‘ব্যাডবয়’ কুশলকে পথে আনছেন জয়াসুরিয়া
Published: 8th, July 2025 GMT
‘ব্যাডবয়’ যখন পারফরমার হন, তখন তাঁর সাত খুন মাফ হয়ে যায়! খেলাধুলায় এটাই অলিখিত রীতি। ভালো খেললে ব্যাডবয়দের ছোটখাটো ভুল দেখেও না দেখার ভান করে মানুষ। কিংবা ব্যাডবয়রাই পারফরম্যান্স দিয়ে থামিয়ে দেন তাঁদের নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা।
কুশল মেন্ডিসকে কি সেটাই বলা যায়—শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ‘ব্যাডবয়?’ প্রেসবক্সের আলাপচারিতায় সঙ্গে সঙ্গে সায় দিলেন শ্রীলঙ্কার দুই সাংবাদিক। তাঁদের একজন রেক্স ক্লেইমেন্ত অবশ্য এটাও জানিয়ে দিলেন, ‘বছর দেড়েক ধরে, বিশেষ করে সনাৎ জয়াসুরিয়া কোচ হয়ে আসার পর থেকে তাকে অনেক কড়া শাসনে রেখেছেন। কুশলও জানে, আর একবার ভুল করলেই সে দলের বাইরে।’
হঠাৎ কুশল মেন্ডিসকে নিয়ে আলোচনা কেন, তা না বললেও চলে সম্ভবত। ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে আছেন শ্রীলঙ্কার টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। পাল্লেকেলেতে আজকের ম্যাচটিসহ ধরলে সর্বশেষ ছয় ওয়ানডের চারটিতেই ফিফটি, বাংলাদেশের বিপক্ষে আজকেরটিসহ যার দুটিকে নিয়েছেন তিন অঙ্কে। আজ তো শ্রীলঙ্কার ইনিংসের প্রায় পুরোটাই সাজিয়ে দিয়েছেন কুশল।
পাল্লেকেলের ব্যাটিং উইকেটেও বাংলাদেশের বোলাররা যখন কোনোভাবেই শ্রীলঙ্কার জুটিগুলোকে বড় হতে দিচ্ছিলেন না, অধিনায়ক চারিত আসালাঙ্কাকে নিয়ে কুশলই প্রতিরোধের দেয়াল তুলে চতুর্থ উইকেটে গড়েন ১২৪ রানের জুটি। ৫৮ বলে ফিফটি ও ৯৫ বলে সেঞ্চুরি করে শেষ পর্যন্ত আউট হয়েছেন শামীম হোসেনের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে। ২৮৫-তে থামা শ্রীলঙ্কার ইনিংস তখন ৪৬তম ওভারে, রান হয়ে গিয়েছিল ২৫৫। যাতে ১১৪ বল খেলা কুশলের একার অবদানই ১২৪।
কলম্বোয় সিরিজের প্রথম দুই ওয়ানডেতে ৪৫ আর ৫৬, গত ফেব্রুয়ারিতে তার আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০১। আরেকটু পেছনে গিয়ে যদি জানুয়ারির নিউজিল্যান্ড সফর এবং নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই খেলা হোম সিরিজ পর্যন্ত যান, কুশলের খাতায় সেঞ্চুরি আর ফিফটি পাবেন আরও একটি করে। সব মিলিয়ে গত ১০ ওয়ানডের হিসাব দিলে কুশলের সেঞ্চুরি তিনটি, ফিফটিও তিনটি।
২০১৫ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেক হওয়া কুশলকে ধরা হতো শ্রীলঙ্কার অন্যতম সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার। ২০১৬ সালে এই পাল্লেকেলেতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাঁর প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি (১৭৬)। যেটি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে করা সেঞ্চুরি হয়ে আছে এখনো।
কিন্তু সেই কুশলকে নিয়েই এখন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটে সাধারণ ধারণা—নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেননি এই ক্রিকেটার। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটও তাই তাঁর কাছ থেকে যতটুকু পাওয়ার, তা পায়নি।
কুশল মেন্ডিসের ক্যারিয়ারে মাঝেমধ্যেই ঝোড়ো হাওয়া বয়ে গেছে মূলত শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ২০২১ সালের জুনে ইংল্যান্ড সফরে শ্রীলঙ্কা দলের তিন ক্রিকেটার কুশল মেন্ডিস, নিরোশান ডিকভেলা ও দানুশকা গুনাতিলকা কোভিড বায়ো-বাবল ভেঙে হোটেল থেকে বের হয়েছিলেন।
এক ভিডিওতে দেখা যায়, কুশল আর ডিকভেলা ডারহামে টিম হোটেলের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এরপর তিন ক্রিকেটারকেই দেশে ফেরত পাঠানো হয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য এবং ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা হয় ছয় মাসের জন্য। সঙ্গে হয়েছিল আর্থিক জরিমানাও। অবশ্য ২০২২ সালের জানুয়ারিতেই তুলে নেওয়া হয় তাঁদের শাস্তি।
ইংল্যান্ডের ঘটনার ঠিক এক বছর আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ের শুরুর দিকে আরও বড় নেতিবাচক খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন কুশল মেন্ডিস। কলম্বোর দক্ষিণে প্যানাদুরা এলাকায় তাঁর চালিত গাড়ির চাপায় নিহত হন ৬৪ বছর বয়সী স্থানীয় এক সাইক্লিস্ট।
সংবাদমাধ্যমে আসা তখনকার খবর অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেটের এক স্টাফের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে ভোর পাঁচটার দিকে ওই এলাকা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কুশল। দুর্ঘটনার পর পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায় কুশলকে। অবশ্য পরদিনই প্যানাদুরা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে ১০ লাখ শ্রীলঙ্কান রুপিতে জামিন পান তিনি।
দুর্ঘটনায় কুশলের কতটা দায় ছিল, সেটি যদিও পরিষ্কার নয়; তবে ওই ঘটনার পর মানসিকভাবে বেশ ভেঙে পড়েছিলেন শ্রীলঙ্কা দলের এই ক্রিকেটার। তিরস্কৃত হন শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট থেকেও।
এটা তো ছিল মাঠের বাইরের দুর্ঘটনা, তবে ক্রিকেটেই কুশলের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আছে বিস্তর। ২০১৭ সালে দলের অনুশীলনে যোগ না দেওয়া এবং গভীর রাতে পার্টিতে যাওয়ার অপরাধে ছয় ম্যাচের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি। সর্বশেষ গত বছর ঘরোয়া ক্রিকেটের এক ম্যাচে টিম ম্যানেজারের সঙ্গে ঝগড়ার এক পর্যায়ে ভেঙে ফেলেন ড্রেসিংরুমের দরজা।
কোচের ভূমিকায় এসে সনাৎ জয়াসুরিয়া কাঁধে নিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের হারানো দিন ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব। সঙ্গে আছে কুশল মেন্ডিসের মতো ক্রিকেটারদের পথে আনার লড়াইও। সম্প্রতি প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও কুশলের কথা আলাদা করে বলেছেন কোচ, বলেছেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ যাঁদের হাতে, কুশল তাঁদেরই একজন।
কোচের বাড়তি দৃষ্টি, হোক সেটা শাসন কিংবা স্নেহের; সেটারই প্রতিফলন হয়তো দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটের ব্যাডবয়ের ব্যাটে!
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ঘটন
এছাড়াও পড়ুন:
বইয়ের ভুবনের এক উজ্জ্বল আলোকশিখা
মাত্র ক’টি বই আর সীমিত পুঁজি নিয়ে শুরুটা হয়েছিল ২০০৫ সালের ১৭ জুন। চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়ের মোড়ে একটি ঘরে যাত্রা শুরু করা বাতিঘর একে একে পেরিয়ে গেছে ২০ বছর। সেই ক্ষুদ্র পরিসরের স্বপ্ন আজ একুশ বছরে পা রেখেছে। বাতিঘর এখন শুধু একটি বইয়ের দোকান নয়; এ এক মনন ও সৃজনশীলতার আলোকদ্যুতি, পাঠকের ভালোবাসার ঠিকানা।
এই দীর্ঘ পথচলার গৌরব উদযাপনে গতকাল মঙ্গলবার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় ‘আলাপ, আড্ডা, আবৃত্তি ও গান’-এর। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া উপেক্ষা করে জড়ো হতে থাকে বইপাগল মানুষ। লেখক, পাঠক, শিল্পী, সাংবাদিক ও শুভানুধ্যায়ীদের মিলনে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে অনুষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, পণ্য হিসেবে বইয়ের বিক্রি অনেক বেশি না। তবে বইবিক্রেতা হিসেবে বাতিঘরের টিকে থাকা তো মননশীলতা-সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে অনেক বেশি আশাজাগানিয়া ঘটনা।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, বাংলাদেশে বইয়ের ব্যবসায় এখন দ্বিতীয় প্রজন্ম চলছে। বাতিঘর দ্বিতীয় প্রজন্মের বই ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। বইয়ের দোকানও যে আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় হতে পারে, তার একটা দৃষ্টান্ত ও মানদণ্ড তৈরি করে দিয়েছে বাতিঘর।
বইয়ের বিক্রি কমে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বই কতজন পড়ল, সেটি বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে, যারা বই পড়ে, তারাই দেশ-সমাজ-রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটা করতে পারে।
অনুষ্ঠানে বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর বলেন, প্রকাশক বাতিঘর অনেক ভালো বই প্রকাশ করেছে। পরেও নিশ্চয় করবে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যকে বিকশিত করার জন্য অনুবাদের দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। অনেক আগেই করা দরকার ছিল। বাতিঘরের মতো প্রকাশকরা অনুবাদে গুরুত্ব দিলে আগামী প্রজন্ম উপকৃত হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ শুভেচ্ছাবার্তায় বলেন, বাতিঘর একটি সৃজনশীল প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বড় শহরগুলোর সুসজ্জিত বই বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতেও এ সৃজনশীলতার পরিচয় মেলে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, লেখক আনিসুল হক, অধ্যাপক মনসুর মুসা, সাহিত্যিক মোহিত কামাল, বাদল সৈয়দ, আলতাফ পারভেজ, আফসানা বেগম, শিল্পী শাহীনুর রহমান, সাংবাদিক দীপ্তি চৌধুরীসহ অনেকে। সন্ধ্যার আয়োজন ছিল গান ও আবৃত্তিতে পূর্ণ। ওয়ারদা আশরাফ, দীপংকর দে, গার্গী ঘোষসহ অনেকেই পরিবেশন করেন সুরের মূর্ছনা।
বাতিঘর এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের চারটি বিভাগীয় শহরে–চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটে। শাহবাগ ও বাংলাবাজারেও রয়েছে দুটি বিক্রয়কেন্দ্র। ২০১৭ সালে পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনা সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি চার শতাধিক বই প্রকাশ করেছে।
একুশ বছরে পা রাখার এই গৌরব উদযাপনে প্রতিষ্ঠানটি ছয় মাসব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছে। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম, ঢাকা, রাজশাহী ও সিলেটের শাখাগুলোয় হবে বইমেলা, আলোচনা, পাঠ, প্রকাশনা ও নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন।