দীর্ঘদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হাসি-আড্ডায় মেতেছিলেন তারা। কেউ তুলছিলেন সেলফি। নিজের সন্তানকে বন্ধুদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন কেউ কেউ। আবার মঞ্চে উঠে নির্দ্বিধায় গাইছিলেন গান, করছিলেন আবৃত্তি। 

গতকাল শুক্রবার আষাঢ়ের সন্ধ্যায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে হা-মীম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের ব্যাংকুয়েট হলে এমনই দৃশ্যের অবতারণা হয়। ‘আষাঢ়ে আমরা’– এই শিরোনামে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম ‘শতবর্ষী রাজেন্দ্র কলেজ: আমার ভালোবাসা’।

এদিন বিকেল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা পরিবার-পরিজন নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকেন। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ামাত্রই তাদের সঙ্গে করছিলেন গভীর আলিঙ্গন। নিজের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন বন্ধুদের। শুরু হয় গল্প-গুজব আর স্মৃতিচারণ। তারা যেন কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর সব ব্যস্ততা ভুলে গিয়েছিলেন। 

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী প্রকৌশলী শফিকুল হক তালুকদার। অনুষ্ঠানে সাবেক শিক্ষার্থীরা অংশ নেওয়ায় রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক শিক্ষক ও আয়োজনের প্রধান উদ্যোক্তা অধ্যাপক ড.

রানা চৌধুরী সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। 

রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ উপস্থিত সবাইকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, অনেকেই অনেক দূর থেকে ভালোবাসার টানে এসেছেন। তারা হয়তো ভালো কোনো আয়োজন ছেড়ে এসেছেন। কারণ হলো, এখানে এলে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে; অনেক গুরুজনের সঙ্গে দেখা হবে– এই আশায়। তাদের কারও সঙ্গে ভবিষ্যতে দেখা নাও হতে পারে। আমরা চাইব পরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী যেন আরও বেশি হয়।

এর পর শুরু হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতে সংগীত পরিবেশন করেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক বিষ্ণুপদ সাহা, রাহিন সুলতানা, শিল্পী সাহা, ফেরদৌসী নাজমা প্রমুখ। কবিতা আবৃত্তি করেন রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠান শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও প্ল্যাটফর্মের অন্যতম সদস্য ড. আবুল হাশেম।

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সমকালের প্রকাশক আবুল কালাম আজাদ, আমাদের সময়ের সম্পাদক আবু সাঈদ খান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু প্রমুখ। সভা সঞ্চালনা করেন কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) ফারুক ই আজম।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এ ক আজ দ র জ ন দ র কল জ র স ব ক শ ক ষ ন কল জ র স ব ক শ ক ষ র থ অন ষ ঠ ন

এছাড়াও পড়ুন:

৭০ শতাংশ করদাতার ‘জিরো ট্যাক্স’: বাস্তবতা নাকি কর ফাঁকি?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, দেশে রিটার্ন দাখিলকারীদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে ৭০ জনই শূন্য আয় দেখিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দেন। কিন্তু এই তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না অর্থ উপদেষ্টা, সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তাদের মতে, এত বড় সংখ্যক মানুষ করযোগ্য আয় না থাকার কথা বাস্তবসম্মত নয়। যারা শূন্য কর দেখাচ্ছেন, তাদের প্রকৃত আয় ও সম্পদের হিসাব খতিয়ে দেখা দরকার। 

প্রশ্ন উঠেছে, তারা কি সত্যিই করযোগ্য আয়ের বাইরে, নাকি আয় গোপন করে কর ফাঁকি দিচ্ছেন? বর্তমানে বাংলাদেশে কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ সেই অনুপাতে বাড়ছে না। কারণ রিটার্ন জমাদানকারীদের একটি বড় অংশ ‘জিরো ট্যাক্স’ দিচ্ছেন, অর্থাৎ কর পরিশোধ করছেন না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪৫ লাখ রিটার্ন দাখিলকারী থাকলেও তাদের মধ্যে প্রায় ৩১ লাখই শূন্য আয় দেখিয়েছেন। এই সংখ্যা শুধু চিন্তার কারণই নয়, বরং কর প্রশাসনের দুর্বলতা ও দেশের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার বড় সংকেত বহন করে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কাদের মধ্যে এই ‘জিরো ট্যাক্স’ প্রবণতা বেশি? দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে পাসপোর্ট, টেন্ডার বা ব্যাংক লোনের জন্য টিআইএন নিয়েছেন এমন অনেকে; ছোট ব্যবসায়ী, যারা নগদ ভিত্তিক লেনদেন করেন এবং হিসাব রাখেন না; অনলাইন উদ্যোক্তা, যারা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছাড়া লেনদেন করেন; মধ্যস্বত্বভোগী, কমিশনভিত্তিক আয়কারী, কিংবা এমন পেশাজীবীরা, যারা নিয়মিত ক্লিনিকে সেবা দেন কিন্তু রিটার্নে তা উল্লেখ করেন না। এদের বেশিরভাগই বাস্তবে করযোগ্য আয় করলেও তা গোপন করেন, রিটার্নে শূন্য আয় দেখান। অনেক সময় তারা কোনো হিসাব না দেখিয়ে শুধু টিআইএন রাখার খাতিরেই রিটার্ন জমা দেন।

এই পরিস্থিতি তৈরির পেছনে কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। যেমন দেশে কর সচেতনতার অভাব প্রকট, মানুষ মনে করে কর দেওয়ার পরও তারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায় না। কর ব্যবস্থায় এখনও দুর্নীতি ও হয়রানি ভয় থাকে বলে অনেকে ইচ্ছা করেও কর দিতে চান না। এনবিআরের নিজস্ব তথ্য যাচাই ব্যবস্থাও দুর্বল। তারা রিটার্নে দেওয়া তথ্য সত্য কি না তা খতিয়ে দেখার মতো প্রযুক্তি, ডেটাবেইজ বা জনবল নিয়ে এখনো শক্ত অবস্থানে যেতে পারেনি। 

আবার অনলাইন রিটার্ন দাখিল পদ্ধতি যতটা সহজ হয়েছে, যাচাই ততটা কড়াকড়িভাবে হচ্ছে না। কেউ একজন নিজের সম্পদ, ব্যাংক হিসাব বা গাড়ি থাকার পরও অনায়াসে ‘জিরো ইনকাম’ লিখে রিটার্ন জমা দিচ্ছেন। এটা কর প্রশাসনের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য এমন একটি সময়ে এসেছে, যখন রাষ্ট্র নিজস্ব আয়ের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে চাইছে। সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের চাপ বাড়ছে, অথচ লাখ লাখ মানুষ কর ফাঁকি দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করার জন্য কী করেছে এনবিআর? বাস্তবতা হলো, এনবিআর কেবল রিটার্নের সংখ্যা বাড়ানোতে খুশি, কিন্তু রিটার্নের মান বা সত্যতা যাচাই করার কোনও কাঠামোগত প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। এই ৭০ শতাংশ ‘জিরো ট্যাক্স’ দাখিলকারীদের মধ্যে কয়েক হাজার জনকে অডিট করলে দেখা যাবে, এদের অনেকেই প্রকৃতপক্ষে করযোগ্য আয় লুকিয়ে যাচ্ছেন।

তাহলে সমাধান কী? প্রথমত, টিআইএন নম্বরকে জাতীয় পরিচয়পত্র, ব্যাংক হিসাব, গাড়ি রেজিস্ট্রেশন, বিদ্যুৎ সংযোগ, প্রপার্টি রেজিস্ট্রেশনসহ সকল নাগরিক সুবিধার সঙ্গে ডিজিটালি সংযুক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা রিটার্নে শূন্য আয় দেখান, তাদের মধ্য থেকে নিয়মিত অডিট করতে হবে। তৃতীয়ত, কর সচেতনতা বাড়াতে হবে এবং করদানে উৎসাহ দিতে স্বচ্ছ ও গণমুখী ব্যয় দেখাতে হবে। যেমন আপনার করের টাকায় রাস্তাঘাট হয়েছে, স্কুল-হাসপাতাল গড়া হয়েছে- এই বার্তাটি জনগণের মনে গেঁথে দিতে হবে।

একই সঙ্গে কর ফাঁকির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। যে ব্যক্তি আয় গোপন করে, তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনোভাবেই যেন সে কর না দিয়ে পার না পায়। অন্যদিকে যারা নিয়মিত কর দেন, তাদের পুরস্কৃত করতে হবে, তাদের জন্য স্বতন্ত্র সুবিধা, বিশেষ সম্মাননা বা কর ছাড়ের ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে।

যদি ৩১ লাখ জিরো রিটার্ন দাখিলকারীর মধ্যে অর্ধেকও করযোগ্য আয় গোপন করে থাকেন, আর প্রত্যেকে গড়ে মাত্র ১০ হাজার টাকা করে কর দিতেন, তাহলে রাষ্ট্রের কোষাগারে ১৫০০ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আসতো। এই অর্থ দিয়ে দেশের শতাধিক উপজেলার সড়ক, স্কুল, ক্লিনিক আধুনিকায়ন করা সম্ভব হতো।

অর্থাৎ, জিরো ট্যাক্স শুধু একটা পরিসংখ্যান নয়, এটি একটি বিপজ্জনক ইঙ্গিত, যে আমাদের করব্যবস্থা এখনও আস্থা, জবাবদিহিতা ও নিয়ন্ত্রণহীনতায় ভুগছে। কর সংস্কারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তি ব্যবহার, তথ্য যাচাই ও জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন- সবই এখন সময়ের দাবি।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সন্দেহ যথার্থ। ৭০ শতাংশ করদাতার শূন্য আয় সত্যিই অস্বাভাবিক। এই সংখ্যার পেছনে লুকিয়ে থাকা সত্য উন্মোচন করা এখন শুধু এনবিআরের কাজ নয়, এটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক টিকে থাকার প্রশ্ন। সঠিক করদাতা চিহ্নিত করতে না পারলে কর ফাঁকির সংস্কৃতি আরও বাড়বে, সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হবেন, আর উন্নয়ন কেবল কাগজে থাকবে,মাঠে নয়। এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্তের, নইলে রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি আমরা হারিয়ে ফেলবো কর ন্যায়বিচারের শেষ ভরসাটুকুও।

লেখক: সাংবাদিক

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ