আমি প্রচুর চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করি। সম্ভবত একটু বেশিই করি। হয়তো পয়সা উশুল করার জন্য। অথবা ঝামেলা পাকানোর জন্য। আমার ধারণা, যন্ত্রকে বিপদে ফেলার জন্য। অনেক সময় এমন হয়, মাথায় একটা প্রশ্ন এল, তারপর আর বেশি চিন্তা না করে সরাসরি টাইপ করে ফেলি, চ্যাটজিপিটি, বলো তো...।

একটা সময় ছিল, এসব প্রশ্ন নিয়ে আমি কষ্ট করতাম। ভাবতাম, গুগল করে হাজারো ঘাঁটাঘাঁটি করতাম, ভুল করতাম, শিখতাম। এখন সেসব কষ্ট নেই। যন্ত্র এসে সব সহজ করে দিয়েছে। কিন্তু এই ‘সহজ করে দেওয়া’র মধ্যেই লুকিয়ে আছে একধরনের বিপদ। যে বিপদ খুব ধীরে ধীরে আসে, সাইলেন্ট মোডে। আপনি টেরও পাবেন না, কখন আপনার চিন্তা করা বন্ধ হয়ে গেছে।

চ্যাটজিপিটি উত্তর দেয় তাড়াতাড়িই, গোছানো, সুন্দর ভাষায়। যেন আপনি যা জানতে চাচ্ছেন, তার চেয়ে এক ধাপ বেশি বুঝে ফেলেছে যন্ত্রটাই। তখন আপনি আর থামেন না। একবার, দুইবার, তিনবার, চারবার .

.. তারপর একসময় এমন হয়, আপনি নিজে ভাবার আগেই মেশিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মানে, একটা সময় গিয়ে আপনার মাথায় প্রশ্ন আসার আগেই উত্তর চলে আসে। মনে হয়, ও আপনার মন পড়ে ফেলছে। অনেকটা প্রশ্নের আগেই উত্তর।

এই অভ্যাস যখন গেঁথে যায়, তখন চিন্তাটা আউটসোর্স করে দেওয়ার মোডে চলে যায়। আপনার মাথার বদলে একটা বিশাল সফটওয়্যার ভাবছে। আপনি শুধু উত্তর নিচ্ছেন না, বিশ্বাসও করছেন। চিন্তা করছেন না। যাচাই করছেন না। তর্কও করছেন না। পাল্টা বাড়ি দিচ্ছেন না। ধমক দিচ্ছেন না ভুল বলে।

এটাই ভয়ংকর। আসলেই ভয়ংকর।

চ্যাটজিপিটি অনেক সময় এমনভাবে উত্তর দেয় যেন ব্যাপারটা খুবই সহজ, নিখুঁত; একদম নির্দ্বিধায় মানার মতো। আপনি ভাবছেন, ‘এই তো, এটাকেই তো খুঁজছিলাম!’ অথচ আমরা বুঝতে পারছি না, উত্তরটা ঠিক হলেও আমরা নিজে কিছু ভাবিনি, আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করিনি। এটা কিন্তু আমাদের বিপদে ফেলছে। অনেকের মাথাকে অসার করে ফেলছে।

আগে কী হতো?

একটা বিষয়ে মাথায় প্রশ্ন এলে আমরা সেটা নিয়ে পড়তাম, বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতাম, নানা রকম চিন্তার ভেতর দিয়ে যেতাম। তর্ক হতো, ঝগড়া হতো। তখন একটা ভুল উত্তরও অনেক সময় ভালো একটা শিক্ষার জন্ম দিত। মাথা আবার চকচকে নতুনের মতো কাজ করত। সেই ভুল করা, দ্বিধায় পড়া, পথ হারানো, বাড়ি খেয়ে আবার পথ খুঁজে পাওয়া—পুরো যাত্রাটা একটা চিন্তার অভ্যাস তৈরি করত। এই অভ্যাসই ছিল আমাদের চিন্তার মূল শক্তি। এটাই মানুষের মূল শক্তি। এটাই আমাদের বিবর্তনের রাস্তা, যেটাতে হেঁটেছি আমরা এত এত শতক।

এখন আমরা সেটাই ছাড় দিচ্ছি।

চ্যাটজিপিটি বলে, ‘এই রাস্তায় হাঁটুন।’ আমরাও চোখ বুজে হাঁটছি। আর এই চোখ বুজে হাঁটার মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রশ্ন করার সাহস। যন্ত্র যে রাস্তা দেখাচ্ছে, সেটা ভালো হতেই পারে, কিন্তু সেটা একমাত্র রাস্তা নয়। আমরা নিজেরা আর খোঁজার চেষ্টা করছি না, বিকল্প ভাবছি না। ভয়ংকর ব্যাপার।

এআই-এর ভাষা এতটাই গোছানো, এতটাই বিশ্বাসযোগ্য যে অনেক সময় ভুল হলেও তা ধরতে ইচ্ছা করে না। আপনি ভাবেন, এত সুন্দর করে বলছে, নিশ্চয় ঠিকই বলেছে। তখন আর নিজের মতো করে চিন্তা করার দরজাটা খোলা থাকে না।

একটা সময় গিয়ে আপনার চিন্তার ধরনটাই বদলে যায়। আপনি নিজের মতো করে ভাবার বদলে চ্যাটজিপিটির মতো করে ভাবতে শুরু করেন। ওর যুক্তি, ওর বাক্যগঠন, ওর কাঠামো সব ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ে আপনার মাথায়। তখন আপনি বুঝতেই পারেন না, আপনার মাথার ভেতরে যেটা ঘুরছে, সেটা আদৌ আপনার নিজের চিন্তা নয়, বরং এটা যন্ত্রের ছায়া। আমি নিজেই উপলব্ধি করেছি, এতগুলো সিস্টেম ব্যবহার করে।

এটাই সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা।

তবে ভয় পাওয়ার দরকার নেই। চ্যাটজিপিটি কোনো শত্রু নয়। ও একটা শক্তিশালী টুল। কিন্তু সেটাকে আপনি কীভাবে ব্যবহার করছেন, সেটাই আসল। আপনি যদি শুধু শর্টকাট চান, ও আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি একটা উত্তর দিয়ে দেবে। সেটা নেওয়াটা ঠিক হবে না।

কিন্তু আপনি যদি নিজে চিন্তা করতে চান, নিজের মতো করে দ্বিধা, ভুল, অনিশ্চয়তা পেরিয়ে সামনে যেতে চান, তাহলে চ্যাটজিপিটিকে সহকারী বানান, গুরু নয়। ওর উত্তর নিয়ে প্রশ্ন করুন, সন্দেহ করুন, তর্ক করুন। দেখবেন, তখনো আপনি শিখছেন, কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা থাকছে আপনার হাতে।

চ্যাটজিপিটি আমাদের চিন্তা কেড়ে নিচ্ছে না। আমরাই বরং নিজেরা তুলে দিচ্ছি। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কি ভাবার আগেই উত্তর পেতে চান, নাকি উত্তর পাওয়ার আগেই ভাবতে চান?

রকিবুল হাসান

টেলিকম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক বইয়ের লেখক এবং লিংকথ্রি টেকনোলজিসের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আপন র ম থ অন ক সময় তর দ য় র আগ ই আম দ র করছ ন ন আপন করত ম

এছাড়াও পড়ুন:

ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির

ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম পর্বত ‘আমা দাবলাম’ জয় করছেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির (২৭)। গত ৪ নভেম্বর নেপাল সময় দুপর ১টার দিকে ৬ হাজার ৮১২ মিটার উচ্চতার এই পর্বতের চূড়া স্পর্শ করেন তিনি। 

পর্বতারোহণ বিষয়ক অর্গানাইজেশন রোপ ফোরের পৃষ্ঠপোষকতা ও তত্ত্বাবধানে এই অভিযানটি পরিচালিত হয়। তার এই অভিযানে সঙ্গী হিসাবে ছিলেন রোপ ফোরের আরেকজন তরুণ পর্বতারোহী আবরারুল আমিন অর্ণব।

আরো পড়ুন:

রঙ হারাচ্ছে অদম্য মেধাবীর ভবিষ্যতের স্বপ্ন

উপজেলায় এইচএসসিতে একমাত্র জিপিএ-৫ পেলেন অনুরাগ

আমা দাবলাম খাড়া বরফ দেয়াল, গভীর ক্রেভাস, ঝুলন্ত বরফ খণ্ড এবং কঠিন আবহাওয়ার জন্য পৃথিবীর অন্যতম চ্যালেঞ্জিং পর্বত হিসেবে পরিচিত। তৌকিরের এই অভিযানটি ছিল বাংলাদেশি পর্বতারোহণ ইতিহাসে এক গৌরবময় সংযোজন।

চূড়ায় পৌঁছার প্রতিক্রিয়ায় তৌকির বলেন, “আমা দাবলাম আমার কাছে শুধু একটা পর্বত নয়, এটা ছিল নিজের সীমা পরীক্ষা করার যাত্রা। পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর এই পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে যখন লাল-সবুজ পতাকাটা তুলে ধরলাম, মনে হলো এটি শুধু আমার সফলতা নয়, এটি বাংলাদেশের সব তরুণের স্বপ্নের স্পন্দন।”

তিনি বলেন, “আমার এই অভিযানটা ছিল পৃথিবীর সব বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জন্য, যাদের জীবনটা কেটে যায় অন্যের ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করে এবং চার দেয়ালের আলোতে পৃথিবী দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে আসা সব প্রাণী শক্তিশালী। আসুন, ডিপেন্ডেবল এই মানুষগুলোর ওপর আরো বিনয়ী হই, ভালোবাসা এবং সাহায্যে তৈরি করি তাদের নতুন পৃথিবী।”

যেভাবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন তৌকির
গত ১২ অক্টোবর দুঃসাহসিক এই অভিযানের জন্য দেশ ছাড়েন তৌকির। এরপর প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে শুরু হয় তার মূল অভিযান। হিমালয়ের পাহাড়ি বন্ধুর পথ ধরে ট্রেকিং করে তিনি বেস ক্যাম্পে পৌঁছান ২২ অক্টোবর। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে তৌকির শুরু করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ায় কৌশল। যা এক্লিমাটাইজ রোটেশন নামে পরিচিত। 

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের ২৯ অক্টোবর সামিটের কথা থাকলেও ২৭ অক্টোবর থেকে হিমালয়ের শুরু হয় তীব্র তুষার পাত। এই তুষার পাতের মধ্যেই তৌকির অবস্থান করেন আমা দাবলাম ক্যাম্প-১ এ। যার উচ্চতা প্রায় ১৯ হাজার ফিট। ২৮ অক্টোবর আবহাওয়া আরো খারাপ হলে তাদের শেরপা লিডার সিদ্ধান্ত নেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যাবার। তীব্র এই তুষার ঝড়ের মধ্যে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে তাদের দল বেস ক্যাম্পে পৌঁছায়। বেস ক্যাম্পে পৌঁছে শুরু হয় নতুন দুশ্চিন্তার কারণ।

৬৮১২ মিটার উচ্চতার আমা দাবলাম পর্বত

তুষার পাতের কারণে ফিক্সড রোপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবহাওয়া ভালো হতে শুরু করলেও নতুন রুট ওপেন না করা পর্যন্ত সামিট পুশ সম্ভব হচ্ছিল না। এভাবেই কেটে যায় পাঁচদিন। তরপর সুখবর আসে রুট ওপেন হবার। নভেম্বরের ২ তারিখ শুরু হয় আবার সামিট বিট। এইদিনে তৌকির পৌঁছে যান ১৯ হাজার ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-১ এ। এরপর ৩ তারিখ ইয়োলো টাওয়ার খ্যাত ১৯ হাজার ৬৮৫ ফিট উচ্চতার ক্যাম্প-২ এ পৌঁছান। বিশ্রাম নিয়ে শুরু করেন সামিট পুশ। তীব্র বাতাস, ফিক্সড রোপে অতিরিক্ত ট্রাফিক এবং আইস ফলকে উপেক্ষা করে ৪ নভেম্বর ২২ হাজার ৩৪৯ ফিট উচ্চতার ‘আমা দাবালাম’ চূড়ায় পৌছান তিনি।

তৌকির বিশ্বাস করেন, ‍“স্বপ্ন যদি সত্যিকার অর্থে জ্বলে, তবে পাহাড়ও নত হয়। প্রতিটি শিখর আমাদের শেখায়, সীমা কেবল মনেই থাকে, সফলতায় নয়।”

তরুণ এই পর্বতারোহী এবারের স্বপ্ন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া ‘মাউন্ট এভারেস্ট’। এই লক্ষ্য নিয়েই তিনি এগোচ্ছেন। এখন প্রয়োজন তার সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৌকির ২০২৬ সালেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় আবারো উড়াতে চান বাংলাদেশের পতাকা।

এর আগে, গত বছরের অক্টোবরে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে নেপালের তিনটি ছয় হাজার মিটার পর্বত চূড়া স্পর্শ করেন পাবনার সন্তান আহসানুজ্জামান তৌকির। ২৭ দিনের অভিযানে গিয়ে কোন শেরপা সাপোর্ট ছাড়াই পর্বতগুলো আরোহণ করেন তিনি। পর্বতগুলো হলো ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক, ৬১৬৫ মিটার উচ্চতার আইল্যান্ড পিক ও ৬৪৬১ মিটার উচ্চতার মেরা পিক।

তারও আগে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে তৌকির খুম্বু রিজিওনের ৫০৭৬ মিটার উচ্চতার নাগা অর্জুন এবং ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে পিক পর্বতের চূড়ায় আরোহণ করে বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা উড়িয়েছেন।

তৌকির পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের বালুচর মহল্লার আকরাম হোসেন সাবু-সুলতানা সামিয়া পারভীন দম্পতি ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট তিনি। চাটমোহর রাজা চন্দ্রনাথ ও বাবু শম্ভুনাথ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিপ্লোমা এবং অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপল-ই তে বিএসসি সম্পন্ন করেছেন

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ