মাসিক নিয়ে অসচেতনতা এসডিজি অর্জনে বাধা
Published: 16th, May 2025 GMT
মাসিক নিয়ে অসচেতনতা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। ১৭টির মধ্যে অন্তত ৬টি লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে। উন্নয়নকর্মীরা মনে করেন, মাসিক নিয়ে সমাজে যে ট্যাবু আছে, তা ভাঙতে হবে।
মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ। এ সংস্থার উপপরিচালক শাহনাজ সুমি জানান, মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার চিহ্নিত সমস্যাগুলো দূর করতে না পারলে এসডিজির বেশ কয়েকটি লক্ষ্য অর্জন ব্যাহত হতে পারে। এর মধ্যে ৩ (সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ), ৪ (মানসম্মত শিক্ষা), ৫ (লিঙ্গ সমতা), ৬ (নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন), ৮ (শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি) এবং ১২ (পরিমিত ভোগ ও উৎপাদন) নম্বর ধারা উল্লেখযোগ্য। এসব লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সম্মিলিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মাসিক হলেই বিয়ে
আদমশুমারি অনুযায়ী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাক্ষরতার হার ৪৫ দশমিক ৩ ভাগ। কন্যাশিশুরা বাল্যবিয়ের শিকার। মাসিক শুরু হলে কয়েকটি গ্রামে কন্যাশিশুদের বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য করা হয়। মেরকুটার আসমার বিয়ে হয় ১১ বছর বয়সে। বর্তমানে তিন সন্তানের মা তিনি। আসমা সমকালকে বলেন, ‘লেখাপড়া কইরা চাকরি করার ইচ্ছা ছিল; কিন্তু বাবা-মা সেই সুযোগ দেন নাই। কারণ মাইয়া মাইনষের মাসিক অইলে নাকি তারে আর ঘরে রাখতে নাই। বিয়া দিওন লাগে।’
শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া নয়; সিলেট, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বরগুনা ও জামালপুরে মাসিক নিয়ে এমন কুসংস্কার ধারণ করা হয়। এসব জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাসিক শুরু হলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সমাজে ট্যাবু
মাসিকের সময় আদিবাসী নারীদের মধ্যে ট্যাবু কাজ করে। অপবিত্র ও ধর্মীয় কাজে অংশগ্রহণের অনুপযোগী বিবেচনা করা হয়। ডিম খাওয়া নিষেধ। খাবার স্পর্শ করতে পারে না। খোলা চুলে বাইরে বের হওয়া যায় না। মাসিক চলাকালে ঘরে কোণঠাসা করে রাখা হয়। স্যানিটারি ন্যাপকিন নয়, তারা পুরোনো কাপড়ের টুকরো ব্যবহার করেন।
আদিবাসী অধিকারকর্মী ডালিয়া চাকমা বলেন, আদিবাসীদের মধ্যে এখনও ৪০ ভাগ কিশোর-কিশোরী মাসিক সম্পর্কে জানেন না। এ সময় কী ধরনের স্বাস্থ্যসেবা বা যত্ন নিতে হয়, তাও জানেন না। মাসিক নিয়ে অসচেতনতা ও ট্যাবুর কারণে এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ কন্যাশিশু ও কিশোরী দীর্ঘমেয়াদি প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।
হতে পারে জরায়ুমুখে ক্যান্সার
মাসিক হলো নারীর শারীরবৃত্তীয় প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এর সঙ্গে শরীরে নিঃসৃত হরমোনের সরাসরি যোগ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা.
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম কাজল বলেন, ‘মাসিকের সময় কেবল পরিচ্ছন্নতা এবং সচেতনতার অভাবে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন অপরিষ্কার কাপড় ব্যবহারের ফলে নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার, ইনফেকশন, যৌনাঙ্গে ঘা, চুলকানি, অস্বাভাবিক সাদা স্রাব প্রভৃতি শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। শারীরবৃত্তীয় এসব নানা জটিলতায় দেশে প্রতিবছর ১৩ হাজার নারী মারা যাচ্ছে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে।’
স্কুল থেকে ঝরে পড়ে কিশোরী
পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে কিশোরী ও নারীরা প্রজননতন্ত্রের নানা সংক্রমণে ভোগেন। শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ওয়াটারএইডের এক সমীক্ষায় জানা গেছে, দেশের ৮২ শতাংশ স্কুলে মাসিক ব্যবস্থাপনায় যথাযথ সুযোগ নেই। এদিকে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেজলাইন জরিপ অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ মেয়েশিক্ষার্থী তাদের মাসিককালে স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। পারিবারিক পর্যায়েও কিশোরী ও নারীরা অনেক টয়লেট বা বাথরুমে পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পানি ব্যবহার করার সুযোগ পান না। মাসিকের কাপড় প্রায়ই শুধু পানিতে ধুয়ে ব্যবহার করেন, যা সাবান ও পরিষ্কার পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো উচিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেগুলো লুকিয়ে শুকানো হয়। ফলে যথাযথভাবে শুকায় না। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
এদিকে কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিতকরণে ২০২১ সাল থেকে কাজ করছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। তাদের ২০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভলান্টিয়ার পিয়ার লিডার মডেল যুক্ত করেছে সিরাক-বাংলাদেশ।
এ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক এস এম সৈকত জানান, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ইউএসএইড সুখী জীবন প্রকল্পের অধীনে সিরাক বাংলাদেশ ২০টি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করে। ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কেন্দ্রগুলোর আশপাশের এলাকা ও বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর মধ্যে কৈশোরবান্ধব প্রজনন ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সচেতনতা বাড়ানো হয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জ
২০২১ সালের জাতীয় ঋতুকালীন স্বাস্থ্য কৌশল প্রণয়ন করে সরকার। তবে তা বাস্তবায়ন হয়নি। প্রথা, সংস্কার, ভ্রান্ত ও নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা নারী ও কিশোরীদের মাসিক স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় বাধা। এ ক্ষেত্রে সাশ্রয়ী, মানসম্পন্ন, নিরাপদ ও পুনঃব্যবহারযোগ্য পণ্যের অভাব রয়েছে। সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। পানি ও স্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই। বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জাতীয় কৌশল ২০১৭-২০৩০-এ কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য,
পুষ্টি, সহিংসতা ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব
দিলেও কার্যকর বাস্তবায়ন নেই। এ জন্য বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসংক্রান্ত জাতীয় কৌশল পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রজনন স ব স থ য ব যবহ র লক ষ য
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে প্রজনন হার হঠাৎ বাড়ছে
বাংলাদেশ কি উল্টো পথে হাঁটছে? দেশের নারীদের মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট (টিএফআর) এখন ২ দশমিক ৪। বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করে প্রজনন হার কমিয়ে ২ দশমিক ১৭ করতে পেরেছিল। এখন আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে এই উল্টো যাত্রা আগে কখনো দেখা যায়নি।
একজন নারী তাঁর প্রজনন বয়সে (১৫ থেকে ৪৯ বছর) যত সন্তানের জন্ম দেন, সেটাকে বলা হয় মোট প্রজনন। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের নারীরা গড়ে ছয়টি বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিতেন। পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ টিএফআর কমানোর চেষ্টা করেছে। অর্থনীতি ও স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের বড় অর্জনের একটি এই জন্মহার কমানো।
গতকাল রোববার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফ যৌথভাবে মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (মিকস) ২০২৫ প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ময়মনসিংহ বিভাগে প্রজনন হার সবচেয়ে বেশি, ২ দশমিক ৮। সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে, ২ দশমিক ২। সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারের নারীদের মধ্যে এবং কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর নারীদের মধ্যে টিএফআর বেশি।
টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারেজনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলামস্বাধীনতার পর বাংলাদেশে টিএফআর ছিল ৬ বা তার বেশি। মিকস ও অন্যান্য উৎসের তথ্য ব্যবহার করে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে টিএফআর ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৭। এরপর তা কমতে থাকে। ১৯৯৪ সালে টিএফআর কমে হয় ৩ দশমিক ৪। টিএফআর আরও কমতে থাকে, ২০০৪ সালে তা কমে হয় ৩। ২০১২ সালে ছিল ২ দশমিক ৩ এবং ২০২২ সালেও একই হার। ২০২৪ সালের দিকে তা ছিল ২ দশমিক ১৭ বা তার কাছাকাছি।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে টিএফআর কখনো কমতে দেখা যায় না। হয় ক্রমাগত কমেছে, না হয় কয়েক বছর ধরে স্থির অবস্থায় ছিল। যেমন ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।
টিএফআর কীভাবে কমেছিলস্বাধীনতার পর জনসংখ্যাকে বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ভাবা হয়েছিল অধিক জনসংখ্যা জাতীয় অর্থনীতির বাধা। সরকার জনসংখ্যা কমানোর নীতি গ্রহণ করে। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়। মানুষের হাতের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কর্মকৌশল দেওয়া হয়। পাশাপাশি ব্যাপক জনসচেতনতা কর্মকাণ্ড চালু করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশন ও বেতার এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। পরিবার পরিকল্পনা মাঠকর্মী ছাড়াও এনজিওরা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
গত কয়েক দশকে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বেড়েছে। মানুষ সহজে হাতের কাছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা দোকান থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কিনতে পারে। এর পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বেড়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এসব উপাদানও টিএফআর কমাতে সহায়তা করেছে।
১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত টিএফআর ৩ দশমিক ৩ ছিল। আবার ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টিএফআর ২ দশমিক ৩ ছিল। অর্থাৎ এক দশক ধরে টিএফআর স্থির ছিল। টিএফআর কেন কমছে না, তা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে।বাংলাদেশের উদ্দেশ্য ছিল টিএফআর ২ দশমিক ১–এ নিয়ে যাওয়া; তা হয়নি। টিএফআর বেড়ে যাওয়ার অর্থ জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়া। বাংলাদেশ এমনিতেই জনবহুল দেশ। তারপরও জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ার ঝুঁকি আছে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে।
জনসংখ্যাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিএফআর বাড়ছে, এর অর্থ আমাদের পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম ঠিকভাবে চলছে না। এটা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যাবিষয়ক নীতি ও কর্মকৌশল সঠিক পথে নেই। এমনিতেই দেশে বেকারত্ব বেশি। টিএফআর বৃদ্ধি দেশের সার্বিক উন্নয়নকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিতে পারে।’