দর-কষাকষি করতে না পারলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্য রপ্তানিতে শুল্কের বোঝা চেপে বসবে—তিন মাস আগের এমন শঙ্কাই সত্য হওয়ার পথে। বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের কথা জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

বাংলাদেশের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানসহ মোট ১৪টি দেশের ওপর নতুন করে শুল্কহার নির্ধারণের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। হোয়াইট হাউসের ৯০ দিনের শুল্ক বিরতির সময়সীমা শেষ হতে চলায় ট্রাম্প এই ঘোষণা দেন। এর আগে ৯ জুলাই থেকে শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও সেটি পিছিয়ে ১ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে দর-কষাকষি করতে পারলে শুল্কহার কমতে পারে, অন্যথায় ঘোষিত হার কার্যকর হবে। অবশ্য তিন মাস আগেই সব দেশের পণ্য রপ্তানির ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর করে যুক্তরাষ্ট্র।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে মোট শুল্ক ভার কত দাঁড়াবে? ৭ এপ্রিল জারি করা ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, এই হার হবে এত দিন থাকা শুল্ক হারের অতিরিক্ত। মানে হলো, এত দিন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের পণ্য যে হারে শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যেত, তার সঙ্গে যুক্ত হবে নতুন এই পাল্টা শুল্ক।

ইউএস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যে যত শুল্ক আদায় করা হয়েছে, তা গড় করলে হার দাঁড়ায় ১৫ শতাংশের মতো। ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে মোট শুল্কহার দাঁড়াবে ৫০ শতাংশ। তার মানে, বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে।

পাল্টা শুল্ক নিয়ে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ জন্য বর্তমানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। তবে গত তিন মাসে দর-কষাকষি শেষে যুক্তরাজ্য ও ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টিও কাছাকাছি পৌঁছেছে বলে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে পিছিয়ে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারকেরা। তাঁরা বলছেন, বাড়তি ৩৫ শতাংশ শুল্ক কার্যকর হলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ধস নামতে পারে। অথচ বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত আলোচনা শুরু করেনি। তিন মাস যখন শেষ হতে যাচ্ছে, তখন তাঁরা কেবল আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসছেন। এই পাল্টা শুল্কের কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করেন তাঁরা।

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির একক বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। গত এপ্রিলে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তখন আগ্রাসী এই শুল্কহার কার্যকর করার আগে সময় দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি লিখেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য-ঘাটতি কমাতে পদক্ষেপ নেওয়া এবং আলোচনার আগ্রহের কথা জানিয়ে জেমিসন গ্রিয়ারকে চিঠি দেন। পরে মে মাসে পাল্টা শুল্ক আরোপ নিয়ে দর-কষাকষি করতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিখিত প্রস্তাব চেয়ে চিঠি দেয় যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) দপ্তর।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ ছাড়া মাথার টুপি বা ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা এবং অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য বেশি রপ্তানি হয়।

গত এপ্রিলে ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। দর-কষাকষির পর এখন সেটি কমে ২০ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর নতুন করে ২৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে মার্কিন প্রশাসন। এ ছাড়া মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যের ওপর ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, বসনিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ, সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ এবং কাজাখস্তানের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্কহার নির্ধারণ করা হয়েছে। এই শুল্ক সব খাতভিত্তিক শুল্কের অতিরিক্ত হিসেবে প্রযোজ্য হবে, তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হলে পণ্য রপ্তানিতে কী প্রভাব পড়বে, সেটি জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তাফিজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, রপ্তানিতে ধস নামবে। তার কারণ, এই পরিমাণ শুল্ক দিয়ে অনেক মার্কিন ক্রেতাই পোশাক কিনতে আগ্রহী হবেন না। শুধু তা–ই নয়, এই পাল্টা শুল্কের প্রভাবে ইইউর বাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, তখন অনেকেই ইইউর ক্রয়াদেশ নিতে চাইবে। ফলে পোশাকের দাম কমানোর সুযোগ নিতে পারেন ইইউর ক্রেতারা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: য ক তর ষ ট র র ব শ ল ক ক র যকর শ ল ক আর প য় র ওপর উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

জাতীয় নির্বাচন ঘিরে শঙ্কা ও সতর্কতাগুলো কী

এ দেশে গণ-অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৯৯০ সালে এ দেশের ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলগুলো একটি সফল গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১০ বছর ধরে ক্ষমতার মসনদে বসে থাকা স্বৈরশাসক এরশাদের পতন ঘটিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তিন মাসের কম সময়ের মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, যা ওই সময় অনেকের কাছেই একটি অসম্ভব বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পরও আমরা একই ধরনের একটি সময় অতিক্রম করছি। কিন্তু ’৯১-এর নির্বাচন যেভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল, সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও অবাধ আগামী নির্বাচনটি হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায়।

’৯১-এর নির্বাচনে তিন জোটের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে যে ঐক্য ছিল, তা এবার অনুপস্থিত। সে সময় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘাত যেমন ছিল না, তেমনি নিজেদের মধ্যে অন্তর্কোন্দলে নেতা-কর্মী নিহত হওয়ার ঘটনাও বিরল ছিল। অপরদিকে বর্তমানে প্রশাসন, পুলিশসহ সরকারি সব দপ্তরকে দলীয়করণের যে অভিযোগ রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে, তা যে ছাব্বিশের নির্বাচনের জন্য একপ্রকার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে এটি একেবারেই দৃশ্যমান যে এবারের নির্বাচন ’৯১-এর নির্বাচনের মতো সরল সমীকরণে নয়; নানাবিধ জটিল হিসাব-নিকাশ করেই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। 

যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ থেকে শুরু করে কমিশনের প্রায় সব স্তরে নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের বসানোর চেষ্টা করে।

জাতীয় নির্বাচনেও কত শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছে, তা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা যেতে পারে।

দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক নতুন বন্দোবস্ত তৈরি করার ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচন আদৌ সফল হবে কি না—সে নিয়ে এখনো সন্দেহের মেঘ কাটেনি; বরং দিন দিন নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। এর মধ্যে অন্যতম চ্যালেঞ্জগুলো হলো:

প্রশাসনিক সক্ষমতার অভাব

সরকারি আমলাদের হাত ধরেই এ দেশে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে; যেখানে রাতের আঁধারে ব্যালট বাক্স ভর্তির ঘটনা, ভোটারসংখ্যার চেয়ে অধিক ভোট গ্রহণসহ সব ধরনের আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড মানুষের চোখের সামনে ঘটেছে এদের মাধ্যমেই। ফলে বর্তমানে যে প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর রয়েছে, সেটি মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েই গঠিত ও প্রভাবিত। পুলিশের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা বিরাজমান। সুতরাং যে পুলিশ ও প্রশাসনের অতীত ইতিহাস সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে ইতিবাচক নয় এবং যাদের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ—সেই কাঠামোর ওপর ভর করে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আশঙ্কা থেকে যায়।

সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো, প্রশাসন কিংবা পুলিশের মধ্যে যাঁরা অতীতে নির্বাচনে কারচুপি ও অসদুপায় অবলম্বন করে নির্দিষ্ট প্রার্থী বা দলের জন্য কাজ করেছেন, তাঁদের কাউকেই বিগত এক বছরের বেশি সময়ের মধ্যে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি। ফলে অসৎ সরকারি কর্মকর্তাদের হাতে এবারের জাতীয় নির্বাচন যেন কোনোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ না হয়—সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। 

আরও পড়ুননির্বাচনের আশ্বাসে অস্বস্তি ও শঙ্কার ঘ্রাণ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন দীর্ঘদিন ধরেই একটি দুর্বল প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। এর অন্যতম কারণ হলো, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, তারা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ থেকে শুরু করে কমিশনের প্রায় সব স্তরে নিজেদের অনুগত ব্যক্তিদের বসানোর চেষ্টা করে। ফলে কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা শুরু থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। এবারের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ এনসিপির কয়েকজন নেতার পক্ষ থেকে একাধিকবার শোনা গেছে। 

পাশাপাশি দেশের নির্বাচনব্যবস্থা, নির্বাচনী সহিংসতা এবং পারিপার্শ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে শক্তিশালী জনবল, লজিস্টিক সহায়তা, আইনগত ক্ষমতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি প্রয়োজন—নির্বাচন কমিশনের মধ্যে তার কোনোটিই যথাযথভাবে বিদ্যমান নয়।

আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা মতামত প্রদানের ক্ষেত্রেও প্রায়ই দ্বিধান্বিত অবস্থায় দেখা যায়। এমনকি নির্বাচনকালীন যদি কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করে, সে ক্ষেত্রে কমিশনের হাতে প্রয়োজনীয় আইনি ক্ষমতা ও জনবল—উভয়েরই ঘাটতি রয়েছে।

অতীতে দেখা গেছে, নির্বাচনে অনিয়ম, কারচুপি ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক প্রার্থী পরবর্তী সময়ে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রকাশ্যে এসব কর্মকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, কিন্তু নির্বাচন কমিশন তখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়নি। তদ্রূপ প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় সম্পত্তি বা অন্যান্য তথ্যসংক্রান্ত নথিতে মিথ্যা বা জাল তথ্য উপস্থাপন করলেও কমিশনের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা দেখা যায় না। এসব কারণে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন একটি দুর্বল ও অকার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ফলে আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা ও প্রয়োজনীয় ক্ষমতা প্রদান করা নিতান্তই আবশ্যকীয় বিষয়ে পরিণত হয়েছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য

বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য খুবই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। যদি খেয়াল করি, দেখা যাবে যে বর্তমানে ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলো কোনো না কোনোভাবে একে অপরের বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। একদিকে বিএনপি বলছে যে তারা কোনোভাবেই পিআর সিস্টেম গ্রহণ করবে না, অন্যদিকে জামায়াত পিআরের জন্য এখনো আন্দোলনরত। আবার প্রধান উপদেষ্টা উচ্চকক্ষে পিআরের ঘোষণা দেওয়ায়  বিএনপি মনঃক্ষুণ্ন। 

শুধু তা-ই নয়, জুলাই সনদের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। একদিকে জামায়াত বলছে নির্বাচনের আগেই গণভোট হতে হবে, অন্যদিকে বিএনপি নির্বাচনের দিন ছাড়া কোনো ভোট মানবে না। এ ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার একই দিনে নির্বাচন ও গণভোটের ঘোষণায় জামায়াত সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট।

তৃণমূলের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে বিএনপির অন্তর্দলীয় বিভাজন এবং সংঘর্ষের ঘটনা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। অপরদিকে জামায়াত-বিএনপি, বিএনপি এবং অন্যান্য দলের মধ্যে সংঘর্ষ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বর্তমান সরকার বা নির্বাচন কমিশনের এই সংঘর্ষ মোকাবিলার যথাযথ সক্ষমতা নেই। সুতরাং দলগুলোর মধ্যে যদি এ ধরনের বিশৃঙ্খলা দিন দিন বৃদ্ধি পায়, তবে তা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবং নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতাকে কমিয়ে দেবে। সর্বোপরি নির্বাচন আয়োজনের পুরো প্রক্রিয়াকেই প্রশ্নের মুখে ফেলবে। 

অপরদিকে আমাদের দেশে পরাজিত প্রার্থী কিংবা দলের নির্বাচন বর্জনের প্রথাও কম প্রচলিত নয়। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল যদি নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন করে নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়, তবে তা দেশকে একটি অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত করবে। 

আরও পড়ুননির্বাচন নিয়ে শঙ্কা নেই, কিন্তু মান নিয়ে সংশয় তৈরি হতে পারে২১ অক্টোবর ২০২৫আওয়ামী লীগের তৎপরতা

আওয়ামী লীগের তৎপরতা আগামী নির্বাচনের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আওয়ামী লীগ তাদের পতনের পরপরই নির্বাচনের দাবি করলেও বর্তমানে তারা নির্বাচনকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না; কারণ, এবারের নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত একেবারেই ক্ষীণ। আওয়ামী লীগের ধারণা অনুযায়ী, যদি তারা এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে এবং নির্বাচনটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে আবার রাজনীতির মূল মঞ্চে ফেরা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। তাই তারা তাদের সব শক্তি ব্যবহার করে নির্বাচনের প্রতিটি প্রক্রিয়া ব্যাহত করার চেষ্টা করতে পারে।

এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা সম্ভাব্য কয়েকটি কৌশল গ্রহণ করতে পারে—প্রথমত, তারা নির্বাচনের আগেই দেশে সহিংসতা সৃষ্টি করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পারে। 

দ্বিতীয়ত, যদি তারা সরাসরি নির্বাচন ভঙ্গ করতে সক্ষম না হয়, তবে তাদের ভোটব্যাংককে নির্বাচন বর্জন ও ভোট না দেওয়ার জন্য প্ররোচিত করা—যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কমে যায়। তৃতীয়ত, ভোটের আগে ও ভোটের দিন জ্বালাও-পোড়াও, হরতাল ও অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাতে ভোটাররা কোনোভাবেই ভোট দিতে যেতে না পারেন। 

ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ যত কম হবে, ভোটের হারও ততই কমবে; পরিণতিতে যখন দেখা যাবে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভোটে অংশগ্রহণ করেনি, তখন আওয়ামী লীগ দাবি করতে পারে যে ওই অনুপস্থিত অংশ তাদের সমর্থক এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভোট বর্জন করেছে—আর এটিকেই প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করবে যে নির্বাচন একতরফা হয়েছে। 

আরও পড়ুনফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই০২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ভোটারদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার শঙ্কা 

দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক ভোট পড়েছিল নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন—২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, যেখানে মোট ভোট পড়েছিল প্রায় ৮৭ শতাংশ। অর্থাৎ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারলে এ দেশের বিপুলসংখ্যক ভোটার ভোট দিতে আগ্রহী থাকে। ফলে আসন্ন ছাব্বিশের জাতীয় নির্বাচনেও কত শতাংশ মানুষ ভোট দিচ্ছে, তা নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা যেতে পারে।

তবে এবারের নির্বাচনে এত বড় শতাংশ ভোটার ভোট দেবে কি না, তা নিয়ে কিছু সন্দেহ থেকে যায়। কেননা যেহেতু আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই তাদের মোট ভোটারের অর্ধেকের বেশি এবারের নির্বাচনে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ যে অঞ্চলগুলোতে শক্তিশালী, সেখানে যদি তারা মানুষকে ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়, তবে সব মিলিয়ে তারা ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট কাস্ট কমিয়ে দিতে পারে। অন্যদিকে এ দেশের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ সাধারণত ভোট দেয় না। ফলে সব মিলিয়ে মোট কাস্টের হার ৬০-৬৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। 

আরও পড়ুনবাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান কী০৭ নভেম্বর ২০২৫উত্তরণের উপায় কী 

আমাদের উত্তরণের উপায় খোঁজার আগে আগামী নির্বাচনের তাৎপর্য খুব ভালো করে বোঝা দরকার। কেননা একটি যেনতেন নির্বাচন যদি অনুষ্ঠিত
হয়, তাহলে সেটা দেশকে দীর্ঘকালীন একটি সংকটের মধ্যে ফেলে দেবে—যে সংকটের একদিকে থাকবে রাজনৈতিক অনাস্থা, অপরদিকে থাকবে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার বাস্তবায়ন এবং জুলাইয়ের দাবিগুলো। 

উদাহরণস্বরূপ যদি ধরে নেওয়া হয় আগামী নির্বাচনে বিএনপি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে—কিন্তু যদি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হয় কিংবা নির্বাচন নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি না হয় এবং সরকারকে বিরোধী দলগুলো আন্দোলন করে অতিষ্ঠ করে তোলে (যার উদাহরণ ’৯১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রতিটি টার্মে দেখা গেছে), তবে বিএনপির জন্য সরকার পরিচালনা করা দুর্বিষহ বিষয় হয়ে উঠবে; দেশও নানাবিধ সংকটের মুখে পড়তে পারে।

সমাধানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেখানে জোর দেওয়া প্রয়োজন, সেটা হলো রাজনৈতিক আস্থার ভিত্তিতে এমন একটি নির্বাচন আয়োজন করা, যেখানে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকবে এবং রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি আস্থাশীল হবে। দলগুলোকে জনগণের সামনে এ প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রয়োজন যে তারা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সরকার বা বিরোধী দল যা-ই হোক না কেন, দেশের স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে পুরোনো দিনের মতো সংঘাতে না জড়িয়ে উন্নয়নের জন্য কাজ করবে। কেননা বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর একে অপরের প্রতি যে বিধ্বংসী মনোভাব দেখা যাচ্ছে, সেটা যেন কোনো তৃতীয় পক্ষ অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি না করে—এটাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। 

পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে মানুষকে ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য উৎসাহিত করা এবং সরকারের প্রধান দায়িত্ব থাকবে ভোটারদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যেন ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে এসে ভোট দিয়ে যেতে পারেন। 

মনে রাখতে হবে, ’৯১-এর নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হতো, তবে ২০০৮ সাল পর্যন্ত গণতান্ত্রিক যে যাত্রা—সেই যাত্রায় সেখানেই একটি ব্যত্যয় ঘটে যেত। ফলে ’২৬-এর নির্বাচনকেও এমন একটি মাপকাঠিতে উন্নীত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে ওই মানদণ্ড অনুযায়ী পরবর্তী নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেটা অর্জনে যদি রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দলগুলো ব্যর্থ হয়, তবে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে আকাঙ্ক্ষা জনমনে সৃষ্টি হয়েছে, সেটা অপূর্ণই থেকে যাবে। 

সৈয়দা লাসনা কবীর অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, লোক প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এস কে তৌফিক হক অধ্যাপক ও পরিচালক, সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

মোহাম্মাদ ঈসা ইবন বেলাল প্রভাষক, লোক প্রশাসন ও সরকার পরিচালনাবিদ্যা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকদের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ