বীজের ওপর কৃষকের মালিকানা প্রতিষ্ঠা এখন কে আটকাচ্ছে
Published: 12th, July 2025 GMT
হাইব্রিড বীজের উচ্চফলনের গল্প থেমে গেছে। জমির উর্বরতা শেষ, বাস্তুতন্ত্র শেষ, তলার পানি শেষ—সঙ্গে আছে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। আছে বীজ কোম্পানির প্রতারণা। মাঝখানে কৃষকের বীজভান্ডার থেকে বীজ হাওয়া হয়ে গেছে।
বন্যার সময় প্রায়ই এ রকম একটা ছবি পত্রিকায় দেখতে পাই—কলার ভেলায় একজন নারী ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কিছু বীজ জড়িয়ে বসে আছেন। একজন নারী সংসার বলতে কী বোঝেন, এটা তারই প্রতীক। এটাই হলো বাস্তুসংস্থান। নারী জানেন, ঝড়, বন্যা, বৃষ্টি, লবণাক্ততায় কীভাবে বিপদ আগলে কৃষি করতে হয়। শিশি, ধামা, ঝুড়ি ও কলসিতে নারীরা বীজ রাখতেন। নারীদের সেই বীজভান্ডার এখন শূন্য। বহুজাতিক কোম্পানি সেই বীজ কেড়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশ গভীর জলের ধানের আঁতুড়ঘর। এখানে সবচেয়ে বেশি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের গভীর পানির ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশ বেগুনের আদি জন্মভূমি। বেগুনকে বলা হয় শস্য ফসলের ক্ষেত্রে ‘সেন্টার অব অরিজিন’।
একেক অঞ্চলের একেক রকম জমি—চরের জমি, বিলের জমি, লালমাটির জমি, উপকূলের জমি, পাহাড়ের জমি। মাটি ও পানি একেকটা কৃষি-প্রতিবেশ অঞ্চল। যে ধরনের উদ্ভিদ বা বীজ লাগালে পরিবেশে বিশেষ জীব, অণুজীব, প্রাণী থাকার কথা নয়; সেই পরিবেশের অনুপযোগী জীবদের প্রবেশাধিকার দিলে পরিবেশের বারোটা বেজে যাবে। বিজ্ঞানীরা এদের নাম দিয়েছেন আগন্তুক প্রজাতি। সমতলের চিলমারীর গাছ রাঙামাটির পাহাড়ে আগন্তুক হিসেবেই বিবেচিত হবে।
দুই.প্রমথ চৌধুরী তাঁর ‘পাপীয় দিবস’ প্রবন্ধে সেকালেই ‘ফসলের জন্মনিরোধ’ শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। হাইব্রিড বীজ হলো সেই বাঁজা বীজ, যে বীজ থেকে আর বীজ হয় না। বলা হয়, বাংলাদেশে ২০ হাজার জাতের ধান ছিল।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের দাবি, তাদের কাছে আট হাজার জাতের ধানের বীজ আছে। সমাজের ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যৌথ আত্মবিশ্বাস, স্বনির্ভরতা ও সম্পদ শত বছর ধরে লুট করে একরৈখিক সরল বয়ান দাঁড় করানো হয়েছে। সবার জন্য ‘এক মাপ’ই সই। এই বয়ানই তো ফ্যাসিবাদের জমিন।
প্রাণসম্পদ ও লোকায়ত জ্ঞান রক্ষা করার আইনের খসড়া (বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড কমিউনিটি নলেজ প্রটেকশন অ্যাক্ট) নাকি সরকারের হাতে পড়ে আছে সেই ১৯৯৮ সাল থেকে; আছে নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে উৎসাহিত করার জন্য আরেকটি আইনের খসড়াও (প্ল্যান্ট ভ্যারাইটি অ্যাক্ট)। এটি একটি দ্রুত প্রণীত সু-জেনেরিস আইন, যার মাধ্যমে বায়োডাইভার্সিটি ও লোকায়ত জ্ঞান সংরক্ষণের বিষয়গুলোকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ছিল। সু-জেনেরিস আইন মানে প্রচলিত কাঠামোর বাইরের একটি আইন। তবে ১৯৯৮ সালের পর এ আইন কখনো সংসদে পাস হয়নি। এর পরিবর্তে ২০১৭ সালে ‘বাংলাদেশ বায়োডাইভার্সিটি অ্যাক্ট, ২০১৭’ নামে একটি নতুন আইন প্রণীত হয়।
অর্থাৎ খসড়া জারি থাকলেও তা কখনো আইনে পরিণত হয়নি। ২০১৭ সালের বাস্তব আইনটিতে অ্যাকসেস অ্যান্ড বেনিফিট শেয়ারিং (এবিএস) মেকানিজম অন্তর্ভুক্ত আছে। অর্থাৎ বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে দেশের বা দেশের বাইরের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান জৈবসম্পদ ব্যবহার করতে পারবে এবং সেখান থেকে অর্জিত মুনাফা ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। অর্থাৎ ১৯৯৮ সালের খসড়ার মতো কমিউনিটি রক্ষাকল্পে জীববৈচিত্র্য ও লোকায়ত জ্ঞান সংরক্ষণের বিষয়টি এখানে নেই। অথচ প্রতিটি গাছপালা ও লতাগুল্মের সঙ্গে পরিবেশ, স্থানীয় মানুষ, তাদের সংস্কৃতি ও বেঁচে থাকার প্রশ্ন জড়িত। অর্থাৎ আমরা গোলাম না, স্বাধীন হব—সে প্রশ্ন যুক্ত। তারপর বীজ কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা এই খসড়াগুলো গায়েব করে ‘কোম্পানিদের অধিকার’ বা ব্রিডারস রাইট রক্ষার জন্য একটি খসড়া আইন কৃষি মন্ত্রণালয়ে পেশ করে।
তিন.দক্ষিণবঙ্গে লবণাক্ততা একটি বাস্তব সমস্যা। আগে এখানে লোনাপানির অনেক জাতের ধান ছিল—নারিকেলমুচি, করচামুড়ি, বড়ান, পাটনাই, কুটেপাটনাই, সাদামোটা, লালমোটা, নোনাখচি, জটাইবালাম, বুড়োমন্তেশ্বর ইত্যাদি। চিলমারী, রৌমারী, জামালপুর-সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের বন্যা-আক্রান্ত এলাকায় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধানের গাছও বড় হয়। এমন জাতগুলো হচ্ছে আলাই, ধাইয়া, বাওরী, মহিষোর, মধুবালা, তুলাধান, জনজিরা ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে দেশি জাতের কোনো বীজ নেই। সবজির বীজ তো নেই-ই। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কাছে সংরক্ষিত আট হাজার জাতের ধানের বীজ কৃষকদের কাছে বিতরণের জন্য থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক।
প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে শস্য ও বীজ সংরক্ষণাগার আছে। এটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের আওতাধীন একটি স্থানীয় কৃষি অবকাঠামো। কাজ ছিল—উন্নত মানের বীজ সংরক্ষণ ও বিতরণ, কৃষকদের বীজ উৎপাদনে সহায়তা প্রদান, শস্য ও বীজের গুণগত মান রক্ষা। কিন্তু কাজির গরু কাগজে থাকা পর্যন্তই। এমনকি হাইব্রিড বীজেরও উৎপাদন সক্ষমতা যাচাই, নজরদারি ও সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা নেই। কৃষক কেমন বীজ জমিতে লাগাচ্ছেন, সেটা দেখভালের কেউ নেই।
শস্য ও বীজ সংরক্ষণাগারগুলো ধান ও অন্যান্য ফসলের দেশি জাতের বীজ কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে ভূমিকা রাখতে পারত। বাংলাদেশে কৃষি-প্রতিবেশ বা বাস্তুসংস্থান এলাকা ৩০ প্রকারের। এসব এলাকা অনুসারে ধান ও সবজির বীজ কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা জানাতে পারেন কীভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়াই আবাদ করা যায়।
বাংলাদেশে যাঁরা প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে এতকাল আমাদের শিক্ষিত করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ এখন বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরাই চাইলে কৃষি ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার মূল কাজটিতে হাত দিতে পারেন।
● নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব শ অর থ ৎ স রক ষ র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
‘বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তা বন্ধের ঝুঁকিতে’
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, আরো অর্থ না পেলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সহায়তার জন্য ২৫৫ মিলিয়ন ডলারের আবেদন করা হয়েছে, যার মাত্র ৩৫ শতাংশ অর্থায়ন করা হয়েছে। শুক্রবার জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র বাবর বালুচ এ তথ্য জানিয়েছেন।
বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী বসতি দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস অভিযানের পর তাদের বেশিরভাগই পালিয়ে এসেছেন।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র বাবর বালুচ বলেছেন, “আমাদের কী প্রয়োজন এবং কী সম্পদ উপলব্ধ রয়েছে তার মধ্যে বিশাল ব্যবধান রয়েছে। এই তহবিল ঘাটতি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার উপর প্রভাব ফেলবে। কারণ তারা খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার জন্য প্রতিদিন মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল।
রয়টার্স জানিয়েছে, রাশিয়া ও চীনের ক্রমবর্ধমান ভয়ের কারণে প্রতিরক্ষা ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে প্রধান দাতাদের তহবিল হ্রাসের ফলে মানবিক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বালুচ বলেন, “বিশ্বব্যাপী তীব্র তহবিল সংকটের কারণে, নতুন আগত শরণার্থী ও ইতিমধ্যে উপস্থিত উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা পূরণ হবে না এবং অতিরিক্ত তহবিল নিশ্চিত না করা হলে সমগ্র রোহিঙ্গা শরণার্থী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।”
ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে এবং ডিসেম্বরের মধ্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে।
ইউএনএইচসিআর অনুসারে, গত ১৮ মাসে কমপক্ষে এক লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারে এসেছেন। বৌদ্ধ অধ্যুষিত মিয়ানমারের পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিপীড়ন হাজার হাজার মানুষকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।
বালুচ বলেন, “বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের এই স্থানান্তর... ২০১৭ সালের পর থেকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি, যখন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মারাত্মক সহিংসতা থেকে পালিয়ে এসেছিল।”
ঢাকা/শাহেদ