জুলাই ২০২৪-এ বৈষম্যহীন সমাজের দাবিতে যে গণঅভ্যুত্থান হলো, তাতে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত ‘সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি’র জরিপ বলছে, ১৪৯ জন শ্রমিক আত্মাহুতি দিয়েছেন, যাদের ১৪৭ জন পুরুষ ও দু’জন নারী। তারা পরিবহন, কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীন দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট আর কিছুদিন পরেই ঘোষিত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ বাজেটে শ্রমিক সমাজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কী ঘটবে?

প্রশ্নটা ওঠার কারণ হলো, ২০২৩-এ প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে শ্রমশক্তি এখন ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। ২০১৮ সালের মার্চে প্রকাশিত শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তির আকার ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তির আকার বেড়েছে প্রায় এক কোটি। বছরে গড়ে প্রায় ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি যুক্ত হয় পুরোনো শ্রমভান্ডারে। তাদের মানসম্মত কর্মসংস্থান জোগাতে জাতীয় বাজেট অতীতে যথেষ্ট যত্নশীল ছিল, তা বলা যায় না।

বিগত সময়ে শ্রম খাতে বাজেটের আকার-আকৃতি
শ্রম খাতসংশ্লিষ্ট দুটি মুখ্য মন্ত্রণালয় হলো শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত পাঁচ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ২০২০-২১-এ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫-এ হয়েছে ৪৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় মোট বরাদ্দের আনুপাতিক হারের বিবেচনায় সেটি বাড়েনি একটুও।  
একই চিত্র প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও। টাকার অঙ্কে পাঁচ বছর আগে ছিল ৬৪২ কোটি আর ২০২৪-২৫-এ ১ হাজার ২১৭ কোটি। আনুপাতিক হিস্যায় বরাদ্দ বাড়েনি। এসবই হচ্ছে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কিত হিসাব। সংশোধিত বাজেটে এই মন্ত্রণালয়গুলোয় টাকার পরিমাণ আরও কমে গেছে।  শ্রমসংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত বাজেটবিষয়ক তথ্য থেকে এটি বলা যায়, অন্তত জাতীয় বরাদ্দের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই শ্রম খাত। বছরওয়ারি জাতীয় বরাদ্দের হিস্যায় শ্রমজীবীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অংশীদারিত্ব বাড়ছে না। তবে নিজেদের তৈরি শ্রম সংস্কার কমিশনের নিম্নোক্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা দিতে পারে। 

১.

স্থায়ী শ্রম সংস্কার কমিশন 
একটি স্থায়ী কমিশন সব শ্রমিকের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষাসহ শিল্প খাতের নানাবিধ বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। একটি সুষম পরিস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিল্প ও অর্থনৈতিক বিকাশে কার্যকর ও শক্তিশালী সংস্থা হতে পারে এ কমিশন। 

২. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি 
শ্রমিকের জীবনমান উন্নত করতে হলে শ্রমের ন্যূনতম মূল্য আগে ঠিক করতে হবে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও কার্যকরের মাধ্যমে মোট শ্রমশক্তির ৮৬ ভাগ যেখানে নিযুক্ত, সেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী পরিবারগুলোকেও দরিদ্র অবস্থা থেকে চূড়ান্তভাবে উদ্ধার করা যায়। জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি আইন ছাড়া বৈষম্য বিলোপের কথা ধোঁকাবাজির মতোই মনে হয়। 

৩. সামাজিক সুরক্ষা আইন ও নিরাপত্তা তহবিল
শ্রমিকের জন্য ‘জীবন চক্রভিত্তিক’ সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, স্বনিয়োজিত, কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে নিয়োজিতসহ সবার জন্য একটি সমন্বিত ‘সামাজিক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে এবং একটি ‘বাধ্যতামূলক সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল’ গঠন করতে হবে– যেখানে নিয়োগকারী, সরকার ও শ্রমিকরা যৌথভাবে অবদান রাখবে। এ তহবিল থেকে বেকারত্বকালীন শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বেকার ভাতা বা আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট দেওয়া হবে। 

৪. শ্রমিকের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা
শ্রম আইনে ৩৩ ধরনের পেশাগত রোগ-ব্যাধির কথা উল্লেখ আছে। শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকবান্ধব হাসপাতাল বা স্যাটেলাইট ক্লিনিক স্থাপন, শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা সুবিধা ও ন্যায্যমূল্যে ওষুধ সরবরাহ, শ্রমিকদের জন্য ‘স্বাস্থ্য বীমা’ এবং ‘স্বাস্থ্যকার্ড’ প্রদানের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা, যাতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। 

৫. ন্যাশনাল পেনশন স্কিম ও অবসরকালীন বিনোদন
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট ন্যূনতম পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পেনশন স্কিমের আওতায় সরকার কর্তৃক চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু করা জরুরি। শ্রমিকদের অবসরকালীন বিনোদনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নীতি প্রণয়ন এবং সরকারি সহায়তায় স্থানীয় পর্যায়ে/শিল্পাঞ্চলে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।

৬. শ্রমিকদের আবাসন সংকটের সমাধান
একটি ‘শ্রমিক আবাসন নীতি’ প্রণয়ন করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে শিল্প ও শ্রমঘন এলাকায় সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায় প্রয়োজনীয় বিধান অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিটি জেলায় বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ও অক্ষম শ্রমিকদের জন্য সরকারি উদ্যোগে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। 

৭. রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা
শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, শ্রম উৎপাদনশীলতার জন্যও খাবারের সংস্থান দরকার। সে জন্যই বর্তমান বাজারে শিল্পাঞ্চলসহ দেশের সবখানে রেশনের দোকান স্থাপন করতে হবে। সেখান থেকে শ্রমিক তাঁর কার্ড দেখিয়ে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করবেন। 

৮. অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ভাতা
শ্রম আইনের সুবিধাবঞ্চিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি নারী। তাদের জন্য অন্তঃসত্ত্বাকালীন সুবিধা নেই বললে চলে। বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে এ ধরনের সুবিধা চালু করা দরকার।

৯. শিল্পাঞ্চল/শহরাঞ্চলে কমিউনিটি ডে-কেয়ার
কর্মজীবী নারীর শিশুসন্তানদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগে সার্ভে পরিচালনা করে সরকারি-বেসরকারি অথবা যৌথ ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি শিল্পাঞ্চল বা কর্ম এলাকায় ডে-কেয়ার চালু করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। ভবিষ্যৎ সুস্থ প্রজন্মের জন্য এ বিধানের বিকল্প নেই। 

১০. শ্রমিক নিবন্ধন ও কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ
সঠিক ডেটাবেজ সঠিক পরিকল্পনার পূর্বশর্ত। শ্রমিকের দক্ষতা-যোগ্যতা বাড়ানোসহ প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে শ্রমিক সম্পর্কিত সঠিক তথ্য থাকতে হবে। এ বছরের বাজেট প্রণয়নে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

১১. দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান
বেকারত্ব রোধ, দেশ ও দেশের বাইরে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ, ঋণসহায়তা ও উদ্যোক্তা বিকাশমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও বৃত্তিমূলক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। 

১২. প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য জীবন বীমা সুবিধা
প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক জীবন বীমা চালু করা, যাতে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হলে পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়। অন্যদিকে ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানো বা দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ৎঋণ সুবিধা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করা এবং তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ 
সৃষ্টি করা।

১৩. শ্রমিকের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
শ্রমিকের ন্যায়বিচার পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা এবং মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অযথা হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনানুগ প্রাপ্য আদায়ে যেসব বাধা আছে, যেমন বলপ্রয়োগ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিক অধিকার আদায়ে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সব বাধা অপসারণ করতে হবে, যেমন হয়রানিমূলক মামলা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।  

সেকেন্দার আলী মিনা: নির্বাহী পরিচালক, সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস)

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর র ন য নতম ম শ রমশক ত দ র জন য ক র জন য বর দ দ র র লক ষ য য় বর দ দ প নশন স পর চ ল প রব স কল য ণ চ বছর ন করত ত করত তহব ল সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেট এবং শ্রমিকের আকাঙ্ক্ষা

জুলাই ২০২৪-এ বৈষম্যহীন সমাজের দাবিতে যে গণঅভ্যুত্থান হলো, তাতে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত ‘সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি’র জরিপ বলছে, ১৪৯ জন শ্রমিক আত্মাহুতি দিয়েছেন, যাদের ১৪৭ জন পুরুষ ও দু’জন নারী। তারা পরিবহন, কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা খাতের বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে বৈষম্যহীন দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বর্তমান সরকারের প্রথম বাজেট আর কিছুদিন পরেই ঘোষিত হতে যাচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, এ বাজেটে শ্রমিক সমাজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন কী ঘটবে?

প্রশ্নটা ওঠার কারণ হলো, ২০২৩-এ প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে শ্রমশক্তি এখন ৭ কোটি ৩৪ লাখ ১০ হাজার। ২০১৮ সালের মার্চে প্রকাশিত শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী শ্রমশক্তির আকার ছিল ৬ কোটি ৩৫ লাখ। অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে শ্রমশক্তির আকার বেড়েছে প্রায় এক কোটি। বছরে গড়ে প্রায় ২০ লাখ নতুন শ্রমশক্তি যুক্ত হয় পুরোনো শ্রমভান্ডারে। তাদের মানসম্মত কর্মসংস্থান জোগাতে জাতীয় বাজেট অতীতে যথেষ্ট যত্নশীল ছিল, তা বলা যায় না।

বিগত সময়ে শ্রম খাতে বাজেটের আকার-আকৃতি
শ্রম খাতসংশ্লিষ্ট দুটি মুখ্য মন্ত্রণালয় হলো শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গত পাঁচ বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ ২০২০-২১-এ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা, যা ২০২৪-২৫-এ হয়েছে ৪৬২ কোটি টাকা। অর্থাৎ পাঁচ বছরে ৩২ শতাংশ বেড়েছে। জাতীয় মোট বরাদ্দের আনুপাতিক হারের বিবেচনায় সেটি বাড়েনি একটুও।  
একই চিত্র প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও। টাকার অঙ্কে পাঁচ বছর আগে ছিল ৬৪২ কোটি আর ২০২৪-২৫-এ ১ হাজার ২১৭ কোটি। আনুপাতিক হিস্যায় বরাদ্দ বাড়েনি। এসবই হচ্ছে প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কিত হিসাব। সংশোধিত বাজেটে এই মন্ত্রণালয়গুলোয় টাকার পরিমাণ আরও কমে গেছে।  শ্রমসংশ্লিষ্ট দুটি মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত বাজেটবিষয়ক তথ্য থেকে এটি বলা যায়, অন্তত জাতীয় বরাদ্দের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই শ্রম খাত। বছরওয়ারি জাতীয় বরাদ্দের হিস্যায় শ্রমজীবীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অংশীদারিত্ব বাড়ছে না। তবে নিজেদের তৈরি শ্রম সংস্কার কমিশনের নিম্নোক্ত সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা দিতে পারে। 

১. স্থায়ী শ্রম সংস্কার কমিশন 
একটি স্থায়ী কমিশন সব শ্রমিকের মজুরি, সামাজিক সুরক্ষাসহ শিল্প খাতের নানাবিধ বৈরী পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। একটি সুষম পরিস্থিতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিল্প ও অর্থনৈতিক বিকাশে কার্যকর ও শক্তিশালী সংস্থা হতে পারে এ কমিশন। 

২. জাতীয় ন্যূনতম মজুরি 
শ্রমিকের জীবনমান উন্নত করতে হলে শ্রমের ন্যূনতম মূল্য আগে ঠিক করতে হবে। জাতীয় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ ও কার্যকরের মাধ্যমে মোট শ্রমশক্তির ৮৬ ভাগ যেখানে নিযুক্ত, সেই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মজীবী পরিবারগুলোকেও দরিদ্র অবস্থা থেকে চূড়ান্তভাবে উদ্ধার করা যায়। জাতীয় মজুরি কমিশন গঠন ও জাতীয় ন্যূনতম মজুরি আইন ছাড়া বৈষম্য বিলোপের কথা ধোঁকাবাজির মতোই মনে হয়। 

৩. সামাজিক সুরক্ষা আইন ও নিরাপত্তা তহবিল
শ্রমিকের জন্য ‘জীবন চক্রভিত্তিক’ সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক, স্বনিয়োজিত, কৃষি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পে নিয়োজিতসহ সবার জন্য একটি সমন্বিত ‘সামাজিক সুরক্ষা আইন’ প্রণয়ন করতে হবে এবং একটি ‘বাধ্যতামূলক সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল’ গঠন করতে হবে– যেখানে নিয়োগকারী, সরকার ও শ্রমিকরা যৌথভাবে অবদান রাখবে। এ তহবিল থেকে বেকারত্বকালীন শ্রমিকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বেকার ভাতা বা আনএমপ্লয়মেন্ট বেনিফিট দেওয়া হবে। 

৪. শ্রমিকের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা
শ্রম আইনে ৩৩ ধরনের পেশাগত রোগ-ব্যাধির কথা উল্লেখ আছে। শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকবান্ধব হাসপাতাল বা স্যাটেলাইট ক্লিনিক স্থাপন, শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রে চিকিৎসা সুবিধা ও ন্যায্যমূল্যে ওষুধ সরবরাহ, শ্রমিকদের জন্য ‘স্বাস্থ্য বীমা’ এবং ‘স্বাস্থ্যকার্ড’ প্রদানের প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা, যাতে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। 

৫. ন্যাশনাল পেনশন স্কিম ও অবসরকালীন বিনোদন
দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট ন্যূনতম পেনশন সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পেনশন স্কিমের আওতায় সরকার কর্তৃক চাঁদা দেওয়ার মাধ্যমে শ্রমিকবান্ধব পেনশন স্কিম চালু করা জরুরি। শ্রমিকদের অবসরকালীন বিনোদনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নীতি প্রণয়ন এবং সরকারি সহায়তায় স্থানীয় পর্যায়ে/শিল্পাঞ্চলে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপন করা যেতে পারে।

৬. শ্রমিকদের আবাসন সংকটের সমাধান
একটি ‘শ্রমিক আবাসন নীতি’ প্রণয়ন করে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে শিল্প ও শ্রমঘন এলাকায় সাশ্রয়ী আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালায় প্রয়োজনীয় বিধান অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিটি জেলায় বয়স্ক, অবসরপ্রাপ্ত ও অক্ষম শ্রমিকদের জন্য সরকারি উদ্যোগে আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। 

৭. রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা
শুধু বেঁচে থাকার জন্য নয়, শ্রম উৎপাদনশীলতার জন্যও খাবারের সংস্থান দরকার। সে জন্যই বর্তমান বাজারে শিল্পাঞ্চলসহ দেশের সবখানে রেশনের দোকান স্থাপন করতে হবে। সেখান থেকে শ্রমিক তাঁর কার্ড দেখিয়ে ন্যায্যমূল্যে খাদ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করবেন। 

৮. অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ভাতা
শ্রম আইনের সুবিধাবঞ্চিত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় আড়াই কোটি নারী। তাদের জন্য অন্তঃসত্ত্বাকালীন সুবিধা নেই বললে চলে। বাজেট বরাদ্দের মাধ্যমে এ ধরনের সুবিধা চালু করা দরকার।

৯. শিল্পাঞ্চল/শহরাঞ্চলে কমিউনিটি ডে-কেয়ার
কর্মজীবী নারীর শিশুসন্তানদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ ও স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য সরকারি উদ্যোগে সার্ভে পরিচালনা করে সরকারি-বেসরকারি অথবা যৌথ ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি শিল্পাঞ্চল বা কর্ম এলাকায় ডে-কেয়ার চালু করতে হবে এবং এ লক্ষ্যে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে হবে। ভবিষ্যৎ সুস্থ প্রজন্মের জন্য এ বিধানের বিকল্প নেই। 

১০. শ্রমিক নিবন্ধন ও কেন্দ্রীয় ডেটাবেজ
সঠিক ডেটাবেজ সঠিক পরিকল্পনার পূর্বশর্ত। শ্রমিকের দক্ষতা-যোগ্যতা বাড়ানোসহ প্রকৃত কল্যাণ নিশ্চিত করতে হলে শ্রমিক সম্পর্কিত সঠিক তথ্য থাকতে হবে। এ বছরের বাজেট প্রণয়নে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। 

১১. দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান
বেকারত্ব রোধ, দেশ ও দেশের বাইরে কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ, ঋণসহায়তা ও উদ্যোক্তা বিকাশমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা দরকার। এ ছাড়া প্রশিক্ষণ ও বৃত্তিমূলক কাজে নিযুক্ত শ্রমিকদের নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ভাতা প্রদানের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে বিশেষ তহবিল গঠন করতে হবে। 

১২. প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য জীবন বীমা সুবিধা
প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক জীবন বীমা চালু করা, যাতে দুর্ঘটনা বা মৃত্যু হলে পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়। অন্যদিকে ফিরে আসা শ্রমিকদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে তাদের অর্জিত দক্ষতা কাজে লাগানো বা দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র ৎঋণ সুবিধা ও পুনর্বাসন কর্মসূচি চালু করা এবং তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ 
সৃষ্টি করা।

১৩. শ্রমিকের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
শ্রমিকের ন্যায়বিচার পাওয়া নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা এবং মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি ও অযথা হয়রানি বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমবিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনানুগ প্রাপ্য আদায়ে যেসব বাধা আছে, যেমন বলপ্রয়োগ বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। শ্রমিক অধিকার আদায়ে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সব বাধা অপসারণ করতে হবে, যেমন হয়রানিমূলক মামলা থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।  

সেকেন্দার আলী মিনা: নির্বাহী পরিচালক, সেফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস)

সম্পর্কিত নিবন্ধ