গোপন বন্দিশালায় ২ বছর, কীভাবে ফিরলেন সুব্রত বাইন, গুম কমিশনের প্রতিবেদনে গোপন বন্দিবিনিময়ের চিত্র
Published: 18th, June 2025 GMT
ছাত্র-জনতার গণ–অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরপর ঢাকার অপরাধজগতে হঠাৎ সক্রিয় হন শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন। দীর্ঘদিন ভারতে পলাতক এই অপরাধী কীভাবে দেশে ঢুকলেন, তা নিয়ে ছিল নানা জল্পনা। তবে সম্প্রতি জমা দেওয়া গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাগি এই সন্ত্রাসী দুই বছরের বেশি সময় বাংলাদেশেই ছিলেন। এখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিচালিত গোপন বন্দিশালায় ছিলেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্যদের সঙ্গে সুব্রত বাইনকেও ছেড়ে দেওয়া হয়।
গুম কমিশনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে ২০২২ সালের এপ্রিলে এই কুখ্যাত সন্ত্রাসীকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ গোপনে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার হাতে তুলে দেয়। বিনিময়ে র্যাব আরেকজন বন্দীকে ভারতের কাছে গোপনে হস্তান্তর করে। দুই দেশের নিরাপত্তা সংস্থার এ লেনদেন গোপনে ও বেআইনিভাবে সম্পন্ন হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, এর পর থেকে সুব্রত বাইন র্যাবের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত টাস্কফোর্স ফর ইন্টারোগেশন সেলে (টিএফআই) বন্দী ছিলেন। উত্তরায় র্যাব-১–এর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে থাকা টিএফআই সেল হচ্ছে শেখ হাসিনা সরকারের সময় যে কয়টি গোপন বন্দিশালা ছিল, তার একটি। এসব গোপন বন্দিশালায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে দীর্ঘদিন আটক রাখা হতো। যাঁদের অনেককে পরবর্তী সময়ে খুন করা হয়েছে। অনেকের কোনো সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ৪ জুন ‘আনফোল্ডিং দ্য ট্রুথ: আ স্ট্রাকচারাল ডায়াগনসিস অব এনফোর্সড ডিজঅ্যাপিয়ারেন্স ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গণ–অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ৫ থেকে ৭ আগস্টের মধ্যে ডিজিএফআই পরিচালিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল (জেআইসি) থেকে তিনজন এবং র্যাব পরিচালিত টিএফআই সেল থেকে অন্তত পাঁচজন মুক্তি পেয়েছিলেন।
সুব্রত বাইনের বিষয়ে গুম–সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইন্টারপোলের রেড নোটিশপ্রাপ্ত এক ব্যক্তিকে গোপনে ভারত থেকে এনে আটকে রাখার সিদ্ধান্ত কেবল র্যাবের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এমন সিদ্ধান্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অথবা তখনকার সরকারের আরও উচ্চপর্যায় থেকে আসতে পারে। সুব্রত বাইনকে ২০২২ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে গোপনে ভারতের কলকাতা থেকে দেশে আনা হয়। তার পর থেকে তাঁকে পুরোপুরি আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়। ফলে তাঁর মুক্তি আইনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল না বা চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ ছিল না। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৬ অথবা ৭ আগস্ট র্যাব তাঁকে ছেড়ে দেয়।
কমিশন মনে করে, র্যাবের মতো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এমন বেআইনি, গোপন এবং অনানুষ্ঠানিক কৌশল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থা মজবুত না করে উল্টো দুর্বল করেছে। এ ধরনের গোপন বন্দিবিনিময়ের অর্থ হচ্ছে, ভারতের ওই গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।
তবে সুব্রত বাইনের বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে যাঁকে গোপনে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, তাঁর পরিচয় গুম–সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন প্রকাশ করেনি। কমিশন সুব্রত বাইনের বিনিময়ে ভারতে হস্তান্তরিত হওয়া সেই বাংলাদেশি নাগরিকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে। তাঁর ব্যাপারে কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আমরা জানতে পেরেছি, তিনি ভারতে পৌঁছানোর পর তাঁর নামে একটি মামলা হয় এবং তিনি সেখানকার কারাগারে দণ্ড ভোগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। তিনি ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলার নথিগুলো দিয়েছেন, যেগুলোর মাধ্যমে তিনি যে ভারতে ছিলেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়।’ সুব্রত বাইনের দাবি, ২০২২ সালের ২৭ রমজান তাঁকে বাংলাদেশে আনা হয়। ভারতীয় মামলা-সংক্রান্ত নথির সঙ্গে এ তারিখ মিলে যাওয়ায় তাঁর দাবিকে সত্য বলে ধরে নিয়েছে কমিশন।
বন্দী থাকাকালে র্যাব কেন সুব্রত বাইনকে হত্যা করেনি, সেটিও বোঝার চেষ্টা করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘র্যাব গোয়েন্দারা কেন সুব্রত বাইনকে এত দিন ধরে সম্পূর্ণ গোপনে, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছাড়াই বন্দী রেখেছিল, তা স্পষ্ট না। এর চেয়ে অনেক কম অপরাধের জন্য বন্দীদের হত্যা করেছে তারা। তাঁকে হত্যা করারও পরিকল্পনা ছিল বলে জানতে পেরেছি আমরা। তবে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের ধারণা, একবার টিএফআই সেলে আটক হওয়ার পর সুব্রত বাইন আর তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিলেন না।’
সুব্রত বাইনকে গত ২৭ মে আরও এক শীর্ষস্থানীয় সন্ত্রাসীসহ কুষ্টিয়া থেকে গ্রেপ্তার করে সেনাবাহিনী। পরদিন তাঁকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে নেওয়ার পর তাঁর আইনজীবী সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, সুব্রত বাইন ‘আয়নাঘরে’ (গোপন বন্দিশালা) ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁকে নারায়ণগঞ্জের ভুলতায় ফেলে যাওয়া হয়।
ওই দিন সুব্রত বাইনও আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের দেখে বলতে থাকেন, ভারতে থাকা অবস্থায় তিনি তিনবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২০২২ সালে তাঁকে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর পর ‘আয়নাঘরে’ ছিলেন।
বেআইনিভাবে সুব্রত বাইনকে গোপন বন্দিশালায় আটক রাখার যে তথ্য বের হয়েছে, এ বিষয়ে র্যাবের বর্তমান কর্মকর্তারা কিছু বলতে রাজি নন। সুব্রত বাইনকে যখন দেশে আনা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তখন র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন (৫ আগস্ট সরকার পতনের সময় তিনি পুলিশের মহাপরিদর্শক ছিলেন)। তিনি এখন কারাগারে আছেন। তাঁর পর র্যাবের মহাপরিচালক হন এম খুরশীদ হোসেন। তিনি ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৪ জুন পর্যন্ত দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর সময়েও সুব্রত বাইনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পরবর্তী সময়ে র্যাবের মহাপরিচালক হন মো.
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে র্যাবের সাবেক দুই মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন ও হারুন অর রশিদের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। দুজনের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তাঁদের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটি সক্রিয় আছে। দুজনের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ফোন করে এবং বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
খুনোখুনিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক আলোচনায় আসেন সুব্রত বাইন। ২০০১ সালের ২৫ ডিসেম্বর যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত সরকার ঘোষণা করেছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সুব্রত বাইন। তাঁর নামে এখনো ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে। তাঁকে ধরিয়ে দিতে তখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এরপর সুব্রত বাইন ভারতে পালিয়ে যান।
বিবিসি বাংলা এবং কালকাতা ও ঢাকাভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সুব্রত বাইনকে কলকাতা পুলিশ ২০০৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে সে দেশে গা ঢাকা দেন। ২০০৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্কফোর্সের (এসটিএফ) কর্মকর্তাদের পিছু ধাওয়ায় নেপাল সীমান্তের কাকরভিটা শহরে পালিয়ে যান এবং নেপালি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে পূর্ব নেপালের ভাদ্রপুর জেলে এবং পরে ঝুমকা কারাগারে পাঠানো হয়। ২০১২ সালের ৮ নভেম্বর ওই কারাগার থেকে ৭৭ ফুট লম্বা সুড়ঙ্গ কেটে অন্য আরও ১০ জনের সঙ্গে সুব্রত বাইনও পালিয়ে যান। নেপালের কারাগার থেকে পালিয়ে কলকাতায় ফিরে যান তিনি। ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর কলকাতা থেকে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে মামলা হয়।
তবে সেসব মামলা থেকে কবে কীভাবে সুব্রত বাইন মুক্তি পেলেন, তারপর গোপনে বাংলাদেশে হস্তান্তরের আগপর্যন্ত ভারতের কোথায়, কোন সংস্থার হেফাজতে ছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো বের হয়নি।
গুম–সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন চিহ্নিত অপরাধীকে বেআইনি প্রক্রিয়ায় দেশে আনা এবং তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত সুব্রত বাইনকে আটকে রাখা যায়নি। র্যাবের এমন ব্যর্থতা সুব্রত বাইনকে নতুন করে অপরাধের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছে।
সুব্রত বাইনকে গোপনে, বেআইনি প্রক্রিয়া এবং অনানুষ্ঠানিক সমঝোতার মাধ্যমে নিয়ে আসার কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থাকে শক্তিশালী না করে দুর্বল করেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় নিরাপত্তার নামে গুমকে এভাবে সমর্থন করা হলে বাস্তবে জননিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। এ ধরনের কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য ক্ষতিকর।
আরও পড়ুনকে এই সুব্রত বাইন, কীভাবে জড়ালেন অপরাধজগতে২৭ মে ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ ম স ক র ন ত তদন ত সরক র র পতন র পর ২০২২ স ল র ত ব যবস থ সরক র র প পর চ ল ত ৫ আগস ট ট এফআই ইন ট র ন র পর ব আইন কলক ত অপর ধ
এছাড়াও পড়ুন:
ইরান আমাদের কাছে কোনো সাহায্য চায়নি: পুতিন
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া কোনো পক্ষের ওপর সমাধান চাপিয়ে দিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, বরং আলোচনার মাধ্যমে আমরা একটি সম্ভাব্য সমাধান বের করতে চাইছি।
স্থানীয় সময় বুধবার সেন্ট পিটার্সবার্গ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে সাংবাদিকদের সঙ্গে এক গোলটেবিল বৈঠকে পুতিন এ সব কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কাউকে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি না। শুধু বলছি, কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যেতে পারে। এই সিদ্ধান্ত মূলত সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর, বিশেষ করে ইরান ও ইসরায়েলের রাজনৈতিক নেতৃত্বের নেওয়ার বিষয়।’
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পুতিন স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের ইরানি বন্ধুরা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কোনো সহায়তা চায়নি।’
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার কর্মীরা ইরানের বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছেন। ইসরায়েল এখন পর্যন্ত এই স্থাপনায় হামলা চালায়নি। তারা রাশিয়ার কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
রাশিয়া ২০০৫ সালে বুশেহর প্রকল্পের নির্মাণ শুরু করে। ২০১১ সালে তা চালু হয়। ইতিমধ্যে ইরানের সঙ্গে একটি ২০ বছর মেয়াদি চুক্তির অধীনে আরও তিনটি পারমাণবিক স্থাপনা নির্মাণে সম্মত হয়েছে রাশিয়া।
পুতিন জানান, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখছেন। তার মতে, ইরানি জনগণ এখন তাদের নেতৃত্বের পেছনে একতাবদ্ধ হচ্ছে এবং এই সংকট সমাধানে কূটনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।