স্বাক্ষর-পরবর্তী সমাজে ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি
Published: 7th, May 2025 GMT
একবিংশ শতাব্দীর এই সমাজকে বলা হচ্ছে ‘পোস্ট-লিটারেট’ বা স্বাক্ষর-পরবর্তী সমাজ। কারণ, বর্তমানে মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, লিখতে পড়তে সক্ষম মানুষ, এমনকি শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও আর বই পড়তে চান না। জ্ঞানচর্চা বা সাধারণ পড়াশোনার ক্ষেত্রে প্রবেশ করতেও তারা অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযুক্তির সহযোগিতা নেন। বর্তমান বিশ্বে তথ্যপ্রবাহ অন্তর্জাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। এই মাধ্যমগুলোই ঠিক করে দেয় কী পড়তে হবে।
স্বীকার করি আর না করি, এই প্রযুক্তি বইয়ের ব্যবহার যথেষ্ট কমিয়ে দিয়েছে। সব থেকে উদ্বেগের বিষয় হলো, বইপড়া ও লেখালেখির এই খরা চিন্তার ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টির পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা ও জটিল তথ্য বিশ্লেষণের ইচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতি তৈরি করছে। এটাই এখন আগামীর বাস্তবতা। বৈশ্বিক মহামারি-পরবর্তী সময়ে মানুষের মাঝে মনঃসংযোগের সমস্যা, যুক্তি প্রয়োগের দক্ষতা হ্রাস, এবং মনগড়া কথা বলার অধিক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তরুণদের মধ্যে এই সমস্যা প্রকট। সকলেই কুতর্কে জয়ী হতে চাইছে। প্রশ্ন উঠেছে, এটা কি প্রযুক্তির ত্রুটি? নাকি বৈশ্বিক মহামারি-পরবর্তী কোনো শারীরিক-মানসিক প্রতিক্রিয়া? নাকি অতি স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী কোনো পরিবর্তন যার মাঝ দিয়েই মানুষের এগোবার কথা ছিল?
Marshall McLuhan তার ‘The Gutenberg Galaxy’ গ্রন্থে অন্তর্জালিক এই উত্থানকে ‘অনুক্রমিক পঠন-পাঠনের বৈশিষ্ট্য থেকে সম্মিলিত মৌখিক যোগাযোগে স্থানান্তর’ বলে মত দিয়েছেন।
২০২২ সালে মাইক্রোসফটের এক গবেষণায় দেখা গেছে, যে কোনো বিষয়ের ওপর একনাগাড়ে মানুষের মনযোগ সক্ষমতার সময় ১২ সেকেন্ড থেকে ৮.
মহামারি-উত্তর বৈশ্বিক পরিবেশে মুখোমুখি যোগাযোগ হ্রাস পাওয়ায় শিক্ষায় বিশ্লেষণের ক্ষমতা কমে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাতে অপব্যাখ্যার সুযোগ বেড়েছে, কারণ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মতামত অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় কুতর্ক তৈরি করছে। একটি স্বাক্ষর-পরবর্তী সমাজে স্থানান্তরিত হওয়ার অর্থ পড়া ও লেখার দক্ষতা-ঘাটতি হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তাই ঘটছে। কোথাও প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই দায়িত্বতীন মন্তব্য করা হচ্ছে যা প্রকৃত বিষয়ের সঠিক উপলব্ধিতে বাধার সৃষ্টি করছে।
সামগ্রিক শিক্ষায় নতুন এই প্রযুক্তি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ের প্রচণ্ড প্রভাব থাকলেও ইতিহাস-চর্চার ক্ষেত্রে তা যেন আলাদা এক ভিন্নস্রোত ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। প্রকৃত ইতিহাসের জনবিচ্ছিন্নতা নতুন নয়। প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের মধ্যে যে ইতিহাস চর্চিত হয় তার জনসম্পৃক্ততা আরো কম। ফলে ঐতিহাসিক, ইতিহাস ও জনতার মাঝে এক ধরনের দুর্লঙ্ঘনীয় দূরত্ব রচিত হয়।
ইতিহাস আসলে কী? ঐতিহাসিক E H Kar তার What is History গ্রন্থে বলেছেন, ‘ইতিহাস আসলে মানবজাতির অপরাধ, বোকামি ও দুর্ভাগ্যের বিবরণ ছাড়া কিছুই নয়’। তবে তিনি এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘কোনো ইতিহাস পড়ার আগে সেই ইতিহাস রচয়িতাকে জানুন’। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন, ‘ইতিহাসের অর্থ হলো প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই’। সেই সূত্রে বলা যায়, ইতিহাস কোনো গল্প নয়, অতীতের কাহিনিও নয়। ইতিহাস ভূগোল, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, সামরিক ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখার অপরিহার্য অংশ। তবে সব কালেই ইতিহাস বেশিমাত্রায় রাজনৈতিক। সেখানে মতামত বিশ্লেষণ যতটা আছে, তার চেয়ে বেশি আছে রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ। সেই কারণে প্রকৃত ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি অতি দুর্বল। ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতার অনিশ্চয়তা থাকলে মতপার্থক্যজনিত কারণে পক্ষ-প্রতিপক্ষের যে ধরনের সহিষ্ণুতা কাম্য, বাস্তবে তা দেখা যায় না।
ইতিহাস চর্চাকারীদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি, ভাষা ব্যবহারে মাত্রাজ্ঞানহীনতা ও মত চাপানোর ক্রদ্ধ আকাঙ্ক্ষা জনগণের মধ্যে দৃশ্যমান বিরূপতা ও হিংস্রতা তৈরি করে। আবার ঐতিহাসিকরা যখন নিজেরাই মত বদলান তখন তাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে হয়। ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীকে একবার এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘ও আপনিই দীপেশ চক্রবর্তী? আপনার সঙ্গে আমাদের মত মেলে না’। শুনে তিনি মনে মনে বলেছিলেন, ‘আমারও মেলে না, সেইজন্য মাঝে মাঝে মত বদলাই।’ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়েছিল, এটা বিশ্বাসঘাতকের মতো আচরণ। কারণ সবাই তখন এর মধ্যে মতলববাজি খুঁজতে থাকবে। আর এতদিনের পক্ষভুক্ত মানুষ গালিগালাজ, পারলে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করবে। তবে অনুকূল পরিবেশে প্রকাশিত হওয়ার জন্য মতলববাজির ইচ্ছাটা শুরুতেই যদি মনে সুপ্তাবস্থায় থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা।
আকর বা দালিলিক প্রমাণ নির্ভরতা ইতিহাস চর্চায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার জনসম্পৃক্ততা যথেষ্ট সবল নয়। সেখানে জনশ্রুতি ও রাজনৈতিক মতাদর্শের গুরুত্ব বেশি। দলিল থেকে ইতিহাস বিনির্মাণের এই পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক, কিন্তু রণজিৎ গুহ আবার প্রশ্ন করেন যে, ইতিহাসের দলিলমুখিনতা সাধারণ মানুষের ইতিহাসবোধ প্রকাশের জন্য যথেষ্ট কি না। একথা সত্য যে, প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চায় জনসম্পৃক্তি কম, কারণ ঐতিহাসিকের ভাষা অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক মতাদর্শিক ভাষা বলে মনে হয়। তবে একথাও ঠিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের কাজে লাগে। চর্চার অভাবে প্রচলিত ইতিহাস জনবিচ্ছিন্ন বা গোষ্ঠীভিত্তিক হয়। চর্চার এই শূন্যতা পূরণ করে নানা জনশ্রুতি ও গুজব।
গ্রন্থ নির্ভরতা ইতিহাসচর্চার একমাত্র পথ নয়, এখন তা বোঝা যাচ্ছে। গ্রন্থের দোহাই দিয়েই জনভাবনা ও জনশ্রুতিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হচ্ছে গুজব মোকাবিলার জন্য। এই বিষয়গুলোকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। প্রথাগতভাবে ইতিহাসের চর্চা প্রাজ্ঞ ও বিদ্বৎজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গণশিক্ষা এক নয়। গণ্ডিবদ্ধ-পেশাদারি ইতিহাস বৃহত্তর জনজীবনে কম ভূমিকা রাখে। প্রাতিষ্ঠানিক পঠন-পাঠনের জনসম্পৃক্তি তৈরি করা নানা কারণেই অসম্ভব। ঐতিহাসিকের গবেষণালব্ধ জ্ঞান জনচাহিদার সঙ্গে স্বল্পই মিলে থাকে। তাই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইতিহাস পড়লেও তার জনসম্পৃক্তি তৈরি হয় না। তাহলে ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি কীভাবে তৈরি হবে? ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র আশঙ্কা ছিল যে ইতিহাস চর্চা একসময় কেবল প্রাজ্ঞজনের বিতর্কের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়বে যদি জ্ঞান সংকলন ও আবিষ্কার করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জনগণের মাঝে প্রচার করা না যায়।
ইতিহাসের শিক্ষক-গবেষক স্বীকৃত জার্নালে লেখা ছাপাতে পারলে কৃতার্থ হন; প্রকাশনার সংখ্যা উল্লেখ করার সময় গর্ব করেন, কিন্তু তাতো সবই বিশেষজ্ঞ পাঠকের জন্য। সাধারণ পাঠক তাতে উপকৃত হন না, তাই জনসম্পৃক্ততা বাড়ে না। যদুনাথ সরকার যেমন একাডেমিক জার্নালে লিখেছেন তেমনি সাধারণ পাঠকদের জন্য খবরের কাগজেও লিখেছেন। মূলত, প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস চর্চার একটি জনসম্পৃক্তি প্রয়োজন, নইলে তা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ করে না। আর জনসম্পৃক্তি তৈরি করতে গেলে ঐতিহাসিককে জনগণের কাছে যেতে হবে। তাদের চিন্তার শিকড়টি অনুধাবন করতে হবে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে বইয়ের গুরুত্ব ক্রমনিম্নগামী। পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই মানুষ গ্রন্থ অপেক্ষা অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে বেশি আগ্রহ অনুভব করেন। তাহলে ইতিহাস চর্চায় জনসম্পৃক্তি বাড়াতে আমাদের এই মাধ্যমকে সফলভাবে ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে। মানুষের হারানো সামাজিক দক্ষতা ফিরিয়ে আনতে হবে। অনলাইন-কন্টেন্ট বিশ্লেষণে দায়িত্বশীলতা, বিজ্ঞানধর্মিতা ও সাংস্কৃতিক-সামাজিক দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-জনতাকে গঠনমূলক হতে হবে। বইয়ের গুরুত্ব বাড়াতে অভিভাবক ও অন্যদের ভূমিকার প্রয়োজন রয়েছে। ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি বাড়াতে চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভূমিকা রাখতে পারে।
পাশ্চাত্যের মতো ইতিহাস বিষয়ক জাদুঘরগুলোর ভূমিকাও জরুরি। ইতিহাসনির্ভর প্রদর্শনীও হতে পারে। তাতে জনসম্পৃক্তি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিহাস-নির্ভর তথ্যচিত্রও অগ্রগতি নিয়ে আসতে পারে। একটি স্বাক্ষর-পরবর্তী সমাজে শুধু গ্রন্থের উপর নির্ভর করে ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি নির্মাণ সম্ভব নয়। প্রযুক্তি-নির্ভর মিডিয়ার ব্যবহার বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। দুর্বল বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক আবহে ইতিহাসের জনসম্পৃক্তি বাড়াতে হলে বইয়ের সঙ্গে অন্য মাধ্যমকেও স্বাগত জানাতে হবে। কারণ বইয়ের অবস্থা দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র পরবর ত র জন ত ক ব যবহ র চর চ র র জন য ন র ভর গ রন থ
এছাড়াও পড়ুন:
নেতারা বলবেন, জনতা শুনবে—এই সংস্কৃতি বদলাতে চায় মানুষ: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘দেশের মানুষ এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন চায়। আগে নেতারা বলতেন আর জনতা শুনত। কিন্তু এখন জনগণ সেই পরিস্থিতির বদল চায়। তারা চায়, জনপ্রতিনিধিরা শুধু বলবেন না, জনগণের কথাও শুনবেন।’
আজ শনিবার রাজশাহীর পবা উপজেলার বায়াতে ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে ‘নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত প্রাক্-নির্বাচনী আঞ্চলিক পরামর্শ সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ কথাগুলো বলেন। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও দাবিগুলো তুলে ধরতে এই নাগরিক সংলাপের আয়োজন করা হয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যে বার্তাটি পরিষ্কারভাবে উঠে আসছে তা হলো, জনগণ এমন একটি নির্বাচন দেখতে চায়, যেখানে প্রকৃত জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন। মানুষ এখন নির্বাচনের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার রোধ এবং দলগুলোকে যোগ্য প্রার্থী মনোনয়নের ওপর জোর দিচ্ছে। জনগণ মনে করে, নির্বাচনের ব্যয় যদি কমানো না যায়, তাহলে দুর্নীতি কমানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।’
জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির ওপর গুরুত্বারোপ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মানুষ চায়, প্রত্যেক জনপ্রতিনিধি তাঁর কাজের বার্ষিক হিসাব দেবেন। এই জবাবদিহির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।’ রাজশাহীর স্থানীয় সমস্যাগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলের জন্য চারটি প্রধান বিষয় উঠে এসেছে। এগুলো হলো—রাজশাহীর মরুকরণ ও তিস্তাসহ পানির সংকট, জ্বালানি সংকট, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পের অভাব।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো—নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি খুব জোরালোভাবে এসেছে। এই নিরাপত্তা কেবল অর্থনৈতিক নয়; এর সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যবসায়িক নিরাপত্তার বিষয়গুলোও জড়িত। সুশাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রশাসনের দক্ষতার সঙ্গে এই নিরাপত্তার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করাও কঠিন হবে বলে তিনি মনে করেন।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়। চলে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত। ‘আগামী নির্বাচনে কী প্রত্যাশায় ভোট দেবেন?’, ‘নবনির্বাচিত সরকারের কাছে কী প্রত্যাশা?’ এই শিরোনামে মুক্ত আলোচনা হয়। এতে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থী, কৃষকসহ নানা শ্রেণির মানুষ অংশ নেন। তবে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না।
সভায় আগামী নির্বাচন, জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহি, সুশাসন এবং স্থানীয় নানা সংকট নিয়ে সাধারণ মানুষ তাঁদের ক্ষোভ ও প্রত্যাশা তুলে ধরেন। তাঁরা আগামী সরকারের কাছে নানা বিষয়ের বাস্তবায়ন চান।
সংলাপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা ভূমি হারানোর শঙ্কা প্রকাশ করেন এবং তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা তাঁদের আশ্রয়ণ প্রকল্প দখল ও কর্মসংস্থানে বাধার অভিযোগ তোলেন। একজন রাজনৈতিক কর্মী প্রশাসনের দলীয়করণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুলিশ কর্মকর্তারাও রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে আচরণ করেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ আলম মাসুদ বলেন, ‘আমরা এমন প্রতিশ্রুতি চাই না, যা বাস্তবায়ন হয় না। আমরা এমন ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে চাই, যাঁরা একটি নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখবেন।’
জবাবদিহির অভাবকে দুর্নীতির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) মোহা. ফরিদ উদ্দীন খান। তিনি বলেন, একজন প্রার্থী নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন, যা তার পাঁচ বছরের বেতনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই টাকা তুলে আনার জন্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি দুর্নীতির আশ্রয় নেন। তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও প্রার্থীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা গেলে এই দুর্নীতি কমানো সম্ভব।
সভা শেষে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সংগঠক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলন আমাদের বলে দেয়, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমরা পরিবর্তন করতে পারি। হতাশ হওয়ার কিছু নেই। এই আলোচনা থেকে উঠে আসা বিষয়গুলো নিয়ে একটি “নাগরিক ইশতেহার” তৈরি করা হবে। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে উপস্থাপন করে একটি চাপ সৃষ্টি করা হবে। কারণ, তাদের ছাড়া এই আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’