নগদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অস্থিরতা শুরু
Published: 15th, May 2025 GMT
মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’–এ প্রশাসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নগদ পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে প্রশাসক দল নগদে কাজ করছিল, তারা দায়িত্ব হারিয়েছে। ফলে নগদের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগ দুই প্রতিষ্ঠানই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
এদিকে নগদের অর্থ তছরুপের জন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, তাঁদের মধ্যে একজনকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি হলেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক মো.
হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দেওয়া আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ নিয়ে ১৯ মে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। প্রশাসক বসানোর পর নিরীক্ষায় উঠে আসে, নগদ লিমিটেডে বড় ধরনের জালিয়াতি সংঘটিত হয়েছে। ভুয়া পরিবেশক ও এজেন্ট দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে আর্থিক জালিয়াতি এবং অতিরিক্ত ইলেকট্রনিক অর্থ বা ই-মানি তৈরি করা হয়েছে। এসব কারণে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার হিসাব মিলছে না। সাবেক সরকারের আমলে নিয়মের বাইরে গিয়ে গ্রাহক বানানো ও সরকারি ভাতা বিতরণসহ একচেটিয়া সুবিধা পায় নগদ। প্রতিষ্ঠানটিতে যখন এসব অনিয়ম সংঘটিত হয়, তখন এর পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। সবার চোখের সামনে এসব অনিয়ম হয়। এ ঘটনায় সরকারের ডাক বিভাগের আটজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক (ডিজি), নগদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ (সিইও) ২৪ জনকে আসামি করে মামলা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এর মধ্যে ‘নগদ’ পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে করা রিটটি গ্রহণযোগ্য নয় বলে তা খারিজ করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা পরে স্থগিত হয়ে যায়। এই রায় গত সোমবার বের হয়। সেদিনই নগদের দায়িত্ব নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডাক বিভাগের কর্মকর্তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। নগদের কর্মকর্তারা নিজেরাই সাবেক পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মামলার আসামি মো. সাফায়েত আলমকে নতুন সিইও হিসেবে নিয়োগ দেন। এখন তাঁরাই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করছেন।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণের টাকার নিরাপত্তা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। আগে প্রতিষ্ঠানটি যেনতেনভাবে চলেছে। এ জন্য সরকার পরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছিল। এখন আদালতের আদেশের কারণে সেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে। আমরা সেই আদেশ প্রত্যাহার চেয়ে আবেদন করেছি। আশা করি, জনগণের টাকার নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার দায়িত্ব ফিরে পাবে।’
২০১৮ সালের ৮ আগস্ট ডাক অধিদপ্তর ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা চালুর অনুমতি চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করে। শর্ত মেনে আবেদন না করার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন অনুমোদন দেয়নি। এরপর ডাক অধিদপ্তর নিজেদের আইনে পরিবর্তন এনে ২০১৯ সালের ২৬ মার্চ ‘নগদ’ নামে মোবাইলে আর্থিক সেবা (এমএফএস) চালু করে দেয়। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেবাটি উদ্বোধন করেন। শর্ত পূরণ না করলেও ২০২০ সালের ১৫ মার্চ নগদকে অন্তর্বর্তীকালীন অনুমোদন দিয়ে ডাক অধিদপ্তরকে চিঠি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন ব্যাংক হিসাব (ট্রাস্ট কাম সেটেলমেন্ট হিসাব) ডাক বিভাগের নামে খোলার শর্ত দেওয়া হয়। কিন্তু তা মানেনি প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও আর কোনো তদারক করেনি। এভাবেই চলছে নগদ। এটি এখন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এমএফএস প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত সরক র র আর থ ক ন র পর নগদ র
এছাড়াও পড়ুন:
ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনে নতুন সম্ভাবনা
বাংলাদেশে ডিজিটাল আর্থিক সেবা গত এক দশকে অনেক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এর মূল চালিকা শক্তি মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস), যা দেশের লাখো মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সহজ করেছে। বর্তমানে দেশে ৯ কোটির বেশি সক্রিয় ব্যবহারকারী প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করছেন এমএফএস সেবার মাধ্যমে।
ইন্টারনেট ব্যাংকিং, কার্ড পেমেন্ট ও অন্যান্য ডিজিটাল চ্যানেলেও প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্কুলার প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংক, এমএফএস বা পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (পিএসপি) অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য যেকোনো অ্যাকাউন্টে তাৎক্ষণিক টাকা পাঠানো যাবে। এটি বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ডিজিটাল অর্থনীতির নতুন যুগের সূচনা করবে।
ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে পিটুপি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। পাকিস্তানে পিটুপি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। দেশটির সরকার কিউআর পেমেন্ট উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করছে।ক্যাশলেস ডিজিটাল লেনদেনের দুটি প্রধান ভিত্তি হলো কুইক রেসপন্স (কিউআর) কোড পেমেন্ট এবং পি টু পি (পারসন টু পারসন) ট্রান্সফার। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২১ সালে বাংলা কিউআর স্কিমের মাধ্যমে সর্বজনীন কিউআর পেমেন্ট চালু করে। ফলে গ্রাহকেরা যেকোনো ব্যাংক বা ওয়ালেট অ্যাপ দিয়ে কোডটি স্ক্যান করলেই টাকা তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপকের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে পারেন।
এখন বাংলাদেশ ব্যাংক পারসন টু পারসন ট্রান্সফার চালু করছে। এর মাধ্যমে দেশের যেকোনো অঞ্চলের কেউ নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্য অঞ্চলের কারও এমএফএস অ্যাকাউন্টে সহজেই টাকা পাঠাতে পারবেন।
বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও সার্ভিস চার্জবাংলাদেশের ক্যাশলেস লেনদেন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হতে পারে। ভারত ২০১৬ সালে ইউনিফায়েড পেমেন্ট ইন্টারফেস (ইউপিআই) চালু করে। যার মাধ্যমে মাসে ১ হাজার ৭০০ কোটি লেনদেন হয়, যা প্রায় ২৮০ বিলিয়ন ডলারের সমমূল্যে। শ্রীলঙ্কা ২০১৮ সালে পিটুপি ট্রান্সফার ও ২০১৯ সালে কিউআর পেমেন্ট চালু করে। পাকিস্তান ২০২২ সালে রাস্ত ডিজিটাল পেমেন্ট পারফর্ম চালু করে।
ভারতে ক্যাশলেস পেমেন্ট সফল হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে পিটুপি ট্রান্সফার ও অধিকাংশ কিউআর লেনদেনে কোনো চার্জ নেই। পাকিস্তানে পিটুপি ট্রান্সফারে কোনো খরচ নেই। দেশটির সরকার কিউআর পেমেন্ট উৎসাহিত করতে প্রোভাইডারদের লেনদেনের শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ ভর্তুকি প্রদান করছে।
আরও পড়ুনক্যাশলেস ব্যাংকিংয়ের স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে?০৫ নভেম্বর ২০২৫বাংলাদেশের বাস্তবতা অনেকটা ভিন্ন। এখানে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস সবচেয়ে জনপ্রিয়। গ্রাহকেরা বিনা খরচে এখানে টাকা গ্রহণ করছেন। যদিও টাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য।
এ বাস্তবতা বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এমএফএস, ব্যাংক ও পিএসপিদের সঙ্গে আলোচনা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্রাইসিং কাঠামো নির্ধারণ করেছে। পিটুপি ট্রান্সফারে, প্রেরক এমএফএস থেকে পাঠালে হাজারে ৮ দশমিক ৫০ টাকা, ব্যাংক থেকে পাঠালে হাজারে ১ দশমিক ৫০ টাকা এবং পিএসপি থেকে পাঠালে হাজারে ২ টাকা সর্বোচ্চ সার্ভিস চার্জ দেবেন গ্রাহক। কিউআর পেমেন্টে গ্রাহককে কোনো চার্জ দিতে হবে না, তবে মার্চেন্ট লেনদেনের খরচ গ্রহণ করবেন এবং সর্বোচ্চ এমডিআর হবে লেনদেনের ১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে সেবার মান ও নিরবচ্ছিন্ন কার্যকারিতা। যাতে প্রতিটি লেনদেন সফলভাবে সম্পন্ন হয় এবং ব্যবহারকারীরা আস্থা ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। পাশাপাশি সব গ্রাহক ও ব্যবসায়ীকে ডিজিটাল পেমেন্টের সুবিধা সম্পর্কে জানাতে হবে। এ উদ্যোগে সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সব সার্ভিস প্রোভাইডারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রণোদনা কার্যক্রম চালু করা যেতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা ক্যাশ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয়। যদি এর অল্প অংশ (যেমন ৫ শতাংশ বা বছরে এক হাজার কোটি টাকা) ডিজিটাল লেনদেন প্রচারে বিনিয়োগ করা যায়, তবে তা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিতে বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ববাংলাদেশ ব্যাংক এ রূপান্তরের নেতৃত্ব দেবে, তবে সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা। ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি—সব অংশীদারকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এ জন্য একটি কার্যকরী কমিটি গঠন করা যেতে পারে। সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে এবং যদি কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা দ্রুত যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
ক্যাশলেস লেনদেন ত্বরান্বিত করার জন্য কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। নিশ্চিত করতে হবে যে বাজারের সব ব্যবসায়ী পেমেন্টের জন্য বাংলা কিউআর কোড ব্যবহার করছেন। বিদ্যমান নিজস্ব কিউআর কোডগুলো দ্রুত বাংলা কিউআর দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। ট্রেড লাইসেন্সধারী সব দোকানে ট্রেড লাইসেন্সের পাশে কিউআর কোড প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা করা যায়।
দেশের ব্যাংক, এমএফএস ও পিএসপি ব্যবহারকারীদের জন্য কিউআর কোড ইস্যু করা যায়, যাতে একজন গ্রাহক অন্যজনের কিউআর স্ক্যান করে সহজে লেনদেন করতে পারেন। ফলে দেশে অল্প সময়ে ১০ কোটির বেশি কিউআর কোড ইস্যু হবে, সচেতনতা ও লেনদেন বাড়বে। পল্লী বিদ্যুৎসহ সব ইউটিলিটি বিলে কিউআর প্রিন্ট করতে হবে। মেট্রোরেলসহ সব সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে কিউআর কোডের মাধ্যমে টিকিট কাটা ও পেমেন্টের ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্যাশলেস লেনদেন উদ্যোগ দেশের নগদনির্ভরতা কমিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে শক্তিশালী করবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের আনুষ্ঠানিক আর্থিক ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করবে। সঠিক নেতৃত্ব, বাস্তবসম্মত নীতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে এ উদ্যোগ ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন অধ্যায় রচনা করবে।
● ড. শাহাদাত খান প্রতিষ্ঠাতা, সিইও, টালিখাতা ও টালিপে