শালবনে আবার শালগাছই ফেরত আনা হবে: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
Published: 25th, May 2025 GMT
টাঙ্গাইলের মধুপুরের শালবনকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে বন বিভাগ। বনটির সীমানা চিহ্নিত করে সেখান থেকে আগ্রাসী প্রজাতির (ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি) গাছ পর্যায়ক্রমে বিলুপ্ত করা হবে। সেখানে শাল (গজারি) ও এর সহযোগী গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক শালবনটি আবার আগের রূপে ফিরিয়ে আনা হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ কথা জানিয়েছেন। আজ রোববার মধুপুর বনে শালগাছের চারা রোপণ, বনের সীমানা চিহ্নিতকরণ কার্যক্রম উদ্বোধন এবং ময়ূর ও কচ্ছপ অবমুক্তকরণের মধ্য দিয়ে মধুপুর শালবন পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রকল্পের কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় তিনি এ কথা বলেন।
বনের টেলকী এলাকায় শাল ও এর সহযোগী গাছের চারা রোপণের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, শালবনে আবার শালগাছই ফেরত আনা হবে। সে কার্যক্রমটা শুরু করার একটি উপায় হচ্ছে বর্ষাকালে শালগাছ লাগিয়ে দেওয়া। সে কাজটা শুরু হলো। এটা টেকসই করার অনেক উপায় আছে। একটা উপায় হচ্ছে যাঁরা বনে বসবাস করেন, তাঁদের এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। প্রথমে যে কাজটি করা হচ্ছে, সেটা হলো শালবনের সীমানা চিহ্নিতকরণ। অনেক জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। বেদখল অর্থ এই নয় যে এখানে যাঁরা বনে বসবাস করেন, তাঁরাও দখলদার।
শালবন থেকে ইউক্যালিপটাসগাছ ক্রমান্বয়ে সরিয়ে সেখানে শাল ও তার সহযোগী গাছগুলো ৭০/৩০ অনুপাতে আনা হবে জানিয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বনে বসবাসকারীদের সঙ্গে বন বিভাগের মামলা–মোকদ্দমা আছে। তিনি ১২৯টি মামলা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। তারপর ক্রমান্বয়ে তাঁরা দেখবেন। অনেক মামলায় বন বিভাগের শুধু শুধু অনেক টাকা ও সময় ব্যয় হয়; কিন্তু ফল আসে না, সে মামলাগুলো প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। তবে জমি দখলের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা অত সহজ নয়, সময়সাপেক্ষ বিষয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, তাঁরা মনে করেন, বন বিভাগের সঙ্গে বনে বসবাসকারীদের দূরত্ব যদি তাঁরা ঘোচাতে পারেন, তাহলে তাঁরাই অংশগ্রহণ করে, তাঁরাই সতর্ক অবস্থান নিয়ে এ বনটিকে আবার ফিরিয়ে আনবেন।
শালগাছের চারা রোপণের পর সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মধুপুর বনাঞ্চলের রাজাবাড়ী এলাকায় সীমানা পিলার স্থাপনের মধ্য দিয়ে বনভূমির সীমানা চিহ্নিতকরণের কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। পরে লুহুরিয়া এলাকায় হরিণ প্রজননকেন্দ্রে নির্মিত শেডে ১০টি ময়ূর এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে ৭৩টি কচ্ছপ অবমুক্ত করেন। বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ময়ূরগুলো আপাতত শেডে আবদ্ধ করে রাখা হবে। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর উন্মুক্ত বনে ছেড়ে দেওয়া হবে।
দুপুরে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মধুপুরের দোখলা জাতীয় উদ্যান মাঠে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে বন বিভাগ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় বক্তব্য দেন গারো জাতিগোষ্ঠীর প্রবীণ নেতা অজয় এ মৃ, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক, ছাত্রনেতা টনি রিছিল প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য দেন টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বন্য প্রাণী–বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ আলী রেজা খান, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো.
জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, ‘বনে বসবাসকারীদের সম্পৃক্ত করে মধুপুরের শালবনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ বন বিভাগ নিয়েছে। এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এর মধ্য দিয়ে বনে বসবাসকারী আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি।’
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: বন ব ভ গ র র শ লবন র জওয় ন পর ব শ বসব স
এছাড়াও পড়ুন:
বরফ গলে মেরু এলাকায় নতুন বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ
তাপপ্রবাহ, ওজোন গ্যাসের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর দুই মেরু এলাকার বরফ গলে যাচ্ছে। তবে উত্তর মেরুর আর্কটিক সাগরের গলিত বরফ ভিন্ন ধরনের লুকানো বাস্তুতন্ত্র প্রকাশ করছে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করে শৈবালের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে দেখা গেছে। পুরু বরফের নিচে এই প্রক্রিয়া অসম্ভব বলে মনে করা হলেও এখন আর্কটিকের খাদ্যশৃঙ্খল ও বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন শোষণের জন্য এই প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন নতুন বাস্তুতন্ত্র জলবায়ুগত সুবিধা দেবে নাকি নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে আসবে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।
আর্কটিক মহাসাগরকে দীর্ঘকাল ধরে হিমায়িত ও প্রাণহীন একটি সীমান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন এই অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ গলতে শুরু করেছে, তখন পানির নিচ থেকে আশ্চর্যজনক নতুন নতুন সব তথ্য জানা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, গলিত বরফ আসলে শৈবালের বৃদ্ধি বাড়িয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। এই শৈবালই মহাসাগরের খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি তৈরি করে। সেখানকার নতুন পরিবেশ আমাদের গ্রহের সংবেদনশীল জলবায়ু ভারসাম্যের জন্য সহায়ক হবে নাকি ক্ষতিকারক হবে, তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।
জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউট ও কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল আর্কটিক মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া পুরু আর্কটিক বরফের নিচে ঘটতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবনের সহায়ক রূপে রূপান্তর করে। এই রূপান্তরের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার জন্য সেখানকার পরিস্থিতিকে খুব চরম বলে মনে করা হতো। নতুন গবেষণা ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে। মধ্য আর্কটিক বরফের নিচে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন ফিক্সেশন বা বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া কেবল ঘটছে তা নয়, বরং এটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিস্তৃত হতে পারে। অন্যান্য সব সমুদ্রে সাধারণত সায়ানোব্যাকটেরিয়া দেখা গেলেও, আর্কটিকে নন-সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত একটি ভিন্ন দলের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্রবীভূত জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে ও নাইট্রোজেন যৌগ মুক্ত করে যা শৈবালকে পুষ্টি জোগায়।
আর্কটিক এলাকাকে একসময় প্রাকৃতিক কার্যকলাপের জন্য খুব অনুর্বর বলে মনে করা হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, গলে যাওয়া সমুদ্রের বরফের কিনারা বরাবর নাইট্রোজেনের বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সূর্যের আলো, পানি ও পুষ্টির উপাদান মিশে গেছে, যা ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল উভয়ের জন্যই আদর্শ পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আর্কটিকের নাইট্রোজেনচক্র নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লিসা ডব্লিউ ভন ফ্রাইসেন বলেন, আর্কটিক মহাসাগরে সহজলভ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ অনুমান করা হয়নি এখনো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে শৈবাল উৎপাদনের সম্ভাবনা কেমন হবে তা এখনো জানা যায়নি। শৈবাল আর্কটিক খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য অপরিহার্য। তারা আণুবীক্ষণিক ক্রাস্টেসিয়ানদের খাবার হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে ছোট মাছ এবং সিল ও তিমির মতো বড় শিকারি প্রাণীরা খায়। আরও শৈবাল এই শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে আর্কটিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সাধারণভাবে শৈবাল কেবল সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য জোগায় না। তারা সালোকসংশ্লেষণের সময় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডও শোষণ করে। যখন শৈবাল মরে যায়, তখন এই কার্বনের কিছু অংশ সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। বিজ্ঞানীরা প্রায়শই শৈবালকে প্রাকৃতিক কার্বন সিংক বা মহাসাগরের নিজস্ব ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে বর্ণনা করেন। নতুন তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া যদি শৈবালের বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে, তবে আর্কটিক মহাসাগর আরও বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করতে পারবে। বিষয়টি একদিক থেকে জলবায়ুর জন্য সুসংবাদ বলে মনে করা হচ্ছে। শৈবালের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বৈশ্বিক কার্বন মাত্রাকে সামান্য হলেও প্রশমিত করতে পারে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে জানিয়েছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। সামুদ্রিক সিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যান্য পরিবেশগত পরিবর্তন এই ইতিবাচক প্রভাবকে দুর্বল করে দিতে পারে।
বিজ্ঞানী ল্যাসে রিম্যান বলেন, ফলাফল জলবায়ুর জন্য উপকারী হবে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে এটি স্পষ্ট যে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে আর্কটিক মহাসাগরের কী হবে, তা অনুমান করার সময় আমাদের নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াকে সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায়, আর্কটিক পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় চার গুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তন কেবল বরফের ওপর নির্ভরশীল প্রজাতিদেরই নয়, বরং মহাসাগর কীভাবে কার্বন সঞ্চয় ও নির্গত করে, তারও পরিবর্তন ঘটায়। নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার ভূমিকা বোঝা গেলে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের জলবায়ু ধরন সম্পর্কে আরও নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করছেন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া