রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, সুনামসম্পন্ন ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক ও আইনের দ্বারা সৃষ্ট বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ লক্ষ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ (এনসিসি) নামের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত এনসিসির সদস্যরা হবেন: ১.

রাষ্ট্রপতি, ২. প্রধানমন্ত্রী, ৩. বিরোধীদলীয় নেতা, ৪. নিম্নকক্ষের স্পিকার, ৫. উচ্চকক্ষের স্পিকার, ৬. প্রধান বিচারপতি, ৭. নিম্নকক্ষের ডেপুটি স্পিকার, ৮. উচ্চকক্ষের ডেপুটি স্পিকার এবং ৯. সংসদের দুই কক্ষের সরকারি ও বিরোধীদলীয় সদস্যদের বাইরে থেকে নির্বাচিত একজন সদস্য, যিনি উভয় কক্ষের সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হবেন। 

শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, তথ্য কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি তিন বাহিনীর প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর প্রস্তাবিত কমিশনের নাম এনসিসির পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় তিন বাহিনীর প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগ এই প্রস্তাবিত কমিটির আওতার বাইরে রাখার।

পরিবর্তিত প্রস্তাবের পক্ষে অধিকাংশ দলের সমর্থন থাকলেও কিছু দল এর সঙ্গে দ্বিমত করে। তাদের যুক্তি হলো, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য এ ধরনের একটি সাংবিধানিক কাঠামো সৃষ্টি করা হলে তা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করবে। এর পরিবর্তে তারা আইনের মাধ্যমে পৃথক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করে। তাদের এ যুক্তি শুধু অসারই নয়, এটির ভয়াবহ পরিণতির আমরা সবাই ভুক্তভোগী।

নির্বাচন কমিশনের কথা ধরা যাক। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের চতুর্থ ভাগ ‘নির্বাহী বিভাগ’–সম্পর্কিত এবং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা, স্থানীয় শাসন, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেল এর অন্তর্ভুক্ত।

পক্ষান্তরে সপ্তম ভাগ ‘নির্বাচন’–সংক্রান্ত, যাতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগবিষয়ক অনুচ্ছেদ ১১৮ অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচন কমিশন যে নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়, তা সুস্পষ্ট হয় সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ থেকে, যাতে ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ বলা হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগসংক্রান্ত কোনো নতুন বিধান কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করবে না। কারণ, নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের অংশই নয়।

নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের অধীন না হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে নির্বাহী বিভাগ প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে আসছে, যাঁদের অনেকেই ছিলেন চরমভাবে বিতর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের ২৫ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ আজিজকে ভোটার তালিকা–সম্পর্কিত বিতর্কের কারণে পদত্যাগ করতে হয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত বিচারপতি আজিজের নিয়োগই অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।

নিয়োগ–সম্পর্কিত বিতর্কের প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির মুখে ২০১১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন, যাতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চার সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করা হয়, যার সদস্য ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষক আহমেদ আতাউল হাকিম ও সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী। 

দুর্ভাগ্যবশত বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে এড়ানোর জন্য গঠিত অনুসন্ধান কমিটিতেই ছিলেন বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট সদস্য। পাঠকদের অনেকের জানার কথা, সাবেক বিচারপতি নূরুজ্জামান তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্যানেলে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জুন মাসে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য তাঁর ১০ বছর হাইকোর্টে ওকালতি করার অভিজ্ঞতা ছিল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ২০১২ সালে রকিব কমিশন নিয়োগ পায়, যাঁদের বদৌলতে আমরা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য পেয়েছি।

অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে চরম পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের নগ্নতম দৃষ্টান্ত হলো নূরুল হুদা কমিশন। এবারও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ৩১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। ২০১৬ সালে ১৭ ডিসেম্বর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংলাপের সূচনা হয়।

সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ‘জনতার মঞ্চে’ অংশ নেওয়া এবং বিএনপির আমলে যুগ্ম সচিব হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো নূরুল হুদার নেতৃত্বে একটি পাতানো নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কমিশনই আমাদের ২০১৮ সালের ‘নৈশ ভোট’ উপহার দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই কলঙ্কিত নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল, বিএনপি ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিল, এমনকি আওয়ামী লীগও দুটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিল।

একইভাবে ২০২২ সালে একটি বিতর্কিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ প্রণয়ন করে এর অধীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে চরমভাবে বিতর্কিত আউয়াল কমিশন গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একটি একতরফা তথাকথিত ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনের মতো পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি, যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ছিলেন।

এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়। তাই এতে এনসিসির মতো একটি সাংবিধানিক কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করলে কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হবে না; বরং রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিলে আন্তদলীয় সম্প্রীতির একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। ফলে রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যা সমাধানের একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আমাদের দেশে গড়ে উঠবে।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আরও সুস্পষ্ট যে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রপতির আহ্বানে একাধিকবারের সর্বদলীয় সংলাপ সফল হয়নি। এমনকি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে নিয়োগ প্রদান করেও নির্বাহী বিভাগের ন্যক্কারজনক আচরণ বন্ধ করা যায়নি। এ কারণেই ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’র মতো একটি সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের নিয়োগ এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ, এসব নিয়োগ হবে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের পদস্থ ব্যক্তিদের সম্মতিতে ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং এ ধরনের সাংবিধানিক কাঠামো সাধারণ আইনের মতো সংসদের নিতান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েও বাতিল বা সংশোধন করা যাবে না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

* মতামত লেখকের নিজস্ব

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ত ব ত র ষ ট রপত ব তর ক ত র সদস য এনস স র ব চ রপত ঐকমত য র জন য ক ষমত আওয় ম ব এনপ সরক র র একট

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদে ঐক্য গড়তে তৎপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন

রাষ্ট্র সংস্কারের এক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে গত কয়েক মাস ধরে এগিয়ে আসছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’। এই সনদে স্বাক্ষর করাকে ঘিরে এখন রাজনৈতিক মহলে প্রতিযোগিতা ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। এরইমধ্যে ২৫টি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করেছে। তবে বামপন্থী চার দল এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখনো সই করেনি। এই কারণে স্বাক্ষর আদায়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তৎপরতা বাড়িয়েছে।

কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বর্তমান রাষ্ট্রসংস্থান, সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন সংস্থা সংস্কারের লক্ষ্যে এই সনদ প্রণয়ন করেছে।

কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে। এরপর ধারাবাহিক আলোচনার পর ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে সনদের খসড়া ঘোষণা করা হয়। রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর মতামত আহ্বান শেষে ১৭ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সনদে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করা হয়।

স্বাক্ষরের অগ্রগতি
আয়োজিত অনুষ্ঠানে কমিশনের প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে মোট ২৫টি রাজনৈতিক দল সনদে স্বাক্ষর করে। অনুষ্ঠানে স্বাক্ষর শেষে সনদ উঁচিয়ে দেখানোর মুহূর্তগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

বাকি দল ও তাদের শর্ত
যদিও বড় দলগুলো এরইমধ্যে স্বাক্ষর করেছে, তবু বামধারার চারটি দল- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ এখনও সই করেনি।

তারা সাত দফা দাবিসহ একটি স্মারকলিপি দিয়েছে। প্রধান আপত্তিগুলো হলো-
সনদের প্রথম অংশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত হয়নি।
ভিন্নমত সংযুক্তির বিষয়ে এনেক্স সংযোজনের প্রস্তাব থাকলেও তার সংবিধানিক কার্যকারিতা স্পষ্ট নয়।
সনদে বলা হয়েছে “কেউ সনদ নিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না” যা তারা নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী বলে মনে করছে। সংবিধানের ১৫০(২) ও ১০৬ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব তারা গ্রহণ করছে না।

অন্যদিকে, এনসিপি জানিয়েছে, তাদের তিনটি শর্ত পূরণ হলে তারা সনদে স্বাক্ষর করবে।

দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, “কমিশন আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত করেনি, তাই আমরা সেদিন সই করিনি। তবে আলোচনা চলছে। শর্তগুলো পূরণ হলে আমরা অবশ্যই স্বাক্ষর করব।”

কমিশনের কৌশল ও প্রস্তুতি
কমিশন এখন বাকি দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সংলাপ বাড়িয়েছে। যেসব দল এখনও মতামত দেয়নি, তাদের দ্রুত মতামত জানাতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “দল ও বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে আলোচনা চলছে। সনদ প্রণয়নের পাশাপাশি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি করতে হবে, যাতে এটি শুধু প্রতিশ্রুতির কাগজ না হয়ে বাস্তব পরিবর্তনের ভিত্তি হয়।”

সনদের মূল বিষয়বস্তু
খসড়া প্রকাশের সময় সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবগুলো ছিল ভাষার অধিকার: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা থাকবে, পাশাপাশি অন্যান্য মাতৃভাষার ব্যবহার ও স্বীকৃতি সংবিধানে যুক্ত করা হবে।
সংবিধান, নির্বাচন, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার। 

এসব সংস্কার পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের আগেই বাস্তবায়নের প্রস্তাব। সংশ্লিষ্ট আইনি পরিবর্তন ও সংবিধান সংশোধনের নির্দেশনাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

চ্যালেঞ্জ ও উদ্বেগ
সনদটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ হলেও এর বাস্তবায়নে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, বাম দল ও এনসিপির শর্ত ও আপত্তি এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। বাস্তবায়নের রূপরেখা এবং টাইমলাইন স্পষ্ট নয়।

আদালতে চ্যালেঞ্জ নিষিদ্ধের ধারা ও সংবিধান পরিবর্তনের অস্পষ্টতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সব দল একসাথে না থাকলে সংস্কার কার্যক্রম রাজনৈতিকভাবে জটিল হয়ে উঠতে পারে।

রাজনৈতিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ দিক
বিশ্লেষকদের মতে, এই সনদ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে— নির্বাচন, সংবিধান, বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কারের একটি স্বীকৃত নকশা তৈরি হবে।

দলগুলোর মধ্যে সংলাপ বাড়বে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। বিদেশি বিনিয়োগ ও নাগরিক আস্থা বাড়তে পারে, কারণ শাসন সংস্কারের রূপরেখা স্পষ্ট হবে। তবে যদি সনদ কেবল প্রতিশ্রুতিতেই সীমিত থাকে, তাহলে এটি রাজনৈতিক হতাশা তৈরি করতে পারে- বিশেষত যারা এতে অংশ নিচ্ছে না বা শর্ত দিয়েছে।

রাজনৈতিক দলের বক্তব্য
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটি সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “জুলাই জাতীয় সনদ (July National Charter) স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে কিছু দল তাদের স্বাক্ষর দিচ্ছে না, তবে সেটি আগামী দিনে করার সুযোগ এখনো খোলা রয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “চুক্তিটি স্বাক্ষর হওয়ার পরও কাজ অনেক আছে, এটি শুরু মাত্র। আমরা আশা করি পূর্ণ বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাবে। রাষ্ট্র আবেগভিত্তিকভাবে চলবে না, আইন‐নীতির ভিত্তিতে চলবে।”

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’র নায়েবে আমীর তাহের বলেছেন, “যদি জুলাই সনদকে আইনগত ভিত্তি দেওয়া না হয়, তাহলে আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সরকারকে মীমাংসার জন্য মামলা করব। আমরা ইতিমধ্যে বলেছি আমরা সনদ স্বাক্ষর করব না, যদি আইনগত ভিত্তি না থাকে। এটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বলেছেন, “আমরা মূলভিত্তিক সংস্কার এবং আইনগত বাধ্যবাধকতা ছাড়া জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব না। অনেকে ভেবেছেন স্বাক্ষর মানে সব মেনে নেওয়া কিন্তু তা ভুল। যদি সনদ কার্যকরভাবে প্রয়োগযোগ্য না হয়, আমরা স্বাক্ষর করব না।”

নাগরিক মত
ঢাকা–৮ আসনের ভোটার ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, “'জুলাই জাতীয় সনদ–২০২৫’ বাংলাদেশের চলমান সংস্কার আন্দোলনের একটি বড় মাইলফলক হতে পারে। রাজনৈতিক দল, কমিশন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে আলোচনায় এসেছে এটি আশাব্যঞ্জক। তবে বাম দল ও এনসিপির শর্ত এবং বাস্তবায়নের রূপরেখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশন সক্রিয়ভাবে দলগুলোকে যুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। যদি সনদ বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি কেবল একটি কাগজ নয় একটি পরিবর্তনের সূচক হয়ে উঠবে।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ প্রস্তুত করছে কমিশন, অগ্রগতি হিসেবে দেখছে এনসিপি
  • বাস্তবায়ন আদেশের ড্রাফট দেখার পর জুলাই সনদে স্বাক্ষর: আখতার
  • ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে এনসিপি
  • জুলাই সনদের বিষয়ে নিষ্পত্তির পর ভোটের দিকে যাবে এনসিপি
  • জুলাই সনদে ঐক্য গড়তে তৎপর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
  • দল হিসেবে আ.লীগকে বাদ দিতে পারেন না: জিএম কাদের
  • দীর্ঘ সংস্কার আলোচনায় অর্জন কতখানি
  • বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পুনরায় সভা করল ঐকমত্য কমিশন