সীমান্ত বাণিজ্যে নতুন আশা ‘প্রশস্ত’ বিলোনিয়া সড়ক
Published: 5th, July 2025 GMT
ফেনী জেলার ব্যস্ততম আঞ্চলিক মহাসড়ক ফেনী-বিলোনিয়া সড়ক। ফুলগাজীসহ আশপাশের উপজেলার মানুষদের বিলোনিয়া স্থলবন্দরে যাওয়া-আসার একমাত্র মাধ্যম হলো এ সড়ক। অবশেষে ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটি দুই লেনে উন্নীত হচ্ছে। এতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বাণিজ্য বাড়বে।
জানা গেছে, বর্তমানে সড়কটির প্রস্থ ৫ দশমিক ৫০ মিটার (১৮ ফুট)। উভয় পাশে ৪ দশমিক ৮০ মিটার করে বাড়ানো হচ্ছে। এতে মোট প্রস্থ হবে ১০ দশমিক ৩০ মিটার (প্রায় ৩৪ ফুট)। তিনটি লটে প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। এর মধ্যে দুটি লটের কাজ পেয়েছে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ও একটি পেয়েছে মাইশা কনস্ট্রাকশন প্রাইভেট লিমিটেড। তবে এখনও কাজ শুরু করেনি ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং।
কাজ চলছে, দুর্ভোগও বাড়ছে: ফেনী শহরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে কাজ শুরুর কথা থাকলেও শুরু হয়েছে ফুলগাজী বাজারের উত্তর প্রান্ত থেকে। ইতোমধ্যে মুন্সীরহাট থেকে আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজ পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন অংশে কাজ চলছে। ফুলগাজী বাজারের একটি অংশে রিজিড পেভমেন্ট সম্পন্ন হওয়ায় সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
তবে বিভিন্ন অংশে একসঙ্গে কাজ চলায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে। বৈদ্যুতিক পিলার ও গাছ অপসারণ না করেই সড়ক প্রশস্ত করা হচ্ছে। ফলে কাজের গতি ধীর হয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, সড়কটি দীর্ঘদিন ধরেই দুর্ঘটনাপ্রবণ। অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ, সংকীর্ণতা ও সংস্কারের অভাবে গত এক বছরে অন্তত ১৫ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত মে মাসে আনন্দপুরে, জুনে গাইনবাড়িতে এবং এপ্রিল মাসে ফুলগাজীর কলাবাগানে একজন নিহত হন। এসব দুর্ঘটনার পর সড়ক প্রশস্ত করার দাবি জোরালো হয়।
ভূমি অধিগ্রহণে অনিশ্চয়তা, ক্ষোভ: ফেনী-বিলোনিয়া সড়কের দুই পাশে রয়েছে কমপক্ষে ১০টি বাজার। রয়েছে অসংখ্য দোকান, ভবন, নাল জমি। কিন্তু এখনও ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়নি। মালিক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এখনও কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি। ফলে তারা কিছুটা চিন্তিত।
ফুলগাজী বাজারের আবদুল আজিজ, কাজী আরাফা মঞ্জিলের মালিক আব্দুল জলিল বলেন, ‘সড়ক বড় করা হলে আমার ভবনের সামনের পিলার ভাঙা লাগতে পারে, তথন তো আমার ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে।’ দোকান মালিক কাজী মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার দোকানের অর্ধেকই চলে যাবে। আমি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো।’ ফুলগাজী বাজারের ব্যবসায়ী মিলন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমার ছয়তলা ভবনের বড় অংশ ভেঙে পড়তে পারে। কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখনও কোনো নোটিশ পাইনি।’ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে জায়গা ছেড়ে স্থাপনা তৈরি করেননি কেন? এই প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তারা চুপ ছিলেন।
আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম কলেজের প্রভাষক জহিরুল ইসলাম রাজু বলেন, ‘সড়ক প্রশস্ত হচ্ছে, আমাদের
দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হতে চলেছে। তবে প্রতিবছর ফুলগাজী বাজার অংশ বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। তাই পুরো বাজারে রিজিড পেভমেন্ট (কনক্রিট ঢালাই) করলে বন্যার পানি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন।’
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : ফেনী সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সুনীতি চাকমা বলেন, ‘ফেনী-বিলোনিয়া সড়ক স্ট্যান্ডার্ড টু লেনে উন্নীত হচ্ছে। এটি সময়সাপেক্ষ কাজ। ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। প্রায় ১০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ বরাদ্দ রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।
বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।
সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।
কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।
একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।
শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।
মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক