কফি উইথ ফারাজ
‘তু আগার খুদকো ভি দেখেগা তো ডার যায়েগা—এই লাইনটার বাংলা আপনি কীভাবে করবেন?’ প্রায় বাটির মতো দেখতে ছড়ানো মুখের পেয়ালা থেকে প্রচুর দুধমালাইসমৃদ্ধ লাতেতে দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি। তিনি তখন মাত্র প্রথম চুমুক দিচ্ছেন নিজের আমেরিকানোতে। আমি যে ইউটিআই অ্যাটাকের ভয়ে তিন বছর আগে কফি ছেড়ে দিয়েছি, সে কথা আর তাঁকে বলিনি। কফিডেটে এসে পাইনঅ্যাপল জুস খাওয়ার কোনো মানে নেই।
তিনি হাসলেন। সুনীলের ভাষায় ‘স্মিতহাস্য’, যা থাকে প্রতিটি ব্যর্থ প্রেমিকের ঠোঁটে। ইনি একজন অনুবাদক। আমি এই কাজটা একেবারেই পারি না। থার্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টার কিংবা ফোর্থ ইয়ার ফার্স্ট সেমিস্টারে একটা কোর্স ছিল ‘ট্রান্সলেশন স্টাডিজ’ নামে। থিওরিতে মোটামুটি উতরে গেলেও প্র্যাকটিক্যাল অংশে আমি লাড্ডু মার্কা নম্বর পেতাম। এমএস সেই কোর্স পড়ানোর সময় বলেছিলেন, ছয় মাস ডুয়োলিঙ্গোতে একটা ভাষা শিখতে হবে আর সেমিস্টারের শেষে একটা রিপোর্ট লিখতে হবে। এসব আজিব আজিব প্রজেক্ট দেওয়া একমাত্র এমএসের পক্ষেই সম্ভব। আমার কাছে ব্যাপারটা বিরক্ত লাগছিল, কারণ আমি তখন ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের একটা গরুর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। তিন মাস গুঁতিয়ে ডুয়োলিঙ্গো থেকে আমার বিদ্যার্জন হলো, একটা স্প্যানিশ বাক্য—‘ইয়ো তেংগো উন গাতো’, মানে হচ্ছে ‘আমার একটা বিড়াল আছে’। এখন এই উর্দু জানা বুড়োর সামনে বসে সেই কথা মনে পড়ল কেন, কে জানে?
তৃতীয় চুমুক দিয়ে দেখলাম বুড়ো জানালার কাচে বৃষ্টির ধারা দিয়ে আঁকা বিবিধ আলপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাইরের সন্ধ্যা হয়ে আসা ব্যস্ত শহরের হঠাৎ বৃষ্টিতে থমকে থাকা ট্রাফিকের দিকে তাঁর নজর নেই। এখন কি আমি অনুমতি না নিয়ে তাঁর একটা ছবি তুলে ফেলব? নাকি বেশি ফাতরামি হয়ে যাবে? বেচারা সিনিয়র সিটিজেন। তবে এ কথা প্রায় নিশ্চিত যে তাঁর এই বেদনাক্লিষ্ট চেহারা দেখলে তিনি নিজেও চমকে যেতেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও বাইরে তাকাই। থেমে থাকা যানবাহনের সারিকে বৃষ্টিভেজা অর্ধস্বচ্ছ কাচের ভেতর থেকে দেখতে লাগছে একটা দীর্ঘ সরীসৃপের মতো। একটা গা ঝাড়া দিয়ে একটু এগিয়েই আবার ঝিমিয়ে পড়ল যেন লাল একটা অ্যানাকোন্ডা। আচ্ছা, সাপের উর্দু কী? জিজ্ঞেস করব এই জ্ঞানী বুড়োকে?
হামকো ফারিয়াদ কারনি আতি হ্যায়, আপ সুনতে নেহি তো কেয়া কিজে?
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ফার্মেসি ডিপার্টমেন্টের বেকুবটার কথা। এখন মনে পড়ার কারণ হলো, শুরুতে যখন হালকা ক্রাশ ছিল, সে বলেছিল ট্রান্সলেশন নাকি একটা অদরকারি বিষয়। সেদিন আমি বিকেলের বাসে শহরে যাব। ক্লাস থেকে সরাসরি গেছি বাস ধরতে। আমার আলুথালু চেহারা দেখেই মনে হয়, গরু জিজ্ঞেস করল ক্লাস ছিল কি না। আমি হ্যাঁ–সূচক উত্তর দেওয়ায়, অনেকটা ভদ্রতা করেই যেন, জানতে চাইল কী ক্লাস। আমি ট্রান্সলেশন স্টাডিজ বলায় সে ঠোঁট উল্টে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলল, ‘এই এআইয়ের যুগে ট্রান্সলেশন স্টাডিজ কেন পড়তে হবে? চ্যাটজিপিটিকে বললেই সবকিছু মুহূর্তের মধ্যে অনুবাদ করে দেয়।’ আমি আগেও দেখেছি সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ছেলেমেয়েদের মধ্যে আর্টস আর হিউম্যানিটিজের সাবজেক্টগুলোর প্রতি খুবই নিম্নধারণা থাকে। বোটানির রকিব একদিন বলছিল, ‘যে দেশে প্রফেশনাল থিয়েটারই নেই সেখানে সব ইউনিভার্সিটিতে কেন নাটক পড়াতে হবে? অযথা প্রতিবছর বেকার তৈরি করা, গভর্নমেন্টের পয়সা অপচয়।’ আমি মারমুখী হয়ে বলেছিলাম, ‘আর তোদের জন্য তো ঘোড়ার ঘাস কাটার চাকরি রেডি আছে সব করপোরেট অফিসে।’ কিন্তু এই বলদের প্রতি যেহেতু আমি অলরেডি দুর্বল হয়ে ছিলাম, তাই তর্ক না করে বললাম, ‘প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস, তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ—এই দুই লাইনের ইংরেজি কীভাবে করবে এআই?’
তখন মার্চ মাস চলে, লিটারেলি চৈত্র। যেকোনো গাধার বাচ্চাও বুঝবে যে আমি ওই লাইনগুলোর ইংরেজি জানতে চাইনি, তার সামনে আওড়াতেই চেয়েছি শুধু। আর চৈত্র মাসের কালচারাল ইফেক্ট যে এলিয়টের ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’ দিয়ে বোঝানো যায় না, সেই জ্ঞান ঝাড়ার ইচ্ছা আমার ছিল না আদৌ। কিন্তু সেই বুরবক পকেট থেকে ফোন বের করে বলল, ‘গিভ মি ওয়ান সেক।’ প্রথমে আমি ভাবলাম হয়তো ফোন এসেছে, পরে দেখি সে আসলেই ট্রান্সলেশন করতে লেগেছে। হুমায়ূন আহমেদ কোথায় যেন লিখেছিলেন, প্রেমে পড়ার পর প্রেমাস্পদ নাকি ফোঁত করে নাক ঝেড়ে সর্দি বের করলে সেটা দেখতেও ভালো লাগে। আমারও অনেকটা সে রকমই দশা হয়েছিল। এই ক্ল্যাসিক ‘বেকুবি’ দেখেও আমি হেসে ফেলেছিলাম, তামান্নাকে বলেওছিলাম পুরো কাহিনি। তামান্না হাসিমুখে বলেছিল, ‘সেদিন একটা মিম দেখলাম, লিখেছে পিপল শুড বি মোর কনসার্নড অ্যাবাউট ন্যাচারাল স্টুপিডিটি দ্যান আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।’ তখন আমার সামান্য মন খারাপ হয়েছিল। কারও ক্রাশের ব্যাপারে এমন চাঁছাছোলা মন্তব্য করাটা বেশ রুড কিন্তু।
সেদিন চৈত্র মাসের শেষ বিকেলের রোদে হাবাটাকে দেখতে দারুণ লাগছিল। একটা কালো টি–শার্টের ওপর ধূসর রঙের ফুলহাতা শার্ট ছিল গায়ে, হাতা দুটো কনুই পর্যন্ত গোটানো, পরনে ফেডেড ডেনিম আর পায়ে ফিতাওয়ালা সেমিফরমাল ব্রাউন জুতা। আমার মনে হচ্ছিল পুরো ক্যাম্পাসে এর চেয়ে সুদর্শন যুবক আর একটিও নেই।
তুলনায় এই উর্দুজ্ঞানী বুড়ো বেশ প্লেইন-লুকিং। থুতনিতে একটা স্টাইলিশ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি যদিও আছে। সাদা ড্রেস শার্টে খুব সূক্ষ্ম স্ট্রাইপ আর প্যান্টটা ঠিক কালো না আবার গ্রে–ও না। জগতে কত যে রঙের শেড আছে, বাংলায় সব কটির প্রতিশব্দ পর্যন্ত নেই। ক্রিমসন, স্কারলেট, ভার্মেলিয়ন, রুবি—সব কটিকেই বাংলায় ‘লাল’ বলতে হয়।
আমি মনে মনে বুদ্ধিদীপ্ত একটা কথা খুঁজতে থাকি বলার জন্য। ‘কী ভাবছেন?’–এর মতন বোকা বোকা প্রশ্ন তো আর করা যায় না। বুড়োর বউ মরে গেছে কিছুদিন আগে। ওভারিয়ান ক্যানসারে বেশ কিছুদিন ভুগেটুগে। মৃত স্ত্রীর কথাই যদি ভাবতে থাকেন, সে কথা কি আর বলবেন আমাকে এখন?
‘পেস্ট্রি খাবেন?’
বুড়ো আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন, সম্ভবত ভাবছিলেন অন্য কোনো কথা। আমার প্রশ্নে একটু যেন চমকেই গেলেন, বললেন, ‘আমার তো সুগার হাই, মিষ্টি কিছুই খাই না। তুমি খাও।’ আমি নিজেও যে কঠিন ডায়েট করি আর চিনিযুক্ত কোনো কিছুই খাই না, সে কথা বললাম না। আসলে তো কিছু একটা বলতে হয় বলে বলেছি, কফি খাওয়ার পর মিষ্টি জিনিস খায় কোন গাড়ল? আমি হেসে বললাম, ‘নাহ, একা একা খেতে ভালো লাগে না।’ তিনি আবার হাসলেন।
আই ওয়ানা হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড
সাহিত্যের সর্বজনীনতা নিয়ে সন্দিহান ছিলাম না বলেই হয়তো, রবীন্দ্রনাথ কপচে নির্দোষ ফ্লার্ট করতে গেছিলাম ফার্মেসি বিভাগের স্টুপিডটার সঙ্গে। তাতে যখন কাজ হয়নি, আমি ঠিক করেছিলাম গান শুনিয়ে সিডিউস করব। পরদিন বাসে উঠে তক্কে তক্কে থাকলাম, ইডিয়টটার ঠিক পাশের সিটটা বাগিয়ে ফেললাম। শহরে যেতে অন্তত ৫০ মিনিট লাগে। জ্যাম থাকলে আরও বেশি। এতক্ষণে কোনো একটা উছিলায় একটা আলাপ তুলে একটা কোনো রোমান্টিক গান শুনিয়ে দেওয়াই হয়তো যাবে। আমার লিস্টে কয়েকটা গান ছিল। নাম্বার ওয়ান বিটলসের ‘আই ওয়ানা হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড’, নাম্বার টু নুসরাত ফতেহ আলি খানের গাওয়া ‘ইয়ে শাম ফির নেহি আয়েগি’ আর নাম্বার থ্রি ঘুড্ডি ছবির সেই বিখ্যাত গান, ‘আবার এল যে সন্ধ্যা’। কিন্তু সেই সায়েন্স ফ্যাকাল্টির মূর্খটা দেখলাম আমাকে জানালার দিকের সিট ছেড়ে দিয়ে আইল সিটে বসে আশপাশের বন্ধুদের সঙ্গে ফাটিয়ে আড্ডা দেওয়া শুরু করেছে। আমি যে একটা মানুষ পাশে বসে আছি, কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই।
একবার ভাবলাম, ঘুমের ভান করে গড়িয়ে পড়ব কি না গায়ের ওপর। বিকেলের বাসে অনেকেই ঘুমায়। সকালে ক্লাস থাকলে তো আগের দিনের ঘুমের ঘাটতি দুপুরের দিকে আক্রমণ করে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু অতটা ছিনালিপনা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমি মোটামুটি ২০–২৫ মিনিট চুপচাপ অপেক্ষা করলাম। কানে হেডফোন গুঁজে দিলেও আসলে গান শোনার চেয়ে বেশি খেয়াল ছিল সেই ছাগলটার গতিবিধির দিকে। যথেষ্ট সরে বসেছিল সে, একটা পা প্রায় পুরোটাই বাইরে ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনোমতেই যেন গায়ে গা লেগে না যায় তেমন একটা সম্মানজনক দূরত্ব রেখে আরকি। আমার খুব আক্ষেপ হলো সেদিন কেন বৃহস্পতিবার না। বৃহস্পতিবারের বিকেলের বাসে গাদাগাদি ভিড় হয়। আলে অনেকে দাঁড়িয়ে থাকে। না চাইলেও চেপে বসতে হয়। বৃষ্টির দিনও না যে জানালা দিয়ে ছাঁট আসবে আর আমি নিজেই সেই উছিলায় চেপে যাব ভেতরের দিকে।
ওর গা থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছিল, আমি শুধু প্রাণপণে সেই বাতাসটুকুকেই নিজের ভেতর নিতে চাইলাম। পল ম্যাকার্টনি আর জন লেনন তখন গেয়ে যাচ্ছেন,
ওহ ইয়ে আই’ল টেল ইউ সামথিং
আই থিংক ইউ’ল আন্ডারস্ট্যান্ড
হোয়েন আই সেই দ্যাট সামথিং
আই ওয়ানা হোল্ড ইয়োর হ্যান্ড।
‘আপনি কি বিটলস ফ্যান?’ হ্যাঁ–সূচক উত্তর পাওয়া যাবে নিশ্চিত ছিলাম। এই বুড়ো বয়সে প্রায় আমার কাকাদের সমান। ওদের সময়ে সবাই বিটলস আর মাইকেল জ্যাকসনই শুনত। কেউ কেউ বব ডিলান কিংবা এরিক ক্ল্যাপটন। কিন্তু ইনি যে জ্ঞানী, পপ অথবা রক এন রোলে হয়তো আগ্রহই না থাকতে পারে তাঁর, সে কথা মনে ছিল না। তিনি বললেন, ‘অতও না। কিন্তু কেন বল তো? তুমি বিটলস ফ্যান?’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। ওদের একটা চমৎকার গান আছে, শুনবেন?’
‘এখন? এখানে?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা কী? ইয়ারফোন আছে তো’। আমি ব্যাগ থেকে ইয়ারবাডসের পাউচ বের করলাম। বুড়ো ইতস্তত করতে লাগলেন। খোদা, এর শুচিবায়ু আছে নাকি? অন্যের ব্যবহৃত ইয়ারবাডস কানে গুঁজতে ঘেন্না লাগে?
ম্যায় ইশক লিখু তুঝে হো যায়ে.
..
সেদিন দুই ব্যাচ সিনিয়র সেই গাধাটাকে কোনোমতেই আকৃষ্ট করতে না পেরে আমি বেশ হতাশ হয়েছিলাম। জীবনে অল্প দু–একবার দু-একজন পুরুষের প্রতি আগ্রহ হয়েছে আমার। কোনোবারেই ব্যাটেবলে মেলেনি। যে কারণে বয়স ২৬ পেরিয়ে ২৭ হওয়ার পরে, মাস্টার্স শেষ করে চাকরি শুরু করার পরও আমার একটা প্রেম হলো না আজও। আমার প্রাণের বান্ধবী তামান্না ক্যাম্পাসে থাকতে বেশ ধুন্ধুমার প্রেম করেছে অন্তত দুই দফা। দ্বিতীয় প্রেমিককে বিয়েও করে ফেলেছে। এই উর্দুজানা জ্ঞানী বুড়োর সঙ্গে কফিডেটে যাওয়ার কথা এখনো ওকে বলিনি। বললে হয়তো ও হেসে বলত, ‘লোলিটা সিনড্রোমে ভুগছিস কেন রে? শেষ পর্যন্ত অশীতিপর বৃদ্ধ?’ তামান্না খুবই ঠোঁটকাটা। লোকের মন রেখে কথা বলা ওর ধাতে নেই। এই ভদ্রলোকের বয়স ষাটের ওপর হতে পারে, নিচেও হতে পারে। আমি ঠিক জানি না। অনেকের চুল–দাড়ি চল্লিশেই পেকে যায়। এর সাদা ফ্রেঞ্চকাট আর প্রশস্ত হতে থাকা কপালের ওপর নব্বই ভাগ সাদা আর দশ ভাগ কালো চুল দেখে ষাট–বাষট্টিই মনে হচ্ছে অবশ্য, অশীতিপর বলা যাবে না কিছুতেই।
সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘তোমার কি দেরি হয়ে যাচ্ছে? উঠবে?’
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছিল সত্যিই। কিন্তু ওঠার ইচ্ছা ছিল না। আমি বললাম, ‘আরেকটু পরেই যাই, এখন ভীষণ রাশ।’ কিন্তু বসে থেকেই–বা আর কী করতাম। উনি তো কথাবার্তা প্রায় বলেনইনি কিছু। আমিই যা একটু–আধটু বললাম। উর্দু কীভাবে শিখলেন, কেন শিখলেন, উর্দু শের বাংলা অনুবাদ করে ফায়দা কী—এই সব হাপঝাপ কথাবার্তা আরকি। স্ত্রীর মৃত্যু নিয়ে বেশি কিছুই জিজ্ঞেস করিনি। এই ব্যাপারে কথা বলতে নিশ্চয়ই তাঁর ভালো লাগবে না। ফেরার সময় তিনি বললেন, ‘বৃষ্টি বেশ জোরেই এসেছে, আমি তোমাকে নামিয়ে দিই, কোন দিকে যাবে?’
তখন আমার আক্ষেপ হলো, তাহলে তো আরও আগেই ওঠা যেত। ক্যাফের টেবিলে একগাদা লোকের সামনে বসে থাকার চেয়ে গাড়ির ভেতর কাছাকাছি বসা যেত আরও বেশিক্ষণ। জ্যাম থাকলেই বরং ভালো।
গাড়িতে উঠে আমি বললাম, ‘এখন গান বাজাই?’
উনি আবার সেই প্রায় অদৃশ্য স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, ‘শিওর’।
ব্লুটুথ কানেক্ট করে আমি গান খুঁজতে থাকলাম। গাড়ির ভেতরে তাঁর কোলনের মৃদু সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এতক্ষণ নাকে আসেনি সেটা। ইশক চালালে কি টু অবভিয়াস হয়ে যাবে? নাকি গারাজ বারাস সাওয়ান গির আয়ো চালাব?
কিন্তু আমি এত অ্যাটেনশন নেওয়ার চেষ্টাই–বা কেন করছি? ইনি নিজে একজন ট্রান্সলেটার, আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজই তো এর অনুবাদ করতে পারার কথা। সায়েন্স ফ্যাকাল্টির সেই ডামিটার মতন চোখের ভাষাও কি বুঝবেন না?
অবশ্য সব অনুভূতির যেমন অনুবাদ হয় না, সব অভিব্যক্তিও তো অনুবাদযোগ্য নয়।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: জ জ ঞ স কর বল ছ ল অন ব দ বলল ম র ওপর র একট বলল ন
এছাড়াও পড়ুন:
ইরানে অব্যবহৃত বোমা ফেলা হতো গাজায়
ইরানের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নেওয়া ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানগুলো অব্যবহৃত বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র অবতরণের আগে গাজায় নিক্ষেপ করত। দেশটিতে সামরিক অভিযান শুরুর প্রথম প্রহর থেকেই তেল আবিবে ফেরার পথে অবশিষ্ট গোলাবারুদ হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন পাইলটরা। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) কমান্ডারদের এ প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন। তারা যুদ্ধবিমানগুলোর অবশিষ্ট লক্ষ্যবস্তু করেছিলেন গাজাকে। এ কারণে ইরানের সঙ্গে যে ১২ দিনের লড়াই চলাকালে গাজায়ও ব্যাপক বিমান হামলা ও প্রাণহানি ঘটে।
সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ইসরায়েলের নির্বিচারে বোমা ফেলার বিষয়টিকে আবারও সামনে এনেছে। এসব বোমায় নিহত প্রায় সবাই বেসামরিক নাগরিক; বিশেষ করে নারী ও শিশু।
আইডিএফের মূল লক্ষ্য ইরানে স্থানান্তরিত হওয়া সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় তার বিমান হামলার তীব্রতা অনেকাংশে বজায় রাখতে সক্ষম হয়। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলছে, প্রাথমিকভাবে এ নিয়ে পরিকল্পনা থাকলেও এসব হামলা যথাযথভাবে পরিকল্পিত ছিল না; এগুলো ‘বৈধ লক্ষ্যবস্তু’তেও আঘাত হানেনি।
গত ১৪ থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত ইরানে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ পরিচালনা করে ইসরায়েল। এ সময় আন্তর্জাতিক দৃষ্টি তেহরানেই নিবদ্ধ ছিল। তবে সময়টি গাজার বেসামরিক নাগরিকদের জন্যও ছিল তীব্র রক্তক্ষয়ী। তখন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতেও ব্যাপক গুলিবর্ষণ করেছে ইসরায়েল। বিমান হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে সামগ্রিকভাবে ত্রাণ সহায়তা কেন্দ্রে গুলিবর্ষণসহ বিমান হামলায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা শত শত।
গত ১৮ জুন বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানায়, গাজার মাগাজি শরণার্থী শিবিরে আইডিএফ বিমান হামলায় এক নারী ও তাঁর শিশুসহ ১০ জন নিহত হন। আল-আত্তারের একটি তাঁবুযুক্ত এলাকায় খান ইউনিসে একই দিনে একটি বিমান হামলায় পাঁচজন নিহত হয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, আইএএফ কমান্ডার মেজর জেনারেল তোমের বার গোলাবারুদ অবশিষ্ট আছে– এমনটা জানতে পেরে তা ব্যাপকভাবে গাজায় ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
৬১৩ ত্রাণপ্রত্যাশীকে হত্যা, জানাল জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস বলছে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কথিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন-জিএইচএফ গাজায় ত্রাণ নিতে আসা ৬১৩ জনকে হত্যা করেছে। জিএইচএফের বিতর্কিত ত্রাণকেন্দ্র এবং এর ‘মানবিক’ কনভয়ের কাছাকাছি অথবা উভয় স্থানেই ক্ষুধার্ত এ ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হয়। এ পরিসংখ্যান গত ২৭ জুন পর্যন্ত। এরপর আরও ঘটনা ঘটেছে।
গতকাল শুক্রবার জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) কার্যালয়ের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে আলজাজিরা জানায়, মৃতের সংখ্যা ৬৫০ জনেরও বেশি। আর ৪ হাজার জনের বেশি আহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের বারণ সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে গাজায় গত মে মাসের শেষ দিকে অস্ত্র হাতে ত্রাণ বিরতণ শুরু করে জিএইচএফ। জাতিসংঘ বলছে, যে প্রক্রিয়ায় ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে, তা নিরপেক্ষ নয়। আর মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ পদক্ষেপকে ‘মানুষ হত্যার কসাইখানা’ বলে অভিহিত করে নিন্দা জানিয়ে আসছে।
গাজার একজন বেসামরিক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, তারা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার প্রমাণ রেকর্ড করেছেন। এ কেন্দ্রগুলোতে ৬০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। কিছু ফিলিস্তিনিকে ইসরায়েলের স্নাইপাররা গুলি করে। অন্যরা সাহায্যপ্রার্থী পরিবারগুলোকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায়।
আরও ১৩৮ জন নিহত
গতকাল শুক্রবার ভোর থেকে গাজায় ইসরায়েল বাহিনীর হামলায় আরও ১৩৮ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪৫২ জন। এর মধ্যে দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস, আল-মাওয়াসি উপকূলীয় এলাকায় অস্থায়ী তাঁবুতে ধারাবাহিকভাবে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হামলায় ১৫ জন নিহত হন। এক সময় ইসরায়েল কর্তৃক এটাকে তথাকথিত ‘মানবিক নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করেছিল। এখন সেই ‘নিরাপদ অঞ্চলকেই’ সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ করে তুলেছে তারা।
হামলায় ফিলিস্তিনি ফুটবল তারকা নিহত
মিডল ইস্ট আই জানায়, গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত ৫৭ হাজার ২৬৮ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬২৫-এর বেশি। গত বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি ফুটবল তারকা মুহান্নাদ ফাদল আল-লেই নিহত হন। চলতি সপ্তাহের শুরুতে মধ্য গাজার আল মুগাজি শরণার্থী শিবিরে হামলায় তিনি আহত হন। তিনি ফিলিস্তিনের জাতীয় ফুটবল দলের সদস্য ছিলেন। এ নিয়ে ইসরায়েল ২৬৫ ফিলিস্তিনি ফুটবলারকে হত্যা করল।
যুদ্ধবিরতি বিবেচনা করছেন হামাস নেতা
চলমান পরিস্থিতিতে হামাস নেতারা গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবিত চুক্তি বিবেচনা করছেন। একটি ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য গার্ডিয়ান অনলাইন গতকাল শুক্রবার জানায়, হামাস নেতারা একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর কাছাকাছি রয়েছেন। তবে তারা আরও দৃঢ় নিশ্চয়তা চান যে, এ যুদ্ধবিরতি ২০ মাস ধরে চলা যুদ্ধের স্থায়ী অবসান ঘটাবে।
হামাস কর্মকর্তারা বৃহস্পতিবার তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হন। পরে এক বিবৃতি জারি করে নিশ্চিত করেন যে, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া ঘোষণার আগে অন্য ‘ফিলিস্তিনি দলগুলোর’ সঙ্গে কথা বলছেন।
মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে ইসরায়েল। এতে ৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তীব্র মানবিক সংকট আরও খারাপ হয়েছে। গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চূড়ান্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্তাবলি মেনে নিয়েছে।
ইসরায়েলের আরেক সেনা নিহত
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গতকাল শুক্রবার জানিয়েছে, গাজায় তাদের আরেক সেনা নিহত হয়েছেন। আসাফ জামির নামে ১৯ বছর বয়সী ওই সেনা সদস্য দক্ষিণ গাজায় নিহত হন। আহত হয়েছেন দু’জন। আলজাজিরা জানায়, গাজায় এ পর্যন্ত ৮৮০ জনেরও বেশি ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় নিহত হন ৩২০ জন।