ব্রিটিশ চ্যাথাম হাউসে উপস্থিতির বাংলাদেশি তাৎপর্য
Published: 19th, June 2025 GMT
চ্যাথাম হাউস– ব্রিটেনে প্রতিষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, যা বিশ্ব রাজনীতির জটিল বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা করে থাকে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠান প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে গড়ে ওঠে। শুরুতে এটি স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করার প্রত্যয়ে গঠিত হলেও শতাব্দীর বেশি সময়ে এর কার্যক্রমে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও করপোরেট স্বার্থের প্রভাব লক্ষণীয়। বিশেষত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তানীতির ক্ষেত্রে এর কার্যক্রম ও অবদান নিয়ে রয়েছে সমালোচনা।
চ্যাথাম হাউস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক নীতি ও কূটনীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিপি, শেভরন, ওয়েলস ফার্গোসহ বিশ্বখ্যাত বড় বড় কোম্পানির অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানটি অনেকাংশে চালিত হয়, যেখানে আমেরিকার আলোচিত ও সমালোচিত ধনকুবেররাও যুক্ত। ফলে সমালোচকরা চ্যাথামের ঘোষিত ও অঘোষিত আয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন।
উল্লেখ্য, ১৯১৯ সালের প্যারিস শান্তি সম্মেলনে ব্রিটিশ ও আমেরিকান প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ‘ব্রিটিশ রাউন্ড টেবিল মুভমেন্ট’ সদস্য ও উপনিবেশবাদী প্রশাসক লায়নেল কার্টিস ব্রিটেনে ‘ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে নাম হয় চ্যাথাম হাউস। একই সময়ে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস’। মূলত উভয় দেশের অভিজাত শ্রেণি বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্রাজ্যবাদ চালু রাখতে প্রতিষ্ঠান দুটি গড়ে তোলে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়েও অতীতে চ্যাথাম মঞ্চে আলোচনা হয়েছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, শ্রীলঙ্কার রণিল বিক্রমাসিংহেসহ অনেক প্রভাবশালী নেতা ও নীতিনির্ধারক এই মঞ্চে অংশগ্রহণ করেছেন। তারা দেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন এবং বৈশ্বিক কূটনীতির জটিলতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অতীতে রোহিঙ্গা সংকট, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতি নিয়ে চ্যাথাম হাউসে অধিবেশন হয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.
তবে এমন মঞ্চে যাওয়াকে সব সময় সরলভাবে দেখার সুযোগ থাকে না। আগেই বলেছি, চ্যাথাম হাউসের পেছনে বিভিন্ন করপোরেট ও রাজনৈতিক স্বার্থ কাজ করে এবং এর আলোচনার ধরন প্রায়ই পশ্চিমা নিরাপত্তানীতির প্রভাব বিস্তার হিসেবে দেখা হয়। প্রতিষ্ঠানটির আলোচনাগুলো প্রায়ই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও শক্তিধরদের শক্তির সমীকরণে ভূমিকা রাখে। ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির মতো বৃহৎ কৌশলগত ধারণাগুলোর প্রচার ও প্রসারে চ্যাথাম হাউসের মতো মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশের কূটনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুনত্ব ও বহুমাত্রিকতা আনার দৃষ্টিকোণ থেকে চ্যাথাম হাউসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার অংশগ্রহণ অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর সঙ্গে সঙ্গে সতর্কতা, দূরদর্শিতা ও নিজেদের স্বতন্ত্র নীতিতে অটল থাকার মতো জরুরি বিষয়গুলোকে কীভাবে রক্ষা করা হচ্ছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ ঐক্য, নীতিমালা ও কৌশলগত ভাবনা অবশ্যই সঠিক হওয়া দরকার।
এই প্রেক্ষাপটে যদি আমরা চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা দেখি তাহলে সুস্পষ্টত অভ্যন্তরীণ ঐক্য শক্ত ভিতের ওপর এখনও দাঁড়াতে পারার দাবি করা যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও কূটনৈতিক কৌশল দৃঢ় ও স্বচ্ছ রাখার মধ্য দিয়ে দেশের স্বাধীন ও সার্বভৌম অবস্থান রক্ষা করা।
চ্যাথাম হাউসের মূল কর্মকাণ্ডকে বিবেচনায় নিয়ে কেউ যদি এমন প্রশ্ন করেন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের জন্য পরিচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন চ্যাথাম হাউসের মতো মঞ্চে গেছেন, যেখানে সাধারণত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যুগুলো নিয়েই আলোচনা বেশি হয়? তাঁর অংশগ্রহণ কি শুধু বাংলাদেশের কথা বিশ্বের সামনে তুলে ধরা, নাকি এর পেছনে অন্য কিছু কৌশল কাজ করছে?
যদিও আমরা পুরো অনুষ্ঠানে দেখেছি, ড. ইউনূস তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরতে চেয়েছেন, তবুও অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, এ ধরনের প্ল্যাটফর্মে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের উপস্থিত হওয়া কতটা প্রাসঙ্গিক? বিশেষত এমন একটি জায়গায়, যেখানে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন স্বার্থের মিলন ঘটে। বাংলাদেশের জন্য কি এটিকে সুযোগ হিসেবে দেখা হবে, নাকি সতর্কতা হিসেবে? কারণ চ্যাথাম হাউসের স্পন্সরদের মধ্যে এমন কোম্পানিও রয়েছে, যাদের বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে। কেউ যদি ভাবেন, নোবেলজয়ী শান্তির দূত ও বিশ্বে সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিত ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন এমন একটি সংস্থায় গেছেন, যার কর্মকাণ্ড ও নীতি সবসময় স্বচ্ছ বা নিরপেক্ষ নয়? তাহলে সেই ভাবনাকে দোষ দেওয়া যাবে না।
ওপরে তোলা প্রশ্নগুলোর আসলে সহজ উত্তর নেই। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন এবং তারপর গত ১০ মাসে নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এখনও পূর্ণ স্থিতিশীলতা আসেনি। সন্দেহ ও অবিশ্বাস শুধু রাজনীতিকে নয়; পুরো দেশের মানুষের জীবনযাপন ও অর্থনীতিকে টালমাটাল করে রেখেছে। বেকারত্ব বাড়ছে; ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হওয়ায় দারিদ্র্যও বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডনের সর্বশেষ সফরে পূর্বঘোষিত এপ্রিলের নির্বাচন শর্ত সাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে এসেছে। তা নিয়ে আবার দেশের কোনো কোনো রাজনৈতিক দল প্রশ্নও তুলেছে। এমন পরিস্থিতিতে চ্যাথাম হাউসে বিভিন্ন বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করা কি শুধুই কাকতাল, নাকি কৌশল?
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম হ ম মদ ক টন ত ক র জন ত ক অবস থ ন সরক র র ইউন স
এছাড়াও পড়ুন:
রাবি প্রোভিসির ফেসবুক স্টোরি, শিক্ষক নিয়োগে জামায়াত নেতার সুপারিশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন খানের ফেসবুক স্টোরিতে শিক্ষক নিয়োগে জামায়াতের সাবেক এমপির সুপারিশ করা প্রবেশপত্র দেখা গেছে। স্টোরি ১৫ মিনিট পরেই ডিলিট করে দেন অধ্যাপক ফরিদ। তবে এটুকু সময়ের মধ্যেই সেই স্টোরির স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
শনিবার (২ আগস্ট) রাত ১২টার দিকে প্রকাশ করা ওই স্টোরিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রপ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে প্রভাষক নিয়োগের প্রবেশপত্রে জামায়াত সমর্থিত চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক এমপি মো. লতিফুর রহমান সুপারিশ করেছেন। তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসন থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালে দুই বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে ওই প্রার্থীর প্রবেশপত্র ভুলভাবে স্টোরিতে চলে এসেছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ফরিদ খান ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমার ফেসবুক স্টোরিতে একজন আবেদনকারীর প্রবেশপত্র কীভাবে আপলোড হয়েছে বুঝতে পারিনি। তবে মোবাইল ফোনটি নিয়ে আমার ছেলে বেশ কিছু সময় গেম খেলছিল। তখন হয়তো ভুলবশত স্টোরিতে এসে গেছে।’’
তিনি আরো লিখেছেন, ‘‘প্রতিদিনই কোনো না কোনো আবেদনকারী বা তাদের পক্ষে বিভিন্ন সূত্রে সাক্ষাৎ করতে এসে সিভি, প্রবেশপত্র দিয়ে যায়, আবার অনেকে ফোন করে আবেদনকারীর প্রবেশপত্র হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করে, কেউ টেক্সট করে সুপারিশ পাঠায়। রুয়ার নির্বাচনের সময় একজন অ্যালামনাস যিনি সাবেক এমপি ছিলেন উনার সাথে পরিচয় হয়। কয়েকদিন আগে উনি ফোন করে উনার এলাকার একজন আবেদনকারীর কথা বলেন এবং তার প্রবেশপত্র সেন্ড করেন।’’
শুধু জামায়াত নেতা নন, বিভিন্ন সূত্রে এমন সুপারিশ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘পরিচিত অনেকেই এরকম সুপারিশ করেন। তাদের মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক, বন্ধু, সহকর্মী, রাজনীতিক অনেকেই আছেন। এই মুহূর্তে আমার অফিসে এবং মোবাইল ফোনে ডজনখানিক এরকম সুপারিশ আছে। তবে এগুলো কোনোভাবেই লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষায় প্রভাব ফেলে না।’’
বিষয়টির জন্য অধ্যাপক ড. ফরিদ পোস্টে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘‘আশাকরি বিষয়টি নিয়ে কেউ ভুল বুঝবেন না।’’
সুপারিশ করার বিষয়ে জানতে চাইলে জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য লতিফুর রহমান বলেন, ‘‘চাকরিপ্রার্থীর প্রবেশপত্রে সুপারিশ করা হয়েছে এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না। তবে ওই প্রার্থীর বিষয়ে উপ-উপাচার্যকে ফোন করেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘বিগত দিনে ভাইবাগুলোতে অনেক বাজে চর্চা হয়েছে। তবে বর্তমান সময়ে আমরা এটা চাই না।’’
প্রবেশপত্রে করা সুপারিশ এবং স্বাক্ষর কার জানতে চাইলে অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, ‘‘যেভাবে স্টোরিতে থাকা ওই প্রবেশপত্র দেখা গেছে, আমার কাছে ওভাবেই এসেছিল। যিনি পাঠিয়েছেন তার লেখা কি না আমি নিশ্চিত নই।’’
রাজশাহী/ফাহিম//