হেফাজতের সমাবেশে হাসনাত: কে কাকে প্রভাবিত করল?
Published: 4th, May 2025 GMT
শনিবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশে সংগঠনটির বিভিন্ন নেতার বক্তব্য জনমনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, সেখানে এনসিপি বা জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহর বক্তব্য তার চেয়ে কম প্রতিক্রিয়া তৈরি করেনি। কিন্তু এনসিপির নেতারা তা মেনে নিতে পারছেন না। তারা বরং সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে হাসনাতের বক্তব্যে জনপ্রতিক্রিয়া দেখে বিস্ময় প্রকাশ করছেন। তাদের বক্তব্য, প্রথমত, হাসনাত সে সমাবেশে এনসিপিকে প্রতিনিধিত্ব করতে যাননি, গণঅভ্যুত্থানের নেতা হিসেবেই হেফাজত নেতারা তাঁকে ওই মহাসমাবেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, হাসনাত তাদের মতে হেফাজত নেতাদের মতো নারীবিদ্বেষী কোনো কথা বলেননি, হেফাজতের মতো নারী কমিশন বাতিলের দাবি যেমন করেননি, তেমনি হেফাজত নেতারা কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশকে যেভাবে ইসলামবিদ্বেষী আখ্যা দিয়েছেন সেভাবে কোনো কথাও বলেননি।
সত্য, বিশেষত নারী কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের সম্পর্কে হেফাজত নেতারা যে চরম বিদ্বেষমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্য রেখেছেন, হাসনাত তেমন কথা বলেননি। কিন্তু তারই সামনে হেফাজত নেতারা যখন নারী কমিশনের প্রধানকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করছিলেন, যিনি জুলাই আন্দোলনে শুধু রাজপথেই ছিলেন না, হাসনাত ও তাঁর সতীর্থদের চিকিৎসারও ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন, তখন হাসনাতের কেমন লেগেছে? তিনি কি তাঁর বক্তব্যে না পারুন অন্তত ব্যক্তিগত আলাপেও এর প্রতিবাদ করেছেন? এর কোনো আলামত আমরা পাইনি, হাসনাতের সহকর্মীরাও অন্তত এখন পর্যন্ত তা দেখাতে পারেননি।
দল গঠনের কয়েক মাস পরও গঠনতন্ত্র বা ঘোষণাপত্র প্রকাশ না করলেও, এনসিপি বরাবরই নিজেকে মধ্যপন্থি দল বলে দাবি করেছে; যদিও মধ্যপন্থি বলতে আদৌ কোনো দল হয় কিনা এ নিয়ে জনপরিসরে প্রশ্ন বিস্তর। যেমন অন্তত মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে কোনো মধ্যপন্থা থাকতে পারে না। নারী এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর অধিকারের মতো বিষয়গুলোতেও মধ্যপন্থাকে সুবিধাবাদিতা রূপে বর্ণনা করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে।
কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম শনিবারের সমাবেশটি যে চার দাবিতে ডেকেছিল সেগুলো হলো– নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবেদন বাতিল; সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল; হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার; ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধে’ সরকারের ভূমিকা রাখা। এনসিপি হয়তো শেষ দুই দাবির সঙ্গে একমত, কিন্তু প্রথম দুই দাবি তো স্পষ্ট এনসিপির ঘোষিত অবস্থাবিরোধী। এনসিপি কি নারী কমিশন ও তার প্রতিবেদন বাতিল চায়? সংবিধানে বহুত্ববাদ তো তারাই প্রস্তাব করেছে। সেই দলের নেতা কীভাবে তাঁর বক্তব্যে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘নারী সংস্কার নিয়ে যে কনসার্ন আপনাদের কাছে এসেছে, আমরা চাই ড.
তিনি বলেছেন, ‘অপ্রয়োজনীয় সংস্কারগুলোকে পাশ কাটিয়ে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারগুলোর মধ্য দিয়ে নারীদের অধিকার ও সম্মান নিশ্চিত হয় এবং আমাদের দেশের ধর্মীয় ও কালচারাল সম্মান যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সেই সংস্কারগুলোর ওপর জোর দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।’ এ আসলে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হেফাজতেরই বক্তব্যে সিলমোহর মারা।
বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য বিবিসিকে দেওয়া এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীবের কথা স্মরণ করা যায়। তিনি বলেছেন, ‘সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, প্রতিবেদনে এমন কিছু প্রস্তাবনা আছে। নারীবিষয়ক সবগুলোতে আমাদের আপত্তি নেই। স্পেসিফিক কয়েকটি বিষয়ে আমাদের আপত্তি আছে। যেমন...উত্তরাধিকার আইন... সমানাধিকার... বিয়ে।’
বস্তুত যা ঘটার তাই ঘটেছে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, এনসিপি হেফাজত ও বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে ‘ঐকমত্য’ তৈরি করেছে। এটা তারা করছে মূলত দেশের এ মুহূর্তের প্রধান দল বিএনপির বিপরীতে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর লক্ষ্যে। হেফাজত ও চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন শুধু বহু পুরোনো সংগঠনই নয়, ইসলামপন্থি শিবিরে যথেষ্ট শক্তিও ধারণ করে। সেই তুলনায় এনসিপি রাজনীতিতে নবিস মাত্র। স্বাভাবিকভাবেই, ওই দুই সংগঠনকে প্রভাবিত করতে গিয়ে এনসিপিরই বরং প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সম্ভবত সেটাই প্রতিফলিত হয়েছে হেফাজতের সমাবেশে হাসনাতের দেওয়া বক্তব্যে।
সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সংস্কারের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতির পর্বে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ জন্য সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।
চলতি মাসে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপকমিটির প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
গতকাল বুধবার ফ্রান্সের স্ত্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দপ্তরে প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন উপস্থাপনের বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ সফরে আসা প্রতিনিধিদলের প্রধান মুনির সাতোরি।
মুনির সাতোরি বলেন, ‘আমাদের সফরের দুটি উদ্দেশ্য ছিল। একটি হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করা ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মানবাধিকারের গুরুত্ব তুলে ধরা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, প্রায় বিস্মৃত হতে যাওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে থাকা। রোহিঙ্গা সংকট যাতে হারিয়ে না যায়, সে জন্য এটি ইইউর রাজনৈতিক এজেন্ডায় আবারও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজ নিয়ে মুনির সাতোরি বলেন, ‘এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতার প্রস্তাব করেছি।’
প্রতিনিধিদলের সদস্য ইজাবেল উইসেলার-লিমা বলেন, যখন বিশ্বে নাটকীয়ভাবে গণতন্ত্র অবনতির পথে, তখন বাংলাদেশ পথ পরিবর্তন করে দেখিয়েছে যে গণতন্ত্রের পথে যাওয়া যায়। তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্রের দিকে যাওয়ার। আর এ জন্য সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এটা আশা করা জরুরি যে সামনে নির্বাচন হবে এবং তা প্রতিযোগিতামূলক হবে, যা হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার এ জন্য চেষ্টা করছে।
রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে ইজাবেল বলেন, ‘কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির। সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা সংকটের কারণে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি মানুষ ভুলে যাচ্ছে। এ সংকট আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, মিয়ানমার তাদের দায়িত্ব নিচ্ছে না। আর বাংলাদেশও দরিদ্র দেশ। বাংলাদেশের নিজেরই বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে নেওয়া তাদের জন্য সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা সংকটের এখনকার চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ বর্তমানে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণে অবস্থায় রয়েছে।’
প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য আরকাদিউজ মুলারজিক বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবিরে সবচেয়ে বেশি মানবিক অনুদান আসে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো থেকে, যদিও আগে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা দিত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রতিশ্রুতি খুবই নগণ্য, এটি আশ্চর্যজনক এবং গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বদলে অনেক দূরে থাকা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোকে এর দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর বড় অংশগ্রহণকারী হওয়া উচিত ছিল। বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গেও কথা বলা উচিত। কারণ, বর্তমানে আমরা ভারতের সঙ্গে একটি চুক্তি নিয়ে দর–কষাকষি করছি।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য ক্যাটারিনা ভিয়েরা বলেন, এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশ ইতিহাসে দেশটি বর্তমানে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি একটি সুযোগ সত্যিকারের অগ্রগতির। শিগগিরই হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের ভেতরে গ্রহণযোগ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবাই নির্বাচনটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক দেখতে চায়। এ বিষয়গুলো শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের থেকে আসেনি, এসেছে নাগরিক সমাজ, ছাত্র ও যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকেও, যাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। তারা নিজেদের মধ্যে সংলাপের মধ্যে রয়েছে। যদিও অনুতাপের বিষয় হচ্ছে ধর্মীয়, লিঙ্গ ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু এবং নারীদের এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ নেই। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের সমাজ গঠনে এখানে উন্নয়নের সুযোগ রয়েছে।
আরকাদিউজ আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে সংস্কারে উৎসাহ, যারা সংস্কারে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ ও গণতান্ত্রিক কাঠামোয় গঠনমূলক সহযোগিতা করে ইইউ ভূমিকা রাখতে পারে। বিশ্ব যখন গণতন্ত্রের উল্টো পথে যাত্রা করছে, তখন বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের আশা করার অবকাশ রয়েছে। গণতন্ত্রের পথে আরও অনেক কাজ করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তায় বাংলাদেশ সামনে দিকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেবে বলে মনে করি। এটি এখন নির্ভর করছে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের প্রতি শান্তিপূর্ণ উপায়ে প্রতিশ্রুতি দেখাতে হবে।’
১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার উপকমিটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বাংলাদেশ সফর করে। এ সময়ে তারা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সমাজ সংগঠন, শ্রমিক প্রতিনিধি এবং মাঠপর্যায়ে কর্মরত বহুপক্ষীয় সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে।
এ ছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরও পরিদর্শন করে।