দিনটি ছিল সোমবার। আষাঢ়ের আকাশে গাঢ় মেঘের ছায়া, বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে ভিজে যাচ্ছিল শহরের অলিগলি। বাতাসে ছিল স্নিগ্ধ শীতলতা, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সুরের মন্দিরে প্রবেশ করলেন বাংলা গানের চিরন্তন পাখি– সাবিনা ইয়াসমিন। যাঁর কণ্ঠে ‘জন্ম আমার ধন্য হলো’, ‘ও আমার বাংলা মা তোর’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে’ কিংবা ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’ গানগুলি বাঙালির রক্ত এখনও তোলপাড় তুলে দেয়। গায়কিতে এখনও অনন্য তিনি। বয়স ৭০। যা তাঁর কণ্ঠের কাছে সংখ্যা মাত্র। রোগ-শোক, দীর্ঘ পথচলা, জীবনের ওঠানামা– সব পেরিয়ে তিনি এখনও যখন গান ধরেন, তখন সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাঁর কণ্ঠে সুরের এমন এক জাদু রয়েছে, যা সময়কে বশ করে নেয়, হৃদয়কে অচেনা শিহরণে ভরিয়ে দেয়। 

মগবাজারের দিলু রোডের রেকর্ডিং স্টুডিওতে যখন তিনি উপস্থিত হলেন, চারপাশে যেন অন্য এক আবেশ ছড়িয়ে পড়ল। পরিচিত সেই কোকিলকণ্ঠ যখন বেজে উঠল, মনে হচ্ছিল না যে তিনি সত্তর পেরিয়েছেন। বরং মনে হলো, কোনো এক তরুণী গান ধরেছে, যার কণ্ঠে মায়া, মমতা আর গভীর প্রেম। গাইছিলেন ‘প্রাণের বাংলাদেশ’। গানটি লিখেছেন আরিফ হোসেন বাবু, সুর করেছেন রোহান রাজ। সাবিনা ইয়াসমিন যেন গানে গানে বাংলাদেশের আত্মাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলেন। এক অন্তরা শেষ করেই থেমে বললেন, ‘এই লাইনটা মনমতো হয়নি, আবার দেই।’ সেই একাগ্রতা, সেই নিষ্ঠা– এ যেন শিল্পের প্রতি তাঁর প্রেমের প্রকাশ। একটানা গাইছিলেন, আবার থেমে যাচ্ছিলেন। সংশোধন করছিলেন, আবার গাইছিলেন দরদ দিয়ে। তাঁর সেই মুহূর্তগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, শিল্পী নিজেই যেন নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক।

তিনি যখন গাইছিলেন, তখন চারপাশটা নিঃশব্দ, রেকর্ডিং স্টুডিওর প্রতিটি দেয়াল যেন তাঁর কণ্ঠে মুগ্ধ হয়ে স্থবির হয়েছিল। তাঁর কণ্ঠে ফুটে উঠল বাংলাদেশের নদী, মাঠ, প্রান্তর, মানুষের দুঃখ-সুখ, প্রেম-বিরহ। ছেলেবেলায় যেমন রুপালি পর্দার নায়িকারা কল্পনায় হেঁটে বেড়াতেন, তেমনই আমাদের কল্পনার পর্দায় হেঁটে বেড়ালেন সাবিনা ইয়াসমিনের সুরেলা কণ্ঠ। কথায় বিনয়, চোখে ক্লান্তির ছায়া। কিন্তু কণ্ঠে ছিল সজীবতা। মনে হচ্ছিল, আমাদের খুব চেনা একজন মানুষ, যার সুরে আছে হাজারো অচেনা অনুভূতির গুঞ্জন।

গানে দরদ নেই, আবেগও নেই 
টানা ৩০ মিনিটে রেকর্ডিং শেষ করলেন সাবিনা ইয়াসমিন। এসে বসলেন পাশে। তিন হাত দূর থেকে কালজয়ী গানের এই শিল্পীকে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। এসেই বললেন সবাই ভালো আছো তো? এরপর ধীরে ধীরে খুললেন গল্পের ঝাঁপি। প্রথমেই জানতে চাওয়া হলো এত দরদ দিয়ে গানটায় কণ্ঠ দিলেন কিন্তু এখনকার গানে এমন দরদ পাই না কেন আমরা? প্রশ্ন করতেই চাতক পাখির মতো তাকালেন। একটু ভেবে বলতে লাগলেন, লাস্ট একটি ছবির গানের সুর করেছিলাম। সেই সিনেমায় এই সময়ের একজন কণ্ঠশিল্পীকে আমি গানটি গাওয়ার ব্যাপারে এক্সপ্রেশনও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সে সিনেমার পরিচালক যিনি, তিনিও শিল্পীকে বলে বলে দরদ ও এক্সপ্রেশনটা পুরোপুরি আনার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি এমন কেন হবে। শিল্পীরা কেন এটা নিয়ে পরিশ্রম করছেন না। তারা কেন নিজ থেকে রেওয়াজ বা অনুশীলন করছেন না। সাদামাটা গেয়ে গেলে তো আর ফিল্মের গানের কিছু হলো না। এখন সেটাই হচ্ছে। সাদামাটাভাবেই যেন সবাই গাইছেন। ফলে এখনকার গানে দরদটা নেই, এক্সপ্রেশন নেই, আবেগও নেই, কোনো কিছুই যেন নেই। বোঝা গেল, সময়টায় মেধাবী শিল্পী থাকলেও সেই মেধা বিকাশের চেষ্টা না থাকায় কিছুটা হলেও মর্মাহত এই গায়িকা। 

কেন গানে দরদ নেই সে বিষয়ে তিনি নিজেই ব্যাখ্যা দাঁড় করালেন– গান যদি এক লাইন এক লাইন করে গাওয়া হয়, একটা একটা শব্দ করে যদি রেকর্ডিং করা হয় তাহলে গানে দরদ কীভাবে আসবে। এখন ডুয়েট গানেও শুনি একজন আরেকজনকে দেখেন না। অথচ আমরা যখন ডুয়েট করেছি তখন একসঙ্গে ভয়েস দিতাম। প্রতিযোগিতা চলত কে কার চেয়ে ভালো গাইতে পারে। একটা উদাহরণ দেই, সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা– এই গানটা আব্দুল আলীম ভাইয়ের সঙ্গে গাইতে গিয়ে তো আমি ভয়ে শেষ। পরে আলীম ভাই সাহস দিলেন। বেশ কয়েকবার আমাকে অভয় দিলেন। পরে গাইলাম। বলতে গেলে বিখ্যাত মানুষের সামনেও আমার পার্ট তার চেয়ে কীভাবে ভালো হয় সে প্রতিযোগিতা ছিল। একইরকম ঘটনা ঘটেছিল কিশোর কুমারের সঙ্গে গাওয়ার সময়। অথচ এখন সেটা অনুপস্থিত।

স্মৃতির ঝাঁপি .

..
সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে কথা হবে আর সেখানে এন্ড্রু কিশোর থাকবেন না, তা হয় না। এই নামটি নিতেই কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গেলেন তিনি। প্রশ্ন করা হলো, যদি কখনও এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে দেখা হয় কী বলবেন? সাবলীল উত্তর, কিছুই বলতাম না। হাত ধরে বাসায় নিয়ে আসতাম। এই কথাতেই তাদের সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। বোঝা যায়, কতটা মিস করেন প্রয়াত এই গায়ককে। কথায় কথায় আলাউদ্দীন আলী ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকেও স্মরণ করলেন তিনি। ছোট ছোট স্মৃতি বলতেই দেখা গেল চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে তাঁর। বলতে শুরু করলেন এখন বুলবুল ও আলাউদ্দীন আলীর মতো মিউজিক ডিরেক্টর কোথায়? আতা ভাই, আলতাফ মাহমুদ, খন্দকার নুরুল আলম, আনোয়ার পারভেজ, সত্যদা, সুবল দা, আলম ভাই, দেবুদা, রবিন ঘোষদের মতো এখন কে আছেন? কী সব মায়া জাগানো সুর ও সংগীত করেছেন তারা। সবারই খুব ডিফারেন্ট টাইপের সুর। একেকজনের স্টাইল একেক রকম। আমরা প্রতিটি গানের পেছনে অনেক পরিশ্রম ও রেওয়াজ করতাম। এখন তো রেওয়াজ কী– সেটাও ভুলে গেছে। এরপর আর কথা বাড়ালেন না শিল্পী। উঠে দাঁড়ালেন। বললেন অনেক বেলা হয়ে গেছে। এবার বাসায় ফিরি। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র কর ড করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

বনানীতে সিসা বারে যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা, জড়িত ৫ জন শনাক্ত

রাজধানী ঢাকার বনানী এলাকায় ‘৩৬০ ডিগ্রি’ নামের একটি সিসা বারে রাহাত হোসেন রাব্বি (৩১) নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত রাহাত ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা করতেন। পুলিশের ধারণা, আর্থিক লেনদেন নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে রাহাতকে হত্যা করা হয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে রাহাত হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম–পরিচয় পাওয়া গেছে।

বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাসেল সারোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, সিসা বারের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাহাতের পায়ে ছুরিকাঘাত করেন তাঁর পূর্বপরিচিত কয়েকজন যুবক। গুরুতর আহত অবস্থায় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওসি রাসেল সারোয়ার আরও বলেন, রাহাত তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে সিসা বারে ছিলেন। কথা-কাটাকাটির জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা রাহাতের পূর্বপরিচিত এবং তাঁরা প্রায়ই এই সিসা বারে আসতেন। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।

রাহাতের ওপর হামলার দৃশ্য ধারণ হয়েছে সিসা বারের একাধিক সিসি ক্যামেরায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, রাহাত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় প্রথমে তিনজন তাঁকে ঘিরে ধরেন। এর মধ্যেই তাঁর ঊরুতে ছুরিকাঘাত করা হয়। এক যুবক রাহাতের ওপর হামলা ঠেকাতে চাইলে তাঁকেও মারধর করা হয়। একপর্যায় রাহাত সিঁড়ি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় ভবনের লিফটের কাছে আসেন। হামলাকারীদের একজন রাহাতকে কিছু একটা দিয়ে পেটান। সবশেষে আরেকজন এসে রাহাতের ডান হাতের কনুইতে ছুরিকাঘাত করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।

নিহত যুবকের চাচাতো ভাই শাকিল শাজাহান ও ফুফু কাজল আক্তার বলেন, রাহাত ইন্টারনেট ব্যবসায়ী ছিলেন। মহাখালী এলাকার রবিউল আলম হাজারীর দুই ছেলের মধ্যে তিনি বড়। রাতে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হয়ে আর বাসায় ফেরেননি। ভোরে তাঁর মুঠোফোন থেকে এক বন্ধু জানান, রাহাত ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে সিসা নিষিদ্ধ মাদক। তবে অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে প্রভাবশালীরা যোগসাজশ করে রাজধানীর অভিজাত এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে সিসা বার পরিচালনা করে আসছেন। অনেকটা প্রকাশ্যে ৩৬০ ডিগ্রি নামের একটি সিসা বার ব্যবসা পরিচালনা করলেও সেটা জানতেন না বলে জানিয়েছেন বনানী থানার ওসি রাসেল সারোয়ার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ৩৬০ ডিগ্রি নামের একটি সিসা বারের নামে আগেও দুটি মামলা করা হয়েছিল। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, নিয়মিত অভিযান না হওয়ায় এভাবে প্রকাশ্যে চলছে সিসা বার। গুলশান এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক শামসুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগে ‘অ্যারাবিক কুজি’ নামে সিসা বারটি পরিচালিত হতো। কিছুদিন আগে অভিযান চালিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এখন ৩৬০ ডিগ্রি নতুন নাম দিয়ে একই মালিক ব্যবসা পরিচালনা করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাথর লুটে জড়িত বড় নেতারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না
  • ‘রুকন না হলে চাকরি থাকবে না’ বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ব্যাখ্যা
  • বিপ্লবের এক বছর পর আশা হতাশায় রূপ নিচ্ছে
  • এশিয়া কাপে বাদ পড়তে পারেন বাবর আজম ও রিজওয়ান
  • ডাকসু নির্বাচন: চতুর্থ দিনে মনোনয়ন ফরম নিলেন একজন
  • কক্সবাজার সৈকতে গোসলে নেমেছিলেন চার বন্ধু, ঢেউয়ে ভেসে একজনের মৃত্যু
  • সার্কভুক্ত ‘দেশি’ ফুটবলার আশীর্বাদ নাকি শঙ্কা
  • বনানীতে সিসা বারে যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা, জড়িত ৫ জন শনাক্ত
  • এখনও হৃতিক সুজানের বন্ধুত্ব রয়ে গেছে
  • ভারতের যে গ্রামের পুরুষেরা দুই বিয়ে করেন