ভারত থেকে এভাবে ‘পুশ–ইন’ সঠিক নয়: খলিলুর রহমান
Published: 7th, May 2025 GMT
অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান বলেছেন, ‘ভারত থেকে এভাবে পুশ–ইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়। আমরা এরই মধ্যে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’
আজ বুধবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে খলিলুর রহমান এ মন্তব্য করেন। খাগড়াছড়ি ও কুড়িগ্রাম জেলা সীমান্তে ভারত থেকে নাগরিকদের পুশ–ইন করার বিষয়ে জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা প্রতিটি কেস আলাদা আলাদাভাবে নিরীক্ষণ করছি। আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমাদের দেশের নাগরিক যদি কেউ হয়ে থাকেন, আর সেটা যদি প্রমাণিত হয়, তাহলে তাঁদের আমরা গ্রহণ করব। তবে এটা ফরমাল চ্যানেলে হতে হবে। এভাবে পুশ–ইন করাটা সঠিক প্রক্রিয়া নয়।’
এটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে কি না জানতে চাইলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি।’
পররাষ্ট্রসচিব পরিবর্তন হচ্ছেন কি না জানতে চাইলে খলিলুর রহমান বলেন, ‘সে রকম কিছু হলে তো আপনারা জানবেন।’
প্রসঙ্গত আজ (৭ মে) খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৬৬ ভারতীয় নাগরিক ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরও ৩৬ রোহিঙ্গাকে পুশ–ইন করার খবর পাওয়া গেছে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
দক্ষিণ এশিয়ায় দুর্ভাগ্যের আরেক অধ্যায়
মঙ্গলবার মধ্যরাত পেরিয়ে বুধবারের শুরুতে পাকিস্তানে ভারতের সর্বশেষ আকাশ-হামলা দুঃখজনক হলেও অবাক হওয়ার মতো নয়। গত দেড় দশকে এবং বিশেষভাবে পেহেলগামের সন্ত্রাসী ঘটনার পর ভারতীয় জনসমাজে যেভাবে যুদ্ধ-উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তাতে পাকিস্তানে এক দফা হামলা অবধারিত ছিল।
পাকিস্তানিরাও সেটা জানত। ভারতের হামলার আশঙ্কায় তাদের শেয়ারবাজার ক্রমে পড়ছিল। এই হামলার মাধ্যমে বিজেপি সরকার তাদের জনগণের যুদ্ধক্ষুধার কিছুটা মেটাল। রাজনৈতিকভাবেও বেশ মুখরক্ষা হলো তাদের। তবে এই হামলা ভারতকে অধিক নিরাপদ করল কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়? যুদ্ধ শুরু করা যত সহজ, বন্ধ করা ঠিক তত কঠিন।
হামলার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন কমপেহেলগামে নির্মম রক্তপাত বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়েছিল। কিন্তু ঘটনার দুই সপ্তাহ পরও ভারত এই হামলার বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত–পরবর্তী সাক্ষ্যপ্রমাণ তুলে ধরতে পারেনি। সেই কারণে গত ১৫ দিন চেষ্টা করেও তারা পাকিস্তানকে দোষারোপের প্রচারণায় আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি তেমন। তাদের মিত্র রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্রও এই ঘটনায় যুক্ত থাকার দায়ে পাকিস্তানের নিন্দা করেছে—এমন ঘটেনি। এ কারণে পাকিস্তানে ভারতের ৬ মের ‘প্রতিশোধমূলক’ হামলা ‘আগ্রাসন’ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বাস্তব কারণ রয়েছে।
পেহেলগামের হামলায় যে ২৬ জন নিহত হয়েছেন, তাঁরা যেমন বিনা অপরাধে খুনের শিকার, তেমনি পাঞ্জাব ও আজাদ কাশ্মীরে ভারতের বোমায় নিহত ব্যক্তিরাও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে খুন হলেন বলে যাঁরা বলছেন, তাঁদের বক্তব্যের যুক্তি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভারতীয় হামলার প্রত্যুত্তরে পাকিস্তানের ছোড়া গোলাগুলিতে যেসব ভারতীয় নাগরিক মারা যাচ্ছেন, তাঁরাও চলমান যুদ্ধ-উন্মাদনার নির্মম বলিমাত্র।
আরও পড়ুনভারত–পাকিস্তানের এই সংঘাত যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র–চীনেরও লড়াই১৪ ঘণ্টা আগেউভয় দেশে এসব মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, সেসব শাসক, জেনারেল, মিডিয়া মালিক কেউ সীমান্তে যুদ্ধ করতে যাবেন না, অতীতেও যাননি। উভয় দেশের সীমান্তে এবং সীমান্তের ভেতরে যাঁরা মরবেন, আহত হবেন, সব সমাজের দরিদ্র মানুষ—কেউ উর্দি পরা থাকবেন, কেউবা উর্দিহীন। দুর্ভাগা এসব মানুষকে নিয়ে ইউটিউবজুড়ে প্রচুর আবেগ ছড়ানো হবে, আর এই ফাঁকে উভয় দেশের সামরিক বাজেট আরেক দফা বাড়বে, সামরিক আমলাতন্ত্রের প্রভাব অতীতের চেয়ে দৃঢ় হবে এবং সমাজজুড়ে ধর্মীয় ও জাতিগত উন্মাদনা নতুন উচ্চতায় উঠবে। পাশাপাশি যুদ্ধে সরাসরি কোনো স্বার্থ না থাকার পরও সাধারণ হিন্দু, মুসলমান, শিখরা আবার পরস্পরকে নতুন করে সন্দেহ-অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করবে।
পাকিস্তান ইতিমধ্যে পাঞ্জাব ও আজাদ-কাশ্মীরের বহু এলাকায় স্কুল-কলেজ, হাটবাজার বন্ধ করে দিয়েছে। ভারতের ভেতরও বহু জায়গায় এ রকমটি করতে হবে শিগগির। তাৎক্ষণিকভাবে বললে, এই যুদ্ধ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজজীবনে দক্ষিণপন্থার প্রভাব আরও বাড়বে এবং এই যুদ্ধ দরিদ্রদের স্বার্থের জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর হবে।
আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের যে জোয়ার চলছে, তারা এই যুদ্ধে নিজেদের দক্ষিণ এশীয় মিত্রদের উত্থান দেখতে পাবে। ওই সব দেশের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির ব্যবসাও এ কারণে চাঙা হবে। ট্রাম্প ও ইসরায়েল প্রশাসন গাজায় তাদের নির্মমতা থেকে বিশ্ববাসীর মনোযোগ বেশ ভালোভাবেই দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানান্তর করতে পারল মোদি প্রশাসনের সহায়তায়। মুখে ট্রাম্প যা–ই বলুন, তাঁদের জন্য ৬ মের ‘অপারেশন সিঁদুর’ আনন্দদায়ক হয়েছে।
আগামী বছর আরএসএসের শত বছর পূর্তি হচ্ছে। তাদের এখনকার তাত্ত্বিক ও আদর্শিক এজেন্ডা একটাই। সেটা হলো, ভারতকে একটা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে আইনগতভাবে ঘোষণা করা। এটা তাদের কোনো গোপন অভিলাষ নয়। বিজেপি পরবর্তী লোকসভায় সাড়ে তিন শ থেকে চার শ আসনের জন্য চেষ্টা করছে। বাবরি মসজিদের জায়গায় দৃষ্টিনন্দন মন্দির গড়েও তারা উত্তর প্রদেশে প্রত্যাশিত ফল পায়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নতুনভাবে তারা নিজেদের রণনীতি-রণকৌশল পুনর্বিন্যাস করেছে।মোদি-শাহ জুটির প্রভাব নতুন উচ্চতায়চলতি যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ায় কীভাবে দক্ষিণপন্থার জয়পতাকা নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে, তার প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় ভারতজুড়ে সেক্যুলার শক্তিকে দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা বের করে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে পুনঃ পুনঃ। আবার দেশটির প্রধান বিরোধী দল নিজে থেকে পাকিস্তানে হামলায় সরকারকে আগে থেকে পূর্ণ সমর্থন দিয়ে রেখেছে। তারা ইতিমধ্যে হামলার জন্য অভিনন্দনও জানিয়েছে। রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য তাদের এই করুণ প্রচেষ্টা শেষ বিচারে বিজেপি-আরএসএস পরিবারের শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনীতিকে শক্তি জোগাবে প্রবলভাবে।
ভারতের প্রায় সব মিডিয়া পাকিস্তানে হামলাকে ‘সন্ত্রাসী ঘাঁটি’তে হামলা হিসেবে প্রচার করছে। মনে হচ্ছে, পাকিস্তানের সবাইকে তারা সন্ত্রাসী হিসেবে দেখে। এ রকম বিপজ্জনক মনোভাব দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যতের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু বিপরীত দিকে, এ মুহূর্তে ভারতজুড়ে আরএসএস-বিজেপি ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মতাদর্শিকভাবে সম্পূর্ণ চ্যালেঞ্জহীন অবস্থায় রয়েছে। যুদ্ধ-উত্তেজনাকে তার রাজনীতির সমার্থক এবং ভারতের জন্য একমাত্র পথ হিসেবে হাজির করতে পেরেছে।
উদ্বেগের দিক হলো, বিজেপি এই যুদ্ধাবস্থাকে ব্যবহার করে আগাম নির্বাচন দিয়ে লোকসভায় বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এসে সংবিধান সংশোধন করে দেশকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করলে সেখানকার ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর কিছুই করার থাকবে না।
আরও পড়ুনভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ৫ ভবিষ্যদ্বাণী০৭ মে ২০২৫অতীতে ভাষ্যকারেরা বলতেন, রাজনীতির যেখানে শেষ, সেখানে যুদ্ধের শুরু। কিন্তু এ–ও সত্য, অনেক রাজনৈতিক মতাদর্শই যুদ্ধ নিয়ে আসে। রক্ত দিয়ে অনেক রাজনীতির চাষাবাদ হয়েছে ইতিহাসে।
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে একটা বিষয় খেয়াল করার আছে যে আগামী বছর আরএসএসের শত বছর পূর্তি হচ্ছে। তাদের এখনকার তাত্ত্বিক ও আদর্শিক এজেন্ডা একটাই। সেটা হলো, ভারতকে একটা হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে আইনগতভাবে ঘোষণা করা। এটা তাদের কোনো গোপন অভিলাষ নয়। বিজেপি পরবর্তী লোকসভায় সাড়ে তিন শ থেকে চার শ আসনের জন্য চেষ্টা করছে। বাবরি মসজিদের জায়গায় দৃষ্টিনন্দন মন্দির গড়েও তারা উত্তর প্রদেশে প্রত্যাশিত ফল পায়নি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে নতুনভাবে তারা নিজেদের রণনীতি-রণকৌশল পুনর্বিন্যাস করেছে।
এখন তাদের প্রয়োজন পাকিস্তান ও মুসলমানবিরোধী তীব্র এক যুদ্ধ–পরিস্থিতি। এই কৌশলে সামাজিকভাবে বিজেপি ইতিমধ্যে কংগ্রেসসহ প্রধান প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলেছে। রাহুল গান্ধী অনেকটাই মোদি-অমিত শাহ জুটির রাজনৈতিক-সামরিক কৌশলের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। পেহেলগাম অধ্যায়কে সর্বোত্তম পন্থায় নগদায়ন করতে নেমেছে সংঘ পরিবার।
দক্ষিণ এশিয়ায় দক্ষিণপন্থা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এগিয়ে রাখবেমোদি সরকারের সর্বশেষ পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসনের জন্যও সুবিধাজনক হয়েছে। যদিও তারা আপাতদৃষ্টে এই যুদ্ধ থেকে একটু দূরে থাকার নীতি নিয়েছে এবং ট্রাম্প ভারতের হামলাকে হতাশাজনক বলেছেন, কিন্তু এই যুদ্ধে চীন যত বেশি পাকিস্তানের পক্ষ নেবে, তত যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ভারতের কাছাকাছি আসবে। ভারতেরও যুক্তরাষ্ট্রকে দরকার হবে। আন্তর্জাতিক মুরব্বি দেশগুলোর এ রকম মেরুকরণ চীনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক আক্রমণাত্মক বিদেশনীতিরই পার্শ্বফল হিসেবে দেখা যায়।
ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে ভূকৌশলগত লক্ষ্য পূরণের পর যুক্তরাষ্ট্র চীনকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে যেভাবে তাদের সমাজকে নতুন মানসিকতায় প্রস্তুত করছে, ভারতের পাকিস্তাননীতি তাতে সহায়ক অবদান রাখবে। এর অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ও আরব সাগরে যেভাবে সামরিক উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তা এই অঞ্চলের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট করবে। ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর যে তাগিদ তৈরি করেছিল, এই যুদ্ধ তাতে বিধ্বংসী বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
আরও পড়ুনভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য কতটা সক্ষম২৮ এপ্রিল ২০২৫বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকি বহুমুখীচলতি যুদ্ধের আঁচ লাগবে বাংলাদেশেও। যুদ্ধরত উভয় দেশ বাংলাদেশকে তাদের দিকে টানবে। বাংলাদেশের জন্য সংকটের দিক হলো, এখানে নির্বাচিত সরকার নেই। জনপ্রতিনিধিদের মতামত রাখার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ফোরামও নেই এ মুহূর্তে। কিন্তু যুদ্ধ নিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের যেকোনো প্রতিক্রিয়া ভারত ও পাকিস্তান তাদের প্রতি সমর্থন বা বৈরিতা হিসেবে দেখবে।
ভারতজুড়ে ইতিমধ্যে সাত-আট মাস ধরে বাংলাদেশবিরোধী তীব্র প্রচারণা চলছে। এসব প্রচারণা প্রযোজকেরা এখন চেষ্টা করবে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশকেও প্রতিপক্ষ হিসেবে ভারতবাসীর সামনে হাজির করতে। ফলে এই যুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখানোর বেলায় বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় তরফে সতর্কতা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডরের আলাপটিও আপাতত একদম স্থগিত থাকা দরকার। সীমান্তে হঠাৎ করে পুশ–ইন নিয়েও বাংলাদেশের জরুরি সতর্ক প্রস্তুতি দরকার।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
[মতামত লেখকের নিজস্ব]