আমদানি বাড়ানো ও শুল্ক কমানোর পণ্য তালিকা চূড়ান্ত হচ্ছে
Published: 12th, May 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরোপ করা পাল্টা শুল্ক থেকে রেহাই পেতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর দাপ্তরিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ট্যারিফ লাইনে থাকা প্রায় ৪০টি এইচএস কোডের পণ্যের আমদানি বাড়ানো এবং ১০০ পণ্যে শুল্ক কমানোর জন্য খসড়া তালিকা তৈরি করেছে সরকার। তালিকা চূড়ান্ত করে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তরে পাঠানো হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত ৭ মে লিখিত প্রস্তাব চেয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনকে চিঠি দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে লিখিত প্রস্তাব পেলে আনুষ্ঠানিক দরকষাকষি শুরু হবে। এর আগে গত ৭ এপ্রিল বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া এবং আলোচনার আগ্রহের কথা জানিয়ে জেমিসন গ্রিয়ারকে চিঠি দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল সোমবার বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, আমদানি বাড়ানো যায় এমন কিছু পণ্যের একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার বিষয়েও সরকার কাজ করছে। তালিকা চূড়ান্ত করে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হবে।
গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করা হয় ৩৭ শতাংশ। তবে ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করা হয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের ওপর এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে ২০ কোটি ডলারের বেশি আমদানি করে এমন অন্তত ১৪ পণ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশি আনার সুযোগ রয়েছে। যেমন– বাংলাদেশ ২০২৩ সালে বিশ্ববাজার থেকে ৭১৬ কোটি টাকার কিছু পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানি করেছে। একই বছর যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্বে ৬ হাজার ৬৪৫ কোটি ডলারের পেট্রোলিয়াম রপ্তানি করেছে, যা বিশ্বে মোট রপ্তানির ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এ পণ্য এসেছে প্রায় শূন্য শতাংশ। বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানিতে শুল্ক ৫ থেকে ২৫ শতাংশ।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ সারাবিশ্ব থেকে ২২২ কোটি ডলার দামের তুলা আমদানি করেছিল, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছিল মাত্র ৩৩ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাপী তুলা রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ছিল ৩৫ দশমিক ৮১ শতাংশ। বাংলাদেশে মার্কিন তুলার আমদানি শুল্ক শূন্য শতাংশ। একই বছর বাংলাদেশ ১৮৯ কোটি ডলারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করেছিল, যার মধ্যে প্রায় ৫ কোটি ডলারের এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ওই বছর আমেরিকা থেকে রপ্তানি করা মোট এলপিজির দাম ছিল ২০৮৮ কোটি ডলার, যা বিশ্ববাজারের প্রায় ৩৬ শতাংশ। একইভাবে প্রাথমিক অনুমান অনুসারে, বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও সয়াবিন, গম, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, ভুট্টা, ভ্যাকসিন, গহনা সামগ্রী, বোর্ড, প্যানেল, লৌহঘটিত বর্জ্য, স্ক্র্যাপ ইত্যাদির আমদানি বাড়ানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে গম, দুধ, ক্রিম উল্লেখযোগ্য।
বাণিজ্য উপদেষ্টা ইউএসটিআরকে দেওয়া চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশের শুল্ক তালিকায় বর্তমানে ১৯০টি পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্য, অর্থাৎ কোনো শুল্ক নেই। ট্যারিফ লাইনের আরও ১০০টি পণ্যকে শুল্কমুক্ত তালিকায় যুক্ত করার চিন্তা করা হচ্ছে। বর্তমানে এনবিআর ১০০টি পণ্য খুঁজে বের করতে কাজ করছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী শূন্য শুল্ক অন্যান্য দেশের জন্যও প্রযোজ্য হবে।
এদিকে ইউএসটিআরের পরামর্শ অনুযায়ী সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য কেনার প্রতিশ্রুতি দেবে বাংলাদেশ। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ জেনারেল মোটরস থেকে গাড়ি এবং এলজি পণ্য কোরিয়া ও ভারত থেকে আমদানি করে, যদিও এগুলো আমেরিকান ব্র্যান্ড। বাংলাদেশ বিমান কেনার সময় বোয়িংকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চিন্তা করছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে বাংলাদেশ অ-শুল্ক বাধা দূর করার নানা পদক্ষেপ নেবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ ল ককর র ওপর আমদ ন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়াশিংটনের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি নিয়ে তৎপর ঢাকা
ওয়াশিংটনের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করার ক্ষেত্রে প্রচলিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চা ও দ্বিপক্ষীয় সুবিধার মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে ঢাকা। চুক্তির খসড়ায় ইতোমধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছালেও এখনও মতপার্থক্য রয়েছে। দেশের স্বার্থ রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে মতপার্থক্য কাটিয়ে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করতে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ।
এর অংশ হিসেবে আলোচনায় অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা ছেড়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। চুক্তি হলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপ করা ট্রাম্প প্রশাসনের বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানো সম্ভব হবে বলে মনে করছে সরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে শুল্ক চুক্তি করার আগ্রহের কথা জানিয়ে একটি খসড়া পাঠায় ট্রাম্প প্রশাসন। তবে এতে এমন কিছু শর্ত রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য নয় বলে মনে করছে বাংলাদেশ। তাই খসড়া সংশোধন করে ইতোমধ্যে তিন দফা মতামত পাঠিয়েছে ঢাকা। এ মতামতের ওপর গত ২৬ জুন ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে শর্তের বিষয়ে কিছু ক্ষেত্রে নমনীয় হলেও উভয়পক্ষ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।
খসড়ায় আবার সংশোধন এনে গত মঙ্গলবার নিরাপত্তা উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশোধিত এ খসড়ার বিষয়ে দরকষাকষি করতে আজ আবারও ইউএসটিআরের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন খলিলুর রহমান। সভায় বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান অনলাইনে যুক্ত হবেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের উপস্থিতিতে ইউএসটিআরের সঙ্গে আগামী ৮ জুলাই আরও একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে অংশ নিতে বাণিজ্য উপদেষ্টা গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন।
এ বিষয়ে গতকাল বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, শুল্ক চুক্তির খসড়ার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যেসব সংশোধনী আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তার ছোট কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সম্মত হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা হয় না। এসব বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ একটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করার সময় অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়েও ভাবতে হয়। তবে চুক্তির ক্ষেত্রে বাধার বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক স্থগিতের মেয়াদ ৮ জুলাই শেষ হয়ে যাবে। এর মধ্যে চুক্তি করা সম্ভব না হলে কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে– এমন প্রশ্নে বাণিজ্য সচিব বলেন, কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এখনও চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশ দরকষাকষির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তিন দফা খসড়া বিনিময় হয়েছে। খসড়ার ওপর ইতোমধ্যে তিনটি বৈঠক হয়েছে। আরও দুটি হতে যাচ্ছে। এ ছাড়া গত ২ এপ্রিলের পর এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২৮ দফা বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়েছে। অন্য কোনো দেশ এত যোগাযোগ করেছে বলে তাঁর জানা নেই।
বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত চুক্তিতে এমন শর্ত দেওয়া হয়েছে, যা অন্যান্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করলে বাংলাদেশকেও তা অনুসরণ করতে হবে– এমন শর্ত রয়েছে। ঢাকা ওয়াশিংটনকে জানিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি সুনির্দিষ্ট দেশের নিজস্ব আইন বাংলাদেশের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শর্তারোপ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য আমদানিতে ছাড় দেবে, একই পণ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোনো দেশকে ছাড় দেওয়া যাবে না। তবে এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মোস্ট-ফেভার্ড ন্যাশন (এমএফএন) নীতির বিরোধী হওয়ায় মানতে নারাজ বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে আরও জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এসব কঠিন শর্তের কারণেই এখন পর্যন্ত কোনো দেশই চুক্তি করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। ইন্দোনেশিয়া চুক্তির বিষয়ে এগিয়ে থাকলেও কঠিন শর্তের কারণে দুই সপ্তাহ আগে তারা জানিয়ে দিয়েছে, এ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারা কোনো চুক্তি করবে না।
গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বিভিন্ন দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক ঘোষণা করা হয় ৩৭ শতাংশ। তবে ৯ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন প্রেসিডেন্ট। এর মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৮ জুলাই। যদিও সব দেশের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ বাড়তি শুল্ক কার্যকর করা হয়েছে।