ফরিদপুরে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদের বাড়িতে চড়াও হওয়ার ঘটনার মামলায় জামিন নিয়েছেন বিএনপির ১৪ নেতাকর্মী। 
মঙ্গলবার সকালে ফরিদপুরের এক নম্বর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আসিফ এলাহী এ আদেশ দেন।

মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন ১৬ জন। তাদের মধ্যে আত্মসমর্পণ করেন ১৩ জন ও সোমবার গ্রেপ্তার বিএনপি কর্মী মির্জা আলীসন আজম প্রিন্স জামিন পান। জামিনপ্রাপ্ত অন্যদের মধ্যে আছেন- প্রধান আসামি মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ, কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান চৌধুরী, নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিনান, মহানগর যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম, মহানগর ছাত্রদলের সহসভাপতি ক্যাপ্টেন সোহাগ প্রমুখ।

আদালতে আসামিদের জামিন আবেদনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট জসীমউদ্দিন মৃধা। তাকে সহায়তা করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা, যুগ্ম আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী ভুঁইয়া রতনসহ বেশ কয়েকজন। এ সময় জামিনের বিরোধিতা করেন বাদীপক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম স্ট্যালিন।

পরে জসীমউদ্দিন মৃধা সাংবাদিকদের বলেন, দুই পক্ষের বক্তব্য শোনার পর আদালত ১০০ টাকার বেলবন্ডে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগ পর্যন্ত আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন।

এদিকে, জামিনপ্রাপ্তদের নিয়ে শহরে মিছিল করেন মহানগর বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আদালত প্রাঙ্গণ থেকে মিছিলটি বিচারপতি ইব্রাহিম সড়ক, মুজিব সড়ক হয়ে ফরিদপুর প্রেস ক্লাবের সামনে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে। সমাবেশে বক্তৃতা করেন মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গী, সদস্য সচিব গোলাম মোস্তফা মিরাজ, যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিনান প্রমুখ।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এ ক আজ দ নগর ব এনপ র ব এনপ র

এছাড়াও পড়ুন:

তেহরানের অভিজ্ঞতা থেকে ঢাকার শিক্ষা

আমরা যতই চোখ বন্ধ করে থাকি, বাস্তবতা ততই তীব্রভাবে সামনে এসে দাঁড়ায়। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধকে কেউ কেউ ভাবতে পারেন মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি সংঘাত, যার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই ধারণা চরম আত্মতুষ্টির। কারণ আজকের যুদ্ধগুলো শুধু গোলাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তা ছড়িয়ে পড়েছে সাইবার স্পেস, সংবাদমাধ্যম এবং নীতিনির্ধারণী স্তরে। এই যুদ্ধের ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক পাঠ, যেটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ইরানের ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে– একটি দেশের পতন বাইরের বোমা দিয়ে নয়, ভেতরের ফাটল দিয়ে শুরু হতে পারে। এই যুদ্ধের শিক্ষার ভেতরে লুকিয়ে আছে একটি সুসংগঠিত জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা তৈরির আহ্বান।

ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েছে ইরান তার ভেতরের বিশৃঙ্খলার কারণে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত। ‘ট্রেচারাস অ্যালায়েন্স’ বইতে গবেষক ত্রিতা পার্সি বলেছেন, ‘ইরানের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের অভাব এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরস্পর দ্বন্দ্বই বিদেশি আগ্রাসনের সবচেয়ে বড় সুযোগ তৈরি করেছে।’ এই বিশ্লেষণ বাংলাদেশের জন্য অমূল্য সতর্কতা। আমাদের দেশেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসনিক ইউনিট, সামরিক ও বেসামরিক দপ্তর– সব একেকটি দ্বীপের মতো। কারও সঙ্গে কারও যোগাযোগ নেই। সমলয়ে কাজ করা দূরের কথা, অনেক সময় পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতাও স্পষ্ট হয়। এই সমন্বয়হীনতাই সবচেয়ে ভয়ংকর। আমরা প্রায়ই বলি, ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, নিজেদের মধ্যকার অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতাই কি এ ধরনের ষড়যন্ত্রকে যেচে আমন্ত্রণ জানায় না?

আগে যুদ্ধ মানেই ছিল ট্যাঙ্ক, কামান, বিমান। এখন যুদ্ধ হয় অতি আধুনিক অস্ত্র দিয়ে, যাকে আমরা বলি সফট পাওয়ার। এর বিশেষ মাধ্যম হচ্ছে ‘মানবাধিকার’, ‘গণতন্ত্র’, ‘বিনিয়োগ নিরাপত্তা’ বা ‘ডিজিটাল আইন’। উইলিয়াম ব্লাম তাঁর ‘কিলিং হোপ’ বইতে দেখিয়েছেন, কীভাবে স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে পশ্চিমা শক্তি ও তার মিত্ররা নির্দিষ্ট দেশের ভেতরে ঢুকে বিভাজন তৈরি করেছে, তথ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং অর্থনৈতিক বাধার মাধ্যমে দেশগুলোর নীতিগত স্বাধিকার কেড়ে নিয়েছে। আজকের যুগে সেই কৌশল আরও ভয়ংকর। কারণ এখন আছে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স। বিদেশি রাষ্ট্র বা করপোরেট শক্তিগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে কোন বার্তাগুলো ভাইরাল হবে– তাও ঠিক করে দিতে পারে, যার সামনে আমরা প্রায়ই অসহায়।
বাংলাদেশ এখনই এই কৌশলের শিকার হতে শুরু করেছে। শ্রমিক অধিকার নিয়ে বিদেশি চাপ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা কিংবা জলবায়ু অনুদানের বদলে রাজনৈতিক সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা– সবই সেই সফট যুদ্ধের অংশ।

দরকার সমন্বিত রাষ্ট্রীয় নীতিমালা
বাংলাদেশের জাতীয় নীতির ক্ষেত্রে যে অসংহতি রয়েছে, তা ইরানের চেয়েও গভীর। ইরান যতই সংকটে থাকুক না কেন, তাদের ন্যূনতম একটি কৌশলগত ভিত্তি রয়েছে, বিশেষত প্রতিরক্ষা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ মূলত বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফল। কখনও ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখানো হয়, আবার কখনও ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাঝে একটি ‘জাতীয় নিরাপত্তানীতি’ও ঘোষিত হয়েছে, স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনার মধ্যে নেই কোনো সুসংহত কাঠামো বা আন্তঃসংস্থাগত সমন্বয়। সবচেয়ে বড় বিষয়, রয়েছে সার্বিক সুশাসনের অভাব। 

দেখা যাবে, বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, সাইবার নিরাপত্তা টিম, প্রশাসন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো চলে। সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নীতি বা কৌশলগত সমন্বয়ের উদাহরণ নেই বললেই চলে। অনেক সময় দেখা যায়, একই ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা থেকে, যা সংকট মোকাবিলায় নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। একটি পূর্ণাঙ্গ, বহুমাত্রিক ও বাস্তবভিত্তিক জাতীয় কৌশলপত্র দরকার, যেখানে রাষ্ট্রের সব গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা একই মানচিত্রে অবস্থান নির্ধারণ করতে পারে। নীতিমালার অভাব মানে শুধু অসংগঠিত অবস্থাই নয়; এটি একটি নিরাপত্তা ঝুঁকিও তৈরি করে, বিশেষ করে যখন প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ও অপ্রত্যাশিত চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। এখন সময় একীভূত কৌশলগত ভাবনার।

এই জায়গায় একটি সম্ভাব্য খসড়া প্রস্তাব হিসেবে ভাবা যেতে পারে ‘এনসিএসআইডি’ বা ন্যাশনাল কোহেশন অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক ইন্টেলিজেন্স ডকট্রিনের কথা, যার মূল স্তম্ভ হবে চারটি।
১. গোয়েন্দা সমন্বয় ব্যুরো-ইন্টেলিজেন্স সিনক্রোনাইজেশন ব্যুরো (আইএসবি): এই সংস্থা মিলিয়ে দেবে বিভিন্ন বাহিনী, ডিজিটাল নজরদারি, সীমান্ত রক্ষা ও অন্যান্য গোয়েন্দা ইউনিটকে। তাদের মধ্যে তথ্য ভাগাভাগি, দ্রুত হুমকি চিহ্নিতকরণ এবং সমন্বিত প্রতিক্রিয়ার কাঠামো গড়ে তুলবে।
২. সাইবার সার্বভৌমত্ব টাস্কফোর্স বা সাইবার সভরেন্টি টাস্কফোর্স (সিএসটি): এই ইউনিট কাজ করবে জাতীয় তথ্যভান্ডার, অর্থনৈতিক ও ডিজিটাল অবকাঠামো রক্ষায়। বিদেশি হ্যাকিং বা ডিজিটাল হামলার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ডেটা হচ্ছে নতুন জ্বালানি– এই উপলব্ধিকে কাজে লাগাবে।

৩. কৌশলগত যোগাযোগ ইউনিট বা স্ট্র্যাটেজিক কমিউনিকেশন ইউনিট (এসসিইউ): এই ইউনিটের কাজ হবে আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষা, বিদেশি বর্ণনার বিপরীতে নিজস্ব বয়ান বা ন্যারেটিভ তৈরি এবং নাগরিকদের মানসিক দৃঢ়তা গড়ে তোলা।
৪. অভ্যন্তরীণ ঐক্য পরিষদ বা ডমেস্টিক কোহেশন কাউন্সিল (ডিসিসি): রাজনৈতিক নেতা, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, একাডেমিক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদ অভ্যন্তরীণ বিভাজনের উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধ করবে। যেন সমস্যা সংঘর্ষে রূপ না নেয়। এই নীতিমালায় থাকবে বার্ষিক পুনর্মূল্যায়ন, আন্তঃসংস্থা মহড়া, বাস্তবমুখী নিরাপত্তা অনুশীলন ও আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সমন্বয় কাঠামো। এটি ‘সার্ভেইল্যান্স’ বা নজরদারিমূলক নয়; বরং প্রতিরোধমূলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ঐক্য কেবল শব্দ নয়; পূর্বশর্ত।

উইলিয়াম ব্লাম দেখিয়েছেন, বাইরের শক্তিগুলো সবচেয়ে বেশি সফল হয় তখনই, যখন ভেতরের ঐক্য থাকে না। তারা নতুন ফাটল তৈরি করে না; শুধু বিদ্যমান ফাটলগুলোকে চওড়া করে। ত্রিতা পার্সিও একইভাবে বলেছেন, ইরানের গোয়েন্দা ব্যর্থতা আসলে অভ্যন্তরীণ অসংগঠনের ফল। তারা পরাজিত হয়নি; বরং তাদের দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগানো হয়েছে।
এই কথাগুলো আমাদের জন্য আয়নার মতো। বাংলাদেশ এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে যায়নি। কিন্তু ভৌগোলিক দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা এমন অবস্থানে রয়েছি, যা ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তো বটেই, গোটা এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলোর নজর রয়েছে এখানে; নতুন ও পুরোনো পরাশক্তিগুলোর স্বার্থও রয়েছে এ অঞ্চলে। বস্তুত গোটা বিশ্বব্যবস্থা আজ এমন নাজুক পরিস্থিতি অতিক্রম করছে, যে কোনো সময় যে কোনো অঞ্চলে বিদ্যমান নিরাপত্তা কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। আমাদের উচিত সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। সে জন্য বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।

বাংলাদেশ একই সঙ্গে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে যেতে চায়– চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও অংশীদারিত্ব। ভারত, রাশিয়া, সৌদি আরব– সবদিকেই সমীকরণ। কিন্তু এই কূটনীতির ফসল ঘরে তুলতে চাইলে আগে ঘরের ভিত শক্ত করতে হবে। আমরা যদি নিজেদের সংস্থাগুলোকে ক্ষেত্রবিশেষে একটি কৌশলে না আনতে পারি; নিজেদের বিভক্তিকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারি, তাহলে অন্য কেউ আমাদের জন্য নীতি বানিয়ে দেবে। তখন আমরা স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলব।

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি
    alauddin0112@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ