ভারত-পাকিস্তান আরও বিপজ্জনক এক যুগে ঢুকে পড়েছে
Published: 11th, May 2025 GMT
(ভারত–পাকিস্তান সংঘাতের নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। আসফান্দয়ার মিরের এই নিবন্ধে সংঘাতের নতুন এই ধরনের পেছনে ভারত ও পাকিস্তান কার কতটা দায় রয়েছে তা তুলে ধরা হয়েছে। নিবন্ধটি যুদ্ধবিরতির আগে প্রকাশিত। এরপরও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এর বাংলা ভাষান্তর প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো।)
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যখন সংঘর্ষ বাধে, তখন বিশ্ব সেটিকে ধর্ম ও কাশ্মীরকে ঘিরে বহুদিন ধরে চলে আসা মীমাংসাহীন দ্বন্দ্বযুদ্ধের আরেকটি নতুন পর্ব হিসেবে দেখে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি যেমন এটিকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘কাশ্মীরে তারা হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করে আসছে’ এবং ‘সম্ভবত তার চেয়েও বেশি সময় ধরে’।
এই যুক্তিটা বোধগম্য। কেননা, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান এবং হিন্দুপ্রধান ভারত কয়েকটি যুদ্ধ ও বহুবার সংঘর্ষে জড়ালেও দুই দেশের মধ্যকার সংঘর্ষ শেষ পর্যন্ত আলাপ-আলোচনা ও কূটনীতির টেবিলে মীমাংসা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তাতে মধ্যস্থতা করেছে। এমনকি দুই দেশের মধ্যে যখন ভীষণ লড়াই বেধেছে, সে সময়েও এই প্রতিষ্ঠিত প্রহরীরা দুই পক্ষকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের মতো অকল্পনীয় জায়গায় পৌঁছাতে দেয়নি।
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের পরিচিত এই চক্রকে এখন অতীত বলে মনে হচ্ছে। গত মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা, যাতে ২৬ জন নিহত হয়েছেন, পর দুই দেশের মধ্যে সাম্প্রতিকতম সামরিক উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই উত্তেজনা দ্রুত সামরিক সংঘাতে রূপ পাওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় ও বিপজ্জনক দিকে মোড় নিয়েছে। দুই প্রতিবেশীকে ধ্বংসাত্মক সংঘর্ষে জড়ানো থেকে নিবৃত্ত রাখার মতো কূটনৈতিক তৎপরতার পরিসর সীমিত হয়ে গেছে।
এই পরিবর্তনটা দুই দেশের একেবারে ভিন্নমুখী পথচলার মধ্যে শনাক্ত করা যায়।
ভারত এখন ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতকে শুধু একটি মহান দেশ হিসেবে নয়, এক সুমহান প্রাচীন সভ্যতার এমন এক গৌরবময় উত্তরসূরি হিসেবেও প্রতিষ্ঠা করতে চান, বিশ্বমঞ্চে যেটি কিনা তার পদচিহ্ন রেখেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি দিল্লির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা আপসহীন মনোভাব তৈরি করেছে।
এতে করে পাকিস্তানকে শুধু ব্যাঘাত সৃষ্টিকারী প্রতিবেশী হিসেবে নয়, বরং ভারতের ন্যায়সংগত জাগরণে বিশাল হুমকি সৃষ্টিকারী দেশ হিসেবে দেখার প্রবণতা বেড়েছে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের (মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল, দুই দেশই তাদের নিজেদের অংশ বলে) ওপর পাকিস্তানের দাবি এবং ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের সমর্থন—ভারত আর সহ্য করবে না।
অন্যদিকে পাকিস্তান তাতে করে চীনের প্রভাব বলয়ে আরও বেশি ঝুঁকে যাবে। এতে করে ২৫ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আর এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশটিই এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজে ফলাফল নিয়ে আসবে এবং ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো আরও গভীর হবে।অন্যদিকে পাকিস্তান দুই দশক ধরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাসংকটে জর্জরিত। পাকিস্তানে একটি প্রতিষ্ঠানই সর্বময় ক্ষমতাধারী। দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনী নীতিনির্ধারণে কর্তৃত্ব করে এবং তাদের হাতে রয়েছে উল্লেখ করার মতো প্রচলিত যুদ্ধ ও পারমাণবিক সামরিক শক্তি। বিপর্যয়ের পরও, আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো রয়েছে পাকিস্তানের। কাশ্মীরের মতো বিষয়গুলো পাকিস্তানের জাতীয় পরিচয়ের একেবারে কেন্দ্রীয় বিষয়, এসব বিষয়ে ইসলামাবাদ দিল্লির সঙ্গে আপস করতে রাজি নয়।
গত কয়েক দশকে, পাকিস্তানের নানা উসকানির মুখেও ভারতকে সাধারণত সংযম প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। একটা সাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সেটা সহায়তা করত। এমনকি ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসীদের হামলায় ১৬৬ জন নিহত হওয়ার পরও, ভারত শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান জানিয়ে সংযত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।
মোদির আমলে ভারতের আগের অবস্থানটা বদলে গেছে। গত এক দশকে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পরিসরে একঘরে করার কৌশল তিনি নিয়েছেন। এর পাশাপাশি গোপন অভিযান, অন্তর্ঘাত ও লক্ষ্যবস্তু করে হত্যার ঘটনাও ভারত ঘটাচ্ছে। একই সময়ে পাকিস্তান এবং নির্দিষ্ট করে দেশটির সেনাবাহিনী তাদের ঐতিহ্যের বাইরে বেরিয়ে কিছুটা সময়ের জন্য ভারতবিরোধী অবস্থান থেকে কিছুটা সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছিল। ২০১৯ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর পাকিস্তান অনেক বেশি সংযত আচরণ করে, ২০২১ সালে যুদ্ধবিরতি পুনরায় চালু করে। কিন্তু এর পর থেকে ভারত তার পথ বদল করে।
এমনকি যদি দুই পক্ষ বর্তমান উত্তেজনা থেকে সরে আসে, এরপরও ভারত খুব স্পষ্টভাবে পাকিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি চাপের মধ্যে রাখার কৌশল অবলম্বন করবে। ভারতের লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেওয়া এবং শক্তির মূল কেন্দ্র সেনাবাহিনীর অপূরণীয় ক্ষতি করা। গত মাসে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে, ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের চূড়ান্ত ধরনের কঠোর অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তাঁরা বলেছেন, পাকিস্তান একটি ব্যর্থ ও উচ্ছৃঙ্খল রাষ্ট্র। ভারতকে অবশ্যই পাকিস্তানকে ধ্বংসের পথ কার্যকরভাবে খুঁজে বের করতে হবে।
ভারতের কৌশলগত এই পরিবর্তন পাকিস্তান বুঝতে পেরেছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার আশা ছেড়ে দিয়ে তারা দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। অশুভ বিষয় হচ্ছে, এই সংঘাত সেই গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচের ওপর হুমকি তৈরি করছে, এত দিন ধরে যেটা সংঘাতের বৃত্ত তৈরি করতে বাধা দিয়ে এসেছে। গত মাসে ভারত ১৯৬০ সালের করা পানিচুক্তি স্থগিত করে। সিন্ধু নদী পাকিস্তানের পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। পাকিস্তান চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্তকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে ঘোষণা দিয়ে ১৯৭২ সালের চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার হুমকি দেয়। এই চুক্তির বলে ভাগ হয়ে যাওয়া কাশ্মীরে একটা সীমান্ত প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার সংকট সমাধানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমেই কমে আসছে। একসময় ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের কাছেই যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বাসযোগ্য মধ্যস্থতাকারী। ভারত-পাকিস্তানকে কয়েকবার যুদ্ধের প্রান্তসীমা থেকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল ওয়াশিংটন। ১৯৯৯ সালে, কাশ্মীরে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষ থামাতে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। ২০০১ সালে ভারতের আইনসভায় সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ত্বরিত কূটনীতিতে উত্তেজনা প্রশমিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা দুই দেশের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনা প্রশমনে এবং এ ঘটনার পেছনে দায়ীদের কয়েকজনকে বিচারের আওতায় আনতে সহায়তা করেছিল।
কিন্তু আজ সেই ‘সৎ মধ্যস্থতাকারী’ ভূমিকার সম্ভাবনা ক্রমেই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন মূলত বেইজিংয়ের প্রভাব মোকাবিলায় নয়াদিল্লিকে আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ হিসেবে পাশে পেতে চাওয়ায় ভারত-পাকিস্তান ইস্যু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে।
ট্রাম্প প্রশাসন প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানালেও, তাদের মনোযোগ সীমাবদ্ধ থেকেছে বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউক্রেন ও গাজায় সংঘাত এবং ইরানের সঙ্গে কূটনীতিতে। তদুপরি নয়াদিল্লি এখন তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকে পাকিস্তানের পক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করে এবং ইসলামাবাদও পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতায় সন্দিহান। ফলে একসময়কার কার্যকর যোগাযোগ চ্যানেলগুলোও এখন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমানে সেই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করার সম্ভাবনা ক্রমেই ফিকে হয় গেছে। বাইডেন প্রশাসন দিল্লিকে প্রশান্ত রাখার জন্য ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় নিজেদের দূরে রেখেছিল। এর কারণ হলো চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ওয়াশিংটন ভারতকে পাশে চেয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন নরেন্দ্র মোদির প্রতি জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করলেও তাদের মূল মনোযোগের কেন্দ্র বাণিজ্যযুদ্ধ, ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ এবং ইরানের সঙ্গে কূটনীতি।
এ ছাড়া তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতাকে ভারত আর স্বাগত জানাবে না, কারণ সেটাকে পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত বলে মনে করবে। ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ককে পাকিস্তান অবিশ্বাসের চোখে দেখে। ফলে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমটাও (যেটা একসময় গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে ভূমিকা পালন করত) এখন অকেজো হয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রকে এখন এটা বুঝতে হবে যে তার গুরুত্বপূর্ণ একটা স্বার্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এশিয়াতে আমেরিকার ভবিষ্যতের জন্য ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে এটা সত্য। মার্কিন প্রশাসনের কেউ কেউ হয়তো ভারতকে আরও একপাক্ষিকভাবে সমর্থন দেওয়ার এবং পাকিস্তানের সঙ্গে পুরোপুরি গুটিয়ে নেওয়ার অবস্থান নিতে পারেন। কিন্তু চীনের সঙ্গে ভারসাম্য, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তায় বড় অবদানকারী এবং বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে ভারতের কার্যকারিতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে; যদি ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যয়বহুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অনন্তকাল ধরে আটকে থাকে।
অন্যদিকে পাকিস্তান তাতে করে চীনের প্রভাব বলয়ে আরও বেশি ঝুঁকে যাবে। এতে করে ২৫ কোটি জনসংখ্যার একটি দেশ পাকিস্তানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ আরও কমে যাবে। আর এই জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশটিই এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজে ফলাফল নিয়ে আসবে এবং ভারতের চ্যালেঞ্জগুলো আরও গভীর হবে।
আসফান্দয়ার মির যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অবস্থিত স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ ফেলো।
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ বন দ ব অবস থ ন ক টন ত স ঘর ষ র জন ত র জন য র ওপর ভ রতক
এছাড়াও পড়ুন:
সহানুভূতি: একটি ভুলে যাওয়া সুন্নাহ
সহানুভূতি একটি শক্তিশালী মানবিক গুণ, যা আমাদেরকে অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আবেগ ও অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করে। তাদের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ বা ভয়ের মতো অনুভূতিগুলো নিজের মধ্যে অনুভব করা যায়।
সহানুভূতি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, যা রাসুল (সা.) তাঁর জীবনে বারবার প্রদর্শন করেছেন। সহানুভূতি অনুশীলনের পাঁচটি ধাপ নিয়ে আমরা আলোচনা করব, যা আমাদের জীবনে এই ভুলে যাওয়া সুন্নাহ পুনরুজ্জীবিত করতে সহায়তা করবে আশা করা যায়।
সহানুভূতি মানে অন্যের অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বোঝা।সহানুভূতি ও সমবেদনার পার্থক্যসহানুভূতি (এমপ্যাথি) ও সমবেদনা (সিমপ্যাথি) প্রায়ই একই মনে হলেও এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সমবেদনা হলো অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন বোধ করা বা তাদের দুঃখে দুঃখিত হওয়া। কেউ অসুস্থ হলে তার জন্য দুঃখবোধ করা সমবেদনা। কিন্তু সহানুভূতি এর চেয়ে গভীর।
সহানুভূতি মানে অন্যের অনুভূতি নিজের মধ্যে অনুভব করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি বোঝা। যেমন, একজন মা তার সন্তানের পড়ে যাওয়ার ব্যথা কেবল বুঝেন না, বরং নিজেও সেই ব্যথা অনুভব করেন। এই পার্থক্য বোঝা সহানুভূতির প্রকৃতি উপলব্ধি করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুনকীভাবে মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসব২৭ এপ্রিল ২০২৫সহানুভূতির প্রকারভেদসহানুভূতির তিনটি প্রধান ধরন রয়েছে, যা এই গুণটির বিভিন্ন দিক বুঝতে সাহায্য করে।
১. জ্ঞানগত সহানুভূতি
জ্ঞানগত সহানুভূতি হলো অন্যের পরিস্থিতিতে নিজেকে কল্পনা করা এবং তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করা। একজন শিক্ষক যখন দেখেন তার ছাত্র পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তিনি ছাত্রের স্থানে নিজেকে কল্পনা করে প্রশ্নপত্রের কাঠিন্য অনুভব করেন। এই ধরনের সহানুভূতি মানুষকে অন্যের অবস্থান বুঝতে এবং সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।
২. আবেগগত সহানুভূতি
আবেগগত সহানুভূতি হলো অন্যের আবেগ নিজের মধ্যে অনুভব করা। এটি দুঃখ, আনন্দ, ভয় বা রাগের মতো অনুভূতিগুলো নিজে অনুভব করে তাদের তীব্রতা বোঝা। যেমন, একজন মা যখন তার সন্তানের পড়ে যাওয়ার ব্যথা দেখেন, তিনি কেবল ব্যথার কথা চিন্তা করেন না, বরং সেই ব্যথা নিজের মধ্যে অনুভব করেন। এই ধরনের সহানুভূতি মানুষের মধ্যে গভীর সংযোগ তৈরি করে।
তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল, যিনি তোমাদের কষ্টে কষ্ট পান, তোমাদের কল্যাণে আগ্রহী এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়।সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮৩. নবীজির সহানুভূতি
মহানবী (সা.)-এর জীবন সহানুভূতির সর্বোচ্চ উদাহরণ। কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল, যিনি তোমাদের কষ্টে কষ্ট পান, তোমাদের কল্যাণে আগ্রহী এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়। ” (সুরা তাওবা, আয়াত: ১২৮)
রাসুল (সা.) কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, এমনকি অমুসলিমদের জন্যও উদ্বিগ্ন ছিলেন।
রাসুল (সা.)-এর জীবন থেকে সহানুভূতির উদাহরণ
তাঁর জীবন সহানুভূতির অসংখ্য উদাহরণে ভরপুর। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হলো:
১. ইকরিমা ইবন আবু জাহলের প্রতি সহানুভূতি
ইকরিমার পিতা আবু জাহল ছিলেন ইসলামের কট্টর শত্রু। বদরের যুদ্ধে তিনি নিহত হন। এই সংবাদে ইকরিমা গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং মক্কায় রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন। রাসুল (সা.) সাহাবীদের নির্দেশ দেন যেন তারা ইকরিমার পিতাকে ‘আবু জাহল’ (অজ্ঞতার পিতা) বলে না ডাকে, কারণ এটি ইকরিমার অনুভূতিতে আঘাত করতে পারে। (ইবনে হিশাম, আস–সিরাত আন–নাবাবিয়্যা, ৪/৩২)
এমনকি ইকরিমা ইসলাম গ্রহণ করলেও তিনি তার পিতার প্রতি তার সন্তানসুলভ ভালোবাসার প্রতি সম্মান দেখিয়েছিলেন। এটি সহানুভূতির একটি অসাধারণ উদাহরণ, যা দেখায় কীভাবে একজন নেতা শত্রুর সন্তানের প্রতিও সংবেদনশীল হতে পারেন।
আরও পড়ুনমহানবী (সা.)-এর প্রথম ক্রন্দন১১ জুন ২০২৫২. বিশর ইবনে উকবার প্রতি সান্ত্বনা
একটি সামরিক অভিযানে মদিনার একজন সাহাবী উকবা (রা.) শহীদ হন। অভিযান থেকে ফিরে আসা সাহাবীদের স্বাগত জানাতে রাসুল (সা.) মদিনার বাইরে যান। ছোট্ট বিশর তার পিতার জন্য অপেক্ষা করছিল, কিন্তু তার পিতাকে না দেখে সে বুঝতে পারে তার পিতা আর নেই। সে কাঁদতে থাকে। রাসুল তাকে দেখে তাঁর বাহন থেকে নেমে তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং বলেন, “কেঁদো না। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবা হবো এবং আয়েশা হবে তোমার মা।” (ইমাম বুখারি, আত–তারিখ আল–কাবির, ২/৭৮; আলবানি, আস–সিলিসলাহ আস–সাহিহাহ, ৭/৭৫৪)
এই ঘটনা রাসুল (সা.)-এর গভীর সহানুভূতির প্রমাণ, যেখানে তিনি একটি শিশুর দুঃখ নিজের মধ্যে অনুভব করে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন।
এ ছাড়াও হাদিসে আছে, তিনি শিশুর কান্না শুনে জামাতের নামাজ সংক্ষিপ্ত করতেন, যাতে মা অস্থির না হন (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৭৮) এবং একজন বেদুইন মসজিদে প্রস্রাব করলে তিনি তাকে শাসন না করে শান্তভাবে বুঝিয়েছিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৮৫)
এই ঘটনাগুলো দেখায় যে রাসুল (সা.) কেবল তাঁর অনুসারীদের জন্য নয়, শত্রু, শিশু, এমনকি অমুসলিমদের প্রতিও গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন।
কেঁদো না। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবা হবো এবং আয়েশা হবে তোমার মা।হাদিস, ইমাম বুখারি, আত–তারিখ আল–কাবির, ২/৭৮সহানুভূতি অনুশীলনের পাঁচটি ধাপসহানুভূতি অনুশীলনের জন্য পাঁচটি ব্যবহারিক ধাপ রয়েছে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই সুন্নাহকে প্রয়োগ করতে সাহায্য করতে পারে:
১. শোনা: কেউ যখন কিছু বলছে, তখন মনোযোগ দিয়ে শোনা উচিত। এটি সহানুভূতির প্রথম ধাপ, যেখানে আমরা অন্যের কথা পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করি।
২. বিচার না করা: শোনার সময় বিচার করা সহানুভূতির বিপরীত। আমাদের উচিত সাহায্য করার মনোভাব নিয়ে শোনা, বিচার করার জন্য নয়।
৩. বোঝা: অন্যের পরিস্থিতি এবং আবেগ বোঝার জন্য বিচক্ষণতার প্রয়োজন। এটি জ্ঞানগত সহানুভূতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৪. কল্পনা করা: নিজেকে অন্যের জায়গায় কল্পনা করে তাদের আবেগ অনুভব করা। এটি আবেগগত সহানুভূতির মূল।
৫. প্রতিক্রিয়া জানানো: সহানুভূতিশীল প্রতিক্রিয়া মানে অন্যের সমস্যার প্রতি উপযুক্তভাবে সাড়া দেওয়া, এমনকি সমাধান দিতে না পারলেও। এটি মানুষের মধ্যে আস্থা ও সংযোগ তৈরি করে।
সহানুভূতির সীমাবদ্ধতামনে রাখতে হবে, অতিরিক্ত সহানুভূতি কখনো কখনো ক্ষতিকর হতে পারে। রাসুল (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন যে মানুষকে খুশি করার আগে আল্লাহকে খুশি করা উচিত। এটা মনে রাখলে সহানুভূতি আমাদের একটি স্বাস্থ্যকর সীমার মধ্যে রাখবে। হাদিসে বলা হয়েছে, “তোমরা সকলেই দায়িত্বশীল, এবং তোমাদের প্রত্যেককে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৯৩)
তাই সহানুভূতি প্রকাশের পাশাপাশি আমাদের দায়িত্ব পালনেও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুনমহান আল্লাহর হাসি১১ জুলাই ২০২৫