সিরাজের বয়স মাত্র দুই। ইমান আল-নূরির ছোট ছেলে সে। গত বৃহস্পতিবার ভোরে ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে গেলে সে কেঁদে কেঁদে মায়ের কাছে খাবার চায়। ঘরে কিছুই ছিল না। খাবার সংগ্রহে সিরাজের ১৪ বছর বয়সী খালাতো বোন শামা তাকে ও তার (সিরাজের) বড় দুই ভাই– ওমর (৯) ও আমিরকে (৫) গাজার দায়ের আল-বালাহর আলতায়ারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে রাজি হয়।
৩২ বছরের ইমান আল-নূরি পাঁচ সন্তানের মা। বিবিসির স্থানীয় এক সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তখনও খোলেনি। তাই তারা ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ আমরা হামলার শব্দ শুনতে পাই।’ ইমান বলেন, ‘আমার স্বামীর কাছে গিয়ে বললাম– হাতিম! তোমার বাচ্চারা। ওরা তো স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে গেছে।’
হামলার শব্দ শোনার পর তড়িঘড়ি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দিকে ছুটে যান ইমান। সেখানে দেখেন, তার ছেলেরা ও ভাগনি একটি গাধার গাড়িতে শুয়ে। হাসপাতালটিতে অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় আহতদের আনা-নেওয়ার জন্য এ গাড়ি ব্যবহার করা হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই পাঁচ বছরের আমির ও কিশোরী শামা নিহত হয়। ওমর ও সিরাজ গুরুতর আহত হয়।
সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে ইমান বলছিলেন, ‘ওমর তখনও একটু একটু করে শ্বাস নিচ্ছিল। স্বাস্থ্যকর্মীরা ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। ওমরকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন ছিল। রক্ত আনতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। তারা রক্ত দিলেন। কোনো পরিবর্তন হলো না।’ ইমানের প্রশ্ন, ‘ওরা কেন চলে গেল? কেন? ওরা কী দোষ করেছিল?’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য বাচ্চাদের মতো ওদেরও স্বপ্ন ছিল। ওদের একটা ছোট খেলনা দিলেই ওরা খুশি হতো। ওরা তো শুধুই বাচ্চা ছিল।’
ছোট্ট সিরাজের মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে– এ দৃশ্য এখনও মা ইমানের চোখে ভাসে। তিনি বলেন, ‘ওর খুলি ফেটে গেছে। চিকিৎসকদের মতে, শুধু রক্তপাত নয়, মাথায় বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে কতক্ষণ এমন অবস্থায় অক্সিজেনের ওপর বেঁচে থাকতে পারবে? দুজন তো আগেই চলে গেছে। একসময় চিকিৎসকেরা জানান, তারা আর সিরাজকে চিকিৎসা দিতে পারছেন না।’
গত শুক্রবার ইমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে এ পর্যন্ত সিরাজের অবস্থা একই রকম। এখনও সে শ্বাস নিচ্ছে; বুক ওঠানামা করছে। তার ভেতর এখনও প্রাণ আছে।’ তিনি মিনতি করে বলেন, ‘ওকে বাঁচান!’ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সহায়তা সংস্থা প্রজেক্ট হোপ আলতায়ারা ক্লিনিক পরিচালনা করে। সংস্থাটির এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে ওই হামলা হয়।
চিকিৎসক মিথকাল আবুতহা বলেন, খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য লাইনে সবার আগে থাকতে নারী ও শিশুরা সকাল ৯টার আগে থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছিল। ইসরায়েলের বিমান হামলার সময়ের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুই ব্যক্তি রাস্তায় হাঁটছেন। তাদের অদূরে একদল নারী ও শিশু দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর ওই দু’জনের পাশে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। চারপাশ ধুলা ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হামলার পর অনেক শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মৃত ও গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে।
ফুটেজে দেখা যায়, এক নারী ছোট্ট একটি মেয়ের পাশে বসে চিৎকার করছিলেন– ‘দয়া করে আমার মেয়ের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স আনুন।’ তখন কারও কিছু করার ছিল না। আবুতহা বলেন, ওই হামলায় ১০ শিশু, ৩ নারীসহ ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা হামাসের এক সদস্যকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। হামাসের সঙ্গে জড়িত নয়, এমন লোকজনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য তারা দুঃখিত।
প্রজেক্ট হোপ বলেছে, হামলাটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের এক নির্লজ্জ লঙ্ঘন। এটি জোরালোভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, গাজায় কেউ কোনো জায়গায় নিরাপদ নয়।’ আবুতহা বলেন, ক্লিনিকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত ও সামরিক সংঘাতের আওতার বাইরে থাকা একটি মানবিক কেন্দ্র। সেখানে সামরিক অভিযান চালানো উচিত হয়নি।
৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে
ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের ১০৩ দিন পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজার সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সেখানে ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশুসহ লাখ লাখ মানুষ ‘লজ্জাজনক আন্তর্জাতিক নীরবতার’ মধ্যে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে। এক বিবৃতির বরাত দিয়ে গতকাল শনিবার আলজাজিরা জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী সব ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এটি আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গত তিন দিনে আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানবিক পরিস্থিতিতে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহের ঘাটতির কারণে কয়েক ডজন মৃত্যু রেকর্ড করেছি। গাজায় এ পর্যন্ত ৬৭ শিশু দুর্ভিক্ষে মারা গেছে। উপত্যকার ১০ লাখ ২৫ হাজার মানুষ বিপর্যয়কর ক্ষুধায় ভুগছে।’
৩০ ত্রাণপ্রত্যাশীসহ নিহত আরও ৭৯
গতকাল শনিবার গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলের ব্যাপক হামলায় আরও ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩০ ত্রাণপ্রত্যাশীও ছিলেন। অন্তত ১৩০ ত্রাণপ্রত্যাশী আহত হয়েছেন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গঠিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানেটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে তারা হতাহত হয়েছেন। গাজা থেকে আলজাজিরার হানি মাহমুদ জানান, দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ নিতে যাওয়া লোকজনের ওপর গুলি ছোড়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। গত ২৭ মে’র পর ত্রাণ দেওয়ার নামে তারা ফিলিস্তিনের আট শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: গ জ গণহত য ইসর য় ল র জন য করছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
এমবাপ্পের ‘সুখের লাগি চাহি প্রেম’...
না হয় তিনি প্যারিস ছেড়েছেন, কিন্তু ফ্রান্সের অদৃশ্য জার্সি তো গায়ে সব সময়ে। বিশ্বকাপ এনে দেওয়া সেই আদরের ঘরের ছেলেই কিনা এখন ফরাসিদের কাছে ‘চোখের বালি’। পিএসজির সমর্থকরা এখন তাঁকে দেখলেই দুয়ো দেন, কথা শুনিয়ে দেন বিশ্বাসভঙ্গের সুরে।
নিউইয়র্কের মেটলাইফ স্টেডিয়ামে গ্যালারিতে থাকা এক ফরাসি দর্শকের একটি ভিডিও রীতিমতো ভাইরাল। যেখানে কিলিয়ান এমবাপ্পেকে উদ্দেশ করে গ্যালারির খুব কাছ থেকে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাকে ছাড়াই প্যারিস ইউরোপের চ্যাম্পিয়ন, তোমাকে ছাড়াই জাদু দেখাতে পারে প্যারিস...।’
ম্যাচে পিএসজি তখন ৩-০ গোলে এগিয়ে, দর্শকের কথাগুলো বোধ হয় শুনতে পান এমবাপ্পে। অসহায়ের মতো সেদিকে তাঁকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। ভেতরে তখন কী চলছিল এমবাপ্পের? শেষ বয়সে অটোবায়োগ্রাফিতে না লিখলে হয়তো কখনোই তা জানা যাবে না। তবে বাইরে থেকে আন্দাজ করা যায় ছেড়ে আসা প্রাক্তনের মন– জানতে চাইছে তুমি সুখে আছো তো?
অসুখী হয়তো নন তিনি, তবে প্রাপ্তি যে তাঁর অপূর্ণ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিততে চান বলে পিএসজির বাবুই পাখির বাসা ভেঙে রিয়াল মাদ্রিদের চড়ুইয়ের মতো অট্টালিকা বেছে নিয়েছিলেন নিজেই। ভিনি, বেলিংহাম, টনি ক্রুজ, মডরিচদের নিয়ে চ্যাম্পিয়ন লিগের মুকুট তখন রিয়ালের মাথায়, প্যারিসের ভালোবাসা ছেড়ে তিনি তখন বেছে নেন সেই রিয়াল মাদ্রিদকেই।
এখানে এসেই ক্লাবের ইতিহাসে প্রথম মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ৩৪ গোল করেছেন। তবে ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সেই রিয়ালেই কিনা এবার ট্রফিশূন্যতার খরা! না জুটেছে লা লিগা, না চ্যাম্পিয়ন লিগ– মুখ রক্ষার জন্য যা একটু আশা ছিল ক্লাব বিশ্বকাপে, সেটিও হাতছাড়া। তাও আবার সেই প্রাক্তনের কাছেই!
কবিগুরুর ভাষায়, ‘সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না।/ শুধু সুখ চলে যায়।/...এরা ভুলে যায়, কারে ছেড়ে কারে চায়।’ কিন্তু এমবাপ্পের চাওয়াটা কি অন্যায় কিছু ছিল? ছেলেবেলায় যে ক্লাবের তারকার পোস্টার শোবার ঘরে রেখে ঘুমাতেন, সেই এমবাপ্পে তো খুঁজে নেবেনই তাঁর স্বপ্নের ঠিকানা। যে ক্লাবে জিদান, রোনালদোর নাম মিশে আছে পেশাদার ফুটবলার হিসেবে, সেখানে যেতে চাইবেনই তিনি। এটা যতটা না মোহ, তার চেয়েও বেশি অনুরাগ। বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের প্রতি তাঁর আকৃষ্ট হওয়ার মধ্যে অনৈতিকতারও কিছু নেই।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম কখনও স্বদেশি ক্লাবের প্রতিপক্ষ হয়ে, কখনও শৈশবের ক্লাবের বিপক্ষ দল হয়ে মাঠে নামতে হচ্ছে। কিন্তু এমবাপ্পের বেলাতেই কেন বারবার খোটা শুনতে হচ্ছে? বেশ কয়েক মাস আগে রেডিও মার্কার এক অনুষ্ঠানে এক ফরাসি সাংবাদিক একটা কারণের কথা বলেছিলেন। যার একটা এমন– কিলিয়ান প্যারিস ছেড়ে আসার সময় পিএসজিকে অবজ্ঞা করে এসেছে। সে মনে করেছে, পিএসজিতে থাকলে ক্যারিয়ারে সে কখনোই চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিততে পারবে না, যা কিনা পিএসজির সমর্থক ছাপিয়ে অনেক ফরাসির মনে আঘাত করেছে।
তাছাড়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাঁখোর সঙ্গে কিলিয়ানের বন্ধুত্ব তো রয়েছে। মাঁখোই নাকি হাত ধরে বলেছিলেন, দেশের ফুটবলের স্বার্থে কিলিয়ানকে পিএসজিতে থাকতে। তবে এমন একটা খবর বছর তিনেক আগেই ফরাসি গণমাধ্যমে এসেছিল। ২০২২ সালে মাঁখোর অনুরোধেই নাকি এমবাপ্পে এক বছর চুক্তি বাড়িয়ে ছিলেন পিএসজির সঙ্গে। কিন্তু শেষের দিকে পিএসজির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে অবিশ্বাস চলে আসে।
পিএসজি চাইছিল, চুক্তির অপশনাল অতিরিক্ত এক বছর তাঁকে সৌদি ক্লাব আল হিলালের কাছে রেকর্ড ৩০০ মিলিয়ন ইউরোয় বিক্রি করে দিতে। তাতে রাজি ছিলেন না এমবাপ্পে। তখন একরকম মানসিক নির্যাতন করা হয় তাঁর ওপর। ‘লোফটিং’– ফ্রান্সে এই শব্দটি বলতে বোঝায়, কোনো খেলোয়াড়কে খেলার বাইরে রেখে প্রশাসনিক বা শাস্তিমূলক কারণে একঘরে করে রাখা। এমবাপ্পে এই ‘অপমানজনক আচরণে’ ক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেন।
যদিও নিউইয়র্কে পিএসজির বিপক্ষে মাঠে নামার আগে সেই মামলা প্রত্যাহার করে নেন। ইঙ্গিত দেন, সম্পর্কের সবটুকু এখনও ছিন্ন হয়ে যায়নি। তবে প্যারিসের প্রসিকিউটর দপ্তর জানিয়েছে, পিএসজির বিরুদ্ধে তাঁর বকেয়া ৫৫ মিলিয়ন ইউরোর আর্থিক মামলাটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনালে এখনও চলমান।
প্যারিসে সাত বছর কাটিয়ে ছয়টি লিগ শিরোপা জিতিয়ে আর্থিক এই দাবিটুকু ‘ছেড়ে দিলাম’ বলতেই পারতেন; কিন্তু পিএসজির শেষ বছরটিতে তাঁর সঙ্গে চলা ঘটনাগুলো এখনও যেন মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেন না এমবাপ্পে।
মাদ্রিদে এই মৌসুমে হয়তো তাঁর হাত শূন্য, কিন্তু আরও যে চারটি বছর পড়ে আছে সামনে। তখন মাদ্রিদের কোনো অর্জনে এমবাপ্পেকে নিয়েই হয়তো কবিতা লিখবে প্যারিস। ফ্রান্সের জার্সিতেই এমবাপ্পের কোনো সফলতায় অভিমান ভুলে আবারও হয়তো ছবি আঁকা হবে তাঁর। শত হলেও এমবাপ্পে তো প্যারিসেরই আপনজন। প্রিয়জন সুখী থাকবে বলেই তো ছেড়ে দিতে হয়।