নুরে জান্নাতের মায়ের সঙ্গে যখন ওর বাবার দাম্পত্য কলহ শুরু হয়, তখন সে মাতৃগর্ভে। আরও দুই মাস পর নুরে জান্নাত যখন পৃথিবীতে আসে, তখন মা–বাবা দুজনই আদালতের কাঠগড়ায়। তার মা তার বাবার বিরুদ্ধে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন।

২০২২ সাল। আমি পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম তখন। আমার আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য ডাক পড়ে। এক পক্ষে নুরে জান্নাতের বাবা নুরজামাল ইসলাম আর অপর পক্ষে মা আঁখি মণি। আঁখি মণির কোলে ১১ মাসের নুরে জান্নাত। আমার মনে হলো, এ মামলায় শাস্তি হলে কোনো দিন আর মা–বাবাকে একসঙ্গে পাবে না সে। আঁখি মনির সংগতিও নেই মেয়েটাকে একলা বড় করার। মনে হলো, তার মা–বাবাও চায় না আসলে এমন।

উভয় পক্ষের সঙ্গে কথা বলি, বোঝাতে থাকি। অবশেষে বরফ গলতে শুরু করে। নুরজামাল এগিয়ে এসে হাত ধরেন আঁখি মণির। একমুহূর্তে আমার এজলাস হয়ে ওঠে পারিবারিক আনন্দের একটা অঙ্গন।

দাম্পত্য বিরোধের সফল নিষ্পত্তির এ সংবাদ ২০২২ সালের ২৩ জানুয়ারি ‘বিচারকের মধ্যস্থতায় প্রথম মা-বাবাকে একসঙ্গে পেল ১১ মাসের জান্নাত’ শিরোনামে প্রথম আলোয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পঞ্চগড়ে এ রকম আরেকটি ঘটনা নিয়ে ২৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখে প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, ‘আদালতের মধ্যস্থতায় টিকে গেল ১৭ বছরের সংসার’।

সারা দেশে দাম্পত্য কলহ নিয়ে এ রকম হাজারো ঘটনা আছে। ছোটখাটো দাম্পত্য বিরোধের জেরে স্বামী বা স্ত্রী রাগের মাথায় আদালতে মামলা করলেও শেষে আপস–মধ্যস্থতায় সমাধানের বহু নজির রয়েছে। অনেক সময় আবার স্বামীর কারাদণ্ড হলে যে অনিশ্চয়তার পড়তে হবে, সেটা ভেবেও নারীরা মামলা চালাতে চান না​। অনেক ভোগান্তির পর তখন তাঁরা আপস করার জন্য আবেদন করেন। এসব বিবেচনায় ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়েও যৌতুকের জন্য ছোটখাটো মারধর বা বিরোধের ঘটনাকে আপসযোগ্য করা হয়েছে।

যৌতুকের কারণে নির্যাতনের মামলাগুলো অনেক সময় সরাসরি আমলে না নিয়ে আদালত থেকে বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি কর্মকর্তাকে তদন্ত করতে দেওয়া হতো। এই তদন্তকালেও অনেক মামলা আপস হয়ে যেত। এসব ক্ষেত্রে শুরুতে উভয় পক্ষের মধ্যে আপস–নিষ্পত্তির সুযোগ থাকলে ভাঙন ও ভোগান্তি থেকে রক্ষা পায় পরিবারগুলো।

পৃথিবীর অনেক দেশেই মামলা করার আগে মধ্যস্থতার জন্য মধ্যস্থতাকারীর কাছে যাওয়ার বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও বিচারপ্রার্থী মানুষের এ দাবি ছিল অনেক দিনের।

এসব বিষয় বিবেচনা করে, আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই অধ্যাদেশের অন্যতম দিক হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করার আগে মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির বিধান।

এ অধ্যাদেশের আরেকটি বড় দিক হলো মধ্যস্থতা চুক্তির কার্যকারিতা। আগে লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত চুক্তিপত্র পক্ষদের ওপর বাধ্যকর ছিল না। ফলে তারা আপস চুক্তি লঙ্ঘন করে আবার মামলায় জড়িয়ে যেত। বর্তমান আইনে পক্ষদের মধ্যে সম্পাদিত ও চিফ লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা কর্তৃক প্রত্যায়িত মধ্যস্থতা চুক্তি চূড়ান্ত বলবৎযোগ্য এবং পক্ষদের ওপর বাধ্যকর হবে মর্মে বিধান করা হয়েছে। এর ফলে ছোটখাটো বিরোধীয় বিষয়গুলো আপস–মীমাংসার মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তা ও মধ্যস্থতাকারীর দ্বারাই নিষ্পত্তি হবে। আর বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকছে।

বর্তমান অধ্যাদেশের তফসিলে যৌতুক নিরোধ আইন এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন–সম্পর্কিত অভিযোগ ছাড়াও পারিবারিক আদালত আইন, বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, সহকারী জজদের এখতিয়ারভুক্ত বণ্টন–সম্পর্কিত বিরোধ, অগ্রক্রয়–সম্পর্কিত বিরোধ, পিতা–মাতার ভরণপোষণ আইন, চেক ডিজঅনার–সম্পর্কিত অভিযোগ (পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অধ্যাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আমি প্রশংসা করতে শুনেছি অনেককে। হয়রানি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে এটা একটা মাইলফলক অধ্যাদেশ হয়েছে মর্মে প্রশংসা করেছেন আইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা।

আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(গ) ধারায় যৌতুকের কারণে নির্যাতনের বিষয়টি মামলা পূর্ব মধ্যস্থতার বিধানের আওতাভুক্ত করায় সমালোচনাও করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু এটির প্রয়োজন রয়েছে। এই ধারায় প্রচুর মামলা হলেও এখন সাজা হয়েছে, এমন ঘটনা খুবই বিরল। প্রায় সব ক্ষেত্রে কয়েক বছর মামলা চলার পর ক্লান্ত বাদিনী আপস করতে চান, স্বামীর সংসারে ফিরে যেতে চান। মাঝখানে মামলায় দীর্ঘ হয়রানি ও আইনি জটিলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় পক্ষদের, কিছু ক্ষেত্রে সংসার ভেঙে যায়।

তাই আমাদের সামাজিক পটভূমি ও বিচারের সংস্কৃতি বিবেচনায় তাই বিচার–পূর্ব মধ্যস্থতা বিরাট সুফল বয়ে আনতে পারে। আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারির ফলে এখন আর্থিক সামর্থ্য–নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তি সরকারি আইনি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের কাছে বিনা মূল্যে আইনি তথ্যসেবা গ্রহণ, আইনি পরামর্শ গ্রহণ এবং বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। মামলা করার আগে মামলায় জয়–পরাজয়, লাভ–ক্ষতি ইত্যাদি বিষয়ে পরামর্শ গ্রহণ করতে পারবেন।

অনেকে আছেন (বিশেষ করে নির্যাতনের শিকার নারীরা) যাঁদের প্রকৃত অধিকারের ন্যায্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আইনি জটিলতা, সম্মানহানি ও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয়ে প্রতিপক্ষকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজের অধিকার ছেড়ে দেন। এমন মানুষের জন্য আদালতের কাঠগড়া নয়; বরং জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে আপস–মধ্যস্থতায় বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ রয়েছে। এতে একদিকে যেমন রক্ষা হয় সামাজিক সম্মান, তেমনি কোনো প্রকার হয়রানি ও ঝামেলা ছাড়াই বিরোধের নিষ্পত্তি ঘটে। নির্যাতনের শিকার নারীদের এখন সরকারি লিগ্যাল এইডে মধ্যস্থতা পাওয়ার সুযোগ অবারিত হয়েছে বলে এ ধরনের অপরাধও কমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে অধস্তন আদালত এবং উচ্চ আদালত মিলে ৪৫ লাখের মতো মামলা বিচারাধীন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এসব মামলায় আদালতের বারান্দায় বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। দেশের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রতিবন্ধকতার মধ্যে মামলাজট একটি বড় অন্তরায়। রায়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির পরও উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্যাগুলো জিইয়ে থাকে যুগের পর যুগ। ফলে দাদার আমলে নিষ্পত্তিকৃত বিষয়টি বংশানুক্রমে নাতিদের পর্যন্ত গড়ায়। বিচারপ্রার্থী মানুষকে দ্রুততম সময়ে কম খরচে ন্যায়বিচার প্রদান করা আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব হলেও বিপুলসংখ্যক মামলার বিপরীতে বিচারকের স্বল্পতা, পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতাসহ নানান সমস্যার কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

এ ক্ষেত্রে আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ মানুষের আইনি সহযোগিতা পাওয়ার পথকে অনেক দূর প্রসারিত করবে। একই সঙ্গে এটি আদালতে মামলার জট হ্রাস করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে।

মতিউর রহমান সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন আইন র র জন য সরক র গ রহণ

এছাড়াও পড়ুন:

মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে

একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।

ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।

প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।

দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।

স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।

ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।

আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।

বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।

ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।

ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।

গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।

খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।

সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা

১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।

ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।

নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?

গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।

আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার

গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।

ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।

গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।

ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’

কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ