পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে রক্তপাত হলেও গতকাল দিনশেষে বাড়ল ভারতের সূচক
Published: 8th, May 2025 GMT
পাকিস্তানে ভারতের সামরিক হামলার জেরে গতকাল বুধবার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মূল্যসূচকের বড় পতন ঘটেছে। যুদ্ধের হুঙ্কারে প্রস্তুত থাকা পাকিস্তানেও শেয়ার সূচকের পতন হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সংঘাত নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
গতকাল বুধবার ভারতের শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরুতেই প্রধান দুটি সূচক সেনসেক্স ও নিফটির পতন ঘটে। সেনসেক্স ২০০ পয়েন্ট পর্যন্ত পড়ে যায়। তবে এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই ঘুরে দাঁড়িয়েছে উভয় সূচক এবং শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে সেনসেক্স সূচক ৫০ পয়েন্ট বেড়ে ৮০ হাজার ৭৪৬ পয়েন্টে উঠেছে। নিফটি সূচক বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮০ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে নিফটি মিডক্যাপ ১০০ ও নিফটি স্মলক্যাপ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ করে বেড়েছে। এদিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। নানা অর্থনৈতিক কারণেও এই উত্থান হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। মঙ্গলবারও দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধযুদ্ধ ভাবের মধ্যে ভারতে শেয়ার সূচক পড়ে গিয়েছিল। খবর ইকোনমিক টাইমসের।
এদিকে পাকিস্তানে ভারতীয় সামরিক হামলার জেরে গতকাল বুধবার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও সূচকের পতন হয়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের পতন হয়েছে ১৪৯ পয়েন্ট। এ ছাড়া ডিএসইএস সূচক ৪১ দশমিক ৯২ পয়েন্ট ও ডিএস ৩০ সূচক ৪০ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট কমেছে। মোট লেনদেন হয়েছে ৫১৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকার।
অন্যদিকে পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে বুধবার রীতিমতো রক্তপাত হয়েছে। সে দেশের দ্য ডন পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের মূল সূচক কেএসই-১০০-এর পতন হয়েছে ৬ হাজার ৫৬০ দশমিক ৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো নয়। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস বলেছে, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়লে পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। বিদেশি ঋণ পাওয়া দেশটির পক্ষে কঠিন হয়ে যেতে পারে।
ভারতের শেয়ারবাজার কেন শক্তিশালী
এনডিটিভির সংবাদে বিশ্লেষকেরা বলেছেন, ভারতের এই হামলা হয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে। তবে হামলার তীব্রতা বাড়ানোর তেমন ইচ্ছা ভারতের নেই। এ দুই কারণে বুধবার সূচক শেষমেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জিওজিত ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ভি কে বিজয়কুমার বলেন, পাকিস্তান কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে বিনিয়োগকারীদের। তবে বাজার আগে থেকেই জানে, এই হামলা হতে পারে। সে কারণেও তেমন একটা প্রভাব পড়বে না বলেই তিনি মনে করেন।
এ ছাড়া ভারতের শেয়ারবাজারে কয়েক দিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। সেটাকেই ভারতীয় শেয়ারবাজার অতটা আক্রান্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করেন বিজয়কুমার। তিনি বলেন, গত ১৪ অধিবেশনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৪৩ হাজার ৯৪০ কোটি রুপির শেয়ার কিনেছেন। মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো বলে বিনিয়োগকারীরা ভারতের দিকে ঝুঁকছেন।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ভারতের বাজার নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।
এনডিটিভির আরেকটি খবর হলো, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়ে একমত হয়েছে। মঙ্গলবার এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এই খবর ভারতের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলেছেন, ভারত এই সময় হামলা না চালালে সেনসেক্স ও নিফটির মান আরও বাড়ত।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
যুদ্ধযুদ্ধ ভাবের মধ্যে কয়েক দিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের ব্যবসায়ী মহল তাদের শঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিল। সংঘাত চললে বা দুই দেশ পুরোপুরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বেশি ক্ষতি হবে পাকিস্তানের। ভারতকেও জের টানতে হবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর্থিক অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতির হার। ফলে ভারতের ব্যবসায়ী মহলের আহ্বান ছিল, সব দিক বিবেচনা করে যেন ভারত সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতের বাণিজ্য সংগঠন সিআইআইয়ের সভাপতি সঞ্জীব পুরী ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, পেহেলগামের মতো ঘটনা মোকাবিলা করার সক্ষমতা ভারতের আছে। তবে জনগণের জীবন ও বাণিজ্যে এই সংঘাতের তেমন প্রভাব যেন না পড়ে, তা দেখতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সরকারের এবং কেন্দ্রের যেকোনো পদক্ষেপে সিআইআই পূর্ণ সমর্থন দেবে।
অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনও বলেছে, সংঘাত হলে ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরাও কয়েক দিন ধরে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা হ্রাস করার বিষয়ে সোচ্চার। দ্য ডনের সংবাদে পাকিস্তানের করপোরেট খাতের নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, এই সংঘাতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। বিশেষ করে বিশ্ববাণিজ্যে যখন আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব বাড়ছে, তখন এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তাঁরা।
পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সংঘাতের কারণে পাকিস্তানের পুঁজিবাজার, মুদ্রাবাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা বলেন, ওষুধ সরবরাহে সমস্যা হবে। কারণ, ওষুধের উপকরণের জন্য পাকিস্তান ভারতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই উত্তেজনা চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ক্ষতি হবে, যা এড়ানোর পথ থাকবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব যবস য় এই স ঘ ত ন হয় ছ দশম ক গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
পাকিস্তানে হামলায় যেসব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে ভারত
ভারত মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রত কাশ্মীর জুড়ে সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে সামরিক অভিযান চালিয়েছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পরিচিত এই অভিযানে ভারতীয় বিমান, নৌ এবং স্থলভিত্তিক তিন বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বালোকোট অভিযানের পর এটি ভারতের দ্বারা পরিচালিত সবচেয়ে বিস্তৃত আন্তঃসীমান্ত নির্ভুল হামলা।
পহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের নয়টি স্থানে ভারতীয় বাহিনী ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ৭০ জন সন্ত্রাসীকে হত্যা করার দাবি করেছে।
আরো পড়ুন:
পাকিস্তানে ৭০ জনকে হত্যার দাবি ভারতের
ভারত সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: অমিত শাহ
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ যেসব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছে ভারত
এনডিটিভ জানিয়েছে, ভারত এই অভিযানে উচ্চ-নির্ভুলতা, দূরপাল্লার স্ট্রাইক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে ছিল ‘স্ক্যাল্প’ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, নির্ভুল বোমা ‘হামার’ এবং লোটারিং যুদ্ধাস্ত্র।
* স্ক্যাল্প (স্টর্ম শ্যাডো): স্ক্যাল্প ক্ষেপণাস্ত্রটি স্টর্ম শ্যাডো নামেও পরিচিত। এটি দূরপাল্লার, আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, যার পাল্লা ২৫০ কিলোমিটারেরও বেশি এবং গভীর-আক্রমণ ক্ষমতার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
* হ্যামার (হাইলি এজাইল মডুলার মিনিশন এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ): হ্যামার স্মার্ট বোমাটি লস্কর এবং জইশ-ই-মোহাম্মদ (জেইএম) কর্তৃক প্রশিক্ষণ ও সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত সুরক্ষিত বাঙ্কার এবং বহুতল ভবনের মতো সুরক্ষিত অবকাঠামো আক্রমণ করতে ব্যবহৃত হয়েছিল। হ্যামার হলো একটি নির্ভুল-নির্দেশিত, স্ট্যান্ডঅব যুদ্ধাস্ত্র যা উৎক্ষেপণের উচ্চতার উপর নির্ভর করে ৫০-৭০ কিলোমিটার পরিসরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।
* কামিকাজে ড্রোন: মূলত নজরদারি চালানোর কাজে ব্য়বহৃত হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না লক্ষ্য নির্ধারণ হচ্ছে, ততক্ষণ উড়ে বেড়ায় এই ড্রোন। এই ড্রোনকে কামিকাজে ড্রোন বা আত্মঘাতী ড্রোনও বলা হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবেও উড়তে পারে এই ড্রোন, আবার রিমোটের মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি, এই ড্রোনে বিস্ফোরক বা পেলোডও বসানো যায়। ড্রোনের মাধ্যমেই আঘাত হানা যায় লক্ষ্যে।
পাকিস্তানে যেসব লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে ভারত
ভারত তাদের ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযানে পাকিস্তানের ৯টি স্থানে হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে চারটি পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে এবং পাঁচটি পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে অবস্থিত।
ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কোনো পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি। বরং নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে।
* মারকাজ সুবহানআল্লাহ, বাহাওয়ালপুর: জৈশ-ই-মোহাম্মদের সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত। এখানে সিনিয়র সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
* মারকাজ তাইবা, মুরিদকে: লস্কর-ই-তৈয়বার শিক্ষা, রসদ ও পরিকল্পনার জন্য ব্যবহৃত ২০০ একর জমির একটি কম্পাউন্ড। এটি অভিযানে আঘাত করা সবচেয়ে সুরক্ষিত লক্ষ্যবস্তুগুলোর মধ্যে একটি ছিল।
* মারকাজ আব্বাস, কোটলি: এই ক্যাম্পটি জৈশ-ই-মোহাম্মদের সদস্যদের আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র বিতরণের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
* সৈয়দনা বিলাল ও শাওয়াই নাল্লা ক্যাম্প, মুজাফ্ফরাবাদ: জৈশ-ই-মোহাম্মদ ও লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্যদের অনুপ্রবেশ পয়েন্ট এবং স্লিপার সেলগুলোর প্রশিক্ষণ সুবিধা হিসেবে পরিচিত।
* মারকাজ আহলে হাদিস, বার্নালা: লস্কর-ই-তৈয়বার একটি সহায়তা কেন্দ্র এবং আঞ্চলিক সরবরাহ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।
* সরজাল, তেহরা কালান: জৈশ-ই-মোহাম্মদে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্যদের শিবির হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
* মেহমুনা জোয়া, শিয়ালকোট: হিজবুল মুজাহিদিনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। কাশ্মীর উপত্যকায় এই গোষ্ঠীর উপস্থিতি হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও এখনও সক্রিয়।
ঢাকা/ফিরোজ