রাজাপুরের অরুণের রসগোল্লা মানেই ‘অথেনটিক মিষ্টি’
Published: 14th, January 2025 GMT
ছোট ও ছিমছাম শহর রাজাপুর। ঝালকাঠির এই উপজেলা শহরের একটি মিষ্টির দোকানের মিষ্টির সুনাম এ অঞ্চলের সর্বত্র। সবার কাছে ‘অরুণের মিষ্টি’ নামে পরিচিত এই রসগোল্লার বিশেষত্ব হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে ছানা বানিয়ে তৈরি করা। শুধু মিষ্টি নয় ছানা, সুস্বাদু মালাইও তৈরি হয় এখানে। ৫০ বছর ধরে ক্রেতাদের কাছে ‘অরুণের মিষ্টি’ বিশ্বস্ততার নাম।
বিএম কলেজের শিক্ষার্থী আল আমিনের বাড়ি পাথরঘাটার কালমেঘা গ্রামে। বাড়িতে যেতে বরিশাল থেকে সরাসরি পাথরঘাটায় বাস থাকলেও প্রতিবার যাওয়ার সময় প্রথমে রাজাপুর আসেন শুধু মিষ্টি খাওয়ার জন্য। নিজে খেয়ে তারপর বাড়িতে পরিবারের জন্য নিয়ে যান। আল আমিন বললেন, অরুণদার মিষ্টি হলো ‘অথেনটিক মিষ্টি’। কারণ, এতে ভেজাল নেই, চোখ বুঝে খেয়ে ফেলা যায়।
দোকানটির কোনো সাইনবোর্ড নেই। একচালা টিনের জরাজীর্ণ ঘর। সেই পুরোনো ঘরানার দোকানে এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসেন মিষ্টির স্বাদ নিতে। দূরদূরান্তের লোকজনও শখ করে আসেন এই মিষ্টিভোজনে।
শীতের এক দুপুরে রাজাপুর শহরে সেই ‘অথেনটিক মিষ্টি’র দোকানে ঢুকে দেখা গেল, মধ্যবয়সী একজন ক্যাশ কাউন্টারে বসে আছেন। পরে জানা গেল তাঁর নাম অরুণ রায়। তিনিই এখন বাবার মৃত্যুর পর এই ব্যবসার হাল ধরেছেন। বাবা নিরঞ্জন রায় মারা গেছেন ১৯৯৮ সালে।
দক্ষিণের বিষখালী নদী অববাহিকার জনপথ রাজাপুর উপজেলার ইতিহাস-ঐতিহ্য বেশ বনেদি-পুরোনো। শহর বেশি বড় না হলেও গোছানো-ছিমছাম। সড়কগুলো সরু হলেও রাজার নামে নামকরণ হওয়ায় বাসিন্দাদের আতিথেয়তায় সেই বনেদি বৈশিষ্ট্যের ছাপ আছে। ইতিহাসের তিনটি প্রভাবশালী রাজবংশ মৌর্য, গুপ্ত ও পালদের দ্বারা শাসিত হয় ধান-নদী-খাল—এই তিন মিলে গড়ে ওঠা জনপথ বরিশাল। ‘চন্দ্রদ্বীপ’ রাজ্য নামে পরিচিত ছিল বরিশাল। আর গৌর সুলতানের আমলে চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চল দুই পাঠান সরদার শাসন করতেন। তাঁদের একজনের নাম ছিল রেজা খান। রেজা খান এ অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। সেই রেজা খানের নামানুসারেই এ স্থানের নাম রাখা হয়েছিল রেজাপুর। পরে তা রাজাপুর নামে পরিচিতি পায়।
দোকানের ভেতরে কাঠের বেঞ্চ, চেয়ার ও টেবিলে বসে মিষ্টি খেতে দেখা গেল কয়েকজনকে। এর মধ্যে ইশতিয়াক নামে এক তরুণের সঙ্গে আলাপ। মিষ্টির স্বাদ নিতে প্রায়ই এখানে আসেন ইশতিয়াক। তাঁর পাশের টেবিলে একজন প্রবীণ ব্যক্তি পাউরুটি রসগোল্লার শিরায় ভিজিয়ে আয়েশ করে মুখে দিতে দিতে বললেন, ‘এই দোহানে রসগোল্লা খাই চল্লিশ বছর অইবে। আর কোনো দোহানের রসগোল্লার এই রহম স্বাদ পাই না।’ এই দোকনের রসগোল্লার স্বাদ আলাদা হওয়ার কারণ কী—জানতে চাইলে এই প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, ‘এরা নিজেরাই গোয়ালগো দিয়া দুধ কেনে, নিজেরাই ছানা বানায়, হেই ছানা দিয়া রসগোল্লা, মালাই বানায়, কোনো ভ্যাজাল নাই। হেইতেই এগো মিষ্টির স্বাদ অন্য রহম।’
ক্রেতাদের সামলে ব্যস্ততা শেষে কথা হলো অরুণ রায়ের সঙ্গে। বললেন, ‘বাবার আমল থেকে আমরা বিশ্বস্ততা ধরে রেখেছি। আমরা প্রতিদিন স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করি। তা দিয়ে নিজেরাই ছানা তৈরি করি। এরপর রসগোল্লা, ছানা, মালাই তৈরি করি।’
রাহাত হাওলাদার নামে একজন ক্রেতা এই দোকান থেকে মিষ্টি কিনতে এনেছেন। কাজের সূত্রে তিনি বরিশালে থাকেন। রাহাত বলেন, ‘বাড়িতে অনুষ্ঠান আছে, এখান থেকে মিষ্টি কিনলাম। মিষ্টি কিনলে এই দোকান থেকেই কিনি, অন্য কোথাও থেকে নয়। যত দোকানের মিষ্টি খেয়েছি, এখানের মতো বিশুদ্ধতার অনুভূতি অন্য কোথাও পাইনি।’
দোকানের মিষ্টির কারিগর শাহীন হোসেনকে দেখা গেল ছানা মিষ্টির গোল্লা তৈরি করে বড় ছেনিতে রাখছেন। তাঁর পেছনে বড় মাটির চুলায় মিষ্টির শিরা জ্বাল দিচ্ছিলেন গৌতম শীল নামে আরেক কারিগর। গৌতম শীল বলেন, তিনি ৩৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। প্রতিটি মিষ্টির গোল্লা পরম যত্নের সঙ্গে বানান তিনি।
অরুণের বাবা নিরঞ্জন রায় এই দোকান করেছিলেন। তিনি ছিলেন মিষ্টির মূল কারিগর। তাঁর বানানো মিষ্টির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সেই সুনাম তিনি ধরে রেখেছিলেন জীবদ্দশায়। চার ভাইয়ের মধ্যে অরুণ বড়। সেজ ভাই মারা গেছেন চার বছর আগে। মেজ ভাই তপন রায়কে নিয়ে অরুণ বাবার ব্যবসা পরিচালনা করেন। ছোট ভাই ঢাকায় একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন।
রসগোল্লার মূল্য ১০, ১৫ ও ২০ টাকা। এই দুর্মূল্যের বাজারে কীভাবে ১০ টাকায় মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন—জানতে চাইলে অরুণ রায় বলেন, ‘মান ঠিক রেখে কম ব্যবসা করি আমরা। আমাদের দোকানে ছোট, বড়, মাঝারি নানা পেশা, ধর্ম, বর্ণের মানুষ আসেন। সবাই যেন মিষ্টির স্বাদ নিতে পারেন, এ জন্য কষ্ট হলেও আমরা কম টাকায় মিষ্টি খাওয়াচ্ছি।’ তবে তাঁর কথায় কিছুটা আশঙ্কার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। অরুণ বললেন, ‘বছরখানেক আগেও প্রতিদিন অন্তত ৩৫০ কেজি দুধ দিয়ে ছানা ও মিষ্টি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন ক্রেতা কম, তাই দেড় থেকে দুই শ কেজি দুধ লাগে প্রতিদিন। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, আমরাও খুব লাভের মুখ দেখছি না। জানি না কত দিন এটা পারব। চিনির দাম, দুধের দাম এবং সঙ্গে কারিগরদের বেতন—সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি মাস শেষে। আমাদেরও তো টিকে থাকতে হবে।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাবে ব্রিটেনে কারিগরি শিক্ষার উত্থান
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দ্রুতগতিতে কর্মক্ষেত্রের দখল নেওয়ায় চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করা তরুণদের মধ্যে। অনেকেই ‘হোয়াইট কলার’ চাকরিকে নিরাপদ মনে করছেন না আর। বরং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং হাতে–কলমে দক্ষতার নিশ্চয়তা পাওয়া যায়, এমন কারিগরি পেশার দিকে ঝুঁকছেন।
এমনই একজন ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী মারিনা ইয়ারোশেঙ্কো। এআই যে অনেক অফিসভিত্তিক কাজ দখল করে নিতে পারে—এমন আশঙ্কা করছেন তিনি। বর্তমানে মারিনা লন্ডনের সিটি অব ওয়েস্টমিনস্টার কলেজে প্লাম্বিং কোর্সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
ইউক্রেন থেকে আসা মারিনা বলছিলেন, ‘এটা এমন একটা কাজ, যেটা এআই নিতে পারবে না।’ তাঁর মতে, প্লাম্বিং বা প্রকৃত প্রকৌশল কাজের সূক্ষ্মতা এবং শারীরিক বাস্তবতা কোনো যন্ত্র পুরোপুরি অনুকরণ করতে পারে না। মারিনা বলেন, ‘আমরা নিশ্চয়ই এআইকে কাজে লাগাব, কিন্তু অনেক কাজ আছে, যা শুধুই মানুষ করতে পারে—যেমন আসল প্লাম্বিং, তড়িৎকৌশল বা ইঞ্জিনিয়ারিং।
আরও পড়ুনযুক্তরাজ্যে নতুন যুগের পড়াশোনা: কোন বিষয়গুলো ট্রেন্ডে?২০ নভেম্বর ২০২৫এআইয়ের প্রভাব: বিশ্ববিদ্যালয়ে অনাগ্রহ, কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি বাড়ছেব্রিটেনে এআইয়ের প্রভাবে বড় ধরনের চাকরির কাঠামোয় পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব পারসোনেল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিআইপিডি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশটির ছয়জনের একজন নিয়োগদাতা মনে করছেন, আগামী ১২ মাসে এআইভিত্তিক টুলস ব্যবহারের কারণে তাঁরা কর্মীর সংখ্যা কমাতে পারেন। এই প্রেক্ষাপটে সিডব্লিউসি (সিটি অব এয়েস্ট মিনস্টার কলেজ) গত তিন বছরে ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন এবং বিল্ট এনভায়রনমেন্ট কোর্সে ভর্তি বেড়েছে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। কলেজের প্রধান নির্বাহী স্টিফেন ডেভিস মনে করেন, এআইয়ের অগ্রগতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয়সংকুল ডিগ্রির প্রতি তরুণদের অনাগ্রহ—এ দুটি কারণেই কারিগরি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
লন্ডনের ইউনাইটেড কলেজেস গ্রুপের অংশ সিডব্লিউসি মূলত একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
অন্যদিকে ট্রেডস ইউনিয়ন কংগ্রেসের (টিইউসি) আগস্টের এক জরিপে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের প্রতি দুজনের একজন এআইয়ের কারণে চাকরি হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। সবচেয়ে উদ্বিগ্ন ২৫–৩৫ বছর বয়সীরা।
লন্ডনের কিংস কলেজের প্রভাষক এবং এআই গবেষক বোক ক্লেইন টিসেলিংক বলেন, এখন তরুণদের মধ্যে অনেক উদ্বেগ রয়েছে যে তাদের চাকরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যাচ্ছে। কিংস কলেজ টিসেলিংকের গত অক্টোবরে এক গবেষণা প্রকাশ করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এআই-চালিত কর্মী ছাঁটাই জুনিয়র পদগুলোকে অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে তরুণদের ক্যারিয়ারের সিঁড়িতে পা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
শিক্ষার্থী ওয়ার্কশপে কাজ শিখছেন