আমি গুরুতর অন্তর্দৃষ্টির, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক — বানু মুশতাক
Published: 24th, May 2025 GMT
বানু মুশতাকের ছোটগল্প সংকলন ‘হার্ট ল্যাম্প’ ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার জিতে নিয়েছে। তিনি দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বাসিন্দা এবং কন্নড় ভাষার লেখক। হার্ট ল্যাম্প কন্নড় ভাষায় লেখা প্রথম বই, যা বিশ্ব সাহিত্যের দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার পেল। কন্নড় থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন দীপা ভাস্তি।
বানু মুশতাক একজন ‘গুরুতর অন্তর্দৃষ্টি’ সম্পন্ন নারী হিসেবে পরিচিত। তিনি ধর্মীয় রক্ষণশীলতার বিরোধিতা করেন এবং সামাজিক কাঠামোগত ধারণাগুলো ভাঙছেন। তার সাহিত্যকর্ম প্রান্তিক মানুষের জীবনের গতিপথকে চিহ্নিত করে এবং পাঠকদের দক্ষিণ ভারতের মুসলমান নারীদের সংগ্রাম ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। তিনি কর্নাটকের হাসান শহরের বাসিন্দা। একজন নারী হয়ে ‘প্রকাশ্যে উচিত কথা’ বলার জন্য তার নিজের সম্প্রদায়ের অনেকেই তাকে বর্জন করেছে। বানু মুশতাকের বয়স ৭৬ বছর এবং এই বয়সে তিনি সেসব গল্পই লিখতে চান, যেসব গল্প তার মতে বলা প্রয়োজন। তিনি কন্নড় ভাষাতেই ভাবেন, লেখেন এবং স্বপ্ন দেখেন।
অনূদিত সাক্ষাৎকারে বানু মুশতাক ভিনিথা মোকিলের সঙ্গে একাধারে তার লেখক, আইনজীবী, অধিকারকর্মী এবং রাজনীতিবিদ হওয়ার ঘটনাবহুল জীবনযাত্রা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে যখন হার্ট ল্যাম্প ছোটগল্প সংকলনটি এ বছরের (২০২৫) মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য দীর্ঘ তালিকায় স্থান পায়। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আউটলুক ইন্ডিয়া ম্যাগাজিনে (২১ মার্চ ২০২৫) এবং পুরস্কার লাভের পরপরই তার পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় গত ২১ মে ২০২৫ তারিখে।
প্রশ্ন:আপনি আপনার লেখায় প্রান্তিক নারীদের জীবনের বিভিন্ন বিষয় আলোকপাত করেন এবং একজন আইনজীবী ও সামাজিক কর্মী হিসেবে আপনি নারীদের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করছেন। নারীরা কেন আপনার লেখার মূল বিষয়?
বানু মুশতাক : সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নারী, কিন্তু সমাজ তাদের কণ্ঠস্বরকে রোধ করে রাখে। আমি আমার নারী চরিত্রদের মাধ্যমে কথা বলতে চাই। আমি তাদের মাধ্যমে চিৎকার ও আর্তনাদ করতে চাই। আমি আমাদের সমাজে নারীদের এবং পুরুষদের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার করা হয়, তা নিয়ে লিখি। আমি মনে প্রাণে অনুভব করি যে, নারীদের নিয়ে গল্প লেখা আমার কাছে একধরনের দায়বদ্ধতা। খুব ছোটবেলা থেকে আমি কোনো অবিচার সহ্য করতে পারিনি। তাই আমি সেসব অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলাম। মুখ খুলে কথা বলা একজন নারীর সবচেয়ে বড় অযোগ্যতা হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিবেচনা করা হয়। বড় হওয়ার সময় আমাকে প্রায়ই ‘বেশি কথা বলার’ জন্য দোষারোপ করা হতো। আমাকে সতর্ক করা হয়েছিল, এই বেশি কথা বলার অভ্যাস আমার পরিবারে অসম্মান বয়ে আনবে। অন্যদিকে পুরুষদের কথা বলার জন্য উৎসাহিত করা হয় এবং সেসব কাজের জন্য তারা প্রশংসিত হয়।
প্রশ্ন:আপনার ছোটগল্প সংকলন ‘বেনকি মালে’ (১৯৯৯) প্রকাশের পর আপনি মুসলমান সম্প্রদায়ের নেতাদের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। এমনকি একজন ছুরিধারী হামলাকারী আপনাকে আক্রমণও করেছিল। আপনার লেখায় ধর্মীয় রক্ষণশীলতা এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতি সমালোচনা করা কতটা কঠিন হয়েছে?
বানু মুশতাক : আমি গুরুতর অন্তর্দৃষ্টির একজন নারী—যা একজন মানুষের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থান। আমার সম্প্রদায়ের অনেকেই আমাকে বহিষ্কার করেছে, কারণ আমি আমার মতামত স্পষ্টভাবে প্রকাশ করি। আমাকে তারা হুমকি-ধামকিও দিয়েছে। শারীরিক আক্রমণের পর আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। তারপর আমি বেশ অনেকটা সময় কিছুই লিখতে পারিনি। কিন্তু এক পর্যায়ে আমি আবারও লেখালেখি শুরু করি। সেসব লেখা এমন লোকেদের সম্পর্কে ছিল, যারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে; নেতাদের সম্পর্কে যারা ধর্ম ও রাজনীতি একসঙ্গে মেশায়; আর সেসব মহিলাদের সম্পর্কে, যারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং যারা নিজেদের জন্য লড়াই করার শক্তি খুঁজে পায়।
প্রশ্ন:আপনার লেখায় কি শক্তিশালী আত্মজীবনীর উপাদান রয়েছে?
বানু মুশতাক : সৃজনশীল লেখায় আত্মজীবনী সংক্রান্ত অনেক উপাদানই ঢুকে পড়া স্বাভাবিক। নিজের অভিজ্ঞতার কিছু উপাদান আমার বিভিন্ন গল্পে স্থান পেয়েছে। তবে সেগুলো কেবল আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমিত নয় বরং অধিকাংশ উপাদানের সার্বজনীন দিক আছে। সেগুলো অনেক নারীর বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে; তাদের স্বপ্ন ও আশা; তাদের পরিবারের এবং সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন ও উত্তেজনা। আমি একজন স্ত্রী এবং একজন মমতাময়ী মা। আমি প্রতিরোধ সাহিত্যের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলাম। এছাড়া আমি কৃষক, দলিত, পরিবেশবাদী এবং নারীবাদীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর আন্দোলনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করেছি। আমার জন্য সেসব আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছিল নিজের বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। আমি কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে শক্তিশালী শক্তিগুলো নারী ও পুরুষদের দমন করে। আমি মানুষদের সঙ্গে দেখা করা, তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করা, তাদের গল্প-কাহিনি শোনা ভীষণ উপভোগ করি। এ সবকিছুই আমার সাহিত্য রচনায় প্রভাব ফেলছে। নারীদের উচিত নাগরিক সমাজের সক্রিয় সদস্য হিসেবে স্বাধীন থাকা। তাদের লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকার মধ্যে আবদ্ধ করা উচিত নয় এবং তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করাও উচিত নয়।
প্রশ্ন:ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বমূলক পরিবেশে একজন লেখকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, যেখানে কর্তৃত্ববাদী নেতারা বিভাজন নীতির কথাবার্তা বলে থাকেন?
বানু মুশতাক : আমি বিশ্বাস করি একজন লেখকের কাজ হলো অন্যায়গুলো লিপিবদ্ধ করা, যা একটি শিল্পসম্মত পদ্ধতির মাধ্যমে করা উচিত। আপনি যদি সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পথ দেখতে পান, তবে তা উল্লেখ করুন। কিন্তু কখনোই সাগ্রহে আলোচনা করবেন না। কখনোই মানুষের ওপর জোরপূর্বক কোনো সমাধান চাপিয়ে দেবেন না। আপনি যে পরিমাণ অন্যায় দেখছেন, তা লিখে রাখুন এবং বাকিটা পাঠকের বিবেকের ওপর ছেড়ে দিন। এটা সত্যি আমরা একটি বিভক্ত জগতে বাস করছি। আমাদের দেশে ডানপন্থীদের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সময়ে নারীদের ওপর আরও বেশি নজর রাখা হচ্ছে। কিছু রাজনীতিবিদ বৃহত্তর সম্প্রদায়ের নারীদের বলেন যে, তারা নিজেদের প্রয়োজনের জন্য আরও বেশি সন্তান জন্ম দেন, যেন নারীরা শুধু প্রজনন যন্ত্র। এখানে বিদ্বেষমূলক ভাষণ, নামকরণ এবং অসৎ আইনি কার্যকলাপের অনেক উদাহরণ আছে। ভোট ব্যাংক রাজনীতি বিদ্বেষের ওপর ভরসা করে; উন্নতি এবং মানুষের কল্যাণের ওপর নয়। তবে ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয় শেষপর্যন্ত স্বৈরাচারী শাসকদের পতন হয়। উত্থান-পতন, দুঃখ-দুর্দশা এবং উদযাপনের মতো ঘটনা রয়েছে.
এখনো উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্প প্রাপ্য মনোযোগ পায় না, তাই নয় কি?
বানু মুশতাক : আমি ছোটগল্পের ধরন পছন্দ করি এবং আমি আনন্দিত আমার গল্প সংকলনটি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। আমি একটি উপন্যাসও লিখেছি। ছোটগল্প আমার প্রথম ভালোবাসা। যদিও ছোটগল্পের পটভূমি সীমিত, কিন্তু এই কাঠামোর মধ্যে কাব্যিকতা এবং শব্দের বাহুল্য থেকে সংযত থাকার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ছোটগল্পে যতটুকু সম্ভব ঘটনার মোড় এবং বাঁক যুক্ত করা, মাংস ও রক্তের চরিত্র সৃষ্টি করা হয়। আমার মনে হয় প্রতিটি সাহিত্যধারার জন্য এক একটি স্থান রয়েছে। উপন্যাসকে ছোটগল্পের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা এবং কৃত্রিম শ্রেণী বিভাগ তৈরি করা অন্যায়।
প্রশ্ন:আপনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখেন, কিন্তু আপনার লেখায় সব সময় শুষ্ক রসিকতা কাজ করে। এই রসিকতা কি প্রতিটি লেখকের জন্য একধরনের উপকারী হাতিয়ার?
বানু মুশতাক : আপনি যখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখেন, তখন আপনার মন রাগ-ক্ষোভে পরিপূর্ণ থাকে। যখন আমি লেখালেখি শুরু করেছি, তখন খুবই উত্তেজিত ছিলাম। ন্যায়-নীতির ক্ষুধা আমাকে গ্রাস করেছিল, কিন্তু আমার কাছে ন্যায়-নীতির কোনো স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। আসলে কী কী উপাদান দিয়ে ন্যায়-নীতি গঠিত? কোন সময়ে আপনি বলবেন সত্যিই ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? রসিকতা আমার মস্তিষ্ককে পরিষ্কার করে, যা আমাকে সাহিত্য রচনায় স্বচ্ছতা দেয় এবং সত্যি বলতে কি রসিকতা ছাড়া আমি হারিয়ে যেতাম।
প্রশ্ন:দীপা ভাস্তি আপনার হার্ট ল্যাম্প গল্প গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
বানু মুশতাক : দীপা একজন অসাধারণ তরুণী। অনুবাদ কাজ করার সময় তার কাছে ছিল দুনিয়ার সমস্ত স্বাধীনতা। আমি তাকে গল্পগুলো নির্বাচন করতে সাহায্য করেছি, যা সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আমরা আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকায় স্থান করে নিতে পেরে আনন্দিত। মনোনয়ন পাওয়ার পরে পুরো বিশ্ব নড়েচড়ে বসেছে এবং বইটির দিকে নজর দিয়েছে। ইংরেজি অবশ্যই উপনিবেশীকরণের ইতিহাস বহন করে, কিন্তু ভাষাটি অনেক সম্ভাবনারও দ্বার খুলে দিয়েছে। তার মূল কারণ ইংরেজিকে এখন সার্বজনীন ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গল্পগ্রন্থটি আমার পাঠকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে এবং কন্নড় সাহিত্যের প্রতি পাঠককে আরও মনোযোগী করে তুলবে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আপন র ল খ ছ টগল প উপ দ ন র জন য ক জ কর র জন ত প রক শ ম শত ক অন য য র ওপর কখন ই
এছাড়াও পড়ুন:
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় নিয়ে কিছু নিরীহ প্রশ্ন
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের মিশন বা কান্ট্রি অফিস খোলা নিয়ে যে ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছে, সেটি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সর্বশেষ বক্তব্যেও স্পষ্ট। যেমন– বৃহস্পতিবার পরররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকরা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, এ ধরনের কার্যালয় খোলা বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে কিনা? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি বিচার আমি করতে চাই না’ (সমকাল অনলাইন, ৩ জুলাই ২০২৫)। তার মানে, বর্তমান সরকার ‘বিচার’ ও বিবেচনা ছাড়াই ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনের অনুমতি দিচ্ছে?
আমরা জানি, গত রোববার (২৯ জুন ২০২৫) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, কান্ট্রি অফিসটি স্থাপনের খসড়া প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঢাকায় প্রাথমিকভাবে তিন বছরের জন্য কার্যালটি স্থাপন হচ্ছে। ওদিকে খোদ জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনারের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, উপদেষ্টা পরিষদ কী অনুমোদন দিয়েছে, এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট ধারণা নেই (সমকাল, ৩০ জুন ২০২৫)। তাহলে কি আমরা ধরে নেব, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের সঙ্গেও সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে?
এটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই যে, এ ধরনের সমঝোতা হতে হয় দুই পক্ষের সম্মতিতে। দুই পক্ষের মধ্যে পুঙ্খানুপুঙ্খ, বলতে গেলে প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে আলোচনা ও বিতর্কের পর খসড়া চূড়ান্ত হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সরকারই কি তাড়াহুড়া করছে? জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন– ‘আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না’। এমন গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কিসের এত তাড়া? অত তাড়াতাড়ি কোথায় যেতে চায়?
মনে আছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর অক্টোবরের শেষদিকে ঢাকা সফর করেছিলেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের ভলকার তুর্ক। ঢাকায় জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকের পর উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ আরও দু’জন উপদেষ্টার উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনের সম্মতি দিয়েছে, শিগগিরই সেটি বাস্তবায়ন হবে। তিনি এও বলেন, ‘এখানে কার্যালয় থাকা মানে মানবাধিকারের জায়গা থেকে আমাদের শক্তি বাড়ল’ (প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০২৪)।
অন্যদিকে, গত বৃহস্পতিবারই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এখন পর্যন্ত চারবার খসড়া আদান-প্রদান হয়েছে। আমরা কিছু সংযোজন-বিয়োজন এনেছি, জাতিসংঘ কিছু সুপারিশ করেছে। আমাদের কিছু পরিবর্তন রয়েছে তাদের দেওয়া খসড়া নিয়ে। সে পরিবর্তন যদি তারা গ্রহণ করে, তাহলে দ্রুত হবে। আর যদি গ্রহণ না করে এবং বলে পরিবর্তন করতে, তখন আমরা দেখব যে পরিবর্তন করা যাবে কিনা। প্রশ্ন হচ্ছে, এখনও যদি খসড়া আদান-প্রদান অবস্থাতেই থাকে, তাহলে গত বছর অক্টোবরে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার পক্ষে ‘সম্মতি’ দেওয়ার কথা বলার অর্থ কী ছিল? বস্তুত, যদি গত ৯ মাসের ধারাবাহিকতা দেখি, ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ কার্যালয় স্থাপন নিয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের মধ্যে সমলয় বা ‘সিনক্রোনাইজেশন’ নেই। তাহলে কি খোদ সরকারের ভেতরেই বিষয়টি নিয়ে এখনও সমন্বয়হীনতা রয়েছে?
এক প্রতিবেদনে দেখছি, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, কার্যালয় ও মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস খোলার বিষয়ে একমত নয়। গত ৩ জুন এ-সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে উপস্থিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি প্রশ্ন তুলেছিলেন, এ ধরনের কার্যালয় থাকা দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলনীয় কিনা (সমকাল, ৩০ জুন ২০২৫)। জুন মাসের গোড়ার ওই বৈঠকের পর গত এক মাসে কি কার্যালয়টি নিয়ে সরকারের ভেতরের এসব প্রশ্ন নিরসন করা সম্ভব হয়েছে?
প্রশ্ন কেবল দেশের ভেতরে নয়; বাইরেও রয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের দাপ্তরিক ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখছি, এ পর্যন্ত ১৫টি দেশে সংস্থাটির কান্ট্রি অফিস রয়েছে। দেশগুলোর নাম হলো– বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, শাদ, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, গিনি, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেক্সিকো, নাইজার, ফিলিস্তিন, সুদান, তিউনিসিয়া ও ইয়েমেন। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ায় নজরদারির জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায়, যুদ্ধাবস্থায় রাশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘন পর্যবেক্ষণে ইউক্রেনে এবং গৃহযুদ্ধরত সিরিয়ার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে লেবাননে সংস্থাটির একটি করে কার্যালয় রয়েছে। দেশগুলো আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও সেগুলোর অভিন্ন বিষয় হচ্ছে যুদ্ধ পরিস্থিতি বা জাতিগত বিরোধ। বাংলাদেশেও কি তেমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে?
এমনকি নেপালেও জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের একটি কার্যালয় সক্রিয় ছিল। কারণ, দেশটিতে ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাজতন্ত্রপন্থি সরকার ও মাওবাদী গেরিলাদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছিল। দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা, রাজতন্ত্রের বিলোপ এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর ২০১১ সালে কার্যালয়টির ব্যাপারে জাতিসংঘের সঙ্গে সমঝোতা আর নবায়ন করেনি নেপাল। এখন বাংলাদেশে কী এমন পরিস্থিতি হলো যে, নেপালের মতো আমাদেরও এ ধরনের কার্যালয় লাগবে?
১৮ দেশের ওই তালিকায় অবশ্য দক্ষিণ কোরিয়ায় স্থাপিত কার্যালয়টি প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়াকে, ইউক্রেনে স্থাপিত কার্যালয়টি রাশিয়াকে এবং লেবাননে স্থাপিত কার্যালয়টি সিরিয়াকে নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। এই আশঙ্কা অমূলক হতে পারে না যে, বাংলাদেশে সম্ভাব্য কার্যালয়টির সম্ভাব্য লক্ষ্য থাকবে প্রতিবেশী মিয়ানমারের দিকে। প্রশ্ন হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউক্রেন বা লেবানন যেভাবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ‘পাঙ্গা’ নিচ্ছে, বাংলাদেশের পক্ষে কি মিয়ানমার প্রশ্নে তেমন অবস্থান নেওয়া সম্ভব বা সংগত?
গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ কথায় কথায় বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার সঙ্গে তুলনা দিত। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের সমর্থক কেউ কেউ কথায় কথায় ইউরোপের তুলনা দিচ্ছেন। স্বপ্নে পান্তার বদলে বিরিয়ানি খাওয়ার মতো এমন উন্নত দেশের তালিকায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে নাগরিকদের ভালোই লাগে বৈকি। কিন্তু জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস থাকা দেশের তালিকা দেখলে তো দুঃস্বপ্নেও চমকে উঠতে হয় না?
এই প্রশ্নও দুর্মুখরা তুলতে পারেন, আমরা কথায় কথায় যেসব দেশের সঙ্গে নিজেদের তুলনা দেই, সেগুলোর কোনটায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কান্ট্রি অফিস রয়েছে? দেখা গেছে, উন্নত দেশ তো বটেই, উন্নয়নশীল দেশগুলোরও কোনোটি এ ধরনের কার্যালয় স্থাপনে সম্মতি দেয় না। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশেই এমন কার্যালয় নেই। তাহলে আমরা সম্মতি দিতে যাচ্ছি কোন উদাহরণ সামনে রেখে?
বড় কথা, নাগরিক হিসেবে আমাদের জানার অধিকার রয়েছে জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চালাচালি চলা খসড়া সমঝোতায় কী রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা বিভিন্ন সময়েই বলেছেন যে, তারা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতে বিশ্বাস করেন। তাহলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর প্রশ্নের মুখে থাকা এমন একটি কার্যালয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজনে গণশুনানি করা উচিত নয় কি?
বড় কথা, বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে কমিশনাররা একযোগে পদত্যাগের পর গত বছর নভেম্বর থেকে সাংবিধানিক সংস্থাটি স্থবির হয়ে রয়েছে। সেটিকে ছয় মাসেও সক্রিয় ও কার্যকর না করে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের কার্যালয় স্থাপনে এমন তাড়াহুড়ার কারণ কী?
শেখ রোকন: লেখক ও নদী-গবেষক
skrokon@gmail.com