শওকত ওসমান ছিলেন একজন সংস্কারক। তাঁর সাহিত্যের রাজনৈতিক গভীরতা ও নৈতিক প্রতিবাদ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। এ সাহিত্য কেবল শৈল্পিক রচনাই নয়, মানবিক বিবৃতিও।

গতকাল বুধবার অমর কথাশিল্পী শওকত ওসমানের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত স্মরণসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড.

সুকোমল বড়ুয়া। প্রধান আলোচক ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও আমার দেশ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ এবং প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সময় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ। সভায় স্বাগত বক্তব্য দেন রয়েল ইউনিভার্সিটির ডিন অধ্যাপক ড. দীপু সিদ্দিকী।
সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া বলেন, শওকত ওসমান শুধু কথাশিল্পী নন, তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক, আধুনিকতা-সচেতন অন্তর্দর্শী। আমাদের দরকার তাঁকে চেতনার আলোয় নতুনভাবে পড়া, গবেষণার মাধ্যমে তাঁর হারিয়ে যাওয়া রচনাবলি উদ্ধার করা। তিনি বাংলা একাডেমিকে শওকত ওসমানের রচনাসমগ্র পুনঃপ্রকাশ, তাঁর নামে একটি সড়কের নামকরণ ও ‘শওকত ওসমান ইনস্টিটিউট’ গঠনের আহ্বান জানান।

প্রধান আলোচক সৈয়দ আবদাল আহমদ বলেন, শওকত ওসমানের সাহিত্য মানুষের মুক্তি ও মানবিক বোধের মুক্তচিন্তা নিয়ে। তার লেখা আজকের সমাজ-রাষ্ট্রের সংকটে আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। 

প্রকাশক ফরিদ আহমেদ বলেন, শওকত ওসমানকে বোঝার জন্য আমাদের কেবল পাঠক নয়, চিন্তক হয়ে উঠতে হবে। তাঁর ভাষা ও বক্তব্যে যে রাজনৈতিক গভীরতা ও নৈতিক প্রতিবাদ, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা হয়ে থাকবে। অনুষ্ঠানে শওকত ওসমানের ছেলে লেখক জাঁ-নেসার ওসমান আবেগঘন স্মৃতিচারণ করেন।

অধ্যাপক ড. দীপু সিদ্দিকী বলেন, শওকত ওসমানের সাহিত্য কেবল শৈল্পিক রচনাই নয়, বরং এক মানবিক বিবৃতিও। সেখানে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, রাজনৈতিক বন্দিত্ব, চিন্তার সংকট ও মানবিক প্রতিরোধ– সবই উঠে এসেছে সাহসের সঙ্গে। যখন লেখালেখি হয়ে ওঠে ক্ষমতার মুখোশ, তখন শওকত ওসমানের লেখনী হয়ে ওঠে বিবেকের ভাষা।

অনুষ্ঠানের শুরুতে শওকত ওসমানের জীবন ও সাহিত্যকর্ম নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর কবিতা আবৃত্তি করেন কবি রিমা চিশতী, আনিসুর রহমান, রফিক চৌধুরী ও অধ্যাপক দীপু সিদ্দিকী। সমাপনী পর্বে শওকত ওসমানের কালজয়ী উপন্যাস ‘ক্রীতদাসের হাসি’ থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠ করেন বাচিক শিল্পী আনিসুর রহমান, রিমা চিশতীসহ অনেকে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: শওকত ওসম ন র অন ষ ঠ

এছাড়াও পড়ুন:

টর্চলাইট

আমি অনেক হাঁটতে পারি। মাঝেমধ্যেই হল থেকে বের হয়ে শহরের রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটা ধরি। যদি এক জোড়া ডানা থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই ওড়ার উদ্দেশ্যেই বের হতাম। আমার এক জোড়া পা আছে। তাই আমি হাঁটি। প্রায়ই ক্লাসে যাই না। মাঝেমধ্যে মিডটার্ম মিস করি। তারপর সেমিস্টারের শেষের দিকে বাবা এসে স্যার আর ম্যাডামদের সঙ্গে আলাপ করেন। বলেন, ‘আমার ছেলেটা অসুস্থ, দেখেন কিছু করা যায় কি না।’ প্রতি সেমিস্টারেই দেখা যায় একজন–দুজন মিডটার্ম মেকআপ দেয়, আমিও তাদের সঙ্গে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। কোনো কোর্সে কোনোমতে পাস করি। কোনো কোনো কোর্সে ফেল করে, পরের বছর আবার পরীক্ষা দিই। এভাবে ‘কোনোমতে’ আমি এখনো টিকে আছি। তিন বছর ধরে দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার পর্যন্ত সব কোর্স শেষ করে এখন চতুর্থ সেমিস্টারের কোর্স নিচ্ছি। দুইবার পরের ব্যাচের ছাত্রদের সঙ্গে নতুন করে ভর্তি হওয়ায় পরপর তিন ব্যাচের ছেলেমেয়েরাই আমাকে চেনে।

আমার চোখ দুটো ঘোলাটে। মণিটা ঠিক বাদামিও নয়, আবার কালোও নয়। চোখের সাদা অংশে বাদামি রঙের ছোপ ছোপ দাগ। আয়নায় নিজের চেহারা দেখে নিজেই বুঝতে পারি না, চোখ দুটো ঠিক কোন দিকে তাকায়। মাথায় চুল উঠলেই মনে হয় শরীরে শত্রুরা বেড়ে উঠছে। আরেকটু বাড়তে দিলেই আমার সব শক্তি শুষে খেয়ে ফেলবে। তাই আমি ঘন ঘন মাথা ন্যাড়া করি। প্রায়ই নাপিতের কাছে গিয়ে গালে থুতনিতে ঘাসের মতো বিচ্ছিন্নভাবে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দাড়ি–গোঁফ কামিয়ে আসি। পলাশীর মোড়ে নাপিত একদিন বলেই বসল, ‘সকালবেলাই দাড়ি কামাইয়া গেলেন, আবার বিকালে কী?’ শরীরের আর অন্য কিছুর ব্যাপারে যত্নবান না হলেও দাড়ি–গোঁফ কামানো এবং চুল ফেলে দেওয়ার ব্যাপারে আমি খুব যত্নবান।

এসএসসি আর এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। কীভাবে করেছিলাম, তা অবশ্য জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েও কেন হেলায় নষ্ট করছি, এ নিয়ে প্রতিদিন আমাকে অনেকের কাছে অনেক কথা শুনতে হয়। তাই আমি পারতে কারও সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলি না। কিন্তু আমার বাবা নাছোড়বান্দা। তিনি প্রায়ই ফরিদপুর থেকে ঢাকায় পৌঁছে সোজা হলের ভেতর চলে আসেন। হলের বড় ভাইদের সঙ্গে কথা বলেন। সবাইকে বোঝান, আমি অসুস্থ। সবাই যখন জিজ্ঞেস করে কী অসুস্থতা, উনি বলেন, মানসিক অসুস্থতা। আশপাশে বেশ কয়েকজন আমার সঙ্গে মিশে বোঝার চেষ্টা করেছে আমার সমস্যাটা কী। কেউই সন্তুষ্ট হওয়ার মতো উত্তর পায়নি। অস্বাভাবিক রকম চুপচাপ থাকায়, কোনো রকম প্রতিক্রিয়া না দেখানোয় এবং এমনকি নিজের প্রয়োজনীয় বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকায় অনেকেই দু–একটা কথা বলার পর আর কোনো কথা বলার আগ্রহ পায় না। ঘরের ভেতর আসবাবপত্রের মতো আমাকেও একটি জড় পদার্থ মনে করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। কেউ আর মনোযোগ দেয় না। প্রথম দিকে আমাকে অদ্ভুত লাগলেও প্রতিদিন একই রকম দেখে এত দিনে তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন এমন হয়েছে যে মাঝেমধ্যে যখন রাতে ফিরে আসি না, কেউ আমার খোঁজও নেয় না। কোথায় গিয়েছিলাম, কেন গিয়েছিলাম কেউ জানতেও চায় না। এতে আমার জীবন আরও সহজ হয়েছে হয়তো।

আমি ঘন ঘন মাথা ন্যাড়া করি। প্রায়ই নাপিতের কাছে গিয়ে গালে থুতনিতে ঘাসের মতো বিচ্ছিন্নভাবে গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দাড়ি–গোঁফ কামিয়ে আসি। পলাশীর মোড়ে নাপিত একদিন বলেই বসল, ‘সকালবেলাই দাড়ি কামাইয়া গেলেন, আবার বিকালে কী?’

হলে যে রুমে থাকি সে রুমে আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন থাকে। তারা সবাই চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। আর আমি চতুর্থ বর্ষে এসেও দ্বিতীয় বর্ষের। এর মধ্যে একজন ছাত্র আছে বাণিজ্য অনুষদের। নাম সাকিব। সাকিব ছেলেটা সব সময় ট্রাউজার আর টি–শার্ট পরে থাকে। মাথায় থাকে একটা ক্যাপ। সকালে উঠে ব্যায়াম করতে যায়। ফিরে এসে গোসল করে ক্লাসে যায়। ক্রিকেট খেলে। সেদিন সে একটা উইন্ডব্রেকার জ্যাকেট আর একটা স্লিপিং ব্যাগ কিনে এনে সবাইকে দেখাচ্ছিল। সে নাকি নেপালে ট্রেকিংয়ে যাবে। দারুণ উৎসাহ। আমার সাকিবের এই উৎসাহ দেখে খুব ভালো লাগল। যদিও নিজে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলিনি, বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম অন্যদের সঙ্গে কথোপকথন আর আড় চোখে দেখছিলাম স্লিপিং ব্যাগটা।

সেদিন রাতে ১০টার দিকে আমি বের হয়ে গেলাম হল থেকে। ঠিক করলাম, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কল্পনা করব আমি পাহাড়ে উঠছি। হেঁটে হেঁটে শাহবাগ মোড়ে এসে দেখি লোকজন ভিড় করে ক্রিকেট খেলা দেখছে বড় স্ক্রিনে। পাকিস্তান–বাংলাদেশ খেলা। বাংলাদেশ ব্যাটিং করছে। আমি প্রস্তুতি নিলাম। শুরু হলো কল্পনা। গন্তব্য কেওক্রাডংয়ের চূড়া। প্রথম ১০-১৫ মিটার পথের ঢাল কম। তারপর মাঝারি ঢাল। ৩০ মিটার একটানা উঠে একটু জিরানোর জন্য দাঁড়ালাম। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের পাদদেশে অনেক মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবাইকে একটু আগেই টিভি স্ক্রিনের সামনে দেখে এসেছি তালি দিচ্ছিল ছক্কা পেটানোয়। এখন আমার সাফল্যে তারা তালি দিচ্ছে আর চিৎকার করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তালির শব্দ অন্য পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করছে। উল্লাস জানানোর শব্দ এলেই পাহাড়ে ওঠা থামিয়ে দিয়ে উল্লসিত জনতার দিকে ফিরে হাত উঁচিয়ে দুই আঙুল দিয়ে ভি চিহ্ন দেখাচ্ছি। এভাবে একে একে ধাপ পেরিয়ে ওপরে উঠি আর কিছুক্ষণ আনমনে নিচের দিকে সাপের মতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে যাওয়া নদীটার দিকে তাকাই। একসময় এত ওপরে উঠে গেলাম যে নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের আর দেখা গেল না। তাদের শব্দ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে লাগল। একটা খাড়া ঢাল পেয়ে এক প্রান্তে আংটা লাগানো একটি বিশেষ ধরনের ট্রেকিংয়ের দড়ি ওপরের দিকে ছুড়ে একটা শক্ত পাথরে আটকালাম, তারপর ওটা বেয়ে ওপরে ওঠা শুরু করলাম। আরেকটু হলেই পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম, এবার নিচের থেকে মানুষেরা উল্লাস প্রকাশ করবে। কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে গেল কারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না। ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম। তাকিয়ে রইলাম নিচের নদীটার দিকে। কে যেন আমাকে পেছন থেকে ডাকল। তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশ। তখন আমি কোনো একটা ফুটওভারব্রিজের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে আছি। ব্রিজের নিচ দিয়ে চলে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে চলতে থাকা বাস, গাড়ি, ট্রাক।

এখানে কী করো?

পাহাড়ে উঠছি।

এটা তো ব্রিজ।

ব্রিজ ভাবলে ব্রিজ, পাহাড় ভাবলে পাহাড়।

নাম কী?

সাকিব।

এখানে কী?

বললাম না একবার, কেওক্রাডংয়ে মানুষ কেন আসবে?

পুলিশ আমার শার্টের কলার ধরে আমাকে দাঁড় করালেন। চলো, থানায় চলো।

আমি মাথা নিচু করে ওনার সঙ্গে হাঁটা ধরলাম। কোনো বাধা দিলাম না দেখে ওনার একটু সন্দেহ হলো। ভালোমতো আমার চেহারা দেখলেন। অন্যদের মতো ওনারও বোধ হয় মনে হলো আমার মাথা খারাপ। জিজ্ঞেস করলেন, বাসা কোথায়?

হলে থাকি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র?

হ্যাঁ।

এত রাতে এখানে কী?

খেলা দেখতে বের হয়েছিলাম। তারপর মনে করলাম আজকে কেওক্রাডংয়ে উঠব। তাই কল্পনা করতে করতে হাঁটছিলাম।

কী!

সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিশ্বাস করবেন কি করবেন না বুঝতে না পেরে খুব আজব একটা চাহনি দিলেন সেই পুলিশ। ওয়াকিটকিতে কার সঙ্গে যেন নিচু স্বরে বললেন, ‘পাগল মনে হয়।’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এত রাতে বাইরে ঘোরা ঠিক না। খেলা শেষ। ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যাও। আমি বললাম, আচ্ছা। তারপর হাঁটা শুরু করলাম। ওই পুলিশ আমাকে থামিয়ে বললেন, ঢাকা ইউনিভার্সিটি এদিকে না, ওই দিকে। আমি তাঁর নির্দেশমতো উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

হাঁটতে কোন দিকে যাচ্ছিলাম জানি না। যখন ভোরের আজান দেওয়া শুরু করল, দেখলাম আমি ফার্মগেটের দিকে। রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে কয়েকজন।

সেদিন সেই অভিযানটা পুরোপুরি শেষ করতে পারিনি ওই পুলিশের জন্য। পরদিন ক্লাসে যেতে পারিনি। সেদিন মিডটার্ম পরীক্ষার ডেট দিয়েছিল, কিন্তু আমি জানতাম না। পরের সপ্তাহে ক্লাসে গিয়ে জানলাম ক্লাস বাতিল হয়েছে। কারণ, বিকেল চারটায় পরীক্ষা। এক ঘণ্টায় আর কী প্রস্তুতি নেব। তাই পরীক্ষা দিতে গেলাম না।

এ ঘটনার কয়েক দিন পর সকালের দিকে টিভি রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখি একটা হিন্দি গান দেখাচ্ছে, শাহরুখ খান একটা সাদা ক্যারাভান চালাচ্ছেন আর তাঁর পাশে বসা লম্বা চুলওয়ালা একজন গ্রাম্য বাউল। গান গাইতে গাইতে গ্রামের পথ দিয়ে যাচ্ছেন। পথে পড়ছে ভেড়ার পাল, গ্রামের মানুষের গোসলের দৃশ্য, মেয়েদের মাথায় পানি নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে গান গাইতে গাইতে এই ছুটে চলা দেখতে আমার ভীষণ ভালো লাগল। সিনেমাটা দেখতে বসে গেলাম। সিনেমাটির নাম স্বদেশ। শাহরুখ খান নাসার একজন বিজ্ঞানী। চাকরি থেকে ছুটি নিয়ে এসে ইন্ডিয়ার একটা গ্রামে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দিনযাপন শুরু করেন। ঘটনাক্রমে গ্রামের জীবনের নানান সমস্যা সমাধানের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলেন। বিদ্যুতের অভাবে সেচ দিতে না পারা কৃষকদের জন্য একটা হাইড্রোইলেকট্রিক পাম্পের ব্যবস্থা করে দেন। গ্রামের মানুষের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে যান যে শেষে গিয়ে দেখা যায় নায়ক সেখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিনেমাটা দেখে আমার এত ভালো লাগে যে তার পরদিন সকালে উঠে আমি আবার হাঁটা শুরু করি। সেদিন সারা দিন আমি হয়ে যাই নাসার বিজ্ঞানী। মানুষের সুখে–দুঃখে তাদের পাশে দাঁড়াই। প্রতিটি দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করতে করতে কাটিয়ে দিই। ফিরতে ফিরতে যখন সন্ধ্যা। হলে এসে জানতে পারি বাবা এসেছিলেন এবং তিনি আমাকে খুঁজতে ডিপার্টমেন্টে গেছেন। রুমে ফিরে একটা ঘুম দিই। রাত ১০টায় যখন ঘুম ভাঙে, দেখি বাবা আমার পাশে শুয়ে আছেন। সকালে বাবা জিজ্ঞেস করেন, ‘কই গেছিলি?’ আমি জবাব দিইনি। তখনো আমি আগের দিনের স্বপ্নে বিভোর ছিলাম।

আমার ক্লাসে একজন সহপাঠী আছে। নাম হায়দার আলী। দুই বছরের জুনিয়র। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হলেও সিট না পাওয়ার কারণে এখনো ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সঙ্গে গণরুমে থাকে। প্রায়ই ক্লাসে না গেলে ক্লাসে কী পড়ানো হয়েছে আমাকে খবর দেয়। ক্লাস নোট জোগাড় করে দেয়। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে পড়ার জন্য বই–খাতা নিয়ে চলে আসে। হায়দারকে নিয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েরা অনেক ঠাট্টা করে। গায়ের রং কালো বলে অনেকে ওকে ডাকে ‘হায়দার কালী’ বলে। ছেলেটা অনেকবার শিক্ষকদের বলে চেষ্টা করেছিল ডিপার্টমেন্ট বদলাতে, কিন্তু পারেনি। ওর নাকি বিষয়টা খুব কঠিন লাগে। পড়াশোনার ধরন ও পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। মুখ গোমড়া করে ঘুরে বেড়ায়। প্রায়ই দেখি, সে তার গ্রামে একটা লাইব্রেরি বানানোর জন্য এখানে–ওখানে ছোটাছুটি করছে।

এক প্রবাসী বাংলাদেশি হায়দারকে বই সংগ্রহ করতে সাহায্য করেন। নাম মাহবুবুল আলম। মাহবুব ভাই আমেরিকায় থেকেও দেশে বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। হায়দারের গ্রামের লাইব্রেরি তাঁর অন্যতম প্রজেক্ট। বাংলাদেশে এসে মাহবুব ভাই একদিন দেখা করতে এসেছিলেন হায়দারের সঙ্গে। ভদ্রলোক বিজনেস ফ্যাকাল্টির ফুডকোর্টে এসে ফোন দিয়ে বলেছিলেন সেখানে দেখা করতে। হায়দারের সঙ্গে আমিও ছিলাম। ফ্যাকাল্টির গেটের সামনে এসে হায়দার থেমে গেল। ফোন করে মাহবুব ভাইকে বলল বাইরে এসে দেখা করতে। ফুডকোর্টে ঢোকার ইচ্ছা তার ছিল না। ফুডকোর্টের খাবার বাইরের তুলনায় দামি। বেশির ভাগ ফাস্ট ফুড পাওয়া যায়। বুঝতে পারছিলাম এ রকম জায়গার প্রতি হায়দারের একটি ভীতি বা গভীর অনিচ্ছা কাজ করে। বোধ হয় হায়দার ভাবে, শহরের সব মেধাবী, তেজোদীপ্ত, উচ্চবিত্ত, ও ঔদ্ধত্য মানুষেরা এখানে আসে, খায়, আড্ডা দেয়। তাদের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে না। হায়দারের কাছে বা আমার কাছে এসব দামি রেস্টুরেন্ট তেমন কোনো অর্থ বহন করে না। যাদের কাছে অর্থ বহন করে, তারা আবার মনে করে আমাদের বুঝি এখানে আসার খুব ইচ্ছা, শুধু কিনে খেতে পারি না বলে ঈর্ষা করি ওদের। তাদের এ রকম ভাব দূর থেকে দেখে আমি বেশ মজা পাই। আমি অবশ্য হায়দারের মতো অত ভয় পাই না। আমাকে যেতে হলে আমি ভেতরে চলে যাব। আমার ধরন আর হায়দারের ধরন এক নয়। আমাকে সবাই প্রচলিত অর্থে মানসিকভাবে অসুস্থ হিসেবে জানে। হায়দারকে জানে অন্যভাবে। হায়দার মানসিকভাবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ। তার ভয় আছে, লজ্জা আছে, সমাজের বিশেষ শ্রেণির বিশেষ ধরনের মানুষের প্রতি তার রাগ ক্ষোভ ভীতি দুই–ই আছে। মেয়েদের দেখলে সে দৌড়ে পালায়, কথা বলতে এলে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে। আমার এ রকম কিছু নেই। আমি নির্বিকার কথার উত্তর দিই। নিজে থেকে প্রশ্ন করি না। জবাব দিতে ইচ্ছা না করলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। ফ্যাকাশে গালের কাটা দাগটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, বিশ্রী বাদামি দাগওয়ালা ঘোলাটে চোখ তুলে আমি যেই নির্লিপ্ত চাহনি দিই, তাতে সবাই মনে করে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ। আর হায়দার মাথা নিচু করে রাখে, কেউ খেপালে খেপে যায়। চেহারা দেখে কষ্ট লুকানোর চেষ্টা বোঝা যায়। সে গোপনে বাথরুমে গিয়ে কাঁদে। আমি কাঁদি না। মানসিকভাবে অসুস্থ—এ ভাবনাটা কারও মাথায় গেঁথে গেলে আমাকে আর কেউ বিরক্ত করে না। আমার শীতল চাহনির মধ্যে কেউ মজা খুঁজে পায় না। কাউকে রাগালে যদি সে না রাগে, প্রশ্ন করলে যদি কেউ না বোঝার ভান করে, তাকে নিয়ে কেউ মজা করতে চায় না। কিন্তু হায়দারকে নিয়ে মজা করা যায়।

মাহবুব ভাই গেটের কাছে এসে যখন প্রশ্ন করলেন, তুমি ভেতরে দেখা করতে চাইলে না কেন। হায়দার এককথায় বলল, ‘আমি ওখানে যাই না।’ মাহবুব ভাইকে দেখে মনে হলো হায়দার কী কারণে ওই দামি রেস্টুরেন্টে ঢুকতে চায় না, তা বুঝতে পারলেন না। উনিই তো খাওয়াতেন। টাকা তো আর হায়দারকে দিতে হতো না। এরপর আমরা হেঁটে গিয়ে বসলাম মধুর ক্যানটিনে। মাহবুব ভাই আমাদের চা আর মিষ্টি খাওয়ালেন। তারপর খানিকক্ষণ পাঠাগারের বই নিয়ে আলাপ করে গাড়ি থেকে অনেকগুলো বই নামালেন। হায়দার আমাকে নিয়ে এসেছিল বইগুলো বহন করে হলে নিয়ে যেতে। সে যেহেতু গণরুমে থাকে, বইগুলো রাখার কোনো জায়গা তার নেই। বইগুলো আমার কাছে রাখতে চায়। সেদিন আমরা দুজনে মিলে প্রায় ৫০টা বই বহন করে নিয়ে এসে আমার খাটের নিচে ঢুকিয়েছিলাম। এর পর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে যাওয়ার সময় সে পাঁচটা পাঁচটা করে বই আমার কাছ থেকে নিয়ে যেত। সেই সুবাদে হায়দারের সঙ্গে আমার যোগাযোগ একটু বেড়ে গেল।

আমার ক্লাসে একজন সহপাঠী আছে। নাম হায়দার আলী। দুই বছরের জুনিয়র। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হলেও সিট না পাওয়ার কারণে এখনো ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের সঙ্গে গণরুমে থাকে। গায়ের রং কালো বলে অনেকে ওকে ডাকে ‘হায়দার কালী’ বলে। ছেলেটা অনেকবার শিক্ষকদের বলে চেষ্টা করেছিল ডিপার্টমেন্ট বদলাতে, কিন্তু পারেনি।

আগে থেকে রিডিং রুমে জায়গা রেখে, রাতে পড়তে যাওয়ার আগে হায়দার আমাকে ডেকে নিয়ে যেত। পড়ালেখায় ফাঁকি দিতে দিতে আমার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে হায়দারের এই সৌজন্যটুকুর জন্য পড়াশোনার জন্য সময় দেওয়া ধীরে ধীরে বেড়ে গেল। একদিন রিডিং রুমে পড়ার সময় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। অন্ধকারে সবাই যখন মোবাইল ফোন জ্বালানো শুরু করেছে, হায়দারকে দেখলাম একটা টর্চলাইট বের করে জ্বালাল। আমি একটু অবাক হয়ে গেলাম। আজকাল কেউ কি আর টর্চলাইট নিয়ে ঘোরে! ১০ মিনিট পরেই বিদ্যুৎ চলে এসেছিল, কিন্তু হায়দার টর্চলাইটটা জ্বালানোয় সেটা অন্যদের চোখে পড়ে যায়। এক বড় ভাই এসে জোর করে তার টর্চটা নিয়ে যায়। হায়দার মাথা নিচু করে টর্চটি দিয়ে দেয়।

তার পরদিন হায়দার আর আমাকে নিতে এল না। আমি অপেক্ষা করলাম। গণরুমে ওর খোঁজ করতে গেলাম। জানলাম, সে হলে নেই। পরদিন সে ক্লাসেও এল না। আমি বিকেলের দিকে হলে গিয়ে প্রথমেই গণরুমে খোঁজ করলাম। দেখি মেঝেতে এক কোণে খালি গায়ে পাশ ফিরে শুয়ে আছে হায়দার। আধো আলোয় তার আঁধার-কালো শীর্ণ শরীরের ভেতরের বুকের খাঁচাটা নিশ্বাস–প্রশ্বাসের সঙ্গে ওঠানামা করছে। আমি কাছে গিয়ে বসলাম। ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করতে করতে দেখছিলাম এই রুমে অন্তত ৩০ জন গাদাগাদি করে কোনো রকমে ঘুমায়। ফার্স্ট ইয়ারে আমাকেও এ রকমভাবেই থাকতে হতো। তখন সামনে থেকে দেখেছি একটা সিট পাওয়ার জন্য কী না করতে হয়েছে ছেলেদের। হায়দারও যে অনেক চেষ্টা করেনি, তা নয়। সে কারও সঙ্গে বেয়াদবি করে না। সব কথাতেই জি জি করে। মিছিলে নিয়মিত যায়, বড় ভাইদের খুশি রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও পরিচিত কেউ না থাকায় বা আগবাড়িয়ে নিজেকে জাহির করতে না পারায় সে ক্রমাগত এই ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গোঙানির মতো শব্দ শুনে তাকাই। দেখি হায়দার বিকট শব্দ করে ধড়মড় করে উঠে বসল। আমি তার হাত ধরে বললাম, কী হইছে?

চোখ কচলাতে কচলাতে হায়দার বলল, স্বপ্ন দেখতেছিলাম।

কী স্বপ্ন?

না, তেমন কিছু না।

দেখে মনে হয় ভয় পাইছিলি খুব?

ভয় তো আছেই। যেকোনো সময়ই মাইর খাইতে পারি।

কেউ ভয় দেখাইছে?

না।

বুঝলাম কিছু হলেও সে সহজে বলবে না আমাকে। জিজ্ঞেস করলাম, টর্চ ফেরত দিছে?

না।

টর্চ নিয়া ঘুরতেছিলি কেন?

এমনেই। অভ্যাস।

আমি আর কিছু বললাম না। এর পর থেকে প্রায়ই দেখি হায়দারকে রাতের দিকে হলে পাওয়া যায় না। ক্লাসেও অনিয়মিত। আরেক দিন ক্লাসে যায়নি বলে বিকেলে ওকে গণরুমে খুঁজতে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আজকে ক্লাসে গেলি না কেন?

প্যান্ট ছিল না।

চুরি হইছে?

না। ফার্স্ট ইয়ারের একটা ছেলে না বইলা পইরা গেছিল গিয়া।

কেন নিছিল?

মনে হয় নিজেরটা ধোয়া ছিল না।

তো আমারটা নিতি।

আপনি ছিলেন না। আর আপনার প্যান্ট তো আমার লাগত না।

গণরুমে ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেদের সঙ্গে সিনিয়রদের থাকাটাই অপমানজনক। তার মধ্যে যত দরকারই থাকুক, একটা জুনিয়র ছেলের সিনিয়রের প্যান্ট না বলে নিয়ে যাওয়ার কথা নয়। আমার মনে হলো হায়দারকে নিয়ে জুনিয়ররাও তামাশা শুরু করেছে, কিন্তু হায়দার স্বীকার করছে না। এই হতাশা কাউকে দেখানোও যায় না।

অলংকরণ: মোশাহিদা সুলতানা ঋতু

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক মারা গেছেন
  • ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক আর নেই
  • গবেষণালব্ধ বই যুগের আলোকবর্তিকা: ধর্ম উপদেষ্টা
  • ৪০ ঘণ্টা পর এক ছাত্রের মরদেহ উদ্ধার, নিখোঁজ আরেকজন
  • সিদ্ধিরগঞ্জে ৭ কেজি গাঁজাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তার 
  • গরুর গোবর কুড়ানো থেকে সাত তারকা হোটেলে, জয়দীপের গল্প জানেন কি
  • টর্চলাইট
  • বারডেম হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক
  • পিআর পদ্ধতিতে স্থায়ী সরকারব্যবস্থা হয় না: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • ৩৫ বছর আগে সর্বশেষ চাকসু নির্বাচনে যা ঘটেছিল