জীবনকে মাঝেমধ্যে লক্ষ্য আর সংগ্রামের মধ্যে টানাপোড়েন বলে মনে হয়। কখনো কখনো আমরা এমন চক্রে আটকে যাই, যেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ জানা থাকে না। আসক্তি—তা স্বভাবগত খারাপ অভ্যাস, মাদক বা ক্ষতিকর আচরণ যা-ই হোক না কেন—দূর করা অসম্ভব মনে হয়। দোয়ার দ্বারা কি তা সম্ভব? ইসলাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আল্লাহর ওপর ভরসা করলে কোনো চেষ্টাই অসম্ভব নয়। দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া আমাদের শক্তি ও ধৈর্যের উৎস হতে পারে। এখানে আমরা সাতটি দোয়া তুলে ধরছি, যা আসক্তি থেকে মুক্তি ও জীবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সহায়তা করবে।

১.

পথহারা হলে হেদায়াতের দোয়া

যদি মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছেন, তাহলে জানুন আল্লাহর হেদায়াত আপনার পথপ্রদর্শক। কোরআন থেকে এই দোয়া পড়ুন: ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম।’ অর্থ, আল্লাহ, আমাদের সরল পথ দেখাও। (সুরা ফাতিহা: ৬)

নামাজে তো আমরা পড়িই, যখন একা থাকেন, তখনই বলুন: ‘ইয়া আল্লাহ, আমাকে সঠিক পথ দেখাও।’

২. আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য দোয়া

আসক্তি কাটিয়ে উঠতে ধৈর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এই দোয়া আপনাকে শক্তিশালী করবে: ‘রাব্বানা আফরিগ আলাইনা সাবরান ওয়া সাব্বিত আকদামানা ওয়ানসুরনা।’ অর্থ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের হৃদয়ে ধৈর্য ঢেলে দাও, আমাদের পদক্ষেপ অটল করো এবং আমাদের বিজয় দান করো। (সুরা বাকারা: ২৫০)

এই দোয়ার মাধ্যমে আপনি আল্লাহর কাছে সংগ্রামে জয়ের শক্তি চাইছেন। মনে রাখবেন, বিজয় আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।

৩. ক্ষমা ও নতুন শুরুর জন্য দোয়া

ভুল হয়ে যায়, কিন্তু আল্লাহর রহমত অসীম। ভুল করলে এই দোয়া পড়ুন: ‘রাব্বি ইন্নি জালামতু নাফসি ফাগফির লি।’ অর্থ, হে আমার প্রতিপালক, আমি আমার নিজের ওপর জুলুম করেছি, তাই আমাকে ক্ষমা করো। (সুরা কাসাস: ১৬)

এই সংক্ষিপ্ত দোয়া আপনাকে মনে করিয়ে দেবে, আল্লাহ আন্তরিক তাওবা ভালোবাসেন এবং প্রতিদিনই একটি নতুন শুরু।

আরও পড়ুনদরুদ কেন পড়ব২৮ এপ্রিল ২০২৫

৪. ভালো অভ্যাস দিয়ে খারাপ অভ্যাস বদলানোর দোয়া

আসক্তি থেকে মুক্তি মানে কেবল কিছু বন্ধ করা নয়, সেই জায়গা ভালো কাজ দিয়ে পূর্ণ করা। সেই রূপান্তরের জন্য এই দোয়া পড়ুন:

রাব্বানা লা তুয়াখিযনা ইন নাসিনা আও আখতানা। রাব্বানা ওয়ালা তাহমিল আলাইনা ইসরান কামা হামালতাহু আলাল্লাজিনা মিন কাবলিনা। রাব্বানা ওয়ালা তুহাম্মিলনা মা লা তাকাতা লানা বিহি। ওয়াফু আন্না ওয়াগফির লানা ওয়ারহামনা। আনতা মাওলানা ফানসুরনা।’

অর্থ, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা যদি ভুলে যাই বা ভুল করি, তবে আমাদের শাস্তি দিয়ো না। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর যে বোঝা চাপিয়েছিলে, তেমন বোঝা আমাদের ওপর চাপিয়ো না। হে আমাদের রব! আমাদের ওপর তা চাপিয়ো না, যা সহ্য করার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের পাপ মোচন করো, আমাদের ক্ষমা করো এবং আমাদের প্রতি দয়া করো। তুমিই আমাদের অভিভাবক। অতএব, আমাদেরকে বিজয় দান করো। (সুরা বাকারা: ২৮৬)

৫. প্রলোভন থেকে রক্ষা পাওয়ার দোয়া

আমাদের চারপাশে নানা প্রলোভনের ফাঁদ ওত পেতে থাকে। একটি দোয়া প্রলোভনের ফাঁদ থেকে আপনাকে সুরক্ষিত রাখবে: ‘আল্লাহুম্মা ইকফিনি বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াকা।

অর্থ, হে আল্লাহ, তোমার হালাল দিয়ে আমাকে তোমার হারাম থেকে রক্ষা করো এবং তোমার অনুগ্রহে আমাকে অন্যের প্রয়োজন থেকে মুক্ত করো। (তিরমিজি, হাদিস: ৩,৫৬৩)

৬. হৃদয় শুদ্ধ করার দোয়া

আসক্তি থেকে নিরাময় হতে পারে হৃদয় পরিশুদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে। হৃদয়ের পরিচ্ছন্নতার জন্য এই দোয়া পড়তে পারেন:

আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিন ফিতনাতিন নারি ওয়া আজাবিন নারি, ওয়া ফিতনাতিল কাবরি ওয়া আজাবিল কাবরি, ওয়া শাররি ফিতনাতিল গিনা, ওয়া শাররি ফিতনাতিল ফাকরি। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিন শাররি ফিতনাতিল মাসিহিদ দাজ্জাল। আল্লাহুম্মাগসিল কালবি বিমায়িস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়া নাক্কি কালবি মিনাল খাতায়া, কামা নাক্কাইতাস সাওবাল আবয়াদা মিনাদ দানাসি। ওয়া বায়িদ বাইনি ওয়া বাইনা খাতায়ায়া কামা বায়াদতা বাইনাল মাশরিকি ওয়াল মাগরিবি। আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজু বিকা মিনাল কাসালি ওয়াল মাআসামি ওয়াল মাগরামি।’

অর্থ, হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে জাহান্নামের ফিতনা, জাহান্নামের শাস্তি, কবরের ফিতনা, কবরের শাস্তি, ধন-সম্পদের ফিতনার ক্ষতি এবং দারিদ্র্যের ফিতনার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে মাসিহ দাজ্জালের ফিতনার ক্ষতি থেকে আশ্রয় চাই। হে আল্লাহ, আমার হৃদয়কে তুষার ও শিলার পানি দিয়ে ধুয়ে দাও এবং আমার হৃদয়কে সব পাপ থেকে এমনভাবে পরিষ্কার করো, যেমন সাদা কাপড় ময়লা থেকে পরিষ্কার হয়। আমার এবং আমার পাপের মধ্যে এমন দূরত্ব সৃষ্টি করো, যেমন তুমি পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছ। হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে অলসতা, পাপ ও ঋণ থেকে আশ্রয় চাই। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,৩৭৭)

মুক্তি আসে আশাবাদী মনে

আসক্তি থেকে মুক্তি সহজ নয়, কিন্তু আল্লাহ আপনার সঙ্গে থাকলে এটি সম্পূর্ণ সম্ভব। এই দোয়াগুলো আপনার আধ্যাত্মিক হাতিয়ার। হতাশ সময়ে আশা মনে হয় দূর-অস্ত ব্যাপার। কিন্তু আল্লাহ আমাদের তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হতে বলেন, ‘বলো, হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছে! আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনি তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার: ৫৩)

সূত্র: মুসলিম গার্ল ডটকম

আরও পড়ুনইয়া জালালি ওয়াল ইকরাম কেন পড়ব ২৭ আগস্ট ২০২৪

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আল ল হ ম ম আম দ র প র দ র ওপর র জন য এই দ য আসক ত

এছাড়াও পড়ুন:

পবিত্র মক্কায় স্মৃতিধন্য পুণ্যস্থানসমূহ

হজের সম্পাদন এলাকাকে হারাম শরিফ বলে। হারাম শব্দটি অতি পবিত্র স্থান নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। হারাম শরিফের সীমা বায়তুল্লাহর পূর্বে জেরুজালেমের পথে ৯ মাইল, পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১০ মাইল, উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৫ মাইল এবং দক্ষিণে তায়েফের পথে ৭ মাইল। হারামের প্রাণকেন্দ্র হলো মাসজিদুল হারাম। এর কেন্দ্রস্থলে কাবা শরিফ অবস্থিত। হজরত আদম (আ.)–এর সৃষ্টির পরপরই কাবাগৃহের সৃষ্টি। এযাবৎ কাবা শরিফ ১২ বার সংস্কার হয়েছে।

কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এই স্থানটুকু পূর্বে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া। দোয়া কবুলের জন্য হাতিম সর্বোত্তম স্থান। হাতিমের ঠিক ওপরে কাবা শরিফে ঘরের ছাদের সঙ্গে একটা সোনার পরনালা আছে। বৃষ্টির সময় এই পরনালা দিয়ে ছাদের পানি পড়ে। সে জন্য এর নাম মিজাবে রহমত। মিজাবে রহমতের নিচে নামাজ পড়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়।

হাজরে আসওয়াদ মানে কালো পাথর, এটি একটি জান্নাতি পাথর। হজরত আদম (আ.)–এর সময় পাথরটি আনীত হয়। এটি মাটি থেকে চার ফুট উচ্চে কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালের বহির্ভাগে প্রোথিত। এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডকে নবী করিম (সা.) অত্যন্ত বিনয় ও মহব্বতের সঙ্গে চুম্বন করতেন। হাজরে আসওয়াদ ও কাবাঘরের দরজার মধ্যবর্তী স্থানটুকু মুলতাজিম নামে পরিচিত। এখানে দোয়া কবুল হয়। কাবা শরিফের পূর্ব দিকে মাকামে ইব্রাহিমে যে প্রস্তরখণ্ড রক্ষিত আছে, তার ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন। হজরত ওমর (রা.) প্রথম এখানে নামাজ পড়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই পবিত্র স্থানের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রতিবার তাওয়াফের পর দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজ ওয়াজিব। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১২৫)

কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এই স্থানটুকু পূর্বে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া

কাবাঘরের পূর্ব দিকে মাসজিদুল হারাম চত্বরেই জমজম কূপ অবস্থিত। এর গভীরতা ৬০ গজ ও এর মুখের প্রসার ৪ গজ। বর্তমানে তাওয়াফের জায়গা সম্প্রসারণের কারণে জমজম কূপ ঢাকা পড়েছে। তবে হারাম শরিফের সবখানেই জমজমের পানি রক্ষিত থাকে। শিশু হজরত ইসমাইল (আ.)–এর পদাঘাতে আল্লাহর কুদরতে মরুভূমিতে এই কূপের সৃষ্টি হয়েছিল। মাসজিদুল হারাম শরিফসংলগ্ন পূর্ব দিকে সাফা ও মারওয়া পাহাড় অবস্থিত। এই দুই পাহাড়ের মধ্যস্থলে বিবি হাজেরা (আ.) শিশুপুত্র ইসমাইল (আ.)–এর পানীয়র অনুসন্ধানে অতি ব্যস্ততাসহকারে ছোটাছুটি করেছিলেন। সেই স্মৃতি রক্ষার্থে হাজিদের এই দুই পাহাড়ের মধ্যে সাত চক্কর দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। একে সাঈ বলা হয়। সাঈ করা ওয়াজিব। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৮)

আরাফাত একটি প্রশস্ত ময়দান। ৯ জিলহজ হাজিদের আরাফাত ময়দানে অবস্থান করতে হয়। আরাফাত মানে পরিচয়। আরাফাত ময়দানে হজরত বাবা আদম (আ.)–এর সঙ্গে হজরত মা হাওয়া (আ.)–এর পুনর্মিলন হয় এবং তাঁরা স্বীয় ভুলের জন্য সেখানে আল্লাহ তাআলার দরবারে মোনাজাত করেন এবং তাঁদের মোনাজাত কবুল হয়। (সুরা বাকারা, আয়াত: ৩৭; সুরা আরাফ, আয়াত: ২৩)

‘জাবালে রহমত’ বা করুণার পাহাড় আরাফাত ময়দানে অবস্থিত। এর উচ্চতা ৩০০ ফুট। এর উপরিভাগে একটি সাদা স্তম্ভ আছে, যেখান থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই পাহাড় দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র লাব্বাইক ও দরুদ শরিফ পড়তে হয়। আল্লাহ তাআলার আদেশে হজরত ইব্রাহিম (আ.) পুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)–কে যে স্থানে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই স্থানের নাম মিনা। মক্কা শরিফ থেকে মিনার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটার। মিনা প্রান্তরে হজের আগের দিন এবং হজের পর তিন দিন তাঁবুতে অবস্থান করতে হয়। এখানেই কোরবানি করতে হয়। (সুরা ছফফাত, আয়াত: ৯৯-১১১)

মিনার পাশেই তিনটি জুমরা বা স্তম্ভ (বহুবচন জামারাত) অবস্থিত। এগুলো ছোট শয়তান (জুমরায়ে উলা), মেজ শয়তান (জুমরায়ে উস্তা), বড় শয়তান (জুমরায়ে আকাবা) নামে পরিচিত। হজরত ইসমাইল (আ.)–কে কোরবানি করতে নেওয়ার পথে এই স্থানে শয়তান বাধা সৃষ্টি করেছিল এবং তিনি পাথর মেরে শয়তানকে তাড়িয়েছিলেন। এর স্মরণে এখানে কঙ্কর মারতে হয়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী

যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম

[email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পবিত্র মক্কায় স্মৃতিধন্য পুণ্যস্থানসমূহ