চ্যাথাম হাউস– ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা বিশ্ব রাজনীতির জটিল বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা করে থাকে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে। শুরুতে এটি স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার প্রত্যয়ে গঠিত হলেও শতাব্দীর বেশি সময়ে এর কার্যক্রমে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তানীতির ক্ষেত্রে এর কার্যক্রম ও অবদান নিয়ে রয়েছে সমালোচনা।

চ্যাথাম হাউস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক নীতি ও কূটনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিপি, শেভরন, ওয়েলস ফার্গোসহ বিশ্বখ্যাত বড় বড় কোম্পানির অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানটি অনেকাংশে চালিত হয়, যেখানে আমেরিকার আলোচিত ও সমালোচিত ধনকুবেররাও যুক্ত। ফলে সমালোচকরা চ্যাথামের ঘোষিত ও অঘোষিত আয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন।

উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালের প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘ব্রিটিশ রাউন্ড টেবিল মুভমেন্ট’ সদস্য ও উপনিবেশবাদী প্রশাসক লায়নেল কার্টিস ব্রিটেনে ‘ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে নাম হয় চ্যাথাম হাউস। একই সময়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’। মূলত উভয় দেশের অভিজাত শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্রাজ্যবাদ চালু রাখতে প্রতিষ্ঠান দুটি গড়ে তোলে।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়েও অতীতে চ্যাথাম মঞ্চে আলোচনা হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, শ্রীলঙ্কার রণিল বিক্রমাসিংহেসহ অনেক প্রভাবশালী নেতা ও নীতিনির্ধারক এই মঞ্চে অংশগ্রহণ করেছেন। তারা দেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন এবং বৈশ্বিক কূটনীতির জটিলতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতীতে রোহিঙ্গা সংকট, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নিয়ে চ্যাথাম হাউসে অধিবেশন হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.

ইউনূসের সাম্প্রতিক লন্ডন সফরকালে চ্যাথাম হাউসে আয়োজিত এক আলোচনায় অংশগ্রহণ চ্যাথাম হাউসের শত বছরের কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে তাৎপর্যপূর্ণ। বলা যায়, একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ। দেশ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার ভাবনা ও বাস্তবতা বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার সুযোগ তিনি নিয়েছেন। যেমন রোহিঙ্গা সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে অবস্থান পরিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।

তবে এমন মঞ্চে যাওয়াকে সব সময় সরলভাবে দেখার সুযোগ থাকে না। আগেই বলেছি, চ্যাথাম হাউসের পেছনে বিভিন্ন করপোরেট ও রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে এবং এর আলোচনার ধরন প্রায়ই পশ্চিমা নিরাপত্তানীতির প্রভাব বিস্তার হিসেবে দেখা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আলোচনাগুলো প্রায়ই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও শক্তিধরদের শক্তির সমীকরণে ভূমিকা রাখে। ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির মতো বৃহৎ কৌশলগত ধারণাগুলোর প্রচার ও প্রসারে চ্যাথাম হাউসের মতো  মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুনত্ব ও বহুমাত্রিকতা আনার দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যাথাম হাউসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতা, দূরদর্শিতা ও নিজেদের স্বতন্ত্র নীতিতে অটল থাকার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, নীতিমালা ও কৌশলগত ভাবনা অবশ্যই সঠিক হওয়া দরকার। 

এই প্রেক্ষাপটে যদি আমরা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা দেখি তাহলে সুস্পষ্টত অভ্যন্তরীণ ঐক্য শক্ত ভিতের ওপর এখনও দাঁড়াতে পারার দাবি করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও কূটনৈতিক কৌশল দৃঢ় ও স্বচ্ছ রাখার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম অবস্থান রক্ষা করা।

চ্যাথাম হাউসের মূল কর্মকাণ্ডকে বিবেচনায় নিয়ে কেউ যদি এমন প্রশ্ন করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের জন্য পরিচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন চ্যাথাম হাউসের মতো মঞ্চে গেছেন, যেখানে সাধারণত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়েই আলোচনা বেশি হয়? তাঁর অংশগ্রহণ কি শুধু বাংলাদেশের কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু কৌশল কাজ করছে?

যদিও আমরা পুরো অনুষ্ঠানে দেখেছি, ড. ইউনূস তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছেন, তবুও অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের উপস্থিত হওয়া কতটা প্রাসঙ্গিক? বিশেষত এমন একটি জায়গায়, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন স্বার্থের মিলন ঘটে। বাংলাদেশের জন্য কি এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখা হবে, নাকি সতর্কতা হিসেবে? কারণ চ্যাথাম হাউসের স্পন্সরদের মধ্যে এমন কোম্পানিও রয়েছে, যাদের বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। কেউ যদি ভাবেন, নোবেলজয়ী শান্তির দূত ও বিশ্বে সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন এমন একটি সংস্থায় গেছেন, যার কর্মকাণ্ড ও নীতি সবসময় স্বচ্ছ বা নিরপেক্ষ নয়? তাহলে সেই ভাবনাকে দোষ দেওয়া যাবে না।

ওপরে তোলা প্রশ্নগুলোর আসলে সহজ উত্তর নেই। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং তারপর গত ১০ মাসে নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এখনও পূর্ণ স্থিতিশীলতা আসেনি। সন্দেহ ও অবিশ্বাস শুধু রাজনীতিকে নয়; পুরো দেশের মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনীতিকে টালমাটাল করে রেখেছে। বেকারত্ব বাড়ছে; ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হওয়ায় দারিদ্র্যও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডনের সর্বশেষ সফরে পূর্বঘোষিত এপ্রিলের নির্বাচন শর্ত সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে এসেছে। তা নিয়ে আবার দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল প্রশ্নও তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে চ্যাথাম হাউসে বিভিন্ন বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করা কি শুধুই কাকতাল, নাকি কৌশল?

মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ ক টন ত ক র জন ত ক অবস থ ন সরক র র ইউন স

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ