বেইলি রোডের ব্যস্ততা কমে না। সকাল থেকে বিকেল, বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা থেকে রাতের বেশ খানিকটা পর্যন্ত—যখনই কেউ বেইলি রোডে আসবেন, দারুণ জমজমাট পরিবেশ পাবেন এখানে। কেনাকাটা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া, বন্ধুবান্ধব নিয়ে প্রাণখোলা আড্ডা, প্রণয়-প্রণয়ী জুটির হাতে হাত রেখে নিবিড় আলাপনে সময় কাটানো, নাট্যামোদীদের মঞ্চনাটক উপভোগ আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কোচিং নিয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও বই–খাতার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীর ঝাঁক বেইলি রোড প্রাণবন্ত রাখে সব সময়।
পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এই সড়ককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা অত্যাধুনিক বিপণিবিতান, বিভিন্ন চেইনশপের আউটলেট, অসংখ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ, শাড়ির দোকান, দেশি বুটিকের বিক্রয়কেন্দ্র, বইয়ের দোকান, ফুলের দোকান, ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির দোকান, কোচিং সেন্টার আর মহিলা সমিতির নাটকের বিখ্যাত মঞ্চ—কী নেই এখানে!
বেইলি রেডের পশ্চিম প্রান্ত শুরু হয়েছে রমনা উদ্যানের ‘অরুণোদয়’ ফটকের বিপরীত দিক থেকে। প্রশস্ত সড়কটির দুই পাশে অফিসার্স ক্লাব পর্যন্ত সরকারি আবাসন ও দপ্তর। এই অংশের ফুটপাতে কোনো দোকানপাট নেই। মন্ত্রী ও পদস্থ কর্মকর্তারা এখানে থাকেন বলে বেইলি রোডের এই অংশই সম্ভবত ঢাকার কোলাহলমুক্ত কয়েকটি সড়কের মধে৵ অন্যতম, যেখানে সড়ক ও ফুটপাতে বাণিজ্যিক পসরা নেই। যানবাহনের চলাচলও তুলনামূলক কম।
বেইলি রোডের পরের অংশের চেহারা একেবারেই অন্য রকম। এই প্রান্ত চলে গেছে পূর্ব দিকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত। এর এক পাশে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। শান্তিনগর মোড়ের প্রান্তে রয়েছে অনেক কোচিং সেন্টার। ফলে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সকাল–বিকেল নিয়মিত এখানে যাতায়াত করতে হয়।
কেনাকাটার জন্যও বেইলি রোড বেশ জনপ্রিয়। এখানে দেশি তাঁতের শাড়ি বিক্রির জন্য আশির দশকে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির’একটি বিক্রয়কেন্দ্র খুলেছিল। পাঠককে বই পড়তে আগ্রহী করতে ‘তবুও বই পড়ুন’ স্লোগান নিয়ে ‘সাগর পাবলিশার্স’ নামে বইয়ের দোকান করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক এম আর আখতার মুকুল। পরে এখানে ‘বিদ্যা ভবন’ নামে আরও একটি বইয়ের দোকান গড়ে ওঠে। খাবারের দোকানের মধ্যে ছিল সুইস বেকারি ও ক্যাপিটাল কনফেকশনারির মতো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। প্রসাধনীর জন্য ছিল বেইলি স্টার নামের একটি দোকান। কালক্রমে এখানে একের পর এক বহুতল বাণিজ্যিক ভবন আর বিপণিবিতান গড়ে ওঠে। এসব ভবনে রয়েছে হরেক রকম খাবারের অনেক রেস্তোরাঁ। কেনাকাটা আর রসনাবিলাসে এসব বিপণিবিতান আর ভোজনালয়গুলো নানা বয়সী হাজারো মানুষের সমাগমে মুখর থাকে পরিবেশ।
বেইলি রোডের কথা বললে অনিবার্যভাবে আসে মঞ্চনাটকের প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার পরে দেশে মঞ্চনাটকের যে বিকাশ ঘটেছিল, বেইলি রোডকে তার সূতিকাগার বলা যায়। এখানে ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘গাইড হাউস’–এর দুটি মঞ্চে অভিনীত হয়েছে বহু সাড়াজাগানো নাটক। প্রতিদিন বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নাটকের দর্শক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের আড্ডায় মুখর থাকত বেইলি রোড। মূলত মঞ্চনাটক ও নাটককেন্দ্রিক আড্ডাকে কেন্দ্র করেই জমজমাট বেইলি রোডের পরবর্তী বাণিজ্যিকীকরণ ঘটেছে। এখন অবশ্য মঞ্চনাটককেন্দ্রিক আড্ডা অনেকটাই এখান থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়। তবে মহিলা সমিতি মঞ্চের নাটক একেবারে বন্ধ হয়নি।
শাড়ির দোকান, দেশি বুটিকের অনেক বিক্রয়কেন্দ্র আছে রাজধানীর বেইলি রোডে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন টক র
এছাড়াও পড়ুন:
মৌলভীবাজারে আশুরার দিনে গায়েবি মোকামে মাতম-বিলাপের জারি
কবে থেকে পবিত্র আশুরার দিনে মৌলভীবাজারে গায়েবি মোকাম ঘিরে মাতম-বিলাপ করা, জারি গাওয়া শুরু হয়েছিল, তার নির্দিষ্ট কোনো সাল-তারিখ কারও জানা নেই। পূর্বপুরুষেরা ওই দিনে গায়েবি মোকাম প্রাঙ্গণে এ রকম জারি করেছেন, মাতম করেছেন। ঐতিহ্য হিসেবে সেই ধারাবাহিকতা এখনো সীমিত পরিসরে হলেও টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের উত্তরাধিকার, স্থানীয় মানুষ। মহররমের ১০ তারিখ আশুরার দিন, যা অনেকের কাছে কতলের দিন নামে পরিচিত। সেই দিনে একদল তরুণ-প্রবীণ জারি গেয়ে দিনটিকে স্মরণ করেন, করুণ কাহিনি নিয়ে বিলাপ করেন।
মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়ঘরে খোজার মসজিদ এলাকায় রয়েছে এই গায়েবি মোকাম। আশুরার দিন বিকেলে আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে অনেক নারী-পুরুষ এখানে সমবেত হন। তরুণ-প্রবীণ মিলে জারি গাইতে গাইতে বিলাপ করেন, শোক প্রকাশ করেন। ১০ মহররম সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেন (রা.) ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে শহীদ হয়েছিলেন।
গতকাল রোববার বিকেলে ঝমঝমে বৃষ্টি নামে। আগে থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল, এই মেঘ, এই রোদের কিছুটা খেলা ছিল। ওই সময় গয়ঘর খোজার মসজিদের কাছাকাছি গায়েবি মোকামের কাছে জারি গাওয়ার জন্য অনেকে সমবেত হতে শুরু করেছেন। অনেকে জারি শুনতে, অংশ নিতে নানা জায়গা থেকে আসছেন। এখানে আশুরার দিনে জারি গাওয়ার প্রচলন আছে শত বছরের। আগের সেই জমজমাট অবস্থা এখন আর নেই। তারপরও প্রচলিত ধারায় ছেদ পড়েনি। স্থানীয় অপেশাদার জারিশিল্পীরা তা এখনো টিকিয়ে রেখেছেন। বৃষ্টি থামতেই অনেকে ছুটে আসেন। ভিড় করেন গায়েবি মোকামের কাছে। সবাই মিলে গায়েবি মোকাম ঘিরে কয়েক চক্কর দিয়ে একটা সময় শুরু হয় জারি গাওয়া। কারবালার প্রান্তরের শহীদদের জন্য বুকের কান্না তাঁরা ঢেলে দেন জারির কথা ও সুরে। কারবালার কাহিনির নানা অংশ গাইতে গাইতে মাতম করেন। এ উপলক্ষে নানা পণ্যের কিছু দোকানও বসেছিল স্থানটিতে।
গয়ঘর গ্রামটি খোজার মসজিদের নামে অনেকের কাছে পরিচিত, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কারণে অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পাঁচশত বছর আগের এই ‘গয়ঘর ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ’। মসজিদটি নির্মাণ করা হয় সুলতান বরবক শাহের পুত্র সুলতান শামস উদ্দীন ইউছুফ শাহের আমলে। হাজী আমীরের পৌত্র ও মুসার পুত্র বিখ্যাত মন্ত্রী মজলিস আলম ৮৮১ হিজরিতে (১৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদ নির্মাণ করান। এই খোজার মসজিদের পূর্ব দিকেই একটি ছোট মোকাম আছে, যা স্থানীয় মানুষের কাছে গায়েবি মোকাম নামে পরিচিত। গায়েবি টাকায় মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল বলে লোকমুখে গায়েবি মোকাম নামে এই মাজারের পরিচিতি আছে।
স্থানীয় জারিশিল্পী আছকর মিয়া জানান, মহররম মাসে গয়ঘরের গায়েবি মোকামের কাছে পূর্বপুরুষ থেকে জারি গাওয়া হয়ে আসছে। কবে, কখন থেকে এই জারি গাওয়া শুরু হয়েছে, কেউ বলতে পারেন না। তবে এখন আর আগের মতো জারির আয়োজন জমজমাট হয় না। আগে তাঁবু বসানো হতো, আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোকজন আসতেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, স্থানীয় এক ব্যক্তির ঘরে গায়েবি টাকা ওঠে। ওই বাড়ির কেউ একজনকে স্বপ্নে মোকাম তৈরির জন্য বলা হয়। তখন মোকামের স্থানটিতে বিশাল একটি বটগাছ ছিল। সেই গাছ একসময় গোড়াসহ উপড়ে পড়ে। তারপর গায়েবিভাবে পাওয়া টাকা দিয়ে বটগাছের স্থানটিতে এই মোকাম তৈরি করা হয়েছে। কারও নামে এই মোকাম তৈরি হয়নি।
আছকর মিয়া বলেন, ‘জারি কারবালার কাহিনি। বিষাদ সিন্ধু থেকে জানছি। কারবালার ইতিহাস পড়ছি। জারিটা হলো বিলাপ। কারবালার কাহিনি বলতে গিয়ে লোকজন বিলাপ করছে, কাঁদছে। এটারে আমরা একটু জারি হিসেবে গাই। আমরা যত জারি গাই, তার অর্থ আছে। এই কাহিনি “বিষাদ–সিন্ধু”, “জমজমা”, “জঙ্গে কারবালা”তে পাওয়া যাবে।’
আরেক জারিশিল্পী কনর মিয়া বলেন, ‘আমরার জন্মের আগে থেকে ময়-মুরব্বিরা এখানে (গায়েবি মোকাম) জারি গাইছেন। এখন আমরা গাই। আমরা শুনছি এটা কারবালার ইতিহাস, সেই ইতিহাসটারে আমরা স্মরণ করি। ৫ মহররম থেকে শুরু হয়, ১০ মহররম কতলের দিনে (আশুরা) জমজমাট হয়। এরপরে কেউ যদি বলে, গাওয়া হয়। তবে আগে গাওয়া যেত, এখন গাওয়ার মানুষ নাই।’
রোববার বিকেলে যখন তরুণ ও প্রবীণরা মিলে জারি গাইছিলেন, মাতম করছিলেন। তখন পশ্চিমের আকাশে মেঘের কোলে লাল রং ছড়িয়ে দিয়েছিল বিদায়বেলার সূর্য। এ যেন কাজী নজরুল ইসলামের মহররম কবিতার মতো ‘কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে/সে কাঁদনে আঁসু আনে সীমারেরও ছোরাতে!’ গায়েবি মোকামের প্রাঙ্গণ তখন একটুকরা ফোরাতের তীরই যেন হয়ে উঠেছিল। সবাই মিলে ফোরাত নদীর তীরে কারবালার মুহূর্তটিকে মনে করে প্রকৃতই কাতর হয়ে উঠেছিলেন। বুকের কান্নাকে তাঁরা জারির পঙ্ক্তি, তাল ও লয়ে প্রকাশ করতে থাকেন। তখন ধীরে ধীরে বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে ঝুঁকছে, অন্ধকারের পর্দা নামছে চরাচরে। জারির আহাজারিতে সেই অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠছে, আরও ইতিহাস–কাতর হয়ে উঠছে।