রাজনৈতিক টানাপড়েনের মধ্যেও এশিয়ান বিচ হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে বাধ্য হলো ভারত। আর সেই বাধ্যতামূলক ম্যাচেই লজ্জার হারে মাঠ ছাড়ল তারা। ওমানের মাসকটে অনুষ্ঠিত ১০ম এশিয়ান বিচ হ্যান্ডবল চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতকে দুই সেটেই সহজে হারিয়ে দেয় পাকিস্তান।

প্রথম সেটে ভারত হারে ৩৪–৬ ব্যবধানে, দ্বিতীয় সেটে ৩৬–৭ ব্যবধানে। পুরো ম্যাচজুড়েই একতরফা দাপট দেখিয়েছে পাকিস্তান দল। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছিটেফোঁটাও রাখতে পারেনি ভারতীয় খেলোয়াড়রা।

Pakistan outclasses India 2-0 in Asian beach handball championship, qualifies for the quarter final of the event.

pic.twitter.com/7m1k6LVnlZ

— Faizan Lakhani (@faizanlakhani) May 9, 2025

তবে প্রশ্ন উঠছে, যেখানে দুই দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনায় বাতিল হচ্ছে একাধিক দ্বিপাক্ষিক প্রতিযোগিতা, সেখানে হ্যান্ডবল ম্যাচে কেন খেলল ভারত? হ্যান্ডবল ফেডারেশন অব ইন্ডিয়া (এইচএফআই)-এর নির্বাহী পরিচালক আনন্দেশ্বর পান্ডে জানিয়েছেন, ম্যাচ না খেললে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও আর্থিক জরিমানার মুখে পড়তে হতো ভারতকে।

টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'আমরা যদি ম্যাচটি না খেলতাম, তাহলে ১০ হাজার ডলার জরিমানার পাশাপাশি দুই বছরের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থেকে নিষিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি ছিল। এশিয়ান হ্যান্ডবল ফেডারেশন (এএইচএফ) পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, খেলায় অংশ না নিলে সেটা অলিম্পিক চার্টার লঙ্ঘনের শামিল হবে।'

ম্যাচ চলাকালীন ভারতীয় খেলোয়াড়েরা প্রতিবাদস্বরূপ কালো ব্যাজ পরে মাঠে নামতে চাইলেও আয়োজকেরা তা অনুমোদন করেননি। বরং সতর্ক করে দেওয়া হয়, এমন কোনো ‘প্রতীকী প্রতিবাদ’ দেখালে দলকে প্রতিযোগিতা থেকে বহিষ্কার করা হবে।

ভারতীয় হ্যান্ডবল ফেডারেশন অবশ্য সরকারের কাছে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ খেলা নিয়ে দিকনির্দেশনা চেয়ে আগেই চিঠি পাঠিয়েছিল। তবে ম্যাচের সময় পর্যন্ত কোনো উত্তর আসেনি। 'যদি সরকার নিষেধ করত, তাহলে আমরা দলই তুলে নিতাম,' বলেন পান্ডে।

তিনি আরও জানান, 'আমাদের এন্ট্রি অনেক আগেই চূড়ান্ত হয়েছিল এবং দল ৫ মে মাসকটে পৌঁছেছে। তখন রাজনৈতিক সম্পর্ক এতটা উত্তপ্ত ছিল না। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনাল বা ফাইনাল খেলাও আমরা এড়িয়ে চলতে পারি।'

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হ য ন ডবল হ য ন ডবল

এছাড়াও পড়ুন:

আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সংকট

ন্যায়বিচার– শব্দটি আদর্শের সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেও, বাস্তবে তা বহু সময়েই আপেক্ষিক। স্থান, সময় আর রাজনৈতিক বাস্তবতায় এর রূপ বদলায়। কোনো অপরাধের বিচার হয়তো প্রক্রিয়াগতভাবে সম্পন্ন হয়, কিন্তু কার্যকর করা সম্ভব হয় না। তখন কি সত্যিই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়? এ প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে; যেখানে বিচার ও ন্যায় অনেক সময়ই শক্তির রাজনীতিতে গৌণ হয়ে পড়ে। তবু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক প্রয়াস মানবসভ্যতার এক অনন্য অগ্রযাত্রা।

প্লেটোর রাষ্ট্র ও ন্যায়বিচারের চিন্তা
প্রাচীন দার্শনিক প্লেটো ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে একটি আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন; যার ভিত্তি ন্যায়বিচার। তাঁর মতে, রাষ্ট্র তখনই আদর্শ হয়ে উঠবে, যখন সমাজে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার জন্য ন্যায় নিশ্চিত হবে। কিন্তু আধুনিক বিশ্বে সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে যা ন্যায় বলে প্রতিভাত হয়, তা সংখ্যালঘুর জন্য অবিচার হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেই কারণে ন্যায়বিচারকে কোনো নির্দিষ্ট, অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞায় আবদ্ধ করলে তা নিজেই হয়ে ওঠে অন্যায়।

জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নুরেমবার্গ ও টোকিও ট্রায়াল আমাদের দেখিয়েছিল, যুদ্ধাপরাধেরও বিচার হতে পারে। এরপর শুরু হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিশ্বজুড়ে আন্দোলন। ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই গৃহীত ‘রোম সংবিধি’র ভিত্তিতে ২০০২ সালে যাত্রা শুরু করেন এ আদালত। ১৭ জুলাই দিনটি তাই আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার দিবস হিসেবে পালিত হয়।

বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে রোম সংবিধি অনুমোদন করে। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এ আন্তর্জাতিক কাঠামোর সঙ্গেই সম্পর্কিত। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

২০১৬ ও ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত জাতিগত নিধনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মিয়ানমার রোম সংবিধির সদস্য না হলেও, বাংলাদেশ সদস্য হওয়ায় রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারিক এখতিয়ারভুক্ত হয়।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আরও দেড় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে; যার বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র বাবর বালুচ জানান, এ পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তার সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

গাজা: বিচার ও ন্যায়ের সংঘাত
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে গণহত্যার অভিযোগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা দায়ের করে দক্ষিণ আফ্রিকা। তাদের ভাষায়, এ হামলা একটি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগঠিত গণহত্যা। তবে ইসরায়েল দাবি করে, তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অতিমাত্রায় বিকৃত, বরং হামাসই গণহত্যাকারী শক্তি।
আইসিজে যদিও আদেশ দিতে পারে, কিন্তু বাস্তব প্রয়োগের ক্ষমতা তাদের নেই। অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কার্যকর হয় না; কারণ তাদের নিজস্ব কোনো প্রয়োগকারী বাহিনী নেই। গ্রেপ্তারের জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর।

বিচারের সীমাবদ্ধতা
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত– আইসিসিকে আজও স্বীকৃতি দেয়নি। এমনকি ইরাকে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধেও আইসিসি কোনো কার্যকর অবস্থান নেয়নি। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও ন্যূনতম পদক্ষেপ দেখা যায়নি। অথচ আফ্রিকান বহু নেতার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এমন পক্ষপাতমূলক অবস্থান আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনমানসে আস্থার সংকট তৈরি করে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘ন্যায়বিচার হলো মানবাধিকারের মূল ভিত্তি। কিন্তু এটি কাগজে থাকা আর বাস্তবে কার্যকর হওয়ার মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। যেখানে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই– সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। ক্ষমতাবানদের জন্য এক রকম বিচার, দুর্বলদের জন্য আরেক রকম। আন্তর্জাতিক বিচারেও ঠিক এ বৈষম্য চোখে পড়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনমতই এখন বড় শক্তি। মানুষ জানতে পারছে, প্রশ্ন করতে পারছে। এ কারণেই আন্তর্জাতিক আদালতের সীমাবদ্ধতা ও পক্ষপাত উন্মোচিত হচ্ছে। সম্পূর্ণ ন্যায়বিচার হয়তো এখনও স্বপ্নের মতো, কিন্তু সেই স্বপ্নের পথেই আমাদের এগোতে হবে।’

আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, এর অস্তিত্ব একটি বড় বার্তা দেয়– ন্যায়ের পক্ষে এক নৈতিক অবস্থান। যদিও অনেক অপরাধী অধরাই থেকে যায়; তবু বিশ্বজুড়ে বিচারের দাবির ভিতকে শক্তিশালী করতে এ আদালতগুলো গুরুত্বপূর্ণ। আজ যখন পৃথিবীর নানা প্রান্তে নিপীড়ন চলছে, তখন ন্যায়বিচারের এ যাত্রা থামিয়ে রাখা নয়– বরং আরও জোরদার করাই মানবতার পক্ষের কাজ। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ