সম্প্রতি ইউক্রেনে রাশিয়ার ব্যাপক বোমাবর্ষণ ও রুশ বাহিনীর অগ্রগতি যুদ্ধের শেষ পরিণতির পূর্বাভাস দিচ্ছে। এটি ইউক্রেনের ওপর নেমে আসবে যদি দেশটি এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার বিকল্প উপায় খুঁজে না পায়। সম্ভাব্য একটি সমাধান হতে পারে জেলেনস্কিকে সুরক্ষা দিয়ে অপেক্ষাকৃত একটি নমনীয় পক্ষ তৈরি করা। সেরা উপায়টি হতে পারে ইউক্রেনে একটি জোট সরকার গঠন করা, যারা রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার বোঝা বহন করতে পারবে।

আজ আমরা জেলেনস্কি ও তাঁর সহযোগীদের কাছ থেকে বারবার শুনছি, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়াই তাঁরা এই যুদ্ধ জিততে পারবেন। ঘৃণিত রুশদের কাছে তাঁরা ইউক্রেনের এক মিটার ভূমিও ছাড়বেন না। এ–ও বলছেন, তাঁরা ‘ভাড়া হিসেবে’ আমেরিকান সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারবেন অথবা জার্মানিকে ফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকান যন্ত্রাংশ কিনত পারবেন।

এখন প্রশ্ন হলো, ইউক্রেনের নেতারা যেটা বলছেন, সেটা কি তাঁরা সত্যিই বিশ্বাস করেন?

আমার ধারণা, তাঁরা নিজেরাও এটা বিশ্বাস করেন না। তাঁরা মূলত জনগণকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যখন সবখানে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বিস্ফোরিত হচ্ছে, আর আপনাকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে কিংবা ঠান্ডা বেজমেন্টে ঘুমাতে হচ্ছে, তখন এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া খুব কঠিন।

আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুলটি হয় ২০২২ সালের ৩০ মার্চ। ধারণা করা হয়, যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইস্তাম্বুলে হওয়া শান্তিচুক্তি থেকে জেলেনস্কিকে সরে আসতে রাজি করিয়েছিলেন।

আমার নিজের পর্যালোচনা হচ্ছে, জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি থেকে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার কারণ হলো তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, এতে তাঁর নিজের সেনাবাহিনী তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারে এবং হয়তো তাঁকে হত্যাও করতে পারে। ফলে জেলেনস্কির সিদ্ধান্তকেই অনেকটা বৈধতা দিয়েছিলেন জনসন।

এর আগে ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট জানিয়েছিলেন, জেলেনস্কি ভয় পাচ্ছিলেন যে রুশরা তাঁকে হত্যা করবে। তখন বেনেট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছ থেকে ‘সেটা করা হবে না’ বলে প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিলেন। কিন্তু হুমকিটা ইউক্রেন সেনাবাহিনীর চরমপন্থী অংশ থেকে এলে সেখানে কোনো প্রতিশ্রুতি আদায় করা সম্ভব ছিল না।

ফরমান জারি করে জেলেনস্কি সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছে। বিরোধী রাজনীতিকদের জেলে পাঠানো হয়েছে কিংবা তাঁদের কর্মকাণ্ড সীমিত করা হয়েছে কিংবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে। জেলেনস্কির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সামরিক শাসন তুলে দেওয়া এবং নির্বাচন আয়োজন করা। তবে জরুরি ভিত্তিতে যেটি করা দরকার, তা হলো রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি জোট সরকার গঠন করা।

এর পর থেকে জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো সমঝোতামূলক আলোচনার প্রশ্নে সম্পূর্ণ অনমনীয় ও একরোখা অবস্থান নেন। তিনি দাবি করতে থাকেন, রুশ সেনাদের ইউক্রেন ছেড়ে চলে যেতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য পুতিনের শাস্তি হতে হবে। জেলেনস্কির এই অনমনীয় অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো সফল মধ্যস্থতার সুযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

নিজের সিদ্ধান্তের দায় ঢাকতে জেলেনস্কি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির দাবি তোলেন। এটি এমন একটা দাবি, যেটা রাশিয়া কখনোই মানবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটি নিয়ে মস্কোকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। ৩ জুলাই পুতিন ও ট্রাম্প টেলিফোনে এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে কথা বলার সময় ধারণাটি আবারও সামনে এসেছে।

ইউক্রেনের সমস্যা এখন শুধু জেলেনস্কির জন্য সৃষ্ট সমস্যা নয়। ইউক্রেনের অস্ত্রভান্ডার ফুরিয়ে আসছে। আশঙ্কাজনকভাবে সেনা ও ভূখণ্ড হারাতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের সরবরাহ পথ, গোলাবারুদের গুদাম, কমান্ড সেন্টার ও কারখানাগুলো একের পর এক ধ্বংস হওয়ার কারণে প্রতিদিনই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

অন্যদিকে রাশিয়ার হাতে এখনো বেশ কিছু তুরুপের তাস রয়ে গেছে। প্রথমত, রাশিয়ার একটি বিশাল সেনাবাহিনী আছে, যার বড় একটি অংশ এখনো যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করা হয়নি। সেই তুলনায় ইউক্রেন নতুন সেনা সংগ্রহের পাশাপাশি পুরোনোদের ধরে রাখার ক্ষেত্রেও ভয়ানক সমস্যায় পড়েছে। সেনাদের পলায়নের হার ভয়ানক হারে বেড়ে গেছে। কেননা, যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় সেনাদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে।

রাশিয়া এখন উত্তর কোরিয়া থেকে আরও বেশি সেনা নিয়ে আসছে। এটা উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং–উনের অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। কিম সম্প্রতি ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত তাঁর সেনাদের (মাত্র পাঁচটি কফিন) জন্য অশ্রুসিক্ত রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন করেন। বিশাল একটি কনসার্টের মাধ্যমে ‘পিতৃভূমির জন্য জীবন উৎসর্গ করা’ সেনাদের মহিমা প্রচার করেন।

এ বাস্তবতায় সামনে এগোনোর পথ কী তাহলে? প্রথম ধাপটি হলো ট্রাম্পকে এমন কিছু কৌশলগত হাতিয়ার দেওয়া, যেটা তিনি রাশিয়ার সঙ্গে দর-কষাকষির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত জেলেনস্কি ঠিক উল্টো কাজটি করেছেন। এটা যদি চলতেই থাকে, তাহলে সেটা হবে আত্মঘাতী।

২০২২ সালে ইস্তাম্বুলে যে সমঝোতায় পৌঁছনো গিয়েছিল, সেখানে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা এবং সেখান থেকে শুরু করাটাই হবে সবচেয়ে সেরা পথ। রাশিয়া বলার চেষ্টা করবে যে ইস্তাম্বুল চুক্তিটি এখন পানির অতলে হারিয়ে গেছে। তবে একটা সম্ভাবনা আছে, পুতিন এটাকে আলোচনা শুরুর সূচনাবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় অনেকবার বলেছেন, ইস্তাম্বুল চুক্তি যুদ্ধের অবসান ঘটাতে পারত এবং রাশিয়া এটি মেনে নিত।

ইস্তাম্বুলে আলোচনার সময় রাশিয়ার এমন কিছু দাবি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি, সেগুলো অবশ্যই এখন বিবেচনায় নিতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইস্তাম্বুল চুক্তিকে সূচনাবিন্দু হিসেবে গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে কূটনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর জন্য একটি ‘বাস্তব’ বিষয় থাকবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো রাশিয়ার জন্য বাজারে প্রবেশের সুযোগ, প্রযুক্তি ভাগাভাগি, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং ইউক্রেন পুনর্গঠনের সহায়তা—এসব জায়গায় যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধা পাওয়ার বাস্তব সুযোগ রয়েছে।

পুতিন বলেছেন, দানেস্ক, জাপোরিঝঝিয়া, খেরসন ও ক্রিমিয়া অঞ্চলের যেসব এলাকা যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো পুনর্গঠনের ব্যাপারে তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু রাশিয়ার কাছে এ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বা অর্থ নেই। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার এ ক্ষেত্রে উচ্চপর্যায়ের একটি সমঝোতার পথ খুঁজছে।

তৃতীয় বিষয়টি হলো ইউক্রেন সরকারের ধরন। ফরমান জারি করে জেলেনস্কি সরকার নির্বাচনের প্রক্রিয়া স্থগিত রেখেছে। বিরোধী রাজনীতিকদের জেলে পাঠানো হয়েছে কিংবা তাঁদের কর্মকাণ্ড সীমিত করা হয়েছে কিংবা নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে।
জেলেনস্কির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো সামরিক শাসন তুলে দেওয়া এবং নির্বাচন আয়োজন করা। তবে জরুরি ভিত্তিতে যেটি করা দরকার, তা হলো রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি জোট সরকার গঠন করা।

একটি জোট সরকার যেকোনো চুক্তির দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সব কটি রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ভাগ করে দিতে পারে, যার ফলে তাদের পক্ষে ছাড় দেওয়ার পথও সহজ হয়। জোট সরকার গঠন করা হলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সুফল হতে পারে, এর মাধ্যমে ফুরিয়ে যাওয়ার হাত থেকে জেলেনস্কিকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব হবে।

ইউক্রেন এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। হয় দেশটি একই পথেই চলতে থাকবে এবং যুদ্ধে হারবে, অথবা বাস্তবতার নিরিখে সিদ্দান্ত নেবে, যেটি দেশটিকে আলোচনার টেবিলে ফেরাবে।

স্টিফেন ব্রায়েন এশিয়া টাইমসের বিশেষ সংবাদদাতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষানীতি বিষয়ক সাবেক উপপ্রতিমন্ত্রী

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জ ট সরক র গঠন কর য ক তর ষ ট র র স ইউক র ন র র জন য অবস থ য একট

এছাড়াও পড়ুন:

কুষ্টিয়ায় আবরার ফাহাদের কবর জিয়ারত করলেন এনসিপির শীর্ষ নেতারা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অসম চুক্তি এবং পানি আগ্রাসন নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে ছাত্রলীগের কর্মীদের মারধরে নিহত আবরার ফাহাদের কবর জিয়ারত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতারা।

মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে কুমারখালী উপজেলার কয়া ইউনিয়নের ৩ নাম্বার ওয়ার্ডের রায়ডাঙ্গা গ্রামে পৌঁছে তারা আবরার ফাহাদের কবর জিয়ারত করেন। এরপর তারা আবরারের পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। 
এনসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা শেষে কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। কুষ্টিয়া শহরে পদযাত্রা শেষে তাদের মেহেরপুর যাওয়ার কথা রয়েছে।  

জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রের কাঠামোগত সংস্কার এবং নতুন সংবিধানের দাবিতে দেশব্যাপী ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি পালন করছে এনসিপি। এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ  কুষ্টিয়া শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পথসভা করবে দলটি। 

আরো পড়ুন:

বিবৃতি দিয়ে আমাদের আটকাতে পারবেন না, ভয় পাই না: হাসনাত আব্দুল্লাহ

রাজনৈতিক দলগুলো চুপ্পুকে সরাতে ভয় পেয়েছে: নাহিদ ইসলাম

এর আগে দলের শীর্ষ নেতারা সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ৫৫মিনিটে কুষ্টিয়া শহরে পৌঁছান এবং আবাসিক হোটেলে রাত্রিযাপন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, যুগ্ম আহ্বায়ক ড. আতিক মুজাহিদ, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম, সাইফুল্লাহ হায়দার, আসাদুল্লাহ আল গালিব, আবু সাঈদ লিয়ন, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, ডা. মাহমুদা আলম মিতু, মোহাম্মদ আতাউল্লাহ, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী এবং কেন্দ্রীয় সদস্য ফিহাদুর রহমান প্রমুখ। 

এ ছাড়াও এনসিপির অঙ্গ সংগঠন যুব শক্তি ও শ্রমিক উইংয়ের কেন্দ্রীয় নেতা এবং কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। 

কাঞ্চন//

সম্পর্কিত নিবন্ধ