আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঝরে পড়ছে। শব্দের চেয়েও দ্রুতগতির ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোতে আঘাত হানছে। আকাশে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, ভবিষ্যতে উচ্চ প্রযুক্তির হামলায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের পুরোনো ও সীমিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যর্থ হয়, তাহলে এমনই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের দৃশ্য দেখা যেতে পারে।

এমনকি মার্কিন নাগরিকদের মাথার অনেক ওপরে যদি একটি ছোট পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে, সেটাও ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ ধরনের বিস্ফোরণে তৈরি হবে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পালস (ইএমএপি), যার কারণে আকাশে উড়তে থাকা উড়োজাহাজ মাটিতে পড়ে যাবে। মোবাইল, চিকিৎসা যন্ত্রপাতি এমনকি পানি সরবরাহ ব্যবস্থা—সবই অকেজো হয়ে পড়বে।

নর্থ ক্যারোলাইনার মন্ট্রিট কলেজের লেখক ও অস্ত্র গবেষক উইলিয়াম ফোর্টসচেন বলেন, ‘আমরা ১০০ বছর পেছনে ফিরে যাব না, বরং সবকিছু হারাব। আমরা জানি না, সেখান থেকে কীভাবে আবার শুরু করব। এটা এমন হবে, যেন আমরা এক হাজার বছর পেছনে চলে গেছি এবং নতুন করে সবকিছু শুরু করতে হবে।’

এই সম্ভাব্য বিপদের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘পরবর্তী প্রজন্মের’ একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরির কথা ভাবছেন, যার নাম দিয়েছেন ‘গোল্ডেন ডোম’।

অনেক বিশেষজ্ঞ একমত, এ ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। তবে এর উচ্চব্যয় ও জটিলতা ট্রাম্পের পরিকল্পনা বাস্তবায়নকে কঠিন করে তুলতে পারে।

নির্বাহী এক আদেশে বলা হয়েছে, শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘আয়রন ডোম’ নামে যে ব্যবস্থা প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা এখন ‘গোল্ডেন ডোম’-এ রূপ নিচ্ছে। আদেশে বলা হয়েছে, পরবর্তী প্রজন্মের অস্ত্রগুলোর হুমকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও তীব্র ও জটিল হয়ে উঠছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভয়ংকর বিপদের কারণ হতে পারে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিসিয়া বাজিলচিক বিবিসিকে বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) প্রতিহত করার জন্য তৈরি।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের বড় আকারের আক্রমণ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা একেবারেই অপর্যাপ্ত। এসব দেশের কাছে শত শত আইসিবিএম এবং হাজার হাজার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

কিন্তু রাশিয়া ও চীনের মতো শক্তিশালী দেশ এখন আরও উন্নত প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে, যেগুলো শুধু প্রতিবেশী দেশ নয় বরং মহাসাগরের ওপারেও আঘাত হানতে সক্ষম।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা যেসব নতুন হুমকির কথা বলছেন, তার মধ্যে রয়েছে—শব্দের চেয়ে দ্রুতগতির হাইপারসনিক অস্ত্র, ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম (এফওবিএস)। এই প্রযুক্তি মহাকাশ থেকে নির্দিষ্ট লক্ষে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে।

এই অস্ত্রগুলো সংখ্যায় কম হলেও কিন্তু মারাত্মক।

বাজিলচিক বলেন, ‘গোল্ডেন ডোম আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা নীতিকে রাশিয়া ও চীনের মতো বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে সরিয়ে নিচ্ছে। কারণ, তারা এখন এমন সব অস্ত্রে বিনিয়োগ করছে, যা আমরা আগে মোকাবিলা করিনি।’

‘গোল্ডেন ডোম’ দেখতে কেমন হবে

এখন পর্যন্ত হোয়াইট হাউস বা প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রকল্পের নির্দিষ্ট কোনো বিবরণ দেননি। কারণ, এটি এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে রয়েছে।

২০ মে ট্রাম্প ওভাল অফিসে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথের সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই ব্যবস্থাটি ‘ভূমি, সমুদ্র এবং মহাকাশে একাধিক স্তরে কাজ করবে, যার মধ্যে থাকবে মহাকাশভিত্তিক সেন্সর ও প্রতিরোধব্যবস্থা।

ট্রাম্প বলেন, এই ব্যবস্থা এমনকি পৃথিবীর অন্য প্রান্ত থেকে বা মহাকাশ থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে পারবে। এই কর্মসূচি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য—যেমন ফ্লোরিডা, ইন্ডিয়ানা ও আলাস্কা থেকে পরিচালিত হবে।

স্পেস ফোর্সের জেনারেল মাইকেল গেটলাইন কংগ্রেসে জানান, ‘গোল্ডেন ডোম’ পূর্ববর্তী আইসিবিএম প্রতিরক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। তবে এতে আরও স্তর যোগ হবে, যা ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রসহ অন্যান্য হুমকি শনাক্ত ও প্রতিরোধ করতে পারবে। এমনকি শত্রুপক্ষ ওই ক্ষেপনাস্ত্র ছোড়ার আগেই বা যেকোনো পর্যায়ে সেটি অকার্যকর করে দিতে পারবে।

ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিসিয়া বাজিলচিক বিবিসিকে বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মূলত উত্তর কোরিয়ার মতো দেশের আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) প্রতিহত করার জন্য তৈরি।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সংস্থা ৪৪টি ভূমিভিত্তিক প্রতিরোধব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে থাকে। সেগুলো আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত। এগুলো শুধু সীমিত হামলা প্রতিরোধ করতে সক্ষম।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের বড় আকারের আক্রমণ ঠেকাতে এই ব্যবস্থা একেবারেই অপর্যাপ্ত। এসব দেশের কাছে শত শত আইসিবিএম এবং হাজার হাজার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ স্টেসি পেটিজন বলেন, বর্তমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কেবল উত্তর কোরিয়ার জন্য তৈরি ছিল। এটা রাশিয়ার বিশাল অস্ত্রভান্ডার বা চীনের তুলনামূলক ছোট হলেও অনেক বড় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে পারবে না।

কংগ্রেসনাল রিসার্চ অফিস (সিবিও) বলেছে, এই ধরনের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে মহাকাশে ‘শত শত বা হাজার হাজার’ প্ল্যাটফর্ম বসাতে হবে, যা হবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’: একটি উদাহরণ

ট্রাম্প গত মার্চে কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে প্রথম ‘গোল্ডেন ডোম’–এর ধারণাটি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের এটি আছে, আরও কিছু দেশের আছে, যুক্তরাষ্ট্রেরও অবশ্যই থাকা উচিত।’

ইসরায়েলের আয়রন ডোম মূলত ছোট আকারের রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়, যা গাজা বা লেবানন থেকে ছোড়া হয়। ২০১১ সাল থেকে তারা এগুলো ব্যবহার করছে। তবে বড় ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে তারা আরও দুটি সিস্টেম ব্যবহার করে: ডেভিড’স স্লিং ও অ্যারো। ইরান বা ইয়েমেনের হুতিদের হামলা প্রতিরোধে এগুলো ব্যবহার করা হয়।

গোল্ডেন ডোম এই সীমা ছাড়িয়ে আরও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত ও প্রতিরোধ করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

বাজিলচিক বলেন, এটি করতে হলে অনেক ধরনের প্রযুক্তি একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এবং এমন একটি কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেম দরকার হবে, যেটা এখনো তৈরি হয়নি।

এটা কি সম্ভব

এই ধরনের একটি জটিল ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই কঠিন এবং একসঙ্গে ব্যয়বহুলও বটে।

ওভাল অফিসে ট্রাম্প বলেন, এই প্রকল্প তাঁর মেয়াদের মধ্যেই শেষ করা সম্ভব। এর জন্য ধাপে ধাপে মোট ১৭ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার খরচ হবে, যার মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার ইতিমধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু সিবিও বলছে, শুধু মহাকাশভিত্তিক ব্যবস্থার জন্যই ২০ বছরে ৫ হাজার ৪০২ কোটি ডলার খরচ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পুরো প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ খেয়ে ফেলবে।

পেটিজন বলেন, এই সময়সীমা বাস্তবসম্মত নয়। এটি খুবই জটিল। প্রতিটি ধাপের আলাদা ঝুঁকি, খরচ ও সময়সীমা আছে। দ্রুত করতে গেলে ব্যয় ও ঝুঁকি আরও বাড়বে।

পেটিজন আরও বলেন, ‘আপনি সম্ভবত এমন কিছু তৈরি করবেন, যা পুরোপুরি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে না। এই প্রক্রিয়ায় ভুলত্রুটি হবেই এবং শেষ পর্যন্ত যা তৈরি হবে, তা হয়তো বড় ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রয়োজন পড়বে।’

‘গোল্ডেন ডোম’ তৈরির পরিকল্পনা একটি নতুন ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ শুরুর আশঙ্কাও সৃষ্টি করেছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষরা এখন এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেদ করা বা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় খুঁজে বের করতে নিজেদের প্রস্তুতি জোরদার করবে।

এ ছাড়া এই প্রকল্পকে ঘিরে আন্তর্জাতিক উদ্বেগও তৈরি হয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই পরিকল্পনা মহাকাশকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।’

যাঁরা সবচেয়ে ভয়ংকর পরিস্থিতি ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা নীতি নিয়ে গবেষণা করছেন, তাঁরা এসব উদ্বেগে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তাঁদের যুক্তি, সম্ভাব্য শত্রুরা এমনিতেই আক্রমণাত্মক অস্ত্রে অনেক বেশি বিনিয়োগ করছে।

বাজিলচিক বলেন, ‘গোল্ডেন ডোম আমাদের শত্রুদের কৌশলগত হিসাব পাল্টে দেবে। এটি তাদের আক্রমণ চালানোর সাহস কমাবে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে।’

নর্থ ক্যারোলাইনার মন্ট্রিট কলেজের লেখক ও অস্ত্র গবেষক উইলিয়াম ফোর্টসচেন বলেন, গোল্ডেন ডোম আংশিকভাবেও তৈরি হলে, তা ভয়ংকর পরিস্থিতি এড়াতে সাহায্য করতে পারে।

ফোর্টসচেন আরও বলেন, ‘তাহলে আমি অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারব। আমাদের এই ধরনের একটি প্রতিরক্ষাব্যবস্থার খুবই দরকার। গোল্ডেন ডোমই এর সমাধান।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: এই ব যবস থ ও চ ন র মত ব যবস থ র র র জন য প রকল প ধরন র প অন ক ব ন বল ন বলছ ন ব যবহ

এছাড়াও পড়ুন:

আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ

আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।

মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।

মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :

তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে

অর্থাৎ :

কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়

[অনুবাদ: লেখক]

অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:

হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে

অর্থাৎ :

এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য

তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।

আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫

মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :

সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি

অর্থাৎ :

হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।

উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।

অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।
ই–মেইল: [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ