শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্য জনমনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেখানে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য তার চেয়ে কম প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। কিন্তু এনসিপির নেতারা তা মেনে নিতে পারছেন না। তারা বরং সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে হাসনাতের বক্তব্যে জনপ্রতিক্রিয়া দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। তাদের বক্তব্য, প্রথমত, হাসনাত সে সমাবেশে এনসিপিকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাননি, গণঅভ্যুত্থানের নেতা হিসেবেই হেফাজত নেতারা তাঁকে ওই মহাসমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, হাসনাত তাদের মতে হেফাজত নেতাদের মতো নারীবিদ্বেষী কোনো কথা বলেননি, হেফাজতের মতো নারী কমিশন বাতিলের দাবি যেমন করেননি, তেমনি হেফাজত নেতারা কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশকে যেভাবে ইসলামবিদ্বেষী আখ্যা দিয়েছেন সেভাবে কোনো কথাও বলেননি।


সত্য, বিশেষত নারী কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের সম্পর্কে হেফাজত নেতারা যে চরম বিদ্বেষমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন, হাসনাত তেমন কথা বলেননি। কিন্তু তারই সামনে হেফাজত নেতারা যখন নারী কমিশনের প্রধানকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করছিলেন, যিনি জুলাই আন্দোলনে শুধু রাজপথেই ছিলেন না, হাসনাত ও তাঁর সতীর্থদের চিকিৎসারও ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, তখন হাসনাতের কেমন লেগেছে? তিনি কি তাঁর বক্তব্যে না পারুন অন্তত ব্যক্তিগত আলাপেও এর প্রতিবাদ করেছেন? এর কোনো আলামত আমরা পাইনি, হাসনাতের সহকর্মীরাও অন্তত এখন পর্যন্ত তা দেখাতে পারেননি।


দল গঠনের কয়েক মাস পরও গঠনতন্ত্র বা ঘোষণাপত্র প্রকাশ না করলেও, এনসিপি বরাবরই নিজেকে মধ্যপন্থি দল বলে দাবি করেছে; যদিও মধ্যপন্থি বলতে আদৌ কোনো দল হয় কিনা এ নিয়ে জনপরিসরে প্রশ্ন বিস্তর। যেমন অন্তত মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কোনো মধ্যপন্থা থাকতে পারে না। নারী এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারের মতো বিষয়গুলোতেও মধ্যপন্থাকে সুবিধাবাদিতা রূপে বর্ণনা করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। 


কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম শনিবারের সমাবেশটি যে চার দাবিতে ডেকেছিল সেগুলো হলো– নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল; সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল; হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার; ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে’ সরকারের ভূমিকা রাখা। এনসিপি হয়তো শেষ দুই দাবির সঙ্গে একমত, কিন্তু প্রথম দুই দাবি তো স্পষ্ট এনসিপির ঘোষিত অবস্থাবিরোধী। এনসিপি কি নারী কমিশন ও তার প্রতিবেদন বাতিল চায়? সংবিধানে বহুত্ববাদ তো তারাই প্রস্তাব করেছে। সেই দলের নেতা কীভাবে তাঁর বক্তব্যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘নারী সংস্কার নিয়ে যে কনসার্ন আপনাদের কাছে এসেছে, আমরা চাই ড.

মুহাম্মদ ইউনূস এই কনসার্নগুলোকে অতিসত্তর অ্যাড্রেস করবেন।’ প্রতিটি বিষয়ের তো একটা পরিপ্রেক্ষিত থাকে। এখানে তা হলো হেফাজতের দাবি যা সরাসরি নারীবিরোধী।


তিনি বলেছেন, ‘অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারগুলোর মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত হয় এবং আমাদের দেশের ধর্মীয় ও কালচারাল সম্মান যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সেই সংস্কারগুলোর ওপর জোর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ এ আসলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হেফাজতেরই বক্তব্যে সিলমোহর মারা।


বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য বিবিসিকে দেওয়া এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের কথা স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাবনা আছে। নারীবিষয়ক সবগুলোতে আমাদের আপত্তি নেই। স্পেসিফিক কয়েকটি বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। যেমন...উত্তরাধিকার আইন... সমানাধিকার... বিয়ে।’ 


বস্তুত যা ঘটার তাই ঘটেছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, এনসিপি হেফাজত ও বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ‘ঐকমত্য’ তৈরি করেছে। এটা তারা করছে মূলত দেশের এ মুহূর্তের প্রধান দল বিএনপির বিপরীতে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে। হেফাজত ও চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন শুধু বহু পুরোনো সংগঠনই নয়, ইসলামপন্থি শিবিরে যথেষ্ট শক্তিও ধারণ করে। সেই তুলনায় এনসিপি রাজনীতিতে নবিস মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই, ওই দুই সংগঠনকে প্রভাবিত করতে গিয়ে এনসিপিরই বরং প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সম্ভবত সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে হেফাজতের সমাবেশে হাসনাতের দেওয়া বক্তব্যে।


সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এনস প র ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

আওয়ামী লীগ ও ভারতের জন্য বাংলাদেশে একটা দাঙ্গা প্রয়োজন: গয়েশ্বর চন্দ্র রায়

আওয়ামী লীগ ও ভারতের জন্য বাংলাদেশে একটা দাঙ্গা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। তিনি বলেছেন, তাহলে রাজনৈতিক মোড়টা ঘুরতে পারে, নির্বাচন বানচাল হতে পারে। সে জন্যই জাতীয় স্বার্থে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গয়েশ্বর চন্দ্র এ কথা বলেন। জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের সনাতনীদের নিয়ে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটি এ সমাবেশের আয়োজন করে।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘শেখ মুজিব বিহারি-বাঙালি দাঙ্গা লাগিয়ে, বিহারি-বাঙালি আলাদা করে ১৯৭০–এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিলেন এই অঞ্চলের লোকদের বাঙালি বানিয়ে। এ ধরনের ঘটনা ঘটানোরও পেছনে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত পটু। দরকার হলে নিজের ঘরে আগুন দিয়ে দেবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা আরও বলেন, সাম্প্রদায়িকতার মাঝে একটা রাজনীতি আছে। এ ভারতবর্ষে, এ উপমহাদেশে অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কিছু গুজবের কারণে। ভারতে এসব দাঙ্গা এখনো চলমান। রাজনৈতিক কুটিলতার মধ্যে এ সাম্প্রদায়িকতা এখন না, হাজার বছর আগে থেকে আছে।

কোনো মানুষ কিংবা ধর্ম সাম্প্রদায়িক নয় উল্লেখ করে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কখনো কোনো কিছু মোকাবিলা করার জন্য দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করাতে হয়। যাতে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আরেক দিকে চলে যায়। এইচ এম এরশাদও ’৮৮ সালে এ কাজটা করেছিলেন। বাংলাদেশে মুসলমান নয়, হিন্দুরাই হিন্দুদের শত্রু, হিন্দুরাই হিন্দুদের ক্ষতি করে।

গয়েশ্বর আরও বলেন, ‘আমি হিন্দু–মুসলমানের ব্যবধান বুঝি না। আমি খারাপ আর ভালো লোকের ব্যবধান বুঝি। সৎ লোক–প্রতারকের ব্যবধান বুঝি। আমি সাম্প্রদায়িকতা পছন্দ করি না, অসাম্প্রদায়িক জীবন যাপন করতে পছন্দ করি।’

সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, ‘হিন্দু-মুসলমান আমরা একটা বৃহত্তর সংস্কৃতির অংশ। এখানে কোনো প্রভেদ ছিল না, কোনো বিভেদ ছিল না। এটাকে শেখ হাসিনা ভাঙতে চেয়েছেন।

দেখাতে চেয়েছেন এই দেশ বিভেদ–বিভাজনে ভরপুর। সুতরাং আমাকে সমর্থন করো। অন্য বিরোধী দল কাউকে সমর্থন করবে না। এ কারণে তিনি জোর করে জনসমর্থন ব্যতিরেকে দিনের ভোট রাতে করে ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের যেতে না দিয়ে নির্বাচন কমিশন দিয়ে ভোট করেছেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করেছেন।’

সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পূজা উদ্‌যাপন ফ্রন্টের সভাপতি অপর্ণা রায় দাস। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহাদী আমিন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, যুগ্ম মহাসচিব মীর সরাফত আলী, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী এবং জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামানিক।

সম্পর্কিত নিবন্ধ