আতঙ্কে বিদ্যালয়ে যাননি মধুপুরে ‘মব ভায়োলেন্সের’ শিকার প্রধান শিক্ষক
Published: 4th, May 2025 GMT
টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ তুলে তাঁর কার্যালয়ে ঢুকে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন কয়েকজন অভিভাবক। গত বুধবার দুপুরের ওই ঘটনার পর আজ রোববার ছিল প্রথম কার্যদিবস। কিন্তু আতঙ্কে তিনি বিদ্যালয়ে যাননি।
জানতে চাইলে ওই প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মিথ্যা অভিযোগে মব ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছি। আতঙ্কে তো আছিই। শিক্ষকনেতাদের নিয়ে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব। পরে এ ব্যাপারে কী করা যায়, সিদ্ধান্ত নেব।’
প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, ‘এটি আমার বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। আমার মেয়েকে স্থানীয় এক যুবক উত্ত্যক্ত করত। তাকে বিভিন্ন সময় বোঝানো হয়েছে। কথা না শোনায় তাকে শাসন করা হয়েছিল। সেই ছেলে ষড়যন্ত্র করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তদন্ত হলে সত্য বেরিয়ে আসবে।’
বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিলে ওই প্রধান শিক্ষক আকাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। বুধবার দুপুরে হঠাৎ কয়েকজন নারী অভিভাবক তাঁর কক্ষে ঢুকে তাঁকে মারধর শুরু করেন এবং টেনেহিঁচড়ে তাঁর জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলেন। অভিভাবকদের অভিযোগ, ওই শিক্ষক তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন। এ সময় বিদ্যালয়ের এক নারী সহকারী শিক্ষকসহ কয়েকজন বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে অভিভাবকেরা তাঁদের ওপর ক্ষিপ্ত হন। পরে বিদ্যালয়ের মাঠে জড়ো হয়ে ওই নারীরাসহ অভিভাবকেরা প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রিফাত আনজুম। তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে অভিভাবকদের শান্ত করেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার আগে কোনো অভিভাবক বা শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের ব্যাপারে কখনো কোনো অভিযোগ করেনি। ওই দিন ১০–১৫ যুবক পাঁচ থেকে ছয় নারীকে নিয়ে বিদ্যালয়ে আসেন। যুবকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নারীরা হঠাৎ প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকে মারধর শুরু করেন। এ সময় তাঁরা শিক্ষকের পরনের কাপড়ও ছিঁড়ে ফেলেন। পরে তাঁরা গিয়ে প্রধান শিক্ষককে উদ্ধার করেন।
এ বিষয়ে অভিভাবকদের কারও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে মধুপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জোবায়ের হোসেন জানান, তাঁর কাছে কেউ এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ করেননি।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম ও নাজমুল ইসলামকে প্রাথমিক তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদন্তে দুই ধরনের তথ্য উঠে এসেছে। কিছু অভিভাবক প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে সন্তানদের সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ করেছেন। আবার প্রধান শিক্ষকের মেয়েকে উত্ত্যক্তের জেরে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তের প্রতিবেদন আজ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে। অধিকতর তদন্তের জন্য তিনি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেবেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত ঘটন র সহক র তদন ত উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
‘বিষাক্ত’ কর্মপরিবেশে টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ
কর্মক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল আলোচিত একটি বাক্য হলো—‘টক্সিক ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট’ বা ‘বিষাক্ত কর্মপরিবেশ’। কর্মক্ষেত্রে যদি বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি হয়, তা অনেকের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।
মূলত পাঁচটি কারণে একটি কর্মক্ষেত্র বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে। সেগুলো হলো বিষাক্ত নীতি ও পদ্ধতি, বিষাক্ত সংস্কৃতি, বিষাক্ত বস/ম্যানেজার, বিষাক্ত সহকর্মী ও বিষাক্ত উন্নয়ন সহযোগী/ক্লায়েন্ট।
উল্লিখিত পাঁচটি কারণের মধ্যে ‘বিষাক্ত সহকর্মী’ হলেন তাঁরা, যাঁরা প্রতিনিয়ত বিষবাষ্প ছড়ানোর মাধ্যমে পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রাখেন; যাঁরা নানান ছুতোয় আগুনে ঘি ঢেলে বসদের মাথা গরম করে নিজেরা ফায়দা লুটতে ও ফাঁকিবাজি করতে মরিয়া হয়ে পড়েন, যার প্রভাব পড়ে পুরো অফিসে ও অন্য কর্মীদের ওপর।
‘বিষাক্ত সহকর্মী’রা এটা চিন্তা করেন না, একটি অফিসে বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ডের ও ব্যক্তিত্বের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন, যাঁদের চিন্তাভাবনা, রুচিবোধ ও সহনশীলতা ভিন্ন ভিন্ন।
কর্মক্ষেত্রে সবাই সাধারণত একটি অভিন্ন লক্ষ্যে দিন শুরু করেন। কেউ কেউ আবার জীবিকার তাগিদে পাহাড়সম সমস্যা মাথায় নিয়েও অফিসে আসেন। এর মধ্যেও দেখা যায়—গুটিকয়েক সহকর্মীর অপ্রয়োজনীয় ও অপেশাদার আচরণ একটি ভালো কর্মপরিবেশ মুহূর্তেই বিষাক্ত করে তোলে।
এই আচরণ অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। ফলে অনেক দক্ষ ও সম্ভাবনাময় কর্মী এমন পরিবেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। যার বিরূপ প্রভাব পড়ে প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক অর্জন ও সুনামের ওপর। একসময় সেই প্রতিষ্ঠান ‘সেরা নিয়োগদাতা’ বা ‘এমপ্লয়ার অব চয়েস’ হিসেবে গড়ে ওঠার পথ থেকেও ছিটকে যেতে পারেন।
প্রশ্ন জাগে, একটি অফিসে ‘বিষাক্ত কর্মপরিবেশ’ কেন তৈরি হয়? এর জন্য দায়ী কে?
এই প্রশ্নের খুব নির্দিষ্ট উত্তর দেওয়া কঠিন। তবে অভিজ্ঞতা বলে—এটি সাধারণত গুটিকয় কর্মীর চিরায়ত অসভ্যতা, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কিংবা দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে ঘটে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরাও যথাযথ কর্তৃপক্ষকে কিছু জানান না, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।
তবু এমন একটি চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে অনেক কর্মী টিকে থাকার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে, প্রতিষ্ঠান ও কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তারা ধৈর্যের সঙ্গে সর্বোচ্চটা নিংড়ে দেন। এর ফলে প্রতিষ্ঠান তাঁদের অনেক সময় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে শনাক্ত করতে পারে।
তবে এটা সত্য—বিষাক্ত কর্মপরিবেশে কাজ করে টিকে থাকা যেমন কঠিন, তার চেয়ে কঠিন হলো মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা ও উৎপাদনশীলতা ধরে রাখা। দিন শেষে প্রতিষ্ঠান যে জবাবদিহি চায়, তা আসে মূলত অর্জিত ফলাফল থেকেই। তাই টিকে থাকার বাস্তবমুখী কিছু কৌশল নিচে তুলে ধরা হলো:
টিকে থাকার ৭টি কার্যকর কৌশল১. আবেগের সীমানা নির্ধারণ করুন:
বিষাক্ত সহকর্মীর আচরণ কখনোই ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না। নিজেকে বারবার মনে করিয়ে দিন—তাঁদের এসব আচরণ তাঁদেরই ব্যর্থতা, এর দায় আপনার নয়। গসিপ কিংবা দোষারোপের খেলায়ও জড়াবেন না। তাঁদের থেকে অহেতুক বিতর্ক এড়িয়ে চলুন।
২. অপেশাদার আচরণ নথিভুক্ত করুন:
বিষাক্ত সহকর্মীরা প্রায়শই অফিসের আচরণবিধি লঙ্ঘন করে থাকেন। সময়–সুযোগমতো তাঁদের আচরণ ও বক্তব্য লিখে রাখুন। কোনো প্রকার কারসাজি, মানসিক নির্যাতন বা তাচ্ছিল্যজনক ভাষা ব্যবহার করে থাকলে তার জন্য কাউকে শেয়ার করে সাক্ষী রাখুন ও যথাযথ রেকর্ড সংরক্ষণ করুন।
৩. অফিশিয়াল যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করুন:
অপেশাদার ব্যক্তিদের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় না গিয়ে ই-মেইল, অফিস চ্যাট বা গ্রুপ মেসেজিং বেছে নিন। প্রমাণ রাখার জন্য তারিখ, সময় ও বিষয়ের উল্লেখ করুন।
৪. অন্ততপক্ষে একজন সহায়তাকারী সহকর্মী খুঁজুন:
অফিসে বিশ্বাসযোগ্য সহকর্মী বেছে নিন, যার সঙ্গে পেশাগত সমস্যাগুলো ভাগ করে নিতে পারেন। তবে ব্যক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ না করাই শ্রেয়। প্রয়োজনে এইচআর বিভাগের একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তিকেও ঘটনাগুলো মৌখিকভাবে জানিয়ে রাখতে পারেন।
৫. নিজের কাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন:
নেতিবাচক পরিবেশ উপেক্ষা করে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন। সময়মতো কাজ সম্পন্ন করুন, অর্জিত ফলাফলগুলো রিপোর্ট করুন, যাতে আপনার অবদান দৃশ্যমান থাকে।
৬. নিজের যত্ন নিন ও মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন:
বিষাক্ত সহকর্মীদের চিন্তা অফিসের পর মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। কখনো অফিসের চাপ বাসায় টেনে আনবেন না। শারীরিক ব্যায়াম করুন, পরিবার ও বন্ধুদের বেশি করে সময় দিন, শখের কাজ করুন, গান শুনুন কিংবা বই পড়ুন। প্রয়োজনে কিছুদিনের ছুটি নিন।
৭. এক্সপোজার সীমিত ও নতুন সুযোগ অনুসন্ধান করুন:
বিষাক্ত সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত করুন। যদি কাজের ব্যাঘাত না ঘটে, তবে তাঁদের এড়িয়ে চলুন। ফেসিয়াল এক্সপ্রেশনে পেশাদার সৌজন্য বজায় রাখুন।
পাশাপাশি নিজের প্রফেশনাল সিভি আপডেট করুন, পেশাগত নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করুন এবং ভালো সুযোগ পেলে নতুন পথে এগিয়ে যান। বিষাক্ত পরিবেশের চাকরি ছাড়ার আগে এক্সিট ইন্টারভিউতে কর্তৃপক্ষকে সবকিছু লিখিতভাবে জানিয়ে দিন।
সবশেষে মনে রাখতে হবে—একটি বিষাক্ত কর্মপরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা প্রশংসনীয়। কিন্তু সেটা নিজের আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে ও মানসিক শান্তির বিনিময়ে নয়।
সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, সেটি দীর্ঘ মেয়াদে ক্যারিয়ার ও জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সচেতন থাকুন, নিজের অবস্থান মজবুত রাখুন। প্রয়োজনে নিজের ও প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি রক্ষায় নির্ভয়ে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিন।
এম এম মাহবুব হাসান, ব্যাংকার ও উন্নয়ন গবেষক
[email protected]