পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে রক্তপাত হলেও গতকাল দিনশেষে বাড়ল ভারতের সূচক
Published: 8th, May 2025 GMT
পাকিস্তানে ভারতের সামরিক হামলার জেরে গতকাল বুধবার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে মূল্যসূচকের বড় পতন ঘটেছে। যুদ্ধের হুঙ্কারে প্রস্তুত থাকা পাকিস্তানেও শেয়ার সূচকের পতন হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এই সংঘাত নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, যুদ্ধে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।
গতকাল বুধবার ভারতের শেয়ারবাজারে লেনদেনের শুরুতেই প্রধান দুটি সূচক সেনসেক্স ও নিফটির পতন ঘটে। সেনসেক্স ২০০ পয়েন্ট পর্যন্ত পড়ে যায়। তবে এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ততই ঘুরে দাঁড়িয়েছে উভয় সূচক এবং শেষ পর্যন্ত আগের দিনের চেয়ে বেড়েছে। এর মধ্যে সেনসেক্স সূচক ৫০ পয়েন্ট বেড়ে ৮০ হাজার ৭৪৬ পয়েন্টে উঠেছে। নিফটি সূচক বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮০ পয়েন্ট। সেই সঙ্গে নিফটি মিডক্যাপ ১০০ ও নিফটি স্মলক্যাপ ১ দশমিক ৫০ শতাংশ করে বেড়েছে। এদিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম বেড়েছে। নানা অর্থনৈতিক কারণেও এই উত্থান হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। মঙ্গলবারও দুই দেশের মধ্যকার যুদ্ধযুদ্ধ ভাবের মধ্যে ভারতে শেয়ার সূচক পড়ে গিয়েছিল। খবর ইকোনমিক টাইমসের।
এদিকে পাকিস্তানে ভারতীয় সামরিক হামলার জেরে গতকাল বুধবার বাংলাদেশের শেয়ারবাজারেও সূচকের পতন হয়েছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্সের পতন হয়েছে ১৪৯ পয়েন্ট। এ ছাড়া ডিএসইএস সূচক ৪১ দশমিক ৯২ পয়েন্ট ও ডিএস ৩০ সূচক ৪০ দশমিক ৩৪ পয়েন্ট কমেছে। মোট লেনদেন হয়েছে ৫১৬ কোটি ৪৬ লাখ টাকার।
অন্যদিকে পাকিস্তানের শেয়ারবাজারে বুধবার রীতিমতো রক্তপাত হয়েছে। সে দেশের দ্য ডন পত্রিকার সংবাদে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের শেয়ারবাজারের মূল সূচক কেএসই-১০০-এর পতন হয়েছে ৬ হাজার ৫৬০ দশমিক ৮২ পয়েন্ট বা ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই ভালো নয়। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস বলেছে, ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়লে পাকিস্তানের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হতে পারে। বিদেশি ঋণ পাওয়া দেশটির পক্ষে কঠিন হয়ে যেতে পারে।
ভারতের শেয়ারবাজার কেন শক্তিশালী
এনডিটিভির সংবাদে বিশ্লেষকেরা বলেছেন, ভারতের এই হামলা হয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে। তবে হামলার তীব্রতা বাড়ানোর তেমন ইচ্ছা ভারতের নেই। এ দুই কারণে বুধবার সূচক শেষমেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। জিওজিত ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের প্রধান বিনিয়োগ কৌশলবিদ ভি কে বিজয়কুমার বলেন, পাকিস্তান কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়, সেদিকে নজর রাখতে হবে বিনিয়োগকারীদের। তবে বাজার আগে থেকেই জানে, এই হামলা হতে পারে। সে কারণেও তেমন একটা প্রভাব পড়বে না বলেই তিনি মনে করেন।
এ ছাড়া ভারতের শেয়ারবাজারে কয়েক দিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। সেটাকেই ভারতীয় শেয়ারবাজার অতটা আক্রান্ত না হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করেন বিজয়কুমার। তিনি বলেন, গত ১৪ অধিবেশনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ৪৩ হাজার ৯৪০ কোটি রুপির শেয়ার কিনেছেন। মূলত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো বলে বিনিয়োগকারীরা ভারতের দিকে ঝুঁকছেন।
ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ভারতের বাজার নিজস্ব অবস্থান ধরে রাখতে পারবে।
এনডিটিভির আরেকটি খবর হলো, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) বিষয়ে একমত হয়েছে। মঙ্গলবার এ নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। এই খবর ভারতের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলেছেন, ভারত এই সময় হামলা না চালালে সেনসেক্স ও নিফটির মান আরও বাড়ত।
ব্যবসায়ীদের শঙ্কা
যুদ্ধযুদ্ধ ভাবের মধ্যে কয়েক দিন ধরেই ভারত ও পাকিস্তানের ব্যবসায়ী মহল তাদের শঙ্কার কথা জানিয়ে আসছিল। সংঘাত চললে বা দুই দেশ পুরোপুরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে বেশি ক্ষতি হবে পাকিস্তানের। ভারতকেও জের টানতে হবে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে আর্থিক অগ্রগতি থমকে যেতে পারে। বাড়তে পারে মূল্যস্ফীতির হার। ফলে ভারতের ব্যবসায়ী মহলের আহ্বান ছিল, সব দিক বিবেচনা করে যেন ভারত সিদ্ধান্ত নেয়।
ভারতের বাণিজ্য সংগঠন সিআইআইয়ের সভাপতি সঞ্জীব পুরী ইকোনমিক টাইমসকে বলেন, পেহেলগামের মতো ঘটনা মোকাবিলা করার সক্ষমতা ভারতের আছে। তবে জনগণের জীবন ও বাণিজ্যে এই সংঘাতের তেমন প্রভাব যেন না পড়ে, তা দেখতে হবে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি সরকারের এবং কেন্দ্রের যেকোনো পদক্ষেপে সিআইআই পূর্ণ সমর্থন দেবে।
অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনও বলেছে, সংঘাত হলে ভারতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরাও কয়েক দিন ধরে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা হ্রাস করার বিষয়ে সোচ্চার। দ্য ডনের সংবাদে পাকিস্তানের করপোরেট খাতের নেতৃত্বকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, এই সংঘাতে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। বিশেষ করে বিশ্ববাণিজ্যে যখন আঞ্চলিক সহযোগিতার গুরুত্ব বাড়ছে, তখন এই সংঘাত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তাঁরা।
পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, সংঘাতের কারণে পাকিস্তানের পুঁজিবাজার, মুদ্রাবাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইতিমধ্যে শেয়ারবাজারে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে। সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ে তাঁরা বলেন, ওষুধ সরবরাহে সমস্যা হবে। কারণ, ওষুধের উপকরণের জন্য পাকিস্তান ভারতের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। এই উত্তেজনা চলতে থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ক্ষতি হবে, যা এড়ানোর পথ থাকবে না।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র ব যবস য় এই স ঘ ত ন হয় ছ দশম ক গতক ল
এছাড়াও পড়ুন:
স্বস্তিতে বিদ্যুৎ, সংকটে গ্যাস সরবরাহ
বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত নিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মের বিস্তর অভিযোগ ছিল গত সরকারের সময়ে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদন বলছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে অন্তত ৬০০ কোটি ডলার নয়ছয় হয়েছে। এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি এক বছরে। আদানি, রামপালসহ বিতর্কিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি বাতিল বা সংশোধনে কমিটি করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে জোর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। ইতিমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে সাশ্রয় করেছে তারা। তারপরও বিদ্যুৎ-গ্যাস খাতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভর্তুকি গেছে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫)। গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এবার লোডশেডিং করতে হয়নি। চাহিদাও কিছুটা কম ছিল। বিদ্যুৎ খাত অনেকটা স্বস্তিতে ছিল। তবে টানা সংকট ছিল গ্যাস সরবরাহে। শিল্পে নতুন সংযোগ বন্ধ আছে আট মাস ধরে।
গত সরকারের সময় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সবচেয়ে বেশি ভুগেছে বকেয়া বিল পরিশোধের চাপে। এতে সরবরাহ ধরে রাখতে পারেনি। টানা তিন বছর লোডশেডিং করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নেয়। শুরুতেই জ্বালানি তেল আমদানির বিদেশি কোম্পানির ৫০ কোটি ডলারের বকেয়া শোধ করা হয়। গ্যাস খাতে ৭৫ কোটি ডলার বকেয়া রেখে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। গত এপ্রিলে সব বকেয়া শোধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যুৎ খাতের বকেয়াও অনেকটা শোধ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতবিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন-২০১০ নিয়ে। এ আইনে বলা হয়, এর অধীন নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতে যাওয়া যাবে না। এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত। বিগত সরকার এ আইনের মেয়াদ বারবার বাড়িয়ে দরপত্র ছাড়া একের পর এক চুক্তি করেছে। এসব চুক্তি বাতিলের দাবি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার গত ২৮ নভেম্বর অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে আইনটি রহিত করেছে। তবে এ আইনের অধীন করা সব চুক্তি বলবৎ রেখেছে। বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বেশি আপত্তি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া নিয়ে, যা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পরিচিত। এক বছরে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া কমানোর দৃষ্টান্ত নেই।
অবশ্য বিশেষ আইনের অধীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় ৫ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি করে দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কমিটি এখনো কাজ করছে। তাদের পরামর্শে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনায় আরেকটি কমিটি করা হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি। এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর সমঝোতা হয়নি।
বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীন ৩৭টি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সম্মতিপত্র দিয়েছিল গত সরকার। এগুলো বাতিল করে দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে সামিটের সঙ্গে চুক্তি করে গিয়েছিল গত সরকার। এটিও বাতিল করা হয়েছে। আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে টার্ম শিট সই হয়েছিল, সেটিও বাতিল করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগে জ্বালানি তেল পরিশোধনের প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার, এটিও বাতিল করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। বিগত সরকার আইন সংশোধন করে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ের হাতে নেয়। এরপর কয়েক দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ায় নির্বাহী আদেশে। অন্তর্বর্তী সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর শিল্পে গ্যাসের দাম এক দফা বাড়ানো হয়। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়নি। তবে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা এখনো জ্বালানি বিভাগের হাতে রয়ে গেছে। প্রতি মাসে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
গ্যাস নিয়ে সংকটগ্যাসের সরবরাহ নিয়ে বিপাকে আছে সরকার। দেশি গ্যাসের উৎপাদন টানা কমছে। নতুন নতুন কূপ খনন করে উৎপাদন ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরবরাহ বাড়াতে এলএনজি আমদানি বাড়ানো হচ্ছে। তবু চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। নতুন গ্যাস আবিষ্কারে গতিশীল কোনো কার্যক্রম নেই। গত দেড় দশকেও সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কার করা যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় সমুদ্রে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের সবশেষ দরপত্রে কোনো কোম্পানি অংশ নেয়নি। সমুদ্রে অনুসন্ধানে থাকা একমাত্র কোম্পানি ভারতের ওএনজিসি চলে যাচ্ছে। তার মানে আগামী কয়েক বছরেও সমুদ্রে গ্যাসের সম্ভাবনা নেই। দরপত্র আহ্বান করতে নতুন উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) করা হচ্ছে। স্থলভাগেও গ্যাস অনুসন্ধানে একটি পিএসসি তৈরি করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সমস্যা এক বছরে সমাধানের মতো নয়। গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু চাইলেই চট করে গ্যাস সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়তেও অন্তত তিন বছর সময় দরকার। তবু সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি করে শিল্পে গ্যাসের চাহিদা মেটানো হয়েছে। গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, বির্তকিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল বা সংশোধন, আদানির সঙ্গে বিরোধ—এসব বিষয়ে ফাওজুল কবির খান বলেন, এসব বিষয়ে অগ্রগতি আছে। কমিটি কাজ করছে। চুক্তি সংশোধন করে বিদ্যুতের দাম কমাতে আলোচনা চলছে। আদানির সঙ্গেও আলোচনায় অগ্রগতি আছে। চূড়ান্ত ফল না আসায় প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না। তবে ভেতরে–ভেতরে অনেক কাজ চলছে। একটু সময় লাগবে।
খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ে নজরবিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ আছে। গত সরকার তাই দফায় দফায় দাম বাড়িয়েছিল। খরচ কমাতে সাশ্রয়ে নজর দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এক বছরের সাফল্য নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ আলাদা করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে খরচ কমানোর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আমদানি ও কেনাকাটার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন এনে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে খরচ কমানো হয়েছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বিশেষ বিধান বাতিল করে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে এলএনজি কেনায় ৩০২ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। চলতি অর্থবছরে আরও ব্যাপক সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জ্বালানি তেল আমদানিতে আগের বছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সাত হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে। কাফকো সার কারখানা ও লাফার্জ সিমেন্টের সঙ্গে নতুন করে গ্যাস বিক্রয় চুক্তি করায় বছরে এক হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় হবে। সিস্টেম লস কমানোয় ২১৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বেড়েছে। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোয় ৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটা ঠিক, সরকারের উদ্যোগে প্রতিযোগিতা বাড়ায় খরচ কমেছে অনেক ক্ষেত্রে। তবে খরচ কমাতে বৈশ্বিক পরিস্থিতিও ভূমিকা রেখেছে। আগের বছরের তুলনায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও এলএনজির দাম কম ছিল গত এক বছর। এ ছাড়া গত বছর বিশ্বে জ্বালানি পরিবহনের জাহাজভাড়া কমেছে।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, দেশি গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে ১৫০টি কূপ সংস্কার ও খননের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নতুন তিনটি রিগ কিনে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ১৯টি কূপের কাজ শেষে দিনে ৮ কোটি ঘনফুটের বেশি গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া গ্যাস খাতের ১০টি প্রকল্পের খরচ কমিয়ে ৩২৮ কোটি টাকা সাশ্রয় খরচ করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিবেদন বলছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তেল আমদানির সার্ভিস চার্জ ৪ শতাংশ কমানোয় ৪৭০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। প্রতি জাহাজে ১৫ হাজার টনের বদলে ২০ হাজার টন তেল আমদানি নির্ধারণ করায় ৩৫৪ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম ৮ টাকা ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করায় বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ কমিয়ে ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্থাপনা ভাড়া, বিলম্ব মাশুল (জরিমানা) আদায়সহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ৯ হাজার ২১০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
সাশ্রয়ের মধ্যেই বেড়েছে ভর্তুকিপেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি শুরুর পর থেকে লোকসান শুরু হয় সংস্থাটির। প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। ২০১৮-১৯ সালে এলএনজি আমদানি শুরু হয়। ওই বছর ভর্তুকি ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এরপর এলএনজি আমদানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভর্তুকিও বাড়তে থাকে। গত অর্থবছরে তারা ভর্তুকি নিয়েছে ৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে ভর্তুকি ছিল ৬ হাজার কোটি টাকা।
বিদ্যুৎ খাতে গত অর্থবছরে ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল ৪৭ হাজার কোটি টাকা। তারা নিয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, এটি চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) কমে আসবে। তাই ৩৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। যদিও গত অর্থবছরে ১০ শতাংশ খরচ কমিয়ে ১১ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। গত বছরের আগস্ট থেকে গত মে পর্যন্ত দেড় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা গেছে। মেয়াদ শেষে ১০টি বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করায় ৫২৫ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গ্রীষ্মে পরিকল্পনা নিয়ে লোডশেডিংমুক্ত রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ বকেয়া ১ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বৈদেশিক বকেয়া শোধ করা হয়েছে ১৫ কোটি ২৬ লাখ ডলার। আদানির বকেয়া ৭ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রকাশ করা হয়েছে।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সারা দেশের সরকারি ভবনের ছাদে সোলার প্যানেল বসিয়ে এক থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। চারটি ধাপে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ৫৫টি স্থানে ৫ হাজার ২৩৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
তবে সরকারের এক বছরের অগ্রগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোক্তাদের পক্ষ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে করণীয় স্পষ্টভাবে সরকারের নজরে আনা হয়েছে; কিন্তু সরকার তার ধারেকাছেও যায়নি। আগের সরকারের আমলে লুণ্ঠনের যে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, তার সুরক্ষা দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। জ্বালানি খাত সংস্কারে সুপারিশ, দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে কিছুই করেনি সরকার।