এলএনজি আমদানি বাড়ছে, ভর্তুকি দিতে হবে ১৬ হাজার কোটি টাকা
Published: 10th, May 2025 GMT
দেশে গ্যাস উৎপাদন ক্রমেই কমছে।এর ফলে বাড়ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরশীলতা। আর এই তরল গ্যাসের পুরোটা আমদানি করতে হয়।
গ্যাসের চাহিদা মেটাতে চলতি বছরে ৯৮টি এলএনজি কার্গো আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ৯০টি কার্গো আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।এসব কার্গো আমদানিতে ব্যয় হবে ৪৫৪ কোটি ৩২ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৬ হাজার ৬৪৭ কোটি টাকা (১ ডলার=১২৩ টাকা হিসাবে)। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জানা গেছে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মার্চে দৈনিক গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৮৬২ এমএমসএফডি। এর আগে ২০২৩ ও ২০২৪ সালের একই মাসে গ্যাসের গড় উৎপাদন ছিল ২ হাজার ১৭৬ এমএমসিএফডি এবং ২ হাজার ৪০ এমএমসিএফডি। বিভিন্ন মাসে উৎপাদন হ্রাস বৃদ্ধি ঘটনা ঘটে।
আরো পড়ুন:
এলএনজি আমদানি: ব্যয় হবে ১৬২০ কোটি ৫ লাখ ২৮ হাজার টাকা
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল
জানা গেছে, অভ্যন্তরীণ গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে চলতি বছরের মধ্যে ৫০টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে জাতীয় গ্রিডে ৬৪৮ এমএমসিএফডি গ্যাস যুক্ত হবে। একইভাবে আগামী ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০টি কূপ খনন ও ওয়ার্কওভারের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এটি বাস্তবায়িত হলে জাতীয় গ্রিডে ৯৮৫ এমএমসিএফডি গ্যাস যুক্ত হবে। এছাড়া চলতি বছরেরর মধ্যেই গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থায় বিদ্যমান সিস্টেম বা কারিগরি লস ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ এমএমসিএফডি। এর বিপরীতে দৈনিক গড় উৎপাদনের পরিমাণ ২ হাজার ৭০৭ এমএমসিএফডি। অর্থাৎ দৈনিক ঘাটতি প্রায় ১১০০ এমএমসিএফডি। এলএনজি আমদানির মাধ্যমে এ ঘাটতি পূরণ করা হয়।
এদিকে, ডলারের দাম বাড়ার কারণে এলএনজি কার্গো আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি এলএনজির গড় মূল্য প্রতি এমএমবিটিইউ ১০ দশমিক ৫০ ডলার। আর স্পট মার্কেট থেকে কেনা হলে প্রতি এমএমবিটিইউ এর গড় মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৪ ডলার।
জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, আমদানিকৃত গ্যাসের মোট বিক্রয় মূল্য হচ্ছে ৩৮ হাজার ৯৭০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থ ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
এদিকে, জ্বালানি খাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ হচ্ছে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এটি বাদ দিলে এ খাতে বছরে নীট ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ১১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা। প্রতি ঘনমিটারে গ্যসের মূল্য পার্থক্য (প্রাইস গ্যাপ) হচ্ছে ৭ টাকা ৮ পয়সা।
সূত্র জানায়, অভ্যন্তরীণ বাজারে গ্যাসের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পরিচালিত দেশি-বিদেশি শিল্প কারখানা চালনোর জন্য প্রতি বছর এলএনজির চাহিদা বাড়ছে। এজন্য প্রতি সপ্তাহে অর্থ উপদেষ্টার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে এলএনজি ক্রয় সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হচ্ছে।যাতে দেশের অভ্যন্তরে এলএনজি কোনো ঘাটতি না হয়।
তিনি আরো জানান, এলএনজি খাতে সরকারকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) এলএনজি খাতে সরকারকে ১৬ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। গত অর্থবছরে যা ছিল ৬ হাজার ৩৫ কোটি টাকা।
ঢাকা/হাসনাত/সাইফ
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর ম ণ ভর ত ক আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
গত বছর কেউ রেকর্ড মুনাফায়, কেউ বড় লোকসানে
২০২৪ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতের মুনাফায় মিশ্র চিত্র দেখা গেছে। কিছু ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে। আবার কয়েকটি ব্যাংকের মুনাফা কমেছে। তবে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে যেসব ব্যাংকে বড় ধরনের লুটপাট হয়েছে তার অনেকগুলো লোকসানে পড়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর ২০২৪ সালের লাভ–লোকসানের সার্বিক চিত্র এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত মিলেছে ২২টি ব্যাংকের চিত্র। এর মধ্যে ১৩টি ব্যাংকের মুনাফা বেড়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে সাতটির মুনাফা কমেছে, দুটির লোকসান বেড়েছে।
ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ব্র্যাক ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকের মুনাফা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফায় বড় ধরনের পতন ঘটেছে। অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের লোকসান বেড়েছে।
নিট বা প্রকৃত মুনাফার হিসাব বের হয় পরিচালন মুনাফা থেকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ ও করপোরেট কর পরিশোধের পর। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর করপোরেট কর ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত ব্যাংকগুলোর করপোরেট কর ৪০ শতাংশ। এদিকে এবার বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি বেশ জোরদার করেছে। তারা প্রায় সব ব্যাংকের বিভিন্ন ঋণ প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন করে এর ভিত্তিতে কী পরিমাণ ঋণ খেলাপি দেখাতে হবে তা বেঁধে দেয়। ফলে অধিকাংশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখার কারণে অনেক ব্যাংক মুনাফায় ধাক্কা খেয়েছে।
এবার পরিচালন মুনাফা অনেক হলেও চাহিদামতো ও অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি চিন্তা করে ব্যাংকের ভিত্তি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ হিসেবে এটি করা হয়েছে।আবুল কাশেম মো. শিরিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, গত বছরে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়ানোর সুযোগ পায়। তাতে তারা সুদ থেকে ভালো আয় করেছে। পাশাপাশি টাকা ও ডলার বিনিয়োগ করেও ভালো আয় করেছে কিছু ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের সুনাম আছে সেগুলো বিপুল পরিমাণ আমানত পেয়েছে। এসব আমানত তাদের মুনাফা বাড়ানোর বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যেসব ব্যাংক নানা কারণে বিতর্কিত ছিল, সেগুলো টাকা ধার করে চলছে। ফলে তাদের সুদ দিতে গিয়ে চাপে পড়তে হয়েছে। সব মিলিয়ে গত বছরে গুটিকয়েক ব্যাংক বেশ ভালো করে। অন্যদিকে চাপ ও সংকটের মধ্য দিয়ে বছর শেষ করে বেশির ভাগ ব্যাংক।
যাদের মুনাফা বেড়েছে
ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মুনাফার চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্র্যাক ব্যাংকের নিট মুনাফা ২০২৪ সালে বেড়ে ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে, যা ২০২৩ সালে ছিল ৮২৮ কোটি টাকা। এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুশাসন ও নিয়মানুবর্তিতার দিক থেকে ব্র্যাক ব্যাংক দেশে শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। তাই আমরা গত বছর অনেক বেশি আমানত পেয়েছি। যখন নানা ধরনের অনিয়মের কারণে অনেক ব্যাংকের প্রতি আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে তখন আমানতকারীরা নির্ভরতার জন্য ব্র্যাক ব্যাংককে বেছে নেয়। আর আমানতকারীদের আমানতের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করেছি। এর ফলে আমরা রেকর্ড মুনাফা করতে পেরেছি।’
সিটি ব্যাংকের মুনাফা ২০২৩ সালের ৬৩৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১ হাজার ১৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। তাতে প্রথমবারের মতো দেশের দুই ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকা নিট মুনাফা অর্জনের ক্লাবে তথা তালিকায় নাম লেখাল।
সিটি ব্যাংকের এমডি মাসরুর আরেফিন বলেন, ‘মানুষ আমাদের ওপর আস্থা রেখে আমানত রেখেছেন। গত বছর আমাদের আয়-ব্যয়ের অনুপাত ৬০ শতাংশ থেকে কমে ৪২ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে মুনাফায় বড় উল্লম্ফন ঘটেছে।’
এ ছাড়া পূবালী, ইস্টার্ন ও প্রাইম ব্যাংকের মুনাফা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। পূবালী ব্যাংকের মুনাফা ৬৯৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৮০ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংকের মুনাফা ৬১১ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৫০ কোটি টাকা ও প্রাইম ব্যাংকের মুনাফা ৪৮৪ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৭৪৫ কোটি টাকা হয়েছে। বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকের মুনাফা ১১ কোটি থেকে বেড়ে ৬৩ কোটি টাকায় উঠেছে। সিটিজেন ব্যাংক ২০২৩ সালে দেড় কোটি টাকা লোকসান করেছিল, তবে ২০২৪ সালে ৪ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
মুনাফায় ধাক্কা খেল যারা
আলোচ্য বছরে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের নিট মুনাফায় বড় পতন ঘটেছে। এর মধ্যে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মুনাফা ২০২৩ সালের ৮০২ কোটি টাকা থেকে কমে ২০২৪ সালে ৪৭৩ কোটি টাকায় নেমেছে। ট্রাস্ট ব্যাংক এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফাও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একই সময়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের মুনাফা ৪২৭ কোটি টাকা থেকে ৩৭৩ কোটি টাকায় এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের মুনাফা ৩৫৮ কোটি টাকা থেকে ১৬৯ কোটি টাকায় নেমেছে। মেঘনা ব্যাংকের মুনাফা ৬৮ কোটি টাকা থেকে কমে ৪৬ কোটি টাকা হয়েছে। কমিউনিটি ব্যাংকের মুনাফা ৭৯ কোটি টাকা থেকে কমে ৭০ কোটিতে নেমেছে। এই চার ব্যাংকে বড় কোনো সমস্যা না থাকলেও আগের চেয়ে নিরাপত্তা সঞ্চিতি বেড়েছে, যার ধাক্কা লেগেছে মুনাফায়।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, এবার পরিচালন মুনাফা অনেক হলেও চাহিদামতো ও অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি চিন্তা করে ব্যাংকের ভিত্তি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ হিসেবে এটি করা হয়েছে।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের এমডি মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত ৪৩০ কোটি টাকা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করা হয়েছে। সামনের বছর নিরাপত্তা সঞ্চিতি আরও বেশি রাখার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, ব্যবসা-বাণিজ অস্থিরতা ও মন্দা চলছে। এ জন্য আমাদের মুনাফা কমে গেছে।
অন্যদিকে ন্যাশনাল ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের লোকসান বেড়েছে। এরমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের লোকসান ১ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১ হাজার ৭০৬ কোটি টাকা এবং আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের লোকসান ৫৬ কোটি থেকে বেড়ে ৯৪ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
এদিকে বেসরকারি খাতের অর্ধেকের বেশি ব্যাংকের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন আটকে গেছে। যে কারণে এসব ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে পারছে না, আবার লভ্যাংশও ঘোষণা করতে পারছে না।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এবার ব্যাংকগুলো যে আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করছে, তা বাস্তবভিত্তিক। এতে লুকানো কিছু নেই। সামনে পরিস্থিতি খারাপ বা ভালো হলে সেই চিত্র উঠে আসবে প্রতিবেদনে।