আবারও লাশ পড়েছে রাউজানে। চাচির জানাজা শেষে ওষুধ কিনতে গিয়ে স্ত্রী-শিশু সন্তানের সামনেই এবার খুন হয়েছেন যুবদল নেতা মোহাম্মদ সেলিম। খুনিরা বোরকা পরে এসে গুলি করে হত্যা করে তাঁকে। এ নিয়ে চট্টগ্রামের উত্তরের এই জনপদে গত ১১ মাসে খুন হলেন ১৫ জন। সব খুনের এজাহার ও আসামি তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়,  ১৩টি খুনের এজাহারভুক্ত কোনো আসামিই গ্রেপ্তার হয়নি। 
খুনের পর আসামি গ্রেপ্তার না হওয়া, রাজনৈতিক চাপ এবং প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণেই একের পর এক লাশ পড়ছে রাউজানে। এ ছাড়া আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, বালুমহাল ও ইটভাটা দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করেও হানাহানি লেগেই আছে। 

গত রোববার হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া সেলিমের স্ত্রী ফেরদৌস আক্তার বলেন, শিশুকন্যা সাবরিনা ও আমাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে ঈষাণভট্টের হাটের শান্তি ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে যান। সেখানেই সিএনজিচালিত অটোরিকশায়  বোরকা পরে এসে আমার স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। রায়হান ও ধামা ইলিয়াস নামের দুই সন্ত্রাসীর নাম আমরা পুলিশকে বলেছি। কিন্তু এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

গ্রেপ্তার হয়নি আরও ১২টি খুনের কোনো আসামি। ৭টি ঘটনায় মামলা করা হয় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে। বাকি মামলাগুলোতে আসামি আছে শতাধিক। এজাহারে অনেকের নাম-পরিচয়ও সুনির্দিষ্ট করা রয়েছে। আছে সিসিটিভি ফুটেজও। 
ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৫ জন ও যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ হাসান হত্যা মামলায় ৩ জনকে ছাড়া বাকিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। বাকি মামলাগুলোর তদন্তেও নেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। 

রাউজান থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, রাউজানে রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিস্তার ঠেকাতে রাজনৈতিক দল, সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। ১১ মাসে ১৫ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৬-৭টি সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড ঘটে। বাকিগুলো জায়গা-জমির বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘটিত হয়েছে। সন্ত্রাসীরা ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় থাকে না। পাহাড়ে পালিয়ে যায়। রাজনৈতিক চাপও তৈরি করে। তাই আসামি ধরতে বেগ পেতে হয়।

সেলিমকে খুন করে পাঁচ অস্ত্রধারী
রাউজানে সর্বশেষ খুন হওয়া সেলিম কদলপুর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের শমসেরপাড়া এলাকার আমির হোসেনের ছেলে এবং ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব। উপজেলা যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ ওয়াসিম জানান, সেলিম ইউনিয়ন যুবদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারী। 
পুলিশ ও পরিবারের দাবি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের সহযোগী রায়হান ও ধামা ইলিয়াছের নেতৃত্বে পাঁচ অস্ত্রধারী গুলি করে সেলিকে হত্যা করে। হত্যাকাণ্ড শেষে খুনিরা সিএনজিচালিত অটোরিকশা পরিবর্তন করে পাহাড়ের দিকে চলে যায়। এ সময় তারা যে অটোরিকশা ব্যবহার করেছে, সেটির চালককে আটক করেছে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে চালক জানিয়েছে, সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তার অটোরিকশায় উঠেছিল। সে খুনের সঙ্গে জড়িত নয়।

যেসব খুনে গ্রেপ্তার হয়নি একজনও
গত ২৮ আগস্ট সবার সামনে বেতবুনিয়া ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি আবদুল মান্নানকে (২৭) পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে পুলিশ রাউজান পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের চৌধুরী মার্কেট এলাকার সড়কের পাশের জঙ্গল থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় জড়িতদের কাউকে শনাক্ত বা কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে দাবি মামলার বাদী জান্নাতুল নুরের। 

গত ১ সেপ্টেম্বর রাউজানের সাবেক সাংসদ ফজলে করিমের বাগানবাড়ি থেকে মো.

ইউসুফ মিয়ার (৬৫) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই ঘটনায় নিহতের ছেলে সাজ্জাদ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় মামলা করেন। তবে পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। নিখোঁজের চার দিন পর গত ২৯ অক্টোবর উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মইশকরম এলাকা থেকে আজম খানের (৫২) অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে রাউজান থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী লাকী আকতার। এখানেও কেউই গ্রেপ্তার হয়নি।
একইভাবে ১১ নভেম্বর নিহত ওলামা লীগের সদস্য শিক্ষক মাওলানা আবু তাহের (৪৮) এবং গত ১৫ মার্চ প্রতিপক্ষের পিটুনি ও ছুরিকাঘাতে নিহত কমর উদ্দিন জিতুর (৩৬) পরিবারও কোনো বিচার পায়নি। জিতুর স্ত্রী ডেজি আক্তার বলেন, আমার স্বামীকে বাজারে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। আমি ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করলেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না।

গত ২১ মার্চ রাউজান উপজেলার পূর্বগুজরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বৃহত্তর হোয়ারাপাড়া এলাকার মোবারক খালের পূর্ব পাশের একটি জমি থেকে মো. রুবেলের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। গরু চোর সন্দেহে তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। এ ঘটনায় নিহতের ভাই মো. সোহেল বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। সোহেল বলেন, আমার ভাই একজন প্রবাসী। তাঁকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমার ভাই হত্যার বিচার পাইনি।

গত ৪ এপ্রিল পারিবারিক দ্বন্দ্বে দুই ছোট ভাইয়ের হাতে ধারালো অস্ত্র ও রডের আঘাতে খুন হন বড় ভাই প্রকৌশলী নূর আলম বকুল (৪৩)। এ ছাড়া ১৭ এপ্রিল রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী ইউনিয়নের মাহামুনি দিঘি থেকে মো. জাফরের (৪০) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এই দুই ঘটনায় মামলা হলেও গ্রেপ্তার হয়নি কেউই।
গত ১৯ এপ্রিল রাতে রাতের খাবার খাওয়ার সময় মুখের ভেতর বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে এবং পায়ে গুলি করার পর চাপাতি দিয়ে আবদুল্লাহ মানিককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ২১ এপ্রিল রাউজান থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫-৬ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন তাঁর স্ত্রী ছেমন আরা বেগম। কিন্তু পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি বলে জানান তিনি।
গত ২২ এপ্রিল বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে দোকানের সামনে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে মো. ইব্রাহিমকে হত্যা করে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাতেও গ্রেপ্তার হয়নি কোনো আসামি।

২৫ জুন বাগোয়ান ইউনিয়নের গোগীপাড়ার কর্ণফুলী নদীর বোটঘাটা থেকে রূপক নাথের ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। সেই মামলায়ও গ্রেপ্তার নেই। গত ৩ জুলাই হারপাড়া গ্রামের দুই কিশোর গ্রুপের মারামারি থামাতে গিয়ে বুকে ঘুসির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যান উরকিরচর ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলমগীর। এ ঘটনায়ও গ্রেপ্তার হয়নি কেউ।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম সানতু সমকালকে বলেন, আধিপত্য বিস্তার ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুন হচ্ছে রাউজানে। উপজেলাটির আশপাশে পাহাড়ি এলাকা থাকায় সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে আমাদের কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে। তবে এসব খুনের ঘটনায় যারা দায়ী, তারা কেউ পার পাবে না।


 
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আস ম দ র ব র দ ধ গ র প ত র করত গ র প ত র হয়ন গ র প ত র কর হত য ক ণ ড র জন ত ক ম হ ম মদ এ ঘটন য় উপজ ল য বদল

এছাড়াও পড়ুন:

টেকনাফের অপহরণকারীদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর গোলাগুলি, অপহৃত একজনকে উদ্ধার

কক্সবাজারের টেকনাফে পাহাড়ের আস্তানায় ডাকাত ও অপহরণকারীদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় ঘটনাস্থল থেকে অপহরণের শিকার এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি বেশ কিছু দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি ও মাদক জব্দ করেছে যৌথ বাহিনী।

আজ রোববার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সালাহউদ্দিন রশীদ তানভীর। তিনি জানান, অপহরণকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ব্যক্তির নাম মো. সোহেল (২০)। তিনি টেকনাফ পৌরসভার নতুন পল্লান পাড়ার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে।

লে. কমান্ডার সালাহউদ্দিন রশীদ তানভীর বলেন, গতকাল শনিবার মধ্যরাতে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা–সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ অবস্থান করছে এমন সংবাদ পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরে কোস্টগার্ড ও পুলিশের একটি যৌথ দল সেখানে অভিযান চালায়। এতে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে দুর্বৃত্তরা যৌথ বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে অতর্কিতে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। আত্মরক্ষার্থে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়েন। গোলাগুলির একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা রাতের অন্ধকারে গহিন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়।

পরে দুর্বৃত্তদের গোপন আস্তানায় তল্লাশি চালিয়ে ১টি জি-৩ রাইফেল, ২টি বিদেশি পিস্তল, ৩টি দেশে তৈরি বন্দুক, ৩ হাজার ১০০টি রাইফেলের গুলি, ১৪টি পিস্তলের গুলি, ১ কেজি আইস মাদক (ক্রিস্টাল মেথ) ও ৪ লিটার দেশি মদ উদ্ধার করা হয়। এ সময় দুর্বৃত্ত চক্রের হাতে জিম্মি থাকা একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা অস্ত্র ও মাদক টেকনাফ থানায় হস্তান্তর করে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টেকনাফে যৌথবাহিনীর সঙ্গে ডাকাত-অপহরণকারীদের গোলাগুলি, অস্ত্র-গোলাবারুদ উদ্ধার
  • টেকনাফের অপহরণকারীদের সঙ্গে যৌথ বাহিনীর গোলাগুলি, অপহৃত একজনকে উদ্ধার
  • যশোরে মশাল মিছিলের দু’দিন পর আটক উদীচীর দু’কর্মী, ছাড়া পেলেন একজন
  • দিনাজপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দগ্ধ ৯