আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করতে গত সপ্তাহে ইরানের পার্লামেন্টে পাস হওয়া একটি বিলে আজ বুধবার অনুমোদন দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ খবর জানিয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে আইএইএর সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সহযোগিতার সম্পর্ক স্থগিত করল ইরান।

গত মাসে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর তেহরান আইএইএর সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধের হুমকি দেয়। তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক সংস্থাটি পশ্চিমা দেশগুলোর পক্ষ নিয়েছে এবং ইসরায়েলের বিমান হামলার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরছে।

এর এক দিন আগে আইএইএর পরিচালনা পর্ষদ ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) অধীনে নিজেদের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ আনার পক্ষে ভোট দেয়।

আরও পড়ুনইরানের পরমাণু প্রকল্প ধ্বংস নিয়ে ট্রাম্প কি তাহলে মিথ্যা বলেছেন৩০ জুন ২০২৫

নতুন আইনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আইএইএর যেকোনো পরিদর্শনের জন্য তেহরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন লাগবে।

আরও পড়ুনইরানের ‘সরিয়ে ফেলা’ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে০১ জুলাই ২০২৫

এদিকে সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বোমা বর্ষণে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনা ফর্দো গুরুতর ও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আরও পড়ুননতুন আলোচনায় বসতে যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই হামলার হুমকি থেকে সরে আসতে হবে: ইরান৩০ জুন ২০২৫আরও পড়ুনইরান কয়েক মাসের মধ্যেই সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন শুরু করতে পারে: আইএইএ২৯ জুন ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানে হামলায় মার্কিন-ইসরায়েলের লোকসানই সার

ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে সরাসরি হামলা চালানোর পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ের ঘোষণা দেন। ‘বোমা হামলায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা ধ্বংস করে দেওয়া’র পর ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে– ‘বিশ্ব এখন অনেক বেশি নিরাপদ’।

হামলার পর ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আসলে কতটা পিছিয়েছে, তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি বলেছেন, কংক্রিটের স্তরের গভীরে কী টিকে আছে– এটি সম্পর্কে গর্তগুলো খুব কমই বার্তা দেয়। ট্রাম্প প্রশাসন স্বীকার করেছে, অন্তত একটি স্থানে বাঙ্কার বাস্টার বোমা ফেলা হয়নি। কারণ এটি মাটির খুব গভীরে ছিল। ইরানের সেন্ট্রিফিউজ ও ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুতের ভাগ্য এখনও অজানা। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ক্ষতির পরিমাণ স্পষ্ট না হলেও বছরের পর বছর বিরাজমান স্বচ্ছ পরমাণু বিস্তার রোধ ব্যবস্থা এখন ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। 

সাম্প্রতিক হামলার আগ পর্যন্ত ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। ১৯৫০-এর দশকে মার্কিন পরমাণু শান্তি উদ্যোগের সহায়তায় এটি চালু হয়। পরবর্তী দশকগুলোতে এতে আরও কয়েকটি পারমাণবিক স্থাপনা যুক্ত করতে এর পরিসর বাড়ানো হয়।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সব দিক কয়েক দশক ধরে আইএইএ কর্তৃক সূক্ষ্ম নজরদারির অধীনে ছিল। দেশটি ১৯৬৮ সালে পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর করে; আর আইনত পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন ত্যাগ করা এবং সব পারমাণবিক উপকরণ আইএইএ সুরক্ষার অধীনে রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়।
২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প জেসিপিওএ (যৌথ ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা) থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি দাবি করেন, জেসিপিওএর চুক্তি অনুসারে ইরান ‘খুব কম দিয়ে খুব বেশি’ কিছু পেয়েছে। ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে চুক্তিটি রক্ষার জন্য বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞাগুলো পুনরায় আরোপ এবং ইরানের অর্থনীতি পঙ্গু করতে ‘সর্বোচ্চ চাপ’-এর প্রচারণা শুরু করে।

ওই চুক্তি থেকে ট্রাম্পের প্রত্যাহারের পরিণতি দ্রুত দেখা গিয়েছিল। চুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে ইরান ধীরে ধীরে দূরে যেতে শুরু করে। ২০২০ সালে ট্রাম্পের নির্দেশে বিমান হামলায় ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হন। তারপর তেহরান ঘোষণা করে, দেশটি আর পারমাণবিক চুক্তিতে বেঁধে দেওয়া কর্মপ্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।
অবাক হওয়ার কিছু নেই, ট্রাম্পের পদক্ষেপ ইরানের সঙ্গে যে কোনো নতুন আলোচনাকে আরও কঠিন করে তুলেছিল। দ্বিতীয়বার ট্রাম্প প্রশাসনের মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের সঙ্গে আলোচনা পুনরায় শুরুর চেষ্টা করেছিলেন এবং বেশ কয়েক দফা পরোক্ষ আলোচনাও হয়েছিল।

ইরানি নেতারা নতুন চুক্তিকে অবজ্ঞা করা হবে না কিংবা একতরফা পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না– এমন নিশ্চয়তা দাবি করেছিলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটন নমনীয়তা না দেখিয়ে বরং আরও কঠোর দাবি জুড়ে দেয়। ইরানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রস্তাবিত চুক্তিটি জেসিপিওএর চেয়ে কম অনুকূল ছিল এবং এটি এমন একটি দেশ থেকে এসেছিল, যার প্রতিশ্রুতি অবিশ্বাসযোগ্য প্রমাণিত হয়েছিল।
মার্কিন-ইসরায়েলি হামলা চলমান আলোচনাকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাকে প্রায় ধ্বংস করে দেয়। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইরান ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নির্ধারিত আলোচনা বাতিল করে এবং দেশটির প্রতিনিধিদের দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়। বোমা হামলার পরের দিনগুলোতে ইরানের সংসদ এনপিটি ত্যাগের জন্য আইন প্রণয়ন শুরু করে। যদি ইরান এ চুক্তিতে পৌঁছায়, তাহলে প্রত্যাহার-বিষয়ক বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের মূল চুক্তিটি ভেঙে ফেলতে পারে।

একটি চুক্তিতে পৌঁছানো অপরিহার্য, কিন্তু এ জন্য আলোচনায় আমেরিকান কূটনীতিকে বাস্তবতার দিকে ফিরে যেতে হবে। ওয়াশিংটনের উচিত ‘শূন্য সমৃদ্ধকরণ’-এর মতো সর্বোচ্চ দাবি পরিত্যাগ করা। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইরানের কোনো সমৃদ্ধকরণ ক্ষমতা নেই বলে জোর দেওয়া অপ্রয়োজনীয় ও অবাস্তব। জেসিপিওএ ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছে– কঠোরভাবে সীমিত সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি এবং জোরালো পর্যবেক্ষণ ইরানের বোমা তৈরির পথ কার্যকরভাবে বন্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত দিতে হবে, তারা নিরাপত্তা নিশ্চয়তা ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিনিময়ে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।
তেহরান তার পক্ষ থেকে ইঙ্গিত দিয়েছে, ন্যায্য চুক্তির প্রস্তাব পেলে তারা উচ্চ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ও ক্যাপ সমৃদ্ধকরণ স্তরের মজুত ত্যাগ করতে ইচ্ছুক, যদিও তারা সমৃদ্ধকরণের অধিকার সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

দিন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ একতরফা পদক্ষেপ নয়, কূটনীতি ও টেকসই আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা পারমাণবিক বিস্তার ঝুঁকি মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। এসব হামলা ছিল গুরুতর কৌশলগত ভুল। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কূটনীতির ক্ষেত্রে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি সমানভাবে ব্যাপক পুনঃপ্রতিশ্রুতির প্রয়োজন হবে।

ওলামাইড স্যামুয়েল: আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ; আলজাজিরা থেকে
সংক্ষেপে ভাষান্তরিত

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ইরানে হামলায় মার্কিন-ইসরায়েলের লোকসানই সার
  • ইরানের ‘সরিয়ে ফেলা’ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে
  • আরও উত্তপ্ত হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্ক
  • আলোচনা চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার চিন্তা বাদ দিতে হবে