আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বগুড়ায় ‘আটকে রাখা’ চার প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ এগুলো প্রস্তাবনার সময় ১ হাজার ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। সরকার পতনের পর চাপা পড়ে থাকা প্রকল্পগুলো  সচলের উদ্যোগ নিলে ব্যয়ের এমন তথ্য সামনে এসেছে। ‘রাজনৈতিক কারণে’ এসব প্রকল্প আটকে রেখেছিল বলে অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে– বগুড়া বিমানবন্দর প্রকল্প, করতোয়া নদী উন্নয়ন, সারিয়াকান্দিতে যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প এবং মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল থেকে শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সড়ক নির্মাণকাজ। স্থানীয় অনেকে মনে করছেন, আওয়ামী লীগের সময়ে বগুড়া রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছিল। সে কারণে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। 
বিগত সরকারের সময় বগুড়ায় বড় কোনো উন্নয়ন হয়নি অভিযোগ করে সদরের গোকুল এলাকার বাসিন্দা মোজাম্মেল হোসেন বলেন, এ জেলাকে উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। বিমানবন্দরটি পর্যন্ত চালুর উদ্যোগ নেয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ও হয়নি। অবহেলিত বগুড়ায় এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু হবে বলে আশা তাঁর।
জানা গেছে, জেলার মানুষের বহু প্রত্যাশিত বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে। ১৯৯৫ সালে সদরের এরুলিয়ায় বগুড়া-নওগাঁ সড়কের পাশে ১০৯ একর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। ১২৩ কোটি টাকায় ৪ হাজার ৭০০ ফুট রানওয়ে নির্মাণসহ কিছু কাজ করা হয়। কিন্তু যাত্রীবাহী বিমান চলাচলে প্রয়োজন ৬ হাজার ফুট রানওয়ে।
এ জন্য প্রয়োজন ছিল আরও ৭১ কোটি টাকা। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এ খাতে আর বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি। ফলে যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা করার সক্ষমতা না থাকায় বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ স্কুল হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। বরাদ্দ না দেওয়ায় বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ে। 
আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বগুড়ায় নতুন করে বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। আরও ১৩শ ফুট রানওয়ে নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ এবং পুরোনো রানওয়ে সংস্কারসহ বিমান চলাচলের উপযোগী করতে ব্যয় ধরা হয় ১ হাজার ২২২ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্পের শুরুতে মাত্র ৭১ কোটি টাকায় এই কাজ সম্পন্ন করা যেত। এখন বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার ১৫১ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ২২ গুণ ব্যয় বেড়েছে করতোয়া নদী উন্নয়ন প্রকল্পে। শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় নদীর উন্নয়নে ১৩২ কোটির প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় ২০০১ সালে। এর পর কেটে গেছে প্রায় ২৩ বছর। পাল্লা দিয়ে ব্যয় বেড়ে হয়েছে ২২ গুণ। দখল-দূষণে মৃত করতোয়ার সর্বশেষ প্রকল্প প্রস্তাবনা ব্যয় ধরা হয়েছে ২ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। ‘স্মার্ট করতোয়া রিভার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’।
বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, করতোয়া নদী উন্নয়নের প্রকল্পটি এতদিন শুধু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ‘সবুজ পাতায়’ ছিল। অর্থাৎ এ-সংক্রান্ত ফাইল চাপা পড়ে ছিল টেবিলে। ৫ আগস্টের পর ফাইলটি সামনে আনা হয়। ইতোমধ্যে সমীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। এতদিনে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে গেছে ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় আরেকটি প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ৯৭ কোটি টাকা। এটি হলো সারিয়াকান্দির যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প। ২০১৭ সালে ৮২৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প হাতে নিলেও অর্থ বরাদ্দ না মেলায় কাজ শুরু হয়নি। ৫ আগস্টের পর এ প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার সবুজ সংকেত পায় কর্তৃপক্ষ। এর পর দেখা যায়, ব্যয় বাড়ছে আরও ৯৭ কোটি টাকা।
প্রকল্প দুটি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় জোর দিয়েছে জানিয়ে বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল হক বলেন, সমীক্ষার কাজ ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে। কিন্তু আগের চেয়ে ব্যয় বাড়ছে কয়েক গুণ। শুরুতে ইতিবাচক হলে এ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো।
এদিকে বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল থেকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের সংযোগ সড়ক প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০০৪ সালে। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। এর পর ঝুলে থাকে ১৮ বছর। এক পর্যায়ে বাস্তবায়নে সরকারের সম্মতি মেলে ২০২২ সালে। ততদিনে ব্যয় বাড়ে ১৪ গুণ। নতুন করে ব্যয় ধরা হয় ১৮৪ কোটি টাকা। 
বগুড়া বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য প্রচারাভিযান (সুপ্র) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক কে জি এম ফারুক। তিনি বলেন, এ কারণে বড় প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ও অনুমোদন মেলেনি। ফলে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বিপুল পরিমাণ অর্থ এক ধরনের অপচয় হচ্ছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: নদ র প রকল প হয় ছ ল র নওয় করত য় আওয় ম র সময়

এছাড়াও পড়ুন:

ধান চাষে আশা জাগাচ্ছে এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতি

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের কৃষক কমলেশ শর্মা পাঁচ বছর ধরে তিন একর জমিতে ধান চাষ করছেন। পানিনির্ভর এ ফসলে সেচ দিতে প্রতিবছর তিনি বিদ্যুৎ বিল গুনতেন ১৩ হাজার টাকার মতো। প্রচলিত সেচ পদ্ধতির চেয়ে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সাশ্রয়ী অলটারনেট ওয়েটিং অ্যান্ড ড্রায়িং (এডব্লিউডি) পদ্ধতি ব্যবহারে সেই খরচ এখন নেমেছে ১০ হাজার টাকায়। আগে যেখানে এক মৌসুমে ৭০-৮০ বার সেচ দিতে হতো, এখন দিতে হচ্ছে ৬০ বার। এ ছাড়া প্রতি বিঘায় ধানও মিলছে ৫ থেকে ৭ মণ বেশি। পরিমিত সেচ দেওয়ায় জমিতে হয় না জলাবদ্ধতাও। এতে একদিকে যেমন ভূগর্ভস্থ পানির অপচয় রোধ হয়েছে, কমেছে রোগবালাইও।

শুধু কমলেশ শর্মা নন; কালীগঞ্জ উপজেলার ৬০০ কৃষক এডব্লিউডি পদ্ধতি ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। শেয়ার দ্য প্ল্যানেটের সহযোগিতায় স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কৃষককে এডব্লিউডি কৌশলের আওতায় নিয়ে এসেছে। 

সম্প্রতি কালীগঞ্জের মহাদেবপুর, কুরুলিয়া, সুন্দরপুর, মহেশ্বরচন্দ, ইছাপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত। চারদিক পাকা ধানের ঘ্রাণে ম-ম। কৃষক সোনালি ফসল মাড়াই করছেন। নিজের ক্ষেতের পাশে বসে কৃষক আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে জানান, এ পদ্ধতিতে ১২ ইঞ্চি একটি প্লাস্টিক পাইপের ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত চারদিকে ছিদ্র করা হয়। এর পর ছিদ্রযুক্ত অংশ ধানের জমির নির্দিষ্ট স্থানে বসানো হয়। ভেতরের মাটি বের করার পর ছিদ্র দিয়ে পানি ঢোকে, যা দেখে জমিতে পানির পরিমাণ বোঝা যায়। ওই পানি দেখে প্রয়োজনমতো জমিতে সেচ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এই পদ্ধতিতে জমিতে ধানের চারা বেশি গজাচ্ছে। রোগবালাইয়ের পরিমাণও কম। সেচ মালিকদেরও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খরচ কমে এসেছে।
উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, আগে প্রতিদিন জমিতে সেচ দিতে হতো। এখন তিন-চার দিন অন্তর দিতে হয়। আগে না বুঝে পুরো জমিতে সেচ দেওয়া লাগত। অনেক বেশি বিদ্যুৎ বিল আসত। এখন তা লাগছে না। 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) গবেষকরা বলছেন, বর্তমানে এক কেজি ধান উৎপাদনে দেড় হাজার লিটারের মতো পানি লাগে, যার বেশির ভাগই পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ থেকে উত্তোলন করা হয়। এডব্লিউডি সেচ পদ্ধতিতে পানি সাশ্রয় হয় ২০০ লিটারের বেশি। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পানি সাশ্রয় হয়। এতে উৎপাদন খরচ কমে ২০ শতাংশের মতো। এ ছাড়া ৩-১০ শতাংশ পর্যন্ত উৎপাদন বাড়বে। 

ব্রির সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাহবুবুল আলম বলেন, দেশের কিছু অংশে ইতোমধ্যে এই পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এখন এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসারে সরকারি বিনিয়োগ দরকার। তিনি আরও বলেন, এডব্লিউডি পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রতিটি পাইপের খরচ ১০০-১৩০ টাকা। এক একর জমিতে তিনটি পাইপ যথেষ্ট।
স্থানীয় এনজিও সোনার বাংলা ফাউন্ডেশন কালীগঞ্জে এডব্লিউডি পদ্ধতির প্রসার ও প্রচারণায় কাজ করছে। ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শিবু পদ বিশ্বাস বলেন, আগে কৃষককে বিনামূল্যে পাইপ সরবরাহ করা হতো। কিন্তু এখন অনেকে নিজেরাই পাইপ কিনে নিচ্ছেন। 

ব্রির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, দেশে ধানক্ষেত থেকে প্রতিবছর ক্ষতিকর মিথেন গ্যাস নির্গমন হয় প্রায় ১.৩৯ থেকে ১.৫৬ মিলিয়ন টন। সেচে এডব্লিউডি ব্যবহারের মাধ্যমে এটি ২৫-৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব। এ ছাড়া ১০ লাখ হেক্টর জমিকে এডব্লিউডির আওতায় আনা গেলে বেঁচে যাওয়া পানি দিয়ে আরও প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় আনা যাবে। 

তবে বৃহত্তর পরিসরে এডব্লিউডি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। ধান বিজ্ঞানী এবং ব্রির সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বলেন, সবচেয়ে বড় বাধা, সেচ মূল্য নির্ধারণ ব্যবস্থা। 
পানি ব্যবহার করলে নলকূপ মালিককে পুরো মৌসুমের অর্থই পরিশোধ করতে হয় কৃষককে। সরকারকে এমন একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেখানে কৃষকরা ব্যবহৃত পানির পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে অর্থ দেবেন। এ ছাড়া কৃষকরা প্রায়ই নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত হন। এই ক্ষেত্রে সরকারি নীতি সংস্কার দরকার। 
আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল (ইফাদ) রিডুসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রামের অধীনে দেশে এডব্লিউডি কৌশল প্রচারের জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশে ইফাদের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ভ্যালানটাইন আচানচো বলেন, মিথেন গ্যাস নির্গমনের অন্যতম প্রধান উৎস দেশের সেচনির্ভর ধান চাষ। ধানক্ষেতে তৈরি হওয়া অক্সিজেনহীন পরিবেশ মিথেন উৎপাদনকারী অণুজীবের জন্য আদর্শ অবস্থা তৈরি করে। এই অবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি করে। তিনি আরও বলেন, রিডিউসিং এগ্রিকালচারাল মিথেন প্রোগ্রাম কর্মসূচির মাধ্যমে ইফাদ অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে, যাতে সচেতনতা বৃদ্ধি, সক্ষমতা উন্নয়ন এবং সরকারের ও সংশ্লিষ্ট অংশীদারদের তথ্যপ্রমাণভিত্তিক সহায়তা দেয়। এতে জলবায়ু-স্মার্ট কৃষি চর্চার গ্রহণযোগ্যতা ত্বরান্বিত করা যায়। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ