‘আশর’ সংখ্যাবাচক আরবি শব্দ। শব্দটির অর্থ দশ। দশে মিলে আমরা যে আসর বসাই; আড্ডা, মজলিশ, সভা বা বৈঠক যা-ই বলি না কেন, এই আসরের উৎপত্তি ওই আশর থেকে। আসর বা আড্ডা জমাতে গুনে গুনে দশজনই প্রয়োজন তেমন কোনো কথা নেই। আড্ডায় পঁচকথা হবে, সেই ‘পাঁচকথা’ও যে পাঁচটি মাত্র কথা নয়- এ অনেকটা তেমন ব্যাপারই বটে!
তবে হ্যাঁ, আসর জমাতে একজনকে চাই-ই-চাই, যার মুখ নিঃসৃত বাণী কথাপুষ্প হয়ে ঝরবে। সুভাষ্য-সুবাসে শ্রোতা মুগ্ধ হবেন, হুল্লোড় তুলে সহাস্যে বিষম খাবেন, বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলবেন- ‘ও তাই!’
সেই একজনের কথায় কথা বাড়বে, কথার খৈ ফুটবে, চিড়ে ভিজবে, এমনকি পাহাড়ও টলে উঠতে পারে! আড্ডায় ওসব হরদম চলে। নইলে জমবে কেন? আষাঢ়ে গল্পই-বা টিকে থাকবে কী প্রকারে? আর কেনই-বা দশের ভিড়ে একজনের কাঁধেই ‘চাপাবাজ’ শব্দটি চেপে বসবে?
মানছি, শব্দটি মান্যতা খুইয়েছে; মান্যবরের সঙ্গী নয়, কিন্তু তার দায় যতটা না চাপার, তারচেয়ে ঢের বেশি চাপিয়ে দেওয়ার। কথায় হেরে যাওয়ার পাত্র তিনি কদাপি নন। ফলে বাচিকশিল্পী হিসেবে তারও স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার আছে। কৃতী সেও কম নয়। যেমন ধরুন: ‘চাটু’ শব্দের মূল অর্থ চিত্তভেদকারী প্রিয়বাক্য। চাটু থেকেই চাপা। চাপাশক্তি বাহুশক্তির চেয়ে কম কিসে?
মহাকবি কালিদাস স্বয়ং এর দারস্থ হয়েছেন। ‘ঋতুসংহার কাব্যে’ প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে পরস্পর চাটু প্রয়োগের বর্ণনা আছে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, মিথ্যা প্রিয়বাক্য না বললে প্রেমে রোমাঞ্চ ঠিক জমে না। এর দরকার আছে।
আমিও তাই বলি- অবশ্যই দরকার আছে। শুধু আমি কেন, ঢের বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞজন যুগে যুগে এ কথা কবুল করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাই যদি বলি- তাঁর মজলিশি গল্পের যাদুতে কে না মজেছে! গল্প, আড্ডায় তাঁর জুরি মেলা ভার। তাঁকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিচারণ এ কথার সাক্ষ্য দেয়। পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায় ‘শরৎ-পূজা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি (শরৎচন্দ্র) কেবল গল্প লিখতেন না, গল্প করবার অনন্য সাধারণ ক্ষমতাও তাঁর ছিল। সভায় তাঁকে মানাত না, কিন্তু গল্পের বৈঠকে তিনি ছিলেন যাদুকর গল্পী।’
‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ কেমন গল্পী ছিলেন একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। শরৎচন্দ্র তখন গ্রামে থাকেন। একদিন বিকালে শুনলেন, পাড়ার একজনের ঘরে বিরাট এক গোখরা বাসা বেঁধেছে। কিছুতেই বের হচ্ছে না। অথচ ওই একটাই তাদের শোবার ঘর। সন্ধ্যা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। যা করার দিনের আলোতেই করতে হবে।
সব শুনে শরৎচন্দ্র বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন। সবাইকে সাহস দিয়ে দু’চারজনকে নিয়ে সাবধানে সেই ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই দেখেন সাপটি কড়িকাঠের ফাঁকে আশ্রয় নিয়েছে। ইয়া লম্বা সাপ! মানুষের শব্দ পেয়ে ফোঁস্ ফোঁস্ করছে।
সাপটি এঁকেবেঁকে দেয়ালের ফাটলে গিয়ে ঢুকলো। অনেক খোঁচাখুঁচি করেও ফাটলের ভেতর থেকে সাপটি বের করা গেল না। তখন বাধ্য হয়ে শরৎচন্দ্র সেই ফাটলে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দিলেন ঘোড়া টিপে।
দুড়ুম করে শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে তাজা রক্ত ফাটলের মুখ দিয়ে গাড়িয়ে পড়তে লাগল।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী?’
শরৎচন্দ্র এ গল্প অনেক জায়গায় রসিয়ে রসিয়ে করেছেন। বিস্ফারিত নেত্রে শ্রোতা এই গল্প শুনেছেন। শরৎচন্দ্রের সাহসিকতায় তাঁদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কিন্তু ঘটনার সত্যমিথ্যা নিয়ে কারো মনে কখনও সন্দেহ জাগেনি। কিন্তু একদিন; হ্যাঁ ওই রকমই এক আড্ডায় গল্পটি শুনে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের খটকা লাগল। শরৎচন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন, ‘গল্পটা সত্যি তো?’
শরৎচন্দ্র মুচকি হেসে বললেন, ‘স্থান ও সময় বিশেষে এমন মিথ্যে বলায় পাপ নেই।’ কবুল করে তিনি আরো বললেন, ‘গল্পটা একেবারে মিথ্যে নয়; সাপটা সত্যি, মেরে ফেলাটাও সত্যি। তবে বন্দুক আর গোখরা এ দুটো মিথ্যে।’
‘তাহলে সাপটা কী ছিল?’
‘‘ও মস্ত বড়ো একটা ‘ঢ্যামনা’ সাপ।’’ শরৎচন্দ্র তাচ্ছিলের সুরে বললেন।
অর্থাৎ এই গল্পে শরৎচন্দ্র যদি বন্দুক আর গোখরা টেনে না-আনতেন তাহলে গল্প আর গল্প হয়ে উঠত না। শ্রোতা হাই তুলতে তুলতে হাঁ করা মুখের সামনে বারকয়েক চুটকি বাজিয়ে নিজেই উঠে চলে যেতেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের আসরে যে গিয়ে একবার বসেছে, তাঁরই শেকড় গজিয়েছে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘মানুষ সময়ের চাকর হয়ে যাক এ আমি কখনো চাইতে পারি না।’ অর্থাৎ তাঁর মজলিশে ঘড়ির কাঁটা পর্যন্ত থেমে যেত!
একবার ঢাকা এসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উঠেছেন প্রিয় বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ঢাকায় বিস্তর শুভাকাক্সক্ষী। সবার বাড়িতেই পায়ের ধুলো দিতে হচ্ছে। যেখানেই যাচ্ছেন তাঁকে ঘিরে মজলিশ জমে উঠছে। তুমুল আড্ডায় সময় পার। একদিন ড.
অবশেষে রাত এগারোটার দিকে অপূর্ব তাঁকে নিয়ে গেলেন। রাতের আহার শেষ করে রাত আড়াইটার দিকে শরৎচন্দ্র চারুচন্দ্রের বাড়ি ফিরলেন।
চারুচন্দ্র বন্ধুর অপেক্ষায় জেগে ছিলেন। শরতকে ফিরতে দেখে অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘শরৎ এবার সময় সম্বন্ধে তোমার একটু খেয়াল রাখা উচিত।’
শরৎচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘মানুষ সময়ের চাকর হয়ে যাক এ আমি কখনও চাইতে পারি না। তাছাড়া তুমি তো দাসত্ব ঘৃণা করো, তবুও আমায় বলছো যে ঘড়ির চাকর হয়ে থাকি!’
শরৎচন্দ্র সাহিত্য সাধনায় সিদ্ধপুরুষ। সিদ্ধিপ্রিয় ছিলেন বলেও বিস্তর বদনাম শুনেছি। ভবঘুরে কৈশর, তারুণ্যে প্রেমে ব্যর্থতা, যৌবনে স্থিতু হওয়ার আশায় দেশত্যাগ, লেখার রসদ সংগ্রহে পতিতালয়ে যাতায়াত, বিয়ে নিয়ে ধোঁয়াশা- সব মিলিয়ে ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ। এমন জীবনে গল্পের সংকট থাকার কথাই নয়। তারপরও আসর জমাতে শরৎচন্দ্রকে চাটুর আশ্রয় নিতে হয়েছে বৈকি। এ জন্য তিনি নির্দোষ মিথ্যা, এমনকি অন্যকে খেপিয়ে তুলতেও দ্বিধা করতেন না।
সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শরৎচন্দ্রের একটা অভ্যাস ছিল মানুষকে খ্যাপানো। এ সময় তিনি ভারি হাল্কামি করতেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমি সময়ে সময়ে দারুণ তর্ক করতাম, কিন্তু তিনি শুধু হাসতেন।’
একদিন রসচক্রের বৈঠকে শরৎচন্দ্র গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তোমরা শুনেছ বোধহয়, আজকাল রমানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও গুরুদেবের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ।’
‘কেন? কেন?’ সবার কৌতূহল উপচে পড়ল।
‘জানো না?’
‘কই এমন কিছু তো শুনিনি!’
শরৎচন্দ্র এবার গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘‘রমানন্দ ইউরোপ গিয়েছিলেন আর দাড়ির জন্য লোকে তাঁকেই রবীন্দ্রনাথ ভেবে ভুল করেছিল। এ কথা জানার পর গুরুদেব রমানন্দকে বলেছেন, দাড়ি কামিয়ে ফেলতে। কিন্তু এতো যত্ন করে বড়ো করা দাড়ি, কেউ পরের কথায় কামিয়ে ফেরতে পারে?
তখন কবিগুরু নতুন একটি প্রস্তাব দেন, রমানন্দ তাহলে যেন দাড়িতে মেহেদী লাগিয়ে নেন। এ কথা শুনে রমানন্দ ভয়ংকর রেগে গেছেন। বলেছেন, ‘আমি কি মুসলমান?’ এরপর থেকেই দুজনের কথাবার্তা বন্ধ।’’
বলা বাহুল্য এটিও শরৎচন্দ্রের মুখে মুখে বানিয়ে বলা গল্প। এবং আসর জমাতেই তাঁর এই প্রয়াস। কিন্তু আসরে বসে এমন গল্প শরৎচন্দ্র খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতেন। যারা শরৎচন্দ্রকে জানতেন তারা হয়তো মুখ টিপে হাসতেন। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা বিস্ময়ে হতবাক হতেন! দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি- শরৎচন্দ্র সেই বিস্মিত চেহারা উপভোগ করছেন।
এখানে পাঠকের মনে পড়বে শরৎচন্দ্রের জন্মের ৭২ বছর পর জন্ম নেওয়া আরেক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে। তিনিও শরৎচন্দ্রের মতোই অভাবনীয় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনিও ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। গল্পের মায়াজাদুতে মুহূর্তেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। সাহিত্য কিংবা আড্ডায় তাঁর কৌতুকবোধ ছিল তীব্র। ফলে তিনি যখন কৌতুক করে কিছু বলতেন তখন শ্রোতার পক্ষে হাস্যসম্বরণ কঠিন হতো। বিস্ময়কর হলো, সেই হাস্যরসে ভাঁড়ামোর বিন্দুমাত্র ছাপ খুঁজে পাওয়া যেত না! বরং অসামান্য পরিমিতিবোধের কারণে হাস্যরসেও লুকিয়ে থাকত গভীর এক অনুভূতির স্পর্শ।
হুমায়ূন আহমেদের জাদুকরী গল্পকথনে মুগ্ধ হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার লিখলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলো রেকর্ড করে রাখা উচিত।’
সম্ভবত সেই লেখা পড়ে এক প্রকাশক হুমায়ূন আহমেদের কথা রেকর্ড করে রাখার উদ্যোগ নেন। একদিন ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা জমে উঠেছে। এমন সময় হুমায়ূন আহমেদ লক্ষ করলেন তাঁর বাম পাশে কালো ছোট্ট একটা বস্তু। সেখান থেকে জোনাকী পোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রকাশকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এটা কী?’
‘স্যার, ভয়েস রেকর্ডার।’
‘ভয়েস রেকর্ডার কেন?’
‘এখন থেকে এই আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।’
এটুকু শুনেই হুমায়ূন আহমেদ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাতদিন আড্ডায় আসবে না।’
আরেক দিনের ঘটনা বলি। সেদিন ‘দখিন হাওয়া’য় যথারীতি বৃদ্ধ বোকা সংঘের তুমুল আড্ডা জমে উঠেছে। এই আড্ডায় সাধারণত সাহিত্য নিয়ে কঠিন কোনো আলোচনা হতো না। বিদেশি কোনো সাহিত্যিক এলে অবশ্য ভিন্ন কথা। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় এরা আড্ডায় ‘অতিথি পাখি’।
একদিন আড্ডায় এক অতিথি পাখি উপস্থিত। ভদ্রলোক রাশিয়া থেকে এসেছেন। কাজ করেন বাংলাদেশের রাশিয়ান দূতাবাসে। তিনি এসেছেন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে। শুনে হুমায়ূন আহমেদ কিছুটা বিরক্ত হলেন। তারপর আড্ডায় উপস্থিত অন্যান্য বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, ‘মহাযন্ত্রণায় পড়লাম। এই রাশিয়াভসকির সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কী ঘটরঘটর করব?’
ভদ্রলোক কিন্তু এ কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। উল্টো হাসিমুখে পরিষ্কার এবং শুদ্ধ বাংলায় বললেন, ‘আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভালোমতো অধ্যয়ন করেছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে বাংলা সাহিত্য নিয়ে ঘটরঘটর করতে পারেন।’
শরৎচন্দ্রের যেমন ‘রসচক্র’, হুমায়ূনের ‘ওল্ড ফুলস ক্লাব’। দু’জায়গাতেই দু’জন মধ্যমণি। মান্য এই, বিধিদত্ত প্রতিভা আর সাধনায় এই এলেম মেলে। বিধাতা সবাইকে তা দেন না। ক্ষিতিমোহন সেন যে কোনো ছোটো ঘটনা অতি সুন্দর রূপ দিয়ে এমনভাবে বলতেন শুনে অবাক হতে হতো। গল্পবলিয়ে হিসেবে এমনই ছিল তাঁর নামডাক। অথচ তাঁর লেখায় সেই রসের কোনো আভাসই পাবেন না। উল্টোদিকে রাজশেখর বসুকে তামাম সাহিত্যজগত সরসলেখক হিসেবে মান্য করেন। অথচ বৈঠক-মজলিশে তিনি ছিলেন রাশভারী প্রকৃতির।
প্রকৃতির এ এক বিচিত্র খেয়াল! রাজশেখর বসুকে কেউ রম্যলেখক বা হাসির গল্পের লেখক বললে উষ্মা প্রকাশ করতেন। এ নিয়ে তাঁর আপত্তি ছিল। একবার এক ভক্ত তাঁকে বললেন, ‘আপনার মতো রসসাহিত্যিক এই বাংলায় এখন আর ক’জন আছে বলুন?’এ কথা শুনে রাজশেখর বসু ওরফে ‘গড্ডলিকা’খ্যাত পরশুরাম জবাব দিয়েছিলেন, ‘রসসাহিত্যিক আবার কী? আমি কি হাঁড়িতে ফুটিয়ে রস তৈরি করি?’
কোনো রসই নিরস বা সরস নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তা স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনায় নিবেদন করা হয়।
নমস্য সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছেই ফিরে যাচ্ছি। তাঁর থেকে ধার করে বলছি, কথাসাহিত্যিক অবধূত গল্প বলার সময় অভিনয় করে দেখাতেন। আমরা যেমন শিশুদের খাইয়ে দেওয়ার সময় নিজেই হাঁ করে বলি, ‘নে এবার হাঁ কর দেখি।’ তো অবধূতের গল্পের সঙ্গে অভিনয়ের এমনতর এলেমের কথা লোকে জানত। এ কাজে তিনি ছিলেন ‘পয়লা নম্বরী ওস্তাদ’। ফলে অনেকেই তাঁর সঙ্গে গল্প করতে আসতেন।
একদিন প্রচন্ড গরম পড়েছে। অবধূত ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ঘণ্টাতিনেক চেষ্টার পর সবেমাত্র তন্দ্রামত এসেছেন, এমন সময় সজোরে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। দরজা খুলতেই দেখলেন দুয়ারে অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। বাইরে তখন কড়া রোদ, রাস্তার ধুলা জড়িয়ে চেহারা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বলল, ‘আজ্ঞে, আদালতে শুনতে পেলুম, আমাদের মোকদ্দমা উঠতে এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি, তাই আপনার সঙ্গে দু’দন্ড রসালাপ করতে এলুম।’
এরপর আলী লিখেছেন, ‘‘আমি শুধোলুম ‘আপনি কী করলেন?’ অবধূত উদাস নয়নে ধানক্ষেতের দিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললে। আমি বেশি ঘ্যাঁটালুম না। কারণ মনে পড়ে গেল, মোটামুট ওই সময়ে চুঁচড়োর জোড়াঘাটের কাছে, সদর রাস্তার উপর দুটো লাশ পাওয়া যায়। খুনী ফেরার। এখনো ব্যাপারটার হিল্যে হয়নি।’’
এরপরই আলী যে বাক্যটি লিখেছেন তার সত্যাসত্যের ভার বিজ্ঞ পাঠক করবেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভালো করে গল্প বলতে হলে আরো মেলা জিনিস শিখতে হয় এবং সেগুলো শেখানো যায় না। আমি স্বয়ং তো আদৌ কোনো প্রকারের গল্প বলতে পারি নে।... তদুপরি আমার জিভে ক্রনিক বাত, আমি তোৎলা এবং সামনের দুপাটিতে আটটি দাঁত নেই।’
এ বিনয়বচন। বড়ো মানুষের মহত্ব। কিন্তু এ যে কত বড়ো মিথ্যা, সে কথার সাক্ষ্য দিয়েছেন ‘শনিবারের চিঠি’র তৃতীয় সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। সজনীকান্তের হুল সে কালে অনেককেই সহ্য করতে হয়েছে। যে কারণে কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত তাঁর নাম দিয়েছেন ‘সজনে ঘন্ট খাস’। খাসা প্যারোডি!
সেই সজনীবাবু সৈয়দ মুজতবা আলীকে কোনো এক অজানা কারণে পছন্দ করতেন না। কড়া সমালোচনাও করেছেন। তো সজনীকান্তের সঙ্গে একবার মুজতবা আলীর দেখা হয়ে গেল এ কালের মুম্বাই শহরে। সৌজন্যবশত কেউ কাউকে এড়িয়ে গেলেন না। ভাগ্যিস সে কালে এই বোধ বেঁচে ছিল! এরপর টুকটাক করে আলাপের এক পর্যায়ে দেখা গেল, মুজতবা আলী কথা বলেই যাচ্ছেন, সজনীকান্ত এবং তাঁর সঙ্গে যে আরো দুজন ছিলেন, তাঁরা নীরব মুগ্ধ শ্রোতা। কখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে কেউ বুঝতে পারেননি। এ দিকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরার উপক্রম। তখন সবাই গিয়ে বসলেন এক কফির দোকানে। সেখানে পুনরায় গল্প শুরু হলো। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। দুপুরের খাওয়া পর্যন্ত হয়নি। হবে কি করে, মুজতবা আলীর কথার জাদুতে কারো খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি!
পরে সজনীকান্ত সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে লিখেছেন ‘আগে মুজতবা আলীর কথাবার্তা শুনে মনে করতাম যে, তাঁর মধ্যে গভীরতা নেই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তিনটি প্রাণীকে প্রায় ঘণ্টাদশেক যাবৎ যিনি তন্ময় করে রাখতে পারেন তাঁর মধ্যে গভীরতা নেই তা কী করে আর বলি!’
মুজতবা আলীর কথার এমনই জাদু। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারতেন। সেই আড্ডায় সুগভীর হাস্যরসের ছোঁয়া পাওয়া যেত।
এই আড্ডা, আসর ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে আছে বিভিন্ন নামে। ‘রসচক্র’ ‘ওল্ড ফুলস ক্লাবে’র নাম আগেই বলেছি। রাজশেখর বসুর পৈতৃক বাড়িতে বসত ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’র আড্ডা। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর নিজস্ব আড্ডার নাম ছিল ‘খিস্তিঋদ্ধ’। সুকুমার রায়ের ছিল ‘মান্ডে ক্লাব’। জোড়াসাঁকোয় ‘বিচিত্রা’র আসরও এককালে খুব জমত। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ তো বটেই আরো অনেক প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক এ আসরে যোগ দিতেন। একবার এই আসরে গিয়ে শরৎচন্দ্র নতুন জুতা হারানোর ভয়ে কাগজে মুড়িয়ে জুতা হাতে নিয়ে বসেছিলেন। এরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৌতূহলে শরৎচন্দ্রের কাছে জানতে চান এবং ‘পাদুকা পুরাণে’র গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ভারতী’র আড্ডাও বিশেষভাবে স্মর্তব্য। এই আড্ডার নিয়মিতদের একজন আবদুশ শাকুরের ভাষ্য অনুযায়ী ‘সেকালের চাড্ডাবাজির জীবন্ত কিংবদন্তি কাজী নজরুল ইসলাম।’
গোস্তাকি মাফ কিজিয়ে, সাহিত্যিককৌতুকীতে কাজী নজরুল ইসলামকে উহ্য রাখা অন্যায় এবং অসম্পূর্ণ। এই লেখার পূর্ণতাপ্রয়াসে তাই কবির শরণ নিচ্ছি। নজরুল বরাবরই প্রাণচঞ্চল, আনন্দ-উল্লাসে মাতিয়ে রাখা সৃষ্টিমুখর এক চরিত্র। তখন তিনি সৈনিক জীবন শেষ করে সদ্য কলকাতা ফিরেছেন। অচেনা শহরে মাথা গোজার ঠাঁই হলো বটে কিন্তু সহসা উপার্জনের উপায় মিলল না। সে অবস্থায়ও কবি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস উদ্দাম হাসি, রাতদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান-বাজনায় মাতিয়ে রাখতেন। হাসি-গানে, ঠাট্টায় আড্ডা মাতিয়ে দিতে নজরুল ছিলেন একাই একশ। কাজী নজরুল ইসলাম যে-ঘরে ঢুকতেন সে-ঘরে কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতেন না। উৎসাহের উচ্ছ্বলতায় উদ্দাম প্রাণশক্তিতে ভরপুর কবি কথা-হাসি-গানে, আড্ডায় আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিতেন। তখন গুরুত্বপূর্ণ কাজও ভেসে যেত।
একবার ঢাকার কয়েকজন খান বাহাদুর কবির সঙ্গে দেখা করার জন্য গঙ্গায় বজরায় অপেক্ষা করছিলেন। আগে থেকে কবির সঙ্গে সেরকমই কথা হয়েছিল। কিন্তু কবির দেখা নেই। অনেক খুঁজে কবিকে বন্ধুবেষ্টিত মজলিশে আবিষ্কার করা হলো। তারপর তাঁকে যখন জানানো হলো সম্মানিত খান বাহাদুররা অনেকক্ষণ ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন কবি বললেন, ‘আমি দেশের কবি, খান বাহাদুররা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না তো কী করবেন? আমি রাজপথ দিয়ে চলব, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর রাস্তার দুই পাশ থেকে আমাকে কুর্ণিশ জানাবেন। আমি সেই কুর্ণিশ গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যাব। এই তো আমাদের মধ্যেকার সত্যিকার সম্পর্ক।’
ভাবা যায়! এই হলো নজরুল- অসংকোচ প্রকাশ, নিঃশঙ্ক চিত্ত। তিনি গানে, কবিতায়, আড্ডায়, বক্তৃতায় সমান পারদর্শী ছিলেন।
অন্যদিকে মজলিশি আড্ডায় মধ্যমণি হয়েও বক্তৃতায় একেবারেই আনাড়ি ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নিজেই একাধিক জায়গায় কবুল করেছেন এই বলে যে, ‘বক্তৃতা দিতে হবে মনে হলেই আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।’ তারপরও সভা-সমিতিতে তাঁকে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করতে হতো। খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে কথা! তিনি অধিকাংশ সময় বিরস কণ্ঠে এড়িয়ে যেতেন। এমনকি স্বীকার করেও অনেক সময় নানা বাহানায় অনুষ্ঠানে যেতেন না। নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতেন।
একদিন সাহিত্যিক মনোজ বসু, শরৎচন্দ্র এবং তুলসীদাস চট্টোপাধ্যায় সামতাবেড় থেকে কলকাতা আসছেন। সেখানে এক সভায় শরৎচন্দ্রকে সভাপতিত্ব করতে হবে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু দূর এসেছেন এমন সময় এক প্রতবেশী বললেন, ‘দাদাঠাকুর! এই না আপনার শরীর খারাপ, আবার আজ কলকাতা যাচ্ছেন?’
পেছন থেকে ডাক শুনে তুলসীদাস সভয়ে বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ! বেরোতে না বেরোতেই পেছনে ডাক! পথে কোনো বিপদ-আপদ না ঘটলেই বাঁচি।’
শরৎচন্দ্র বললেন, ‘বিপদ আর ঘটবে কী? ঘটেই তো গেছে। আজকের সভায় সভাপতি যখন করেছে তখন কিছু বক্তৃতা না করিয়ে কি ছাড়বে?’
আরেকবার বিহার শরীফে গিয়ে মঞ্চে উঠে ‘হামারা গর্দান বইঠে গিয়া’ বলে নিজেই হাসির পাত্র হয়েছেন। সে এক কান্ড বটে!
এমন শত কান্ড ঘটে বলেই আড্ডা বহমান স্রোতধারার মতো সজীব। আড্ডাপ্রিয় বাঙালির সৃজনফোয়ারা ওই আড্ডাতেই উর্ধ্বমুখি ধায়। আড্ডা নেই তো জীবনের রং-রূপ-রস নেই। মানুষের সমস্ত গুণপনা ওই আড্ডাতেই প্রকাশ পায়; প্রশ্রয় পেয়ে বিকশিত হয়। দন্ত বিকশিত হাসির অন্ত মেলে না। মুখচোরারও তখন বোল ফোটে, অকালকুষ্মান্ড ডানা মেলতে চায়, অলস আড়মোড় ভাঙে, কলুর বলদ হাফ ছেড়ে বাঁচে, মগজের ঘাঁইয়ে তৈরি হয় নতুন নতুন দর্শন।
সাধারণের যদি এই হয়, তবে শিল্পী-সাহিত্যিকের কথা বলা বাহুল্য। এ কারণেই তাঁদের ঘটা করে আড্ডার সহস্র আয়োজন। তাতে তাঁরা কসুর করেননি কোনো কালেই। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু আড্ডার আকর্ষণে মাইলের পর মাইল হেঁটে কলকাতার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যেতেন। চাইলে এমন উদাহরণ আরো পেশ করা যাবে। সেই আড্ডায় জলযোগের ব্যবস্থা থাকলে কৌতুকী ফুরাবে না। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে এই আড্ডাবাজির ইতি টানতে হবে। কাজ পড়ে আছে।
‘কাজ! আড্ডা কি কাজ নয়?’
‘ওই তো আড্ডার দুঃখ। স্বীকৃতি জুটলো না! থাক্ কথায় কথা বাড়বে।’
কথার পিঠে উঠে আসা কথাই আড্ডার প্রাণ। অনেকটা সোয়েটারের ছিঁড়ে যাওয়া উলের মতো। এক কোণা ধরে শুধু টান দিতে হবে- ব্যস্। বয়স্কদের কাছে এ হলো দুষ্টুমি। সুতরাং থাকুক। অন্য একদিন এগেইন ফের পুনরায় আবার জমিয়ে আড্ডা হবে। ভয় নেই- আড্ডা ভাঙে কিন্তু মরে না।
তারা//
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর হ ম য় ন আহম দ নজর ল ইসল ম সজন ক ন ত ন দ রন থ র জন য এস ছ ন র কর ড আল র ক কর ছ ন বন দ ক বক ত ত করত ন একদ ন কলক ত বলল ন অবধ ত মজল শ একব র তখন ক ত রপর
এছাড়াও পড়ুন:
সাহিত্যিক আড্ডার কৌতুকী
‘আশর’ সংখ্যাবাচক আরবি শব্দ। শব্দটির অর্থ দশ। দশে মিলে আমরা যে আসর বসাই; আড্ডা, মজলিশ, সভা বা বৈঠক যা-ই বলি না কেন, এই আসরের উৎপত্তি ওই আশর থেকে। আসর বা আড্ডা জমাতে গুনে গুনে দশজনই প্রয়োজন তেমন কোনো কথা নেই। আড্ডায় পঁচকথা হবে, সেই ‘পাঁচকথা’ও যে পাঁচটি মাত্র কথা নয়- এ অনেকটা তেমন ব্যাপারই বটে!
তবে হ্যাঁ, আসর জমাতে একজনকে চাই-ই-চাই, যার মুখ নিঃসৃত বাণী কথাপুষ্প হয়ে ঝরবে। সুভাষ্য-সুবাসে শ্রোতা মুগ্ধ হবেন, হুল্লোড় তুলে সহাস্যে বিষম খাবেন, বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বলবেন- ‘ও তাই!’
সেই একজনের কথায় কথা বাড়বে, কথার খৈ ফুটবে, চিড়ে ভিজবে, এমনকি পাহাড়ও টলে উঠতে পারে! আড্ডায় ওসব হরদম চলে। নইলে জমবে কেন? আষাঢ়ে গল্পই-বা টিকে থাকবে কী প্রকারে? আর কেনই-বা দশের ভিড়ে একজনের কাঁধেই ‘চাপাবাজ’ শব্দটি চেপে বসবে?
মানছি, শব্দটি মান্যতা খুইয়েছে; মান্যবরের সঙ্গী নয়, কিন্তু তার দায় যতটা না চাপার, তারচেয়ে ঢের বেশি চাপিয়ে দেওয়ার। কথায় হেরে যাওয়ার পাত্র তিনি কদাপি নন। ফলে বাচিকশিল্পী হিসেবে তারও স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার আছে। কৃতী সেও কম নয়। যেমন ধরুন: ‘চাটু’ শব্দের মূল অর্থ চিত্তভেদকারী প্রিয়বাক্য। চাটু থেকেই চাপা। চাপাশক্তি বাহুশক্তির চেয়ে কম কিসে?
মহাকবি কালিদাস স্বয়ং এর দারস্থ হয়েছেন। ‘ঋতুসংহার কাব্যে’ প্রেমিক প্রেমিকার মধ্যে পরস্পর চাটু প্রয়োগের বর্ণনা আছে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন, মিথ্যা প্রিয়বাক্য না বললে প্রেমে রোমাঞ্চ ঠিক জমে না। এর দরকার আছে।
আমিও তাই বলি- অবশ্যই দরকার আছে। শুধু আমি কেন, ঢের বিজ্ঞ, প্রাজ্ঞজন যুগে যুগে এ কথা কবুল করেছেন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কথাই যদি বলি- তাঁর মজলিশি গল্পের যাদুতে কে না মজেছে! গল্প, আড্ডায় তাঁর জুরি মেলা ভার। তাঁকে নিয়ে অনেকের স্মৃতিচারণ এ কথার সাক্ষ্য দেয়। পাঁচুগোপাল মুখোপাধ্যায় ‘শরৎ-পূজা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তিনি (শরৎচন্দ্র) কেবল গল্প লিখতেন না, গল্প করবার অনন্য সাধারণ ক্ষমতাও তাঁর ছিল। সভায় তাঁকে মানাত না, কিন্তু গল্পের বৈঠকে তিনি ছিলেন যাদুকর গল্পী।’
‘অপরাজেয় কথাশিল্পী’ কেমন গল্পী ছিলেন একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। শরৎচন্দ্র তখন গ্রামে থাকেন। একদিন বিকালে শুনলেন, পাড়ার একজনের ঘরে বিরাট এক গোখরা বাসা বেঁধেছে। কিছুতেই বের হচ্ছে না। অথচ ওই একটাই তাদের শোবার ঘর। সন্ধ্যা ক্রমেই ঘনিয়ে আসছে। যা করার দিনের আলোতেই করতে হবে।
সব শুনে শরৎচন্দ্র বন্দুক নিয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে গেলেন। সবাইকে সাহস দিয়ে দু’চারজনকে নিয়ে সাবধানে সেই ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই দেখেন সাপটি কড়িকাঠের ফাঁকে আশ্রয় নিয়েছে। ইয়া লম্বা সাপ! মানুষের শব্দ পেয়ে ফোঁস্ ফোঁস্ করছে।
সাপটি এঁকেবেঁকে দেয়ালের ফাটলে গিয়ে ঢুকলো। অনেক খোঁচাখুঁচি করেও ফাটলের ভেতর থেকে সাপটি বের করা গেল না। তখন বাধ্য হয়ে শরৎচন্দ্র সেই ফাটলে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে দিলেন ঘোড়া টিপে।
দুড়ুম করে শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে তাজা রক্ত ফাটলের মুখ দিয়ে গাড়িয়ে পড়তে লাগল।
‘তারপর?’
‘তারপর আর কী?’
শরৎচন্দ্র এ গল্প অনেক জায়গায় রসিয়ে রসিয়ে করেছেন। বিস্ফারিত নেত্রে শ্রোতা এই গল্প শুনেছেন। শরৎচন্দ্রের সাহসিকতায় তাঁদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। কিন্তু ঘটনার সত্যমিথ্যা নিয়ে কারো মনে কখনও সন্দেহ জাগেনি। কিন্তু একদিন; হ্যাঁ ওই রকমই এক আড্ডায় গল্পটি শুনে অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়ের খটকা লাগল। শরৎচন্দ্রের কাছে জানতে চাইলেন, ‘গল্পটা সত্যি তো?’
শরৎচন্দ্র মুচকি হেসে বললেন, ‘স্থান ও সময় বিশেষে এমন মিথ্যে বলায় পাপ নেই।’ কবুল করে তিনি আরো বললেন, ‘গল্পটা একেবারে মিথ্যে নয়; সাপটা সত্যি, মেরে ফেলাটাও সত্যি। তবে বন্দুক আর গোখরা এ দুটো মিথ্যে।’
‘তাহলে সাপটা কী ছিল?’
‘‘ও মস্ত বড়ো একটা ‘ঢ্যামনা’ সাপ।’’ শরৎচন্দ্র তাচ্ছিলের সুরে বললেন।
অর্থাৎ এই গল্পে শরৎচন্দ্র যদি বন্দুক আর গোখরা টেনে না-আনতেন তাহলে গল্প আর গল্প হয়ে উঠত না। শ্রোতা হাই তুলতে তুলতে হাঁ করা মুখের সামনে বারকয়েক চুটকি বাজিয়ে নিজেই উঠে চলে যেতেন। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্পের আসরে যে গিয়ে একবার বসেছে, তাঁরই শেকড় গজিয়েছে। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘মানুষ সময়ের চাকর হয়ে যাক এ আমি কখনো চাইতে পারি না।’ অর্থাৎ তাঁর মজলিশে ঘড়ির কাঁটা পর্যন্ত থেমে যেত!
একবার ঢাকা এসে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উঠেছেন প্রিয় বন্ধু চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি। ঢাকায় বিস্তর শুভাকাক্সক্ষী। সবার বাড়িতেই পায়ের ধুলো দিতে হচ্ছে। যেখানেই যাচ্ছেন তাঁকে ঘিরে মজলিশ জমে উঠছে। তুমুল আড্ডায় সময় পার। একদিন ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বাড়িতে গিয়ে আড্ডায় মজে গেলেন। সেদিন সুরেশচন্দ্রের বাড়িতেও তাঁর নিমন্ত্রণ ছিল। ওদিকে অপূর্ব কুমার এসে বসে আছেন, তাঁকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবেন বলে।
অবশেষে রাত এগারোটার দিকে অপূর্ব তাঁকে নিয়ে গেলেন। রাতের আহার শেষ করে রাত আড়াইটার দিকে শরৎচন্দ্র চারুচন্দ্রের বাড়ি ফিরলেন।
চারুচন্দ্র বন্ধুর অপেক্ষায় জেগে ছিলেন। শরতকে ফিরতে দেখে অনুযোগের স্বরে বললেন, ‘শরৎ এবার সময় সম্বন্ধে তোমার একটু খেয়াল রাখা উচিত।’
শরৎচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘মানুষ সময়ের চাকর হয়ে যাক এ আমি কখনও চাইতে পারি না। তাছাড়া তুমি তো দাসত্ব ঘৃণা করো, তবুও আমায় বলছো যে ঘড়ির চাকর হয়ে থাকি!’
শরৎচন্দ্র সাহিত্য সাধনায় সিদ্ধপুরুষ। সিদ্ধিপ্রিয় ছিলেন বলেও বিস্তর বদনাম শুনেছি। ভবঘুরে কৈশর, তারুণ্যে প্রেমে ব্যর্থতা, যৌবনে স্থিতু হওয়ার আশায় দেশত্যাগ, লেখার রসদ সংগ্রহে পতিতালয়ে যাতায়াত, বিয়ে নিয়ে ধোঁয়াশা- সব মিলিয়ে ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ। এমন জীবনে গল্পের সংকট থাকার কথাই নয়। তারপরও আসর জমাতে শরৎচন্দ্রকে চাটুর আশ্রয় নিতে হয়েছে বৈকি। এ জন্য তিনি নির্দোষ মিথ্যা, এমনকি অন্যকে খেপিয়ে তুলতেও দ্বিধা করতেন না।
সংগীতজ্ঞ দিলীপকুমার রায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘শরৎচন্দ্রের একটা অভ্যাস ছিল মানুষকে খ্যাপানো। এ সময় তিনি ভারি হাল্কামি করতেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমি সময়ে সময়ে দারুণ তর্ক করতাম, কিন্তু তিনি শুধু হাসতেন।’
একদিন রসচক্রের বৈঠকে শরৎচন্দ্র গম্ভীরভাবে বললেন, ‘তোমরা শুনেছ বোধহয়, আজকাল রমানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও গুরুদেবের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ।’
‘কেন? কেন?’ সবার কৌতূহল উপচে পড়ল।
‘জানো না?’
‘কই এমন কিছু তো শুনিনি!’
শরৎচন্দ্র এবার গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘‘রমানন্দ ইউরোপ গিয়েছিলেন আর দাড়ির জন্য লোকে তাঁকেই রবীন্দ্রনাথ ভেবে ভুল করেছিল। এ কথা জানার পর গুরুদেব রমানন্দকে বলেছেন, দাড়ি কামিয়ে ফেলতে। কিন্তু এতো যত্ন করে বড়ো করা দাড়ি, কেউ পরের কথায় কামিয়ে ফেরতে পারে?
তখন কবিগুরু নতুন একটি প্রস্তাব দেন, রমানন্দ তাহলে যেন দাড়িতে মেহেদী লাগিয়ে নেন। এ কথা শুনে রমানন্দ ভয়ংকর রেগে গেছেন। বলেছেন, ‘আমি কি মুসলমান?’ এরপর থেকেই দুজনের কথাবার্তা বন্ধ।’’
বলা বাহুল্য এটিও শরৎচন্দ্রের মুখে মুখে বানিয়ে বলা গল্প। এবং আসর জমাতেই তাঁর এই প্রয়াস। কিন্তু আসরে বসে এমন গল্প শরৎচন্দ্র খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতেন। যারা শরৎচন্দ্রকে জানতেন তারা হয়তো মুখ টিপে হাসতেন। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা বিস্ময়ে হতবাক হতেন! দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছি- শরৎচন্দ্র সেই বিস্মিত চেহারা উপভোগ করছেন।
এখানে পাঠকের মনে পড়বে শরৎচন্দ্রের জন্মের ৭২ বছর পর জন্ম নেওয়া আরেক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে। তিনিও শরৎচন্দ্রের মতোই অভাবনীয় পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনিও ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। গল্পের মায়াজাদুতে মুহূর্তেই সবার দৃষ্টি কেড়ে নেয়ার অসম্ভব ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। সাহিত্য কিংবা আড্ডায় তাঁর কৌতুকবোধ ছিল তীব্র। ফলে তিনি যখন কৌতুক করে কিছু বলতেন তখন শ্রোতার পক্ষে হাস্যসম্বরণ কঠিন হতো। বিস্ময়কর হলো, সেই হাস্যরসে ভাঁড়ামোর বিন্দুমাত্র ছাপ খুঁজে পাওয়া যেত না! বরং অসামান্য পরিমিতিবোধের কারণে হাস্যরসেও লুকিয়ে থাকত গভীর এক অনুভূতির স্পর্শ।
হুমায়ূন আহমেদের জাদুকরী গল্পকথনে মুগ্ধ হয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার লিখলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলো রেকর্ড করে রাখা উচিত।’
সম্ভবত সেই লেখা পড়ে এক প্রকাশক হুমায়ূন আহমেদের কথা রেকর্ড করে রাখার উদ্যোগ নেন। একদিন ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা জমে উঠেছে। এমন সময় হুমায়ূন আহমেদ লক্ষ করলেন তাঁর বাম পাশে কালো ছোট্ট একটা বস্তু। সেখান থেকে জোনাকী পোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। হুমায়ূন আহমেদ সেই প্রকাশকের কাছে জানতে চাইলেন, ‘এটা কী?’
‘স্যার, ভয়েস রেকর্ডার।’
‘ভয়েস রেকর্ডার কেন?’
‘এখন থেকে এই আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।’
এটুকু শুনেই হুমায়ূন আহমেদ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাতদিন আড্ডায় আসবে না।’
আরেক দিনের ঘটনা বলি। সেদিন ‘দখিন হাওয়া’য় যথারীতি বৃদ্ধ বোকা সংঘের তুমুল আড্ডা জমে উঠেছে। এই আড্ডায় সাধারণত সাহিত্য নিয়ে কঠিন কোনো আলোচনা হতো না। বিদেশি কোনো সাহিত্যিক এলে অবশ্য ভিন্ন কথা। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায় এরা আড্ডায় ‘অতিথি পাখি’।
একদিন আড্ডায় এক অতিথি পাখি উপস্থিত। ভদ্রলোক রাশিয়া থেকে এসেছেন। কাজ করেন বাংলাদেশের রাশিয়ান দূতাবাসে। তিনি এসেছেন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে। শুনে হুমায়ূন আহমেদ কিছুটা বিরক্ত হলেন। তারপর আড্ডায় উপস্থিত অন্যান্য বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বললেন, ‘মহাযন্ত্রণায় পড়লাম। এই রাশিয়াভসকির সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কী ঘটরঘটর করব?’
ভদ্রলোক কিন্তু এ কথায় বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। উল্টো হাসিমুখে পরিষ্কার এবং শুদ্ধ বাংলায় বললেন, ‘আমি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ভালোমতো অধ্যয়ন করেছি। আপনি ইচ্ছা করলে আমার সঙ্গে বাংলা সাহিত্য নিয়ে ঘটরঘটর করতে পারেন।’
শরৎচন্দ্রের যেমন ‘রসচক্র’, হুমায়ূনের ‘ওল্ড ফুলস ক্লাব’। দু’জায়গাতেই দু’জন মধ্যমণি। মান্য এই, বিধিদত্ত প্রতিভা আর সাধনায় এই এলেম মেলে। বিধাতা সবাইকে তা দেন না। ক্ষিতিমোহন সেন যে কোনো ছোটো ঘটনা অতি সুন্দর রূপ দিয়ে এমনভাবে বলতেন শুনে অবাক হতে হতো। গল্পবলিয়ে হিসেবে এমনই ছিল তাঁর নামডাক। অথচ তাঁর লেখায় সেই রসের কোনো আভাসই পাবেন না। উল্টোদিকে রাজশেখর বসুকে তামাম সাহিত্যজগত সরসলেখক হিসেবে মান্য করেন। অথচ বৈঠক-মজলিশে তিনি ছিলেন রাশভারী প্রকৃতির।
প্রকৃতির এ এক বিচিত্র খেয়াল! রাজশেখর বসুকে কেউ রম্যলেখক বা হাসির গল্পের লেখক বললে উষ্মা প্রকাশ করতেন। এ নিয়ে তাঁর আপত্তি ছিল। একবার এক ভক্ত তাঁকে বললেন, ‘আপনার মতো রসসাহিত্যিক এই বাংলায় এখন আর ক’জন আছে বলুন?’এ কথা শুনে রাজশেখর বসু ওরফে ‘গড্ডলিকা’খ্যাত পরশুরাম জবাব দিয়েছিলেন, ‘রসসাহিত্যিক আবার কী? আমি কি হাঁড়িতে ফুটিয়ে রস তৈরি করি?’
কোনো রসই নিরস বা সরস নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তা স্থান, কাল, পাত্র বিবেচনায় নিবেদন করা হয়।
নমস্য সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছেই ফিরে যাচ্ছি। তাঁর থেকে ধার করে বলছি, কথাসাহিত্যিক অবধূত গল্প বলার সময় অভিনয় করে দেখাতেন। আমরা যেমন শিশুদের খাইয়ে দেওয়ার সময় নিজেই হাঁ করে বলি, ‘নে এবার হাঁ কর দেখি।’ তো অবধূতের গল্পের সঙ্গে অভিনয়ের এমনতর এলেমের কথা লোকে জানত। এ কাজে তিনি ছিলেন ‘পয়লা নম্বরী ওস্তাদ’। ফলে অনেকেই তাঁর সঙ্গে গল্প করতে আসতেন।
একদিন প্রচন্ড গরম পড়েছে। অবধূত ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে ঘণ্টাতিনেক চেষ্টার পর সবেমাত্র তন্দ্রামত এসেছেন, এমন সময় সজোরে কড়া নাড়ার শব্দ হলো। দরজা খুলতেই দেখলেন দুয়ারে অচেনা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। বাইরে তখন কড়া রোদ, রাস্তার ধুলা জড়িয়ে চেহারা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করতেই লোকটি বলল, ‘আজ্ঞে, আদালতে শুনতে পেলুম, আমাদের মোকদ্দমা উঠতে এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি, তাই আপনার সঙ্গে দু’দন্ড রসালাপ করতে এলুম।’
এরপর আলী লিখেছেন, ‘‘আমি শুধোলুম ‘আপনি কী করলেন?’ অবধূত উদাস নয়নে ধানক্ষেতের দিতে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললে। আমি বেশি ঘ্যাঁটালুম না। কারণ মনে পড়ে গেল, মোটামুট ওই সময়ে চুঁচড়োর জোড়াঘাটের কাছে, সদর রাস্তার উপর দুটো লাশ পাওয়া যায়। খুনী ফেরার। এখনো ব্যাপারটার হিল্যে হয়নি।’’
এরপরই আলী যে বাক্যটি লিখেছেন তার সত্যাসত্যের ভার বিজ্ঞ পাঠক করবেন। তিনি লিখেছেন, ‘ভালো করে গল্প বলতে হলে আরো মেলা জিনিস শিখতে হয় এবং সেগুলো শেখানো যায় না। আমি স্বয়ং তো আদৌ কোনো প্রকারের গল্প বলতে পারি নে।... তদুপরি আমার জিভে ক্রনিক বাত, আমি তোৎলা এবং সামনের দুপাটিতে আটটি দাঁত নেই।’
এ বিনয়বচন। বড়ো মানুষের মহত্ব। কিন্তু এ যে কত বড়ো মিথ্যা, সে কথার সাক্ষ্য দিয়েছেন ‘শনিবারের চিঠি’র তৃতীয় সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। সজনীকান্তের হুল সে কালে অনেককেই সহ্য করতে হয়েছে। যে কারণে কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত তাঁর নাম দিয়েছেন ‘সজনে ঘন্ট খাস’। খাসা প্যারোডি!
সেই সজনীবাবু সৈয়দ মুজতবা আলীকে কোনো এক অজানা কারণে পছন্দ করতেন না। কড়া সমালোচনাও করেছেন। তো সজনীকান্তের সঙ্গে একবার মুজতবা আলীর দেখা হয়ে গেল এ কালের মুম্বাই শহরে। সৌজন্যবশত কেউ কাউকে এড়িয়ে গেলেন না। ভাগ্যিস সে কালে এই বোধ বেঁচে ছিল! এরপর টুকটাক করে আলাপের এক পর্যায়ে দেখা গেল, মুজতবা আলী কথা বলেই যাচ্ছেন, সজনীকান্ত এবং তাঁর সঙ্গে যে আরো দুজন ছিলেন, তাঁরা নীরব মুগ্ধ শ্রোতা। কখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়েছে কেউ বুঝতে পারেননি। এ দিকে দাঁড়িয়ে কথা বলতে বলতে পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরার উপক্রম। তখন সবাই গিয়ে বসলেন এক কফির দোকানে। সেখানে পুনরায় গল্প শুরু হলো। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা। দুপুরের খাওয়া পর্যন্ত হয়নি। হবে কি করে, মুজতবা আলীর কথার জাদুতে কারো খাওয়ার কথা মনেই পড়েনি!
পরে সজনীকান্ত সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে লিখেছেন ‘আগে মুজতবা আলীর কথাবার্তা শুনে মনে করতাম যে, তাঁর মধ্যে গভীরতা নেই। কিন্তু সত্যি বলতে কী, তিনটি প্রাণীকে প্রায় ঘণ্টাদশেক যাবৎ যিনি তন্ময় করে রাখতে পারেন তাঁর মধ্যে গভীরতা নেই তা কী করে আর বলি!’
মুজতবা আলীর কথার এমনই জাদু। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে পারতেন। সেই আড্ডায় সুগভীর হাস্যরসের ছোঁয়া পাওয়া যেত।
এই আড্ডা, আসর ইতিহাসে স্থায়ী হয়ে আছে বিভিন্ন নামে। ‘রসচক্র’ ‘ওল্ড ফুলস ক্লাবে’র নাম আগেই বলেছি। রাজশেখর বসুর পৈতৃক বাড়িতে বসত ‘উৎকেন্দ্র সমিতি’র আড্ডা। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর নিজস্ব আড্ডার নাম ছিল ‘খিস্তিঋদ্ধ’। সুকুমার রায়ের ছিল ‘মান্ডে ক্লাব’। জোড়াসাঁকোয় ‘বিচিত্রা’র আসরও এককালে খুব জমত। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ তো বটেই আরো অনেক প্রখ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক এ আসরে যোগ দিতেন। একবার এই আসরে গিয়ে শরৎচন্দ্র নতুন জুতা হারানোর ভয়ে কাগজে মুড়িয়ে জুতা হাতে নিয়ে বসেছিলেন। এরপরই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৌতূহলে শরৎচন্দ্রের কাছে জানতে চান এবং ‘পাদুকা পুরাণে’র গল্প মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘ভারতী’র আড্ডাও বিশেষভাবে স্মর্তব্য। এই আড্ডার নিয়মিতদের একজন আবদুশ শাকুরের ভাষ্য অনুযায়ী ‘সেকালের চাড্ডাবাজির জীবন্ত কিংবদন্তি কাজী নজরুল ইসলাম।’
গোস্তাকি মাফ কিজিয়ে, সাহিত্যিককৌতুকীতে কাজী নজরুল ইসলামকে উহ্য রাখা অন্যায় এবং অসম্পূর্ণ। এই লেখার পূর্ণতাপ্রয়াসে তাই কবির শরণ নিচ্ছি। নজরুল বরাবরই প্রাণচঞ্চল, আনন্দ-উল্লাসে মাতিয়ে রাখা সৃষ্টিমুখর এক চরিত্র। তখন তিনি সৈনিক জীবন শেষ করে সদ্য কলকাতা ফিরেছেন। অচেনা শহরে মাথা গোজার ঠাঁই হলো বটে কিন্তু সহসা উপার্জনের উপায় মিলল না। সে অবস্থায়ও কবি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস উদ্দাম হাসি, রাতদিন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান-বাজনায় মাতিয়ে রাখতেন। হাসি-গানে, ঠাট্টায় আড্ডা মাতিয়ে দিতে নজরুল ছিলেন একাই একশ। কাজী নজরুল ইসলাম যে-ঘরে ঢুকতেন সে-ঘরে কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতেন না। উৎসাহের উচ্ছ্বলতায় উদ্দাম প্রাণশক্তিতে ভরপুর কবি কথা-হাসি-গানে, আড্ডায় আনন্দের হিল্লোল বইয়ে দিতেন। তখন গুরুত্বপূর্ণ কাজও ভেসে যেত।
একবার ঢাকার কয়েকজন খান বাহাদুর কবির সঙ্গে দেখা করার জন্য গঙ্গায় বজরায় অপেক্ষা করছিলেন। আগে থেকে কবির সঙ্গে সেরকমই কথা হয়েছিল। কিন্তু কবির দেখা নেই। অনেক খুঁজে কবিকে বন্ধুবেষ্টিত মজলিশে আবিষ্কার করা হলো। তারপর তাঁকে যখন জানানো হলো সম্মানিত খান বাহাদুররা অনেকক্ষণ ধরে তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন, তখন কবি বললেন, ‘আমি দেশের কবি, খান বাহাদুররা আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না তো কী করবেন? আমি রাজপথ দিয়ে চলব, খান বাহাদুর, রায় বাহাদুর রাস্তার দুই পাশ থেকে আমাকে কুর্ণিশ জানাবেন। আমি সেই কুর্ণিশ গ্রহণ করতে করতে এগিয়ে যাব। এই তো আমাদের মধ্যেকার সত্যিকার সম্পর্ক।’
ভাবা যায়! এই হলো নজরুল- অসংকোচ প্রকাশ, নিঃশঙ্ক চিত্ত। তিনি গানে, কবিতায়, আড্ডায়, বক্তৃতায় সমান পারদর্শী ছিলেন।
অন্যদিকে মজলিশি আড্ডায় মধ্যমণি হয়েও বক্তৃতায় একেবারেই আনাড়ি ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নিজেই একাধিক জায়গায় কবুল করেছেন এই বলে যে, ‘বক্তৃতা দিতে হবে মনে হলেই আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়।’ তারপরও সভা-সমিতিতে তাঁকে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করতে হতো। খ্যাতির বিড়ম্বনা বলে কথা! তিনি অধিকাংশ সময় বিরস কণ্ঠে এড়িয়ে যেতেন। এমনকি স্বীকার করেও অনেক সময় নানা বাহানায় অনুষ্ঠানে যেতেন না। নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতেন।
একদিন সাহিত্যিক মনোজ বসু, শরৎচন্দ্র এবং তুলসীদাস চট্টোপাধ্যায় সামতাবেড় থেকে কলকাতা আসছেন। সেখানে এক সভায় শরৎচন্দ্রকে সভাপতিত্ব করতে হবে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছু দূর এসেছেন এমন সময় এক প্রতবেশী বললেন, ‘দাদাঠাকুর! এই না আপনার শরীর খারাপ, আবার আজ কলকাতা যাচ্ছেন?’
পেছন থেকে ডাক শুনে তুলসীদাস সভয়ে বলে উঠলেন, ‘সর্বনাশ! বেরোতে না বেরোতেই পেছনে ডাক! পথে কোনো বিপদ-আপদ না ঘটলেই বাঁচি।’
শরৎচন্দ্র বললেন, ‘বিপদ আর ঘটবে কী? ঘটেই তো গেছে। আজকের সভায় সভাপতি যখন করেছে তখন কিছু বক্তৃতা না করিয়ে কি ছাড়বে?’
আরেকবার বিহার শরীফে গিয়ে মঞ্চে উঠে ‘হামারা গর্দান বইঠে গিয়া’ বলে নিজেই হাসির পাত্র হয়েছেন। সে এক কান্ড বটে!
এমন শত কান্ড ঘটে বলেই আড্ডা বহমান স্রোতধারার মতো সজীব। আড্ডাপ্রিয় বাঙালির সৃজনফোয়ারা ওই আড্ডাতেই উর্ধ্বমুখি ধায়। আড্ডা নেই তো জীবনের রং-রূপ-রস নেই। মানুষের সমস্ত গুণপনা ওই আড্ডাতেই প্রকাশ পায়; প্রশ্রয় পেয়ে বিকশিত হয়। দন্ত বিকশিত হাসির অন্ত মেলে না। মুখচোরারও তখন বোল ফোটে, অকালকুষ্মান্ড ডানা মেলতে চায়, অলস আড়মোড় ভাঙে, কলুর বলদ হাফ ছেড়ে বাঁচে, মগজের ঘাঁইয়ে তৈরি হয় নতুন নতুন দর্শন।
সাধারণের যদি এই হয়, তবে শিল্পী-সাহিত্যিকের কথা বলা বাহুল্য। এ কারণেই তাঁদের ঘটা করে আড্ডার সহস্র আয়োজন। তাতে তাঁরা কসুর করেননি কোনো কালেই। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু আড্ডার আকর্ষণে মাইলের পর মাইল হেঁটে কলকাতার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে যেতেন। চাইলে এমন উদাহরণ আরো পেশ করা যাবে। সেই আড্ডায় জলযোগের ব্যবস্থা থাকলে কৌতুকী ফুরাবে না। কিন্তু পাঠকের সঙ্গে এই আড্ডাবাজির ইতি টানতে হবে। কাজ পড়ে আছে।
‘কাজ! আড্ডা কি কাজ নয়?’
‘ওই তো আড্ডার দুঃখ। স্বীকৃতি জুটলো না! থাক্ কথায় কথা বাড়বে।’
কথার পিঠে উঠে আসা কথাই আড্ডার প্রাণ। অনেকটা সোয়েটারের ছিঁড়ে যাওয়া উলের মতো। এক কোণা ধরে শুধু টান দিতে হবে- ব্যস্। বয়স্কদের কাছে এ হলো দুষ্টুমি। সুতরাং থাকুক। অন্য একদিন এগেইন ফের পুনরায় আবার জমিয়ে আড্ডা হবে। ভয় নেই- আড্ডা ভাঙে কিন্তু মরে না।
তারা//