সাংবিধানিক কাঠামো তৈরি করা কেন জরুরি
Published: 8th, July 2025 GMT
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সৎ, যোগ্য, সুনামসম্পন্ন ও দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক ও আইনের দ্বারা সৃষ্ট বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা চলছে। এ লক্ষ্যে কমিশনের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় কনস্টিটিউশনাল কাউন্সিল’ (এনসিসি) নামের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত এনসিসির সদস্যরা হবেন: ১.
শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, তথ্য কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি তিন বাহিনীর প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর প্রস্তাবিত কমিশনের নাম এনসিসির পরিবর্তে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’ করার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত হয় তিন বাহিনীর প্রধান ও অ্যাটর্নি জেনারেলের নিয়োগ এই প্রস্তাবিত কমিটির আওতার বাইরে রাখার।
পরিবর্তিত প্রস্তাবের পক্ষে অধিকাংশ দলের সমর্থন থাকলেও কিছু দল এর সঙ্গে দ্বিমত করে। তাদের যুক্তি হলো, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের জন্য এ ধরনের একটি সাংবিধানিক কাঠামো সৃষ্টি করা হলে তা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করবে। এর পরিবর্তে তারা আইনের মাধ্যমে পৃথক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করে। তাদের এ যুক্তি শুধু অসারই নয়, এটির ভয়াবহ পরিণতির আমরা সবাই ভুক্তভোগী।
নির্বাচন কমিশনের কথা ধরা যাক। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের চতুর্থ ভাগ ‘নির্বাহী বিভাগ’–সম্পর্কিত এবং রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা, স্থানীয় শাসন, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ ও অ্যাটর্নি জেনারেল এর অন্তর্ভুক্ত।
পক্ষান্তরে সপ্তম ভাগ ‘নির্বাচন’–সংক্রান্ত, যাতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগবিষয়ক অনুচ্ছেদ ১১৮ অন্তর্ভুক্ত। নির্বাচন কমিশন যে নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়, তা সুস্পষ্ট হয় সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ থেকে, যাতে ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’ বলা হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনে নিয়োগসংক্রান্ত কোনো নতুন বিধান কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করবে না। কারণ, নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের অংশই নয়।
নির্বাচন কমিশন নির্বাহী বিভাগের অধীন না হওয়া সত্ত্বেও ঐতিহাসিকভাবে নির্বাহী বিভাগ প্রধান নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দিয়ে আসছে, যাঁদের অনেকেই ছিলেন চরমভাবে বিতর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের ২৫ মে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এম এ আজিজকে ভোটার তালিকা–সম্পর্কিত বিতর্কের কারণে পদত্যাগ করতে হয়। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত বিচারপতি আজিজের নিয়োগই অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।
নিয়োগ–সম্পর্কিত বিতর্কের প্রেক্ষাপটে একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবির মুখে ২০১১ সালের ডিসেম্বর ও ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন, যাতে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টিসহ ২৩টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির নির্দেশে ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে চার সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করা হয়, যার সদস্য ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নূরুজ্জামান, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিরীক্ষক আহমেদ আতাউল হাকিম ও সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী।
দুর্ভাগ্যবশত বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগে এড়ানোর জন্য গঠিত অনুসন্ধান কমিটিতেই ছিলেন বিতর্কিত ও পক্ষপাতদুষ্ট সদস্য। পাঠকদের অনেকের জানার কথা, সাবেক বিচারপতি নূরুজ্জামান তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্যানেলে ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং জুন মাসে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্তির জন্য তাঁর ১০ বছর হাইকোর্টে ওকালতি করার অভিজ্ঞতা ছিল কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ২০১২ সালে রকিব কমিশন নিয়োগ পায়, যাঁদের বদৌলতে আমরা ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন এবং ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ সংসদ সদস্য পেয়েছি।
অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে চরম পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের নগ্নতম দৃষ্টান্ত হলো নূরুল হুদা কমিশন। এবারও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ৩১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করেন। ২০১৬ সালে ১৭ ডিসেম্বর প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংলাপের সূচনা হয়।
সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে ‘জনতার মঞ্চে’ অংশ নেওয়া এবং বিএনপির আমলে যুগ্ম সচিব হিসেবে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো নূরুল হুদার নেতৃত্বে একটি পাতানো নির্বাচন কমিশন নিয়োগ দেওয়া হয়। এ কমিশনই আমাদের ২০১৮ সালের ‘নৈশ ভোট’ উপহার দেয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই কলঙ্কিত নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছিল, বিএনপি ১ হাজার ১৭৭টি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিল, এমনকি আওয়ামী লীগও দুটি কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছিল।
একইভাবে ২০২২ সালে একটি বিতর্কিত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২২’ প্রণয়ন করে এর অধীন বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে গঠিত একটি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশে চরমভাবে বিতর্কিত আউয়াল কমিশন গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি একটি একতরফা তথাকথিত ‘আমি আর ডামির’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবারও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইনের মতো পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি, যিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, অনুসন্ধান কমিটির সদস্য ছিলেন।
এটি সুস্পষ্ট যে নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিকভাবে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নির্বাহী বিভাগের অংশ নয়। তাই এতে এনসিসির মতো একটি সাংবিধানিক কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করলে কোনোভাবেই নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব হবে না; বরং রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিলে আন্তদলীয় সম্প্রীতির একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। ফলে রাজপথের আন্দোলনের পরিবর্তে আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যা সমাধানের একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতিও আমাদের দেশে গড়ে উঠবে।
অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আরও সুস্পষ্ট যে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রপতির আহ্বানে একাধিকবারের সর্বদলীয় সংলাপ সফল হয়নি। এমনকি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে নিয়োগ প্রদান করেও নির্বাহী বিভাগের ন্যক্কারজনক আচরণ বন্ধ করা যায়নি। এ কারণেই ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের মতো সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি’র মতো একটি সাংবিধানিক কাঠামোর মাধ্যমে নিয়োগ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ধরনের নিয়োগ এসব প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ, এসব নিয়োগ হবে রাষ্ট্রের সব অঙ্গের পদস্থ ব্যক্তিদের সম্মতিতে ও রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে এবং এ ধরনের সাংবিধানিক কাঠামো সাধারণ আইনের মতো সংসদের নিতান্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েও বাতিল বা সংশোধন করা যাবে না।
● ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
* মতামত লেখকের নিজস্ব
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রস ত ব ত র ষ ট রপত ব তর ক ত র সদস য এনস স র ব চ রপত ঐকমত য র জন য ক ষমত আওয় ম ব এনপ সরক র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে কোন কোন ক্ষেত্রে ঐকমত্য-মতানৈক্য, জানাল বিএনপি
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপি কোন কোন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে মতানৈক্য রয়েছে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে দলটি।
বিএনপির মতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে আগ্রহ ও প্রত্যাশা যেমন অনেক তেমনি হতাশা ও উৎকণ্ঠাও রয়েছে জনমনে। বিএনপির পক্ষ থেকে যেমন ৬টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়া হয়েছে তেমনি ঐকমত্য কমিশনের প্রতিদিনের আলোচনায় দলের প্রতিনিধিরা কার্যকর অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে।
দলটি বলছে, বিভিন্ন বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার জন্য দলের প্রতিনিধিরা সভায় অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এছাড়া অনেক বিষয়ে ছাড় দিয়ে হলেও একমত হয়ে কমিশনের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে সহযোগিতা করেছে।
রোববার রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ আলোচনার পর সংস্কার কমিশনগুলো যেসব প্রস্তাব পেশ করেছেন, তার বিপরীত কিংবা নতুন নতুন প্রস্তাব উত্থাপন এবং তা নিয়ে অনেক সময় অচলাবস্থা সৃষ্টির কারণে কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আগ্রহী বলেই আমাদের প্রতিনিধিরা ধৈর্য ধরে আলোচনা শুনছেন এবং তথ্য প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিশনকে সহযোগিতা করছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার নামে জনগণের নির্বাচিত সংসদ, নির্বাচিত সরকার তথা রাষ্ট্র কাঠামোকে দুর্বল ও অকার্যকর করার কোন প্রস্তাবের যুক্তিসঙ্গত বিরোধিতা সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। জনগণকে জবাবদিহিতা করতে বাধ্য কোনও সরকারকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় দুর্বল ও অকার্যকর করা অবশ্যই সংস্কারের মূল আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ফলে এমন কোনও প্রয়াসে সমর্থন জানানো সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের পরিপন্থি বলে তা থেকে বিরত থাকার অর্থ- সংস্কার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা নয় বরং এই প্রক্রিয়াকে সহযোগিতা করা।
মির্জা ফখরুল বলেন, ৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের বিষয় এখনও আলোচনায় আসেনি। তবে ওই কমিশনে আমাদের দলের প্রতিনিধিবৃন্দের কাছে আমরা যতটুকু জেনেছি তাতে র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়েই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দুদক সংস্কার কমিশনে কতিপয় ছাড় দিয়ে ৪৭টি সুপারিশের ৪৬টিতেই আমরা সম্মতি জানিয়েছি। শুধু ২৯ নম্বর সুপারিশে আইনের মাধ্যমে করার পরিবর্তে আমরা আদালতের অনুমতি নেওয়ার বিদ্যমান বিধান অব্যাহত রাখার কথা বলেছি। আমরা মনে করি এটা না হলে দুদকের কার্যক্রমকে অহেতুক বিলম্বিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে।
তিনি বলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ২০৮টি সুপারিশের মধ্যে ১৮৭টি প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি এবং ৫টিতে আংশিক একমত হয়েছি। ৫টি সুপারিশে আমরা ভিন্নমত প্রদান করেছি। ১১টি প্রস্তাবে আমরা একমত হতে পারিনি- যেগুলো দেশে প্রদেশ সৃষ্টি, পদোন্নতি ও অন্যান্য প্রশাসনিক অসংগতির বিষয়ে। উল্লেখযোগ্য, পদোন্নতির বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় কার্যকর রয়েছে।
ফখরুল বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টি সুপারিশে আমরা একমত হয়েছি এবং ৯টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছি। ১৮টিতে ভিন্নমত পোষণ করে যুক্তিসহ পরামর্শ দিয়েছি। উল্লেখযোগ্য, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বিষয়ক সব প্রস্তাবে আমরা একমত হয়েছি। তবে এর কিছু বিষয়ে নির্বাচিত সংসদে আইন প্রণয়ন কিংবা ইতোমধ্যে কোনও অধ্যাদেশ হলে তা সংসদে রিটিফাই ও সাংবিধানিক সংশোধনীর প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, নির্বাচনী ব্যবস্থা বিষয়ক সংস্কার কমিশনের ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে আমরা একমত হয়েছি এবং ১৪টিতে আংশিকভাবে একমত হয়েছি। ৬৪টিতে আমরা ভিন্নমতসহ একমত হয়েছি। অর্থাৎ এসব বিষয়ে পরিবর্তনে একমত হয়ে বিভিন্ন আইনে ও বিধিতে সংশোধনী অধিকতর কার্যকর হবে তা প্রস্তাব করেছি। ২৪টি বিষয়ে আমরা একমত হতে পারিনি। উল্লেখযোগ্য, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংক্রান্ত ১২টি আইন ও ৬টি নীতিমালা আছে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও নির্দিষ্ট বিধান আছে। এসব প্রস্তাবের বেশ কয়েকটি বাস্তবায়নযোগ্য নয় এবং কয়েকটি নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে স্পষ্টতই বাধা সৃষ্টি করে তাদের সাংবিধানিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবে। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আনিত সব প্রস্তাবে একমত হয়েছি। আইনি সংস্কারের বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশে আমরা দফা ওয়ারী মতামত দিয়েছি। অধিকাংশ সুপারিশে একমত হয়েছি। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘৭০’ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ। দুই বিষয়েই আমরাই ছাড় দিয়েছি। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেয়ার বিধান বিশ্বের কোথাও না থাকার পরেও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা সম্মত হয়েছি। প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়েও আমরা আমাদের প্রস্তাব থেকে সরে এসে একমত হয়েছি।
তিনি বলেন, জাতীয় সংসদে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির পদ বিরোধী দলকে দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টিসহ আসন সংখ্যার অনুপাতে সভাপতির পদ দিতেও আমরা সম্মত হয়েছি। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংক্রান্ত আর্টিকেল ৪৯ পরিবর্তনে আমরা সম্মত হওয়ায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তন, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা, জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা বিন্যাসে সংস্কার আনার জন্য সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন ও আইনের মাধ্যমে বিশেষায়িত কমিটি গঠনেও আমরা একমত হয়েছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সম্মত হয়ে আমরা তা বিচার বিভাগের সাথে আলোচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নে পরামর্শ দিয়েছি। কারণ, ইতোপূর্বে ১৯৮৮ সালে এমন উদ্যোগকে উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছিলেন।
তিনি বলেন, এমন বহু সংস্কার প্রস্তাবে শুধুই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমরা একমত হয়েছি যেগুলো বাস্তবায়ন অত্যন্ত দূরুহ এবং যে উদ্দেশ্যে এসব প্রস্তাব তা অর্জনের সাফল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। রাষ্ট্র পরিচালনার এবং সংসদীয় কার্যক্রম দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা যুক্তিগ্রাহ্য মতামত দিয়ে আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি।
তিনি বলেন, ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। সংস্কার কমিশনসমূহের প্রস্তাবের উপর আলোচনা করে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও নিত্যনতুন এমন সব প্রস্তাব আসছে যেগুলো রাজনীতি, রাষ্ট্র ও সংসদ পরিচালনায় বিপুল প্রভাব ফেলবে। এসব প্রভাব ইতিবাচক হলে অবশ্যই তা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু রাষ্ট্রের মালিক জনগণকে সম্পৃক্ত না করে তাদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা প্রত্যাশার ক্ষেত্রে বড় কোনও পরিবর্তন করার অধিকার কোনও ব্যক্তি দল কিংবা কমিশনের আছে কিনা তা বিবেচনায় নিতে হবে। এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বলে আমরা মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিএনপি শুধু টিকে থাকেনি বরং অধিকতর শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়েছে। শত শহীদের রক্তে, গুম, খুনের শিকার সহকর্মীদের আত্মত্যাগে আর লাখো নেতাকর্মীর অবর্ণনীয় দুঃখ-শোকে বিএনপির ঐক্য আরও দৃঢ় হয়েছে। এই ঐক্যবদ্ধ শক্তি ও সমর্থ নিয়ে এবং দীর্ঘদিন রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিএনপি দেশে আবারও গণতন্ত্র পুনঃ-প্রতিষ্ঠায় ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থান রোধে আমরাই সবচেয়ে সক্রিয়। ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে অধিক ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ কায়েম হয় ঠিক তেমনি নির্বাচিত সরকার এবং সংসদকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল, ভঙ্গুর ও অকার্যকর হয়। আমরা যেন দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত পরিবর্তনের এই সুযোগকে গঠনমূলকভাবে কাজে লাগাই। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০-এর ছাত্র গণঅভ্যুত্থান এবং ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ না হই।
যারা নির্বাচন বিলম্ব করতে চায় তারা গণতন্ত্র ও জুলাই-আগস্টের পক্ষের শক্তি নয় বলে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন তিনি।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমেদ।