স্বপ্ন দেখে প্রতারিত মানুষের বিদ্রোহে আজকের দিনে চালানো হয়েছিল গুলি
Published: 20th, May 2025 GMT
বছর ঘুরে ফিরে আসে ‘মুল্লুকে চলো’র দিন। এটি ছিল এই অঞ্চলে (আসামসহ বৃহত্তর সিলেট) চা-বাগান তৈরির সময় বঞ্চিত, নিপীড়িত একদল মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সংঘবদ্ধ উত্থানের ডাক। মুল্লুকে চলো দিনটি চা-শ্রমিকদের মনে করিয়ে দেয়, একদিন স্বপ্নের ঘোর কেটে যাওয়া একদল মানুষ কী করে জন্মভিটার দিকে পা বাড়িয়েছিলেন। কী করে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে জন্মভিটায় ফিরতে চেয়েছিলেন। একদিন কী বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে জীবন বাজি রেখেছিলেন তাঁরা।
খরা ও দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের এসব মানুষ নিশ্চিত ও উন্নত জীবনের আকাঙক্ষা নিয়ে একদিন জন্মস্থান ছেড়ে এসেছিলেন। গাছ ঝাঁকালেই টাকা পাওয়া যায়—এমন স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল সেই মানুষগুলোকে। আসাম অঞ্চলের গভীর জঙ্গলে চা-বাগান তৈরি করতে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল। তবে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের এই মোহ কাটতে বেশিদিন লাগেনি তাঁদের। তাঁরা বুঝে যান, তাঁরা ঠকেছেন। জন্মভূমিতে ফিরতে স্বপ্নচ্যুত এই মানুষেরা মুল্লুকে চলো ডাক দিয়ে তখন পথে নামেন।
পথে ১৯২১ সালের ২০ মে চাঁদপুরে গোর্খা সেনারা এই মানুষদের ওপর হামলা করেন। অনেকেই আর ঘরে ফিরতে পারেননি। চা চাষের বৃত্তবদ্ধ জীবনে তাঁরা স্থায়ী শ্রমিক হয়ে বাঁধা পড়লেন। এই রক্তাক্ত দিনটি এখন চা-শ্রমিকদের কাছে স্বপ্নভঙ্গের প্রতিবাদের দিন হয়ে আছে। চা-শ্রমিকেরা দিনটিকে (২০ মে) এখন ‘চা-শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকেন।
চা-শ্রমিক সংগঠকদের সূত্রে জানা গেছে, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে চা-বাগানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। তখন ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের টিলাভূমিতে একের পর এক চা-বাগান তৈরি করতে থাকে। জঙ্গলাকীর্ণ এসব ভূমিতে চা-বাগান তৈরিতে তখন অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এই অঞ্চলের দুর্গম পাহাড়ি জমিতে সাপ, জোঁক, পোকামাকড়ের মধ্যে কাজ করার মতো শ্রমিকের অভাব ছিল। ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো তখনকার অবিভক্ত ভারতের ওডিশা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, চেন্নাই, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন অঞ্চলের খরা ও দারিদ্র্যপীড়িত, অনুর্বর অঞ্চলে দালাল নিয়োগ করে। দালালদের মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষকে নিশ্চিত, সুন্দর ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখানো হয়। দালালদের ফাঁদে পড়েন এসব মানুষ।
এই শ্রমিকদের নিপীড়ন করা হতো। চালানো হতো শারীরিক নির্যাতন। স্বপ্নচ্যুত চা-শ্রমিকেরা গোপনে ‘নিজ মুল্লুকে’ (নিজ দেশে) ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু ফিরে যাওয়ার পথ কারও জানা নেই। তাঁদের শুধু জানা ছিল, চাঁদপুর থেকে স্টিমারে কলকাতা যাওয়া যায়। এই জানাটুকু সম্বল করেই ১৯২১ সালে দিনক্ষণ ঠিক করে কাছাড় ও সিলেটের প্রায় ৩০ হাজার শ্রমিক মুল্লুকে চলো ডাক দিয়ে পথে নেমে পড়েন।
দিনের পর দিন হেঁটে একসময় নদীবন্দর চাঁদপুরে গিয়ে পৌঁছান তাঁরা। পথে অনেকের মৃত্যু হয়। চা-শ্রমিকদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন চা-শ্রমিক নেতা গঙ্গাদয়াল দীক্ষিত, দেওশরন ত্রিপাঠি, হরিচরণ প্রমুখ। এদিকে চা-বাগান ছেড়ে আসা শ্রমিকদের পথরোধ করতে সরকারের সহযোগিতায় চাঁদপুরে মোতায়েন করা হয় আসাম রাইফেলের গোর্খা সেনা। স্টিমারে উঠতে চাইলে গোর্খা সেনার প্রতিরোধের মুখে পড়েন চা-শ্রমিকেরা। বাধার মুখে শ্রমিকেরা তখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। শ্রমিকদের বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৯২১ সালের ২০ মে সেনারা নির্বিচার গুলি চালান। অনেক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
ঘটনাটি ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এই আন্দোলন তখন একটি সর্বভারতীয় শ্রমিক আন্দোলনে রূপ ধারণ করে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদে চাঁদপুর ও লাকসাম জংশনের রেলশ্রমিকেরা ২১ মে থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন। ২৪ মে থেকে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের শ্রমিক ও ২৮ মে থেকে স্টিমার ধর্মঘট চলতে থাকে। আসাম বেঙ্গল রেলশ্রমিকেরা ৩ মাস এবং স্টিমারশ্রমিকেরা ৬ সপ্তাহ ধর্মঘট করেছিলেন। এই ধর্মঘট ও দেশজুড়ে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ফলে চা-বাগানের ব্রিটিশ মালিকেরা শ্রমিকদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ সময় চা-বাগানের মালিক ও প্রশাসনের প্রতিশ্রুতিতে কিছু শ্রমিক বাগানে ফিরে যান। আর অনেকে ফিরে যান নিজ মুল্লুকে। যাঁরা ফিরে এলেন, তাঁরা বাঁধা পড়লেন চা-বাগানের সেই জীবনে।
এ বছর ১০৪তম ‘চা-শ্রমিক দিবস’ পালন করা হচ্ছে জানিয়ে বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপংকর ঘোষ বলেন, এ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি চলছে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: হয় ছ ল
এছাড়াও পড়ুন:
৪৪তম বিসিএসের ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন ও পিএসসি সংস্কারের দাবি
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন এবং সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সংস্কারের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছেন একদল চাকরিপ্রার্থী। আজ শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তাঁরা। প্রায় দুই ঘণ্টা পর তাঁদের সেখান থেকে সরিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের হাতাহাতি হয়। তাতে বেশ কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন।
শুক্রবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তাঁরা সড়ক ‘ব্লকেড’ করলে যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে।
আন্দোলনকারীরা ‘জুলাই আবার এসেছে, ছাত্রসমাজ আবার জেগেছে’, ‘এই মুহূর্তে দরকার, পিএসসির সংস্কার’, ‘জেগেছে রে, জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘নিশিরাতের ফলাফল, মানি না মানব না’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
আন্দোলনকারীরা দাবি তুলে ধরে বলেন, ৪৪তম বিসিএসের চড়ূান্ত ফলাফলে একই পদের ক্যাডারকে আবার সেই ক্যাডারেই রাখা হয়েছে। এই ফলাফল তাঁরা মানেন না। অবিলম্বে পিএসসির সংস্কার চান তাঁরা।
মো. লুৎফুর রহমান নামের এক আন্দোলনকারী ৪৪তম বিসিএসের ফলাফলকে ‘নিশিরাতের ফলাফল’ আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার ফলাফলে ১৬৯০ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ ৮০০ ক্যাডার রিপিট করা হয়েছে, যা আমাদের জায়গা বঞ্চিত করার শামিল। আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে ৪৩০টা পদ বাড়ানো হলেও উপদেষ্টার অফিস থেকে তা কোনো এক অদৃশ্য কারণে বাদ দেওয়া হয়েছে।’
আন্দোলনকারী অন্য এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘আমাদের এই বিসিএসের ফাঁদে প্রায় সাড়ে চার বছর সময় নষ্ট করা হয়েছে। দুইবার ভাইভা নেওয়া হয়েছে। তবু সবশেষে দেখলাম, এখানেও এখনো কোনো না কোনো দুর্নীতি হয়েছে। আমরা অবিলম্বে এই ফলাফলের পুনর্মূল্যায়ন চাই। রিপিট ক্যাডার বাতিল চাই।’
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন এবং সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) সংস্কারের দাবিতে আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন একদল চাকরিপ্রার্থী। এ সময় শাহবাগ মোড় দিয়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়