পার্থিব জাঁকজমক যেন আধ্যাত্মিকতার বাধা না হয়
Published: 7th, May 2025 GMT
উৎসবের কোলাহল, আতশবাজির শব্দ, ছোট্ট মসজিদের ওপরে উঁচু ভবনের ছায়া, কেনাকাটার উন্মাদনা, ফ্যাশন ও ভোগবাদের প্রতি আসক্তি—এসবই আমাদের আধুনিক জীবনের পরিচিত চিত্র। শিক্ষিত মানুষেরা কঠোর পরিশ্রম করে ডিগ্রি অর্জন করছে, কিন্তু তা প্রায়ই কাগজে লিখিত সম্মান, স্বীকৃতি, পদ–পদবি ও ক্ষমতার জন্য। বাড়িঘর ক্রমেই বড় ও ব্যয়বহুল হচ্ছে, দরিদ্ররা পিছিয়ে পড়ছে। পার্টি, সংগীত, নাচ, নারী–পুরুষের অবাধ মেলামেশা—এসব রাতের গভীরে তাহাজ্জুদ নামাজের আধ্যাত্মিকতা ভুলিয়ে দিচ্ছে।
নতুন জীবনধারা, ব্যয়বহুল শখ, ফ্যাশনের প্রতিযোগিতা—এসব এখন আমাদের দুনিয়ার অংশ। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তবে এই দুনিয়ার আকর্ষণ থেকে মুক্তি পাওয়া ও আখিরাতের জন্য জীবন গড়ার পথ কীভাবে খুঁজে পাব আমরা?
নবীজির (সা.
) আদর্শ
মহানবী (সা.)–এর যুগেও দুনিয়ার এই চাকচিক্য বিদ্যমান ছিল। তৎকালীন সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য চরমে পৌঁছেছিল, দরিদ্ররা উপেক্ষিত ছিল, দয়ার মূল্য কম লোকে বুঝত। ধনী কুরাইশরা ভাবত, তাদের সম্পদ দিয়ে তারা জান্নাত কিনে নিতে পারবে। আজকের দিনেও আমরা একই চিত্র দেখি, শুধু আধুনিকতার ছদ্মবেশে।
আরও পড়ুনসুরা আদিয়াত বলছে মানুষের স্বভাবের কথা০৩ মে ২০২৫হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সামনে এই দুনিয়াকে নিজের করে নেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু তিনি বারবার তা থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেছেন। তিনি দুনিয়ার দায়িত্ব ও আখিরাতের প্রতি নিষ্ঠার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করেছেন। তিনি খাবার পেলে তা উপভোগ করতেন, প্রয়োজনে রোজা রাখতেন। তিনি একাকী নামাজ ও প্রার্থনায় সময় কাটাতেন, আবার পরিবার ও সঙ্গীদের সঙ্গেও সময় ভাগ করে নিতেন। তিনি ইসলাম প্রচারে কঠোর পরিশ্রম করতেন, যুদ্ধে অংশ নিতেন, কিন্তু বিশ্রামের প্রয়োজন হলে ঘুমাতেন। বলা হয়, ‘তাঁর পায়ের কাছে দুনিয়া ছিল, কিন্তু তাঁর নামে একটি দিনারও (স্বর্ণমুদ্রা) ছিল না।’ তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর স্ত্রী আয়েশা (রা.)–কে তাঁর শেষ সাত দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দান করতে বলেছিলেন, যাতে আল্লাহ তাঁকে এই সম্পদের জন্য প্রশ্ন না করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩,০৯৮)
দুনিয়ার মোহ থেকে সতর্কতা
দুনিয়ার প্রতি আকর্ষণ থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। আমরা মাঝেমধ্যে বিনোদন, স্বীকৃতি, বড় বাড়ি বা বিলাসবহুল জীবনের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু এই আকর্ষণ আমাদের আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে নিয়ে যায়। আলী (রা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া তার প্রলোভন দিয়ে মানুষকে প্রতারিত করে, তার মিথ্যা আশায় মানুষকে ধ্বংস করে। এটি এমন এক নববধূর মতো, যার প্রতি সবার দৃষ্টি, সবার হৃদয় মুগ্ধ।’ (আবু নু’আইম, আল–হিলিয়াহ, ২/১৩৫-১৩৬)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়া অভিশপ্ত, এতে যা কিছু আছে, তা অভিশপ্ত, কেবল আল্লাহর স্মরণ, তাঁর নৈকট্য লাভের কাজ, জ্ঞানী ব্যক্তি ও জ্ঞানের শিক্ষার্থী ব্যতীত।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২৩২২)
আরও পড়ুননবী (সা.) যুগের ঐতিহাসিক ইবাদতগাহ০২ মে ২০২৫সত্যিকার মূল্যবান বস্তু কী
এখন সময় দানের। দান আমাদের সেসব দরিদ্রের কথা মনে করিয়ে দেয়, যাঁরা তাঁদের ধৈর্যের কারণে জান্নাতের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। এখন সময় জ্ঞান ভাগাভাগির; উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের অহংকারে অন্যদের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা উচিত নয়। এখন সময় শিশু ও দুর্বলদের প্রতি দয়া প্রদর্শনের, কারণ তাদের প্রার্থনা রিজিক বয়ে আনে।
নামাজকে ভুলবেন না, কারণ এটি মুমিন ও আল্লাহর মধ্যে এতখানি দূরত্ব কমায়, যতখানি কপাল ও জায়নামাজের মধ্যে দূরত্ব। সুন্নাহর ছোট ছোট অংশ পুনরুজ্জীবিত করুন, যা আমাদের জীবনকে অর্থপূর্ণ করে। আমাদের ইচ্ছা, মহত্ত্বের আকাঙ্ক্ষা, অপচয়শীল সম্পদ, অবিরাম পার্টি ও ফ্যাশনের প্রতি আসক্তি নিয়ন্ত্রণ করা ছাড়া আমাদের এখন আর উপায় নেই।
সঠিক পথে আছি কি
দুনিয়া ও আখিরাত দুটি পরস্পরবিরোধী শত্রু ও ভিন্ন পথ। যে দুনিয়াকে ভালোবাসে এবং তার প্রতি ঝোঁকে, সে আখিরাতের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে এবং তার শত্রু হয়। এ দুটি পূর্ব ও পশ্চিমের মতো, যে যত একটির কাছে যায়, অন্যটি থেকে ততই দূরে সরে যায়। এরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। (নাহজুল বালাগা, হিকমত ১০৩)
আমাদের ভাবতে হবে, আমরা আল্লাহর পৃথিবীতে কী করছি? আমরা কি সত্যিকারের পথিকের মতো আচরণ করছি? আমরা কি আমাদের চারপাশের প্রতি যথেষ্ট যত্নশীল, নাকি আল্লাহর স্মরণের পরিবর্তে শুধু নিজেদের স্মরণীয় করে রাখতে চাই? দুনিয়া সাময়িক, আখিরাত চিরস্থায়ী। আমরা এই দুনিয়ার জন্য কতটা কাজ করছি, আর আখিরাতের জন্য কতটা? এই দুনিয়া সীমিত, কিন্তু আমরা যা করি, অনুভব করি, বলি ও কাজ করি, তা আখিরাতে প্রতিফলিত হবে। মৃত্যুর পর সংশোধনের সুযোগ থাকবে না, কারণ সেই সুযোগ এখনই।
‘ডিসকভারিং ইসলাম’ আর্কাইভ থেকে
আরও পড়ুনকোরআন বোঝা কি কঠিন০২ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই দ ন য র স মরণ আল ল হ আম দ র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
আয়ের ভরসা নারী শ্রমিক, সুরক্ষায় শূন্যতা
অপারেটর হিসেবে কারখানায় পোশাক তৈরির সেলাইয়ের একেবারে প্রাথমিক কাজটি করেন ৩২ বছর বয়সী রুপা আক্তার। ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা থাকেন কারখানায়। বেতন পান ১৫-২০ হাজারের মধ্যে। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তারি পরীক্ষায় রক্তে ইনফেকশন ধরা পড়ে তার।
চিকিৎসক টানা কয়েক সপ্তাহ পরামর্শ নিতে বলেছেন, তবে ছুটির দিন ছাড়া কারখানা কামাই দেওয়ার সুযোগ নেই তার। কামাই দিলেই কাটা যাবে বেতন। শরীরে অসুস্থতা নিয়েই তাই নিয়মিত কারখানায় যেতে হচ্ছে থাকে। আর চিকিৎসার বাড়তি খরচের চাপে পড়ে দিশাহারা তিনি।
শুধু রুপা আক্তার নয়, পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করা নারী শ্রমিকদের প্রায় সবার গল্প প্রায় একই রকম।
রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমই-এর তথ্য (বায়োমেট্রিকস ডেটাবেজ অনুসারে) (জুন ২০২৪ পর্যন্ত) অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় ৩৩ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে ৫২ দশমিক ২৮ শতাংশই নারী শ্রমিক। সংখ্যার হিসাবে নারী শ্রমিক রয়েছেন ১৭ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫৯ জন।
এরমধ্যে শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা ইপিজেডে ৯০টিসহ সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই অঞ্চলে মোট ৫৫৯টি পোশাক কারখানা রয়েছে। ইপিজেডের বাইরে বিজিএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৪০১টি এবং বিকেএমইএ অন্তর্ভুক্ত কারখানার সংখ্যা ৬৮টি। এসব কারখানায় শ্রমিকদের প্রায় অর্ধেকের বেশিই নারী শ্রমিক। পোশাক কারখানার আয়ের সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখলেও নারীদের সুরক্ষার সঙ্কট রয়েছে।
কারখানাগুলোতে নারী শ্রমিকদের সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষা নিয়ে রয়েছে নানা প্রশ্ন। বেশিরভাগ শ্রমিকই মানবেতর জীবনযাপন করেন। রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তি পর্যায়ে সঙ্কট সমাধানে উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পোশাক খাতে কাজ করা প্রতি ১০ জন নারী শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ৬ জন কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকির শিকার হন। বিশেষ করে দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কাজ করা, গরম পরিবেশ, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার অভাব তাদের শারীরিকভাবে দুর্বল করে তোলে।
এছাড়া ব্র্যাকের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, নারী শ্রমিকদের ৭০ শতাংশই সন্তান লালন-পালনে প্রতিবেশীর সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানকে গ্রামে রেখে শহরে কাজ করতে হয়। এতে শিশুর বেড়ে ওঠা ব্যাহত হয়, আবার মায়ের মানসিক চাপও বাড়ে।
সাভারের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক রুপা আক্তার বলেন, “প্রতিদিন সকাল আটটায় কারখানায় যেতে হয়। সেখানে টানা ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করি। যা বেতন পাই, এই টাকায় সংসার, স্বামী-সন্তান আর অসুস্থ মাকে নিয়ে কোনও রকমে দিন চলে যায়। কিছু দিন ধরে আমি অসুস্থ। চিকিৎসার খরচ নিজেকে বহন করতে হচ্ছে। ঘর ভাড়া, খাওয়া, বাচ্চার পড়ার খরচ দিয়ে নিজের চিকিৎসার টাকা থাকে না।”
তিনি বলেন, “আমরা কাজ করি, কিন্তু বিপদে কেউ পাশে থাকে না। চাকরি করতে গিয়ে অসুস্থ হলে বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমাদেরই সব খরচ বহন করতে হয়। পরিবার-পরিজনই একমাত্র ভরসা।”
প্রায় সাত বছর ধরে আশুলিয়ার পোশাক কারখানায় কর্মরত তানিয়া আক্তার বলেন, “সকালে বের হলে বাচ্চাদের দেখার কেউ থাকে না। পাশের বাসার খালার কাছে রেখে যাই। কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হলে বা ছুটি চাইলে অনেক সময় সমস্যা হয়। সন্তান ছোট বলে মাঝেমধ্যেই আমাকে বকা শুনতে হয়।”
তিনি বলেন, “ভাড়া বাসায় থাকি, মাসে চার হাজার টাকা ভাড়া। তার ওপর ওষুধপত্র আর বাচ্চাদের খরচ জুটাতে হিমশিম খেতে হয়।”
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ও সোয়েটার্স ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন মিন্টু বলেন, “নারী শ্রমিকরা সব থেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। দুর্ঘটনা হলে মালিকরা দায় নিতে চায় না। অথচ এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা তাদেরই দায়িত্ব। শ্রম আইন প্রয়োগে কারখানাগুলোতে জবাবদিহি না থাকলে সুরক্ষা আসবে না।”
এই শ্রমিক নেতা বলেন, “অসংখ্য নারী শ্রমিক প্রতিদিন কাজের ঝুঁকি, স্বাস্থ্যঝামেলা আর পারিবারিক চাপে এগিয়ে যাচ্ছেন। তারা দেশের রপ্তানি আয়ের বড় অংশ গড়ে তুললেও নিজেরা নিরাপদ নন। পরিবারের সহায়তা হয়তো সাময়িক স্বস্তি দেয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধান নয়। নারী শ্রমিকদের প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উভয় দিকেই টেকসই উদ্যোগ নিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাভারের একটি পোশাক কারখানার কর্মকর্তা বলেন, “আমরা শ্রমিকদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। অনেক কারখানায় বীমা সুবিধাও চালু করা হয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও উৎপাদন ব্যয় সামলাতে গিয়ে সব কারখানায় একই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হয় না।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, “এখানে সরকারের ভূমিকা প্রধান। বিজিএমইএ এর করার কথা, তাদের দেখার কথা। দেশে আগে যে কারখানা ছিল, সেগুলোতে হাসপাতাল, স্কুল সবই থাকতো। এখন কেন নাই, সেটা দেখা, শ্রম আইনের মধ্যে যাতে এগুলো কার্যকর হয়, তা দেখার এক দিকে দায়িত্ব বিজিএমইএ এর ও সরকারের। সরকারের অবহেলা বা শ্রম পরিদর্শক যারা আছে, তাদের ঘাটতির কারণে এটা কার্যকর হচ্ছে না। তারপর ট্রেড ইউনিয়ন করতে দেওয়া হয় না। সেটা হলে শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তি থাকলে তা বাস্তবায়িত হতো। সেটিও একটি দুর্বলতা আছে। সবমিলিয়ে হচ্ছে না। আর এখানেই উত্তরণের উপায় লুকিয়ে।”
ঢাকা/এস