈরি হয় নতুন পণ্য–টাইলস তৈরির উপকরণ, নির্মাণসামগ্রী, ইনস্যুলেশন, এমনকি ঘর সাজানোর সামগ্রী। পুরোনো বোতল বা মোড়কের টুকরো থেকে তৈরি হচ্ছে চেয়ার, প্যাকেজিং বাক্স কিংবা শিল্প গ্রানুলস–যেগুলো দেশের বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে।
এটিই হলো ‘সার্কুলার ইকোনমি’– একটি অর্থনৈতিক মডেল; যেখানে ব্যবহারযোগ্য জিনিস একবার ব্যবহার করে ফেলে না দেওয়া হয়, বরং পুনর্ব্যবহার, মেরামত ও রূপান্তরের মাধ্যমে আবারও ব্যবহারচক্রে ফিরিয়ে আনা হয়। এই ব্যবস্থায় ‘বর্জ্য’ই হয়ে ওঠে সম্পদ। চট্টগ্রাম নগরী এখন এই ধারার এক উজ্জ্বল বাস্তব উদাহরণ; যেখানে ব্যবহৃত প্লাস্টিক রূপ নিচ্ছে নতুন পণ্যে, তৈরি করছে কর্মসংস্থান এবং কমাচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ।
বর্তমানে চট্টগ্রামে ১,০০০টিরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহকারী ভাঙারির দোকান বা ইউনিট সক্রিয় রয়েছে, যেখানে কাজ করছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এই দোকানগুলোই হয়ে উঠেছে পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থার মূল সেতুবন্ধ, প্রতিদিন প্লাস্টিক সংগ্রহ, বিক্রয় ও সরবরাহ হচ্ছে রিসাইক্লিং কারখানায়। একটি বোতল, এক টুকরো মোড়ক কিংবা একটি ব্যাগ– সবকিছুরই এখন আলাদা বাজারমূল্য রয়েছে।
২০২৩ সালে চট্টগ্রাম থেকে রপ্তানি হওয়া রিসাইক্লিং পণ্যের দাম দাঁড়ায় প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। ভারত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে এইসব সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে চলেছে। ফলে, এক সময়কার ‘ফেলনা প্লাস্টিক’ আজ দেশের অর্থনীতির এক সম্ভাবনাময় খাতে পরিণত হয়েছে।
এই পুরো পরিবর্তনের পেছনে রয়েছে একটি সমন্বিত উদ্যোগ। ২০২২ সাল থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক), বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইপসা এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশ একত্রে কাজ করছে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। তিন বছরে তারা ২৪ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেছে। পাশাপাশি, তিন হাজারের বেশি ওয়েস্ট পিকারকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে দক্ষ জনবল, যারা এখন আরও নিরাপদ ও সম্মানজনক পরিবেশে কাজ করছেন।
চট্টগ্রাম আজ বাংলাদেশের জন্য একটি দৃষ্টান্ত; যেখানে প্লাস্টিক মানেই দূষণ নয়, বরং সঠিক ব্যবস্থাপনায় তা হয়ে উঠতে পারে জীবিকার উৎস, রপ্তানিযোগ্য পণ্য এবং একটি সবুজ, টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি। এই শহর প্রমাণ করে দিয়েছে, যতই ফেলনা মনে হোক; টুকরো টুকরো প্লাস্টিকেও লুকিয়ে থাকতে পারে একটি পরিবারের আশ্রয়, একটি শহরের ভবিষ্যৎ, আর একটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য পৃথিবীর স্বপ্ন। 

শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ
ফরেস্ট্রি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ