আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে ঢাকায় আয়োজিত কর্মসূচি শেষে ফেরার সময় কয়েকজন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীকে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

আজ রোববার ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে এ ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। প্রতিবাদে রাত পৌনে আটটার দিকে দিনাজপুর স্টেশনে ট্রেনটি অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে রাত ৮টা ৫৫ মিনিটে নির্ধারিত গন্তব্য পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ট্রেনটি।

অভিযোগকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, দিনাজপুরে জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ১৭ জন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গত শনিবার আয়োজিত কর্মসূচিতে যোগ দিতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। কর্মসূচি শেষে রোববার সকাল সোয়া ১০টায় কমলাপুর স্টেশনে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন তাঁরা। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর টিটিই (ট্রাভেল টিকিট এক্সামিনার) তাঁদের কাছে টিকিট দেখতে চান। এ সময় টিটিইকে তাঁরা জানান যে তাড়াহুড়ো করে তাঁরা ট্রেনে উঠে পড়েছেন। এই মুহূর্তে তাঁদের কাছে টাকা নেই। সময় দিলে তাঁরা বিকাশের মাধ্যমে টাকা পরিশোধ করবেন। কিন্তু টিটিই তাঁদের সামনের স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। সিরাজগঞ্জ স্টেশনে এসে আবার তাঁদের কাছে টিকিট দেখতে চান। এ সময় পুলিশের এক সদস্য ও টিটিই ওয়াসিবুর রহমান (শুভ) তাঁদের ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেন। এ সময় রাসেল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থী পড়ে গিয়ে বাঁ হাতের কনুইয়ে আঘাত পান। পরে তাঁরা আবার ট্রেনে ওঠেন।

অভিযোগকারী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা কেন গেছি ঢাকায়? এ ধরনের প্রশ্ন করে আমাদের চার্জ করেছেন ওই পুলিশ ও টিটিই। তাঁরা আওয়ামী লীগের দোসর। তাঁরা পরিকল্পিতভাবে আমাদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করেছেন। আমরা ওই পুলিশ ও টিটিইর বিচার দাবি করি।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে টি‌টিই ওয়ার‌সিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ট্রেন থে‌কে‌ কাউকে ধাক্কা দি‌য়ে নামিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘ‌টে‌নি।

এ বিষয়ে দিনাজপুর রেলস্টেশনের সুপারিনটেনডেন্ট জিয়াউর রহমান বলেন, একতা এক্সপ্রেস ট্রেনে দায়িত্ব পালনকারী দুজনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। পরে সন্ধ্যায় দিনাজপুর রেলস্টেশনে তাঁরা ট্রেনটি আটকে দেন। শিক্ষার্থীরা একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তদন্ত শেষে ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আওয় ম

এছাড়াও পড়ুন:

আলপনার গ্রাম

‘আলপনা গ্রাম’ নামে দেশে পরিচিত এই গ্রামের অবস্থান চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল উপজেলায়। বর্তমানে এই গ্রামের প্রায় সব নারীই শিল্পী। তাদের হাতের ছোঁয়ায় বা শিল্পকর্মে গ্রামের বাড়ির ঘর, রান্নাঘর থেকে প্রতিটি ঘর ও দেয়াল আলপনায় ভরা।

দেশের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ। তেভাগা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেত্রী ইলা মিত্রের স্মৃতিবিজড়িত নাচোল উপজেলার নেজামপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম টিকইল। এই গ্রামে বসবাসরত চার শতাধিক মানুষের মধ্যে প্রায় ৯০টি পরিবার সনাতন ধর্মাবলম্বী। তারা সবাই বর্মণ পদবির। তাদের হাত ধরেই গ্রামটির নাম ‘আলপনা গ্রাম’ নামে দেশ তথা বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বর্তমানে এই গ্রামের সব নারীই শিল্পী। এ সব নারীর হাতের ছোঁয়ায়-শিল্পকর্মে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির ঘর-রান্নাঘর থেকে শোয়ার ঘর, প্রতিটি দেয়ালই আলপনায় ভরা।
গ্রামের একটি আলপনাবাড়ি থেকে এখন এটি আলপনার গ্রাম। প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই গ্রামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস। বংশপরম্পরায় বছরের পর বছর বাড়ির দেয়ালে আলপনা আঁকার ঐতিহ্য টিকিয়ে রেখেছেন এই গ্রামের মেয়েরা। মাটির তৈরি এসব বাড়ির ভেতরে-বাইরে কোনো দেয়ালেই বাদ পড়ে না তুলির আঁচড়। 
আগে আলপনাবাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে শুধু নানা বৈচিত্র্যের আলপনা আঁকা থাকত। ধীরে ধীরে এই গ্রামের মেয়েরা আলপনা এঁকে বাড়িকে সাজিয়ে রাখা শুরু করেন। বিশেষ করে বছরে দু’বার– লক্ষ্মীপূজা ও দুর্গাপূজায় বাড়িকে সাজানো হয়। রঙের খরচ বেড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ বছরে একবার– শুধু দুর্গাপূজায় বাড়ি নতুন করে আলপনা দিয়ে ভরিয়ে দেন। টিকইলকে এখন ‘আলপনা গ্রাম’ নামেই চেনে দেশ-বিদেশের লোকজন।
এই গ্রামের আলপনা আঁকার কাজে আগে ব্যবহার হতো স্থানীয় লালমাটি, খড়িমাটি, চাল ভিজিয়ে ছেঁচে বানানো সাদা রং। এসবের সঙ্গে বিভিন্ন গাছের কষ মেশানো হয় আলপনাগুলো দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য। আগের থেকে পরিশ্রম এখন অনেকটা সহজ হয়েছে। বর্তমানে বাজারে পাওয়া রং দিয়ে আঁকা হয় আলপনা। নিজেদের খাবারের বা পরার বস্ত্রের অভাব থাকলেও, বাড়িঘর সাজাতে এসব পরিবার এক ধাপ এগিয়ে। যেন আগে বাড়ির আলপনা সাজানো, তারপর অন্য কিছু। একটি বাড়ি সাজাতে চার-পাঁচ বছর আগে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা খরচ হলেও বর্তমানে এ খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। দরিদ্র হলেও তাদের মনের জোর অনেক। এই আলপনা দিয়ে তাদের ঘরে লক্ষ্মী প্রবেশ করে। টিকইল গ্রামের মেয়েরা দেয়ালে দেয়ালে আলপনা এঁকে বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে দেবতার সুদৃষ্টি ও আশীর্বাদ কামনা করেন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই গ্রামের দেখন বর্মণের হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন রঙের, বাহারি আলপনার উৎপত্তি। আগে এই গ্রামের মেয়েরা খুব বেশি আলপনা করতেন না। কয়েক বছর ধরে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই আলপনার বিস্তার হয়েছে। তাদের দাবি, আলপনা গ্রামের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে, এককভাবে কাউকে নয়; সব পরিবারের জন্যই আর্থিকসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতাও দরকার।
এদিকে আলপনার উৎপত্তিস্থল দেখন বর্মণের বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়ির প্রতিটি ঘরকে সাজানো হয়েছে আলপনা দিয়ে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইলা মিত্রের স্মৃতি ও তাদের প্রতিকৃতিও।
দেখন বর্মণ জানান, অনেক বছর ধরে আলপনা আঁকা হলেও তা ছিল সীমিত পরিসরে। পরে তাঁর হাত ধরে বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন রঙের, বাহারি আলপনার প্রচলন ও প্রসার হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির বেশির ভাগ দেয়ালে আলপনা জায়গা করে নিয়েছে। এ কারণে তিনি আলপনার উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে। সনদ, সোলার প্যানেলসহ নানাভাবে তাঁকে সহায়তা করেছে প্রশাসন।
দেখন বর্মণ পর্যটকের জন্য একটি পরিদর্শন বই খোলার বিষয়টি আনন্দচিত্তে এ প্রতিবেদককে দেখিয়ে আরও জানান, সরকারিভাবে চার কক্ষের একটি বাড়ি দেওয়া হয়েছে।
নাচোল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালে একটি ক্রেস্ট ও এর সঙ্গে ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন।
পাশের বাড়িতে বসবাসকারী অনিতা বর্মণ জানান, সম্প্রতি তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর মা দেখন বর্মণ অনেকটা ভেঙে পড়েছেন। অনিতার স্বামী কীর্তন করেন এবং তিনি সেলাইয়ের কাজ করে কোনোরকমে সংসার চালান। খরচ বেড়ে যাওয়ায় তারা বছরে একবার দুর্গাপূজার সময় আলপনা আঁকেন। তাঁর মা দেখন বর্মণ আলপনাগুলো একটু বিবর্ণ হলেই তাতে তুলির আঁচড় দেন। তিনি আরও জানান, এ গ্রামের প্রায় সবার বাড়ি সাদা রং দিয়ে আলপনা আঁকা হলেও সুশীল, সুকুমারের বাড়িসহ পাঁচ-ছয়টি বাড়িতে বিভিন্ন রঙের আলপনা আঁকা হয়েছে।
সাথী বর্মণ জানান, তাঁর দাদি ও তিনি প্রায়ই তুলির আঁচড় দিয়ে থাকেন আলপনাগুলোতে। এ গ্রামের আলপনা শিল্পী নয়ন মনি ও বিপতী রানী দাস জানান, আগে আলপনা শুধু কয়েকটি বাড়িতেই আঁকা হতো। ধীরে ধীরে এ গ্রামের সব বাড়ির নারীরাই আলপনা এঁকে বাড়িকে সাজিয়ে রাখেন।
স্থানীয়রা জানায়, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলপনা গ্রামের রাস্তাটি মেরামত এবং সৌরবাতি দিয়ে গ্রামকে আলোকিত করা হয়েছে। লেখুনী বর্মণসহ চারটি পরিবারকে ত্রাণের বাড়ি দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মন্দির সংস্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আলপনা গ্রামের উন্নয়নে গ্রামের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, পানির ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা রয়েছে। এ গ্রামের আলপনা যেন দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়ে এবং বিদেশেও এর বিস্তার ঘটে সে আশাই করেন দেখন বর্মণসহ গ্রামের বাসিন্দারা।
একসময় হয়তো মাটির বাড়ি থাকবে না, কিন্তু পাকা বাড়িতেও এই আলপনা এঁকে ঐতিহ্য ধরে রাখবেন এই গ্রামের নারীরা। এই গ্রামের আলপনা যেন দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে যায় এবং বিদেশেও এর বিস্তার লাভ করুক, এমনই আশাবাদ এই গ্রামের বাসিন্দাদের। v

সম্পর্কিত নিবন্ধ